সাবধানে নামবু। সামনে ধুলো চুবানো ঢালুপথ। রঘুকে সতর্ক করে চুনারাম। শুধু চ্যাটচেটে কাদা নয়, ধুলোও পেছল কাটায় ওস্তাদ। বেকায়দায় ব্যাঙ ঠিকানো ঠিকরে গেলে ধুলো ঢুকে যাবে চোখে-মুখে। এ ধুলো ভূত সাজাতে ভালোবাসে। রঘু নিজে সতর্ক হয়ে বুড়ো মানুষটাকে হুঁশে ফেরায়, আমার জন্যি ভাবতে হবেনি। তুমি ঠিকঠাক নামো তো।
-নামছি রে, নামছি। গলা ঘড়ঘড় করল চুনারামের। ঘর থেকে বেরনোর সময় হড়বড়িতে ভুল হয়ে গিয়েছে। হাতের লাঠিটা ভুলে ফেলে এসেছে সে। লাঠি থাকলে শুধু পায়ের নয় মনেরও জোর বাড়ে। ঢালুপথে লাঠি, সাইকেলের ব্রেকের মতো কাজ করে। এখন নিজের ভুলের জন্য নিজেই আফসোস করে চুনারাম। কিন্তু মুখ ফুটিয়ে রঘুকে সে কিছু বলে না, রঘুই তার নড়বড়ে চেহারা দেখে খিঁচিয়ে ওঠে, সেদিন যে বেবুর ডালার লাঠিটা এনে দিলাম, সেটা কুথায়?
-ঘরে আচে। চুনারাম হালকা করতে চাইল প্রসঙ্গ।
রঘু রাগে লাল হয়ে বলল, ঘরে থাকলে চলবে? লাঠি দিয়ে কি ঘরে ঠেকো দেওয়া হবে?
-বললাম তো ভুল হয়ে গিয়েছে। চুনারামকে অসহায় দেখাল, বয়স হলে সব কথা কী ঠিকঠাক মনে থাকে রে। তাছাড়া আমার হাজার চিন্তা। তোর বাপ যে কুথায় গিয়েছে কে জানে। সে না ফেরা তক আমার চোখে নিদ আসবে নি।
–ফি-বছর তো যায়, এবারের ক্ষেপটা নিয়ে এত ভাবছো কেন?
–ও তুই বুঝবি নে, বয়স হোক, তারপর সব বুঝবি! চুনারামের কথাটায় রঘুর ভেতরটা ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল। সে এখন যা বুঝতে পারে না ঠিকঠাক-বয়স হলে কি সব বুঝতে পারবে সে? তার তো ঢের বয়স হয়েছে, গোঁফের রেখা ফুটেছে তাহলে সে কেন বুঝতে পারবে না। চুনারামের কথাগুলোই রহস্যে মোড়া। এই হেঁয়ালি সে প্রায়ই বুড়োধুড়োদের মধ্যে লক্ষ্য করে। তার ভালো লাগে না। তার মনে হয়-এরা বুঝি কিছু লুকোতে চায় যা ওদের অক্ষমতা, কমজোরি।
বাঁধের গাঁ-ছোঁয়া ঢালুপথ সাপের চেরা জিভের মতো দুফাঁক হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছে। একদিকে জমজমাট গ্রাম, অন্যদিকে বামুন পুকুরয়াড়। ছায়ায় ছায়ায় পথটা বেশ আরামদায়ক। খুব বড়ো-সড়ো গাছ চোখে পড়ে না, মাঝারি মাপের গাছগুলোই এখানকার শাসনকর্তা। কতবার যে এখানে ছুতোনাতায় পালিয়ে এসেছে তা রঘুনাথ নিজেও জানে না। পথের ধুলোয় ভরে আছে চুনারামের গোড়ালির নিচটা, ধুলো সোহাগে গায়ের বর্ণ বোঝা দায়, শরীরও ধুলোছোঁয়ায় গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। ক’ পা হেঁটে এলেই ঝোপ-ঝাড়ে ঠাসা হয়ে যায় এলাকা, টাক তাতানো রোদের বুক ছুঁয়ে পাখির ডাক ভেসে আসে। হা-করে দাঁড়িয়ে পড়ে রঘু। জুলজুলিয়ে আশেপাশে তাকায়। চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে আশ্চর্যবোধ। নজর এড়ায় না চুনারামের, অমন করে ভ্যালভেলিয়ে কী দেখচিস? হ্যাঁ রা, তুর কি হলো বল তো?
এ সময় ঢিলি কাকিকে দেখবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। মেয়েমানুষটার কি গরম-টরম লাগে না? লু’ কে জব্দ করে কিভাবে। ছাতিতে দম আছে বলতে হবে। চোখ ডলে নিয়ে রঘু আপন মনে বলল, হা দেখো দাদু, ঢিলি কাকি বনের ভেতর কি করছে দেখো। ওর জানে কি ভয়-ডর নেই?
হাসল চুনারাম, ম্যায়াঝিটার মাথাটা গিয়েচে। টুকে গরম পড়লে ঘিলু গলে লাড়িয়া তেল হয়ে যায়। যাদের মাথার দোষ, তাদের এই সময়টাতে ঘরে এটকে রাখা দায়। লুলারামের বৌ-ভাগ্যটা পুকায় কাটা। এ আর ভালা হবার নয়।
জ্ঞান পড়ার পর থেকে রঘুনাথ ঢিলিকে দেখছে টো-টো কোম্পানী হয়ে ঘুরে বেড়াতে। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো সবাই জানে তার মাথার গণ্ডগোল। এ রোগ সহজে সারে না। কবিরাজ, ফকির, বৈদ্য, পীরবাবার থান, মনসাতলা, ঢিলবাঁধা, সুতো বাঁধা…সব বৃথা গেল, হত্যে দেওয়াও বিফলে গেল, ঢিলি কোনো কিছুতেই ভালো হল না, তার চঞ্চল চোখ, অসহিষ্ণু চোখের তারা সব সময় কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। পাড়ার লোকে বলে লুলারামের চরিত্র দোষ, ভিকনাথের বউয়ের সঙ্গে তার নাকি লটখট চলছে। অনেকেই দেখেছে ওদের আড়ালে-আবডালে কথা বলতে। ঢিলির কানে গিয়েছে কথাগুলো। শোনার পর থেকে তেতে গিয়েছে মাথা। পাগল বলে সে তো দেখতে শুনতে মন্দ নয়। দেখে-শুনে লুলারাম তাকে বউ করে এনেছিল ঘরে। তখন চাঁদের সাথে, নালফুলের সঙ্গে তুলনা করত তার। দুই মেয়ের পরে সে এখন আকাশের ঘুরঘুট্টিয়া আঁধার। ঘরে থাকলেও লুলারাম তাকে পুছেও দেখে না, ক্ষেপি, বদমেজাজী বনবেড়াল ভেবে এড়িয়ে চলে। ঢিলি মরমে মরে, মনে মনে কাঁদে। ঝারির কথা সে দুর্গামণির কাছে ফলারের চিড়ের মতো চটকে দেয়, জানো তো দিদি, সে ঢেমনিটা তুমার ঠাকুরপোকে বশ করেচে। বেহায়া মরদটা তার আঁচলের চাবিগোছা হয়ে ঝুলচে। আমি কোথায় যাই বলদিনি। তাদের তো লাজ-লজ্জা নেই। এদিকে আমি যে লাজে মুখ দেখাতে পারচি নে।
–তুমি বেশি ভেবো না বুন। তুমার তো শরীল তত বিশেষ ভালো নেই।
কে বলল ভালো নেই? ঢিলি প্রতিবাদে মুখর হল, আমার শরীল দিব্যি ভালো আচে। শরীলের দোহাই দিয়ে তোমরা কেউ পার পাবা না। আমি কাউরে ছাড়বো না। সব্বাইকে টানতে-টানতে পাকুড়তলার বিচার সভায় নিয়ে যাব। ছাড়ব না। মার দিব্যি দিয়ে বলচি–কাউরে ছাড়ব না।
হাট ছাড়ি দিব, পরনের কাপড় ছাড়ি দিব তবু ভাতার ছাড়ব না। ঢিলি মুখের দুপাশে গাজরা ছড়িয়ে হাঁপায়। চোখের গুলি দুটো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায়, এক অসহনীয় জ্বালা তার বুকের ভেতরটাতে নারকেল কোরার মতো কুরতে থাকে। ঘরে আর মন বসে না ঢিলির, বাইরের উন্মুক্ত প্রকৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। ঢিলি বাঁধের ধুলোয় উঠে আসে, দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে কার সঙ্গে কথা বলে, বিড়বিড় করে, কখনও কাঁদে, কখনও হাসে। কখনও বা জলের দিকে তাকিয়ে সে একনাগাড়ে ধারাভাষ্য দেয়, সারাদিনের ঘটনাগুলোকে সে হুড়মুড়িয়ে আউড়াতে থাকে, যেন এ পৃথিবীর সমাজ সংসারের সব কিছু তার মুখস্থ, স্বয়ং মা সরস্বতী তার কণ্ঠে যেন ভর করেছেন, এতকিছুর পরেও ঢিলির কোনো ক্লান্তি নেই, সে বুনোপাড়া ছাড়িয়ে অনায়াসে চলে যায় বাবুপাড়ায়, বাবুপাড়া ছাড়িয়ে চোখের নিমেষে পৌঁছে যায় অশোথ তলায়, সেখান থেকে বামুনপুকুর কিংবা মোকামপাড়ার বিলে। মন ভালো থাকলে সে উচ্চস্বরে গান গায়, হাসিতে বাতাস ফালাফালা করে নিজের অস্বস্তিকে ভাসিয়ে দেয়।