চোখ ভরে দেখার মতো পুকুর বটে বামুনপুকুর। চারধারের পাড় বাঁধানো জল বুড়ো-মা মেলায় বেচতে আসা কাচ বাঁধানো ফ্রেমের মত, একবার দেখলে চোখ ফেরান যায় না, বট আঠায় লটকে যাওয়া বনিপাখির মতো লটপটায়। ভালো লাগার রেণুগুলো মথের গায়ে জড়িয়ে থাকা রেশমী ধুলোর মতো মনের আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ায়, মনটাকে চোখের পলকে বানিয়ে দেয় ফুলের বাগান। এই মুগ্ধতাকে দু’হাতে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে উড়িয়ে দেয় ঢিলি, রঘুনাথের মুখোমুখি এসে সে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, রঘু না? এখানে মরতে কী করতে এয়েচিস? যা ঘর যা। চড়া রোদে তুর মাথার চুল উঠে চাঁদ পড়ে যাবে। তখন ব্যা-থা হবে না, মেয়েঘরের বাপ বলবে ছেলে তুমাদের টাকলা। কথা শেষ হল না হাসি সংগতের মতো বেজে উঠল দুই ঠোঁটে। অবাক হয়ে তা দেখতে থাকল রঘুনাথ। ঢিলি কাকির বয়স চল্লিশ ছুঁয়েছে তবু এই বয়সে তার চেহারাটা বামুনপুকুরের চেয়েও ভরাট। তার শরীরে ঢেউ ওঠে সর্বদা, চঞ্চল চোখের মণি দুটোয় ক্ষ্যাপাটে এক দৃষ্টি বুনো বাতাসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভালো লাগার ডালপালা ছড়িয়ে ঢিলিকাকি যেন বলে–আমাকে দেখ। আমি গাঁয়ের বউ তবু শহরের কারোর চাইতে কম নয়। বুনো ঘরের বউ বলে নয় ঢিলি বরাবরই সুন্দর! রঘুর মনে হল সব পাগলই সুন্দর, ওদের মনের স্বচ্ছতা সুন্দর করে তোলে বাঁধনহীন, তোয়াক্কাহীন মনটাকে।
ঢিলি কাকির কথায় রঘুনাথ তাই অবাক না হয়ে পারে না, কি বলছ গো কাকি? আমার আর কত বয়স, আমাকে কেনে বিয়ে সাদীর কথা বলছো?
-তোকে বলব না তো কি গাছকে বলব? ঢিলি বিড়বিড়িয়ে উঠল, যা বাপ কথা না বাড়িয়ে গা ধুয়ে আয়। এক সাথে ঘর ফিরব।
আমার ফিরতে দেরি হবে। রঘুনাথ ঢিলির চরকাটা চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল, তুমি যাও গো। আমি নাল ফুলের ডাঁটি তুলব। মা বলেছে–ঘরে শাকপাতা নেই। আজ নালফুলের ডাঁটি চচ্চড়ি হবে।
–অঃ। তুর মায়ের যেমন বুদ্ধি। নালফুলের ডাঁটায় কি আচে রে, কিছু নেই। শুধু ভুসভুসিয়া জল। টুকে আঁচ লাগলে জল কাটে, লোহার কড়াই হয়ে যায় বুড়িগাঙ। ঢিলি রহস্যভরা চোখে হাসল, তুর মা বাপু সুবিধের মেয়েমানুষ নয়। ওর মনে ভারি গর্ব। আমার ছিমুতে হাত পাততে শরমায়। আরে বাবা, আমার কাছে লাজে রাঙা হওয়ার কি আছে, আমি কি পর নাকি?
-মা বরাবরই ওইরকম। শুকোবে, শুকিয়ে সুপুরি হয়ে যাবে তবু হাত পাতবে না। রঘুনাথের গলায় দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
পানসে হেসে ঢিলি বলল, তুর মা’র মতো তুর বাবার মাথাতে গোবর পুরা। ড্যাং-ড্যাং করে জন-ঘাটতে ভিন দেশে চলে গেল। গিয়ে কি লাভ হল, কিছু না! চারদিকে এখন খরা চলছে। তুই দেখে নিস এবছর ঠিক আকাল হবে। ঢিলি বেশ গুছিয়ে কথাগুলো বলে তৃপ্তি পেল। এরকম ভালো ভালো কথা সে প্রায়ই বলে থাকে। যখন সে এসব বিবেচনার কথা বলে তখন তাকে পাগলি বলে মনেই হয় না। এই জন্যই বুঝি চুনারাম তাকে সেয়ানা পাগলা বলে আখ্যা দিল। চুনারামের কথার সঙ্গে রঘুনাথ একমত নয়। তার নজরে ঢিলি কাকির আলাদা সম্মান আছে। ওরা শুধু বড়োলোক বলে নয়, বড়ো মন আছে ওদের। বুনোপাড়ায় একমাত্র ঢিলিকাকিদের মাটির দোতলা ঘর, ঘরের মাথায় সোনাখড়ের টাইট চাল। সেই চালের মাঝখানে বিশেষ কায়দায় লাগানো আছে মুখোমুখি দুটো টিনের ময়ুর, মিস্ত্রি যত্ন নিয়ে বানিয়েছে। হাওয়া দিলে সেই পাতলা টিনের ময়ূর ঝনঝনিয়ে কেঁপে যায়, ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে ওরা যেন উড়তে চাইছে খোলা আকাশে। ওরা টিনের নয়, যেন সত্যিকারের ময়ুর।
.
০২.
বয়সকালে খারাপ দেখতে ছিল না ঢিলিকাকি, রাতে ফোটা পদ্মফুলের মতো চনমনে ছিল তার মেজাজখানা। লুলারাম খুড়া তার রূপে মোহিত হয়ে ঘুরঘুর করত তার চারধারে। তার তখন কাজে কম্মে মন ছিল না। ঢিলিই ঠেলে-ঠেলে পাঠাত কাজের জন্য। অভিমানে মুখ ফোলাত, ঘরে বসে কি সুখ পাও জানি না গো…। তুমার জন্যি লোকে আমাকে দশ কথা শোনায়। নিন্দে করে।
-কি কথা আমি কি শুনতে পারি?
–শুনে হজম করতে পারবা তো? সব খাবার সবার পেটে হজমায় না।
–বলে তো দেখো। লুলারাম কাকার কণ্ঠস্বরে জেদ।
হাসতে হাসতে ঢিলির কাঁচা হলুদ শরীরে ঢেউ উঠত, সব্বাই বলে–আমি তুমারে নাকি জাদু করেছি। আমার নজরে নাকি আটা আচে। আমার শরীরটা নাকি শ্যাওড়াগাছের চেয়েও ভয়ের। বলদিনি, এসব শুনে কার মন ভালো থাকে?
-কে বলেছে এসব কথা, বলো। আমি তার জিভ উপড়ে নেব। লুলারাম হাঁপাতে থাকে। তার বুকের ভেতর পাঁচ-ঘোড়ার ইঞ্জিন চলে, এ গাঁয়ের কাউকে না হলে আমার চলে যাবে কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার এক পল চলবে না। আমি পাগল হয়ে যাবেখন।
-কেন? দিঘল চোখে আঠা বেছায় ঢিলি।
-সত্যি কথা বলব? শুনে তুমার হাসি পাবে। ভেজা বেড়ালের মতো চোখে ঢিলির দিকে তাকাল লুলারাম, আগে বুঝিনি-এখন বুঝেচি গো, বউ হল মায়ের চেয়েও বড়। বউকে সুখে রাখলে আমার দশদিক সুখে থাকবে।
–এ কথা তুমি মন থিকে বলতে পারলে? তুমার জিভ উল্টালো না? ঢিলির নিরীহ শান্ত চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরল, খবরদার তুমি আমারে ছোঁবে না। শরীলের নেশায় তুমি পাগল হয়ে গিয়েচ। তুমি আমাকে ভালোবাসো না, শুধু আমার এই নাদুসনুদুস গতরটাকে ভালোবাসো। যতদিন আমার রূপ যৌবন থাকবে ততদিন তোমার ভালোবাসা টাটকা থাকবে। রূপ ফুরোলে তুমিও ফুড়ুত করে উড়ে যাবে।