ঢিলিকাকিকে দেখে রঘুনাথের অবাক হওয়ার ঘোর বুঝি আর কাটে না, সে ভাবতে থাকে এত চড়া রোদে বউ-মানুষটা এখানে এল কী ভাবে? তাহলে পাড়াপড়শিরা যা বলে তা সব সত্যি। ঢিলিকাকি পাগলী, তার মাথার দোষ আছে, হরিনাথপুরের বুড়োমা তলায় মানত করেও সে আর ভালো হবে না। লুলারাম কাকা আবার আর একটা বিয়ে করবে, ঝারি বা তার চেয়ে সুন্দরী কাউকে। ঢিলিকাকির দু’ মেয়ে নূপুর আর নোলক চোখ ভাসিয়ে কাঁদবে, কাকার হাতে-পায়ে ধরেও তার মন গলাতে পারবে না। লোকে বলে লুলারাম কাকার নাকি পাথরের মন, মুনিরাম দাদুর ডাকাতের রক্ত তার শরীরেও বইছে। রক্তের দোষ যাবে কোথায়?
ঝোপঝাড় ঠেলে ভর দুপুরে এলোমেলো শরীরে ধুলো পথের উপর এগিয়ে এল ঢিলি। ঘাড় বেঁকিয়ে রঘুনাথ আর চুনারামকে এক ঝলক দেখে নিয়ে সে ক্ষিপ্রপায়ে এগিয়ে গেল ঘাটের দিকে। রঘুনাথ ভয় পাচ্ছিল, ঝোঁকের মাথায় ঢিলি কাকি আবার বামুনপুকুরে ঝাঁপ দেবে না তো? পাগলের মন বোঝা দায়, কখন কি করে আগাম বলা মুশকিল। ভয় আর উত্তেজনায় চোখের তারা কেঁপে উঠল রঘুনাথের, চুনারামের দিকে সে অসহায় চোখে তাকাল। চুনারাম তাকে ভরসা দিয়ে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই রে। ও ম্যায়াঝি মরবে না। পুরো ঘর-সনসার জ্বালাবে, তারপর যদি কিছু হয় তো হবে।
রঘুনাথ খুশি হল, কেমন থতমত খাওয়া চোখে তাকাল, তুমি অমন করে কেনে বলচো গো দাদু? কাকির উপর তুমার দেখচি কুনো মায়া দয়া নেই।
না, নেই। যেন হ্যাটাবাঘের গলায় গর্জে উঠল চুনারাম, ও আটকুড়ীর বেটি রাজোয়ার বংশের মুখে চুনকালি লেপবে, তুই জানিস নে দাদু, ওর জন্যি আমাদের কত দুর্নাম, লোকে টি-টি কার দেয়। সব কতা তো কানে আসে, শুনি। বুঝি না কেন যে ডুবে মরতে জল জোটে না ওর।
রঘুনাথ স্পষ্টত বুঝতে পারে ঢিলি কাকির উপর চুনারামের কেন গোখরো ক্ষরিস রাগ। বুনো পাড়ায় ঘর হলেও লুলারামের রমরমা অবস্থা, গেল সনের আউড়গাদাই বলে দেবে ক’ বস্তা ধান উঠেছিল জলজমি থেকে। এখনও বাড়িঘরে ধানের গন্ধ ম-ম করে। ঘর-বাড়ি সবখানে মা লক্ষ্মীর উপচে পড়ার ছাপ আছে। লুলারাম কাকারা বড়লোক, ওদের পয়সাকড়ি আছে–এ কথা ভেবে মনে মনে সুখ পায় রঘুনাথ। তবে সে জানে–পরের সোনা নিয়ে গর্ব করা ভালো নয়, কেন না ফি-কথায় দুর্গামণি বলে–পরের সোনা দিও না কানে, খুলে নেবে হ্যাঁচকা টানে।
উবু হয়ে ঢিলি দু-হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে বুনো জল-শ্যাওলা। পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো লক্ষ্মণ তার আর নেই। বেশ বোঝা যায় পাগলামীর উগ্রতায় সর পড়েছে। ঢিলি আঁজলা ভরে জল খায় পশুর মতো। কাপড়-চোপড় এমন কী বুকের কাছটা তার ভিজে সপসপে দেখায়। চুনারাম হা করে দেখছে। শুধু চোখ নয়, মুহূর্তে কঠিন হয়ে ওঠে তার মেটে রঙের পুরু ঠোঁট দুটো, দেখলু, আমি বলছিলেম না ও ম্যায়াঝি মরবে নি। ও হল গিয়ে সাধের পাগল, সেয়ানা পাগল। সবার চোখে ধুল দিলেও আমার চক্ষে তা ছিটোতে পারবে নি। আরো বাব্বাঃ, বয়সে আমার মুচ পেকেছে, রসে পাকেনি রে! হুঁস করে খাস ভাসিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল চুনারাম। ঘরের বউ না যাওয়া অবধি সে ঘাটে যাবে কি করে? খুড়শ্বশুর বলে কথা। ধর্ম মান ভাসিয়ে দিয়ে তো লোকালয়ে বাঁচা যাবে না। একটা মাঝারি মাপের পিটুলিগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে খুট থেকে ডিবা বের করে বিড়ি ধরাল। বিড়ির পেছনে লম্বা টান দিয়ে আয়েসী চোখে সে দূরের দিকে তাকাল। এখন আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি তবু রোদের কী তেজ দেখো। মনে মনে সে যেন নিজেকেই শোনাতে চাইল ভাবনাগুলো। গুয়ারামের উপর আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে সে কেমন ময়দা-লেচির মতো লতলতে হয়ে গেল স্নেহ-মায়ায়।
জল খেয়ে, মাথা ভিজিয়ে পাড়ে উঠে এল ঢিলি। রঘুনাথ লক্ষ্য করল ঢিলিকাকির পরনের কাপড় চোপড়ের কোনো ঠিক নেই। ঢিলাঢালা পোশাকটা কোনোমতে লজ্জা স্থানগুলোয় ঢাকা দেওয়া। জোরে বাতাস এলে তা পুরনো, হলদেটে পাতার মতো খসে গিয়ে মহালঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিতে পারে। নপুর, নোলক বড়ো হয়েছে। ওরাও তো এদিকটা দেখভাল করতে পারে। নাকি লোকমুখে শুনে শুনে ওরাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে দুটোর এই অমনোযোগী মনোভাব মন থেকে মেনে নিতে পারল না রঘুনাথ। কোথা থেকে কষ্ট এসে তার মনটাকে সাঁতিয়ে গেল। মনে মনে সে ভাবল ঘরে ফিরে গিয়ে সে নূপুর আর নোলকের দুয়ারে যাবে। ওদের বোঝাবে। ওরা যদি না বোঝে তা হলে লুলারাম কাকাকে দিয়ে ওদের গাল খাওয়াবে। সে যে ওদের থেকে বড়ো–এটা আজ সে প্রমাণ করে ছাড়বে।
বামুনপুকুরে চ্যাটপেটে কাদা নেই, বেশির ভাগই বালি, ফলে ঘাটের কাদা পায়ে জড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগই থাকে না। এ তল্লাটের সব চাইতে বড়ো পুকুর বামুনপুকুর। বর্ষাকালে এই পুকুর যেন মোকামপাড়ার বিলটাকে শরীর ফুলিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয়, গর্বে গালভরিয়ে বলে, দেখো, বিলকুমারী আমি তুমার চাইতে কোনো অংশে কম নই। তুমার শরীল পেচিয়ে শুধু ভ্যাদা লতা, জলা-শ্যাওলা। আর আমাকে দেখো-কেমুন লাল শাপলা আর সাদা শাপলায় সেজেচি দেখো। আমার জলো-লতার ফুলগুলো নাকছাবি, মন হলে আমি পাল্টে পাল্টে পরি। সাজতে যে আমার বড়ো ভালো লাগে। তুমি বিলকুমারী হলে আমি হলাম জলকুমারী, রাজকুমারী।