দোতলা থেকে নেমে তিনি থরথর করে কাঁপছিলেন। কপোতাক্ষ বিস্ময়ে শুধোলেন, তোমার কি হল? তুমি কেন কাপছ?
–ওরা রঘুটাকে মেরে ফেলবে গো।
-মারুক। মেরে মেরে শেষ করে দিক। একটা চোরকে আমি কখনও সাপোর্ট দেব না। ওই অত রাতে রাগে-উত্তেজনায় সিগারেট ধরালেন কপোতাক্ষ। ধোঁয়া ছেড়ে সেই উড্ডীয়মান ধোয়ার কুলির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তখনই দোতলার দরজায় সজোরে ধাক্কা মারল সূর্যাক্ষ, মা, দরজা খোল। তাড়াতাড়ি দরজা খোল মা। ওরা রঘুকে মেরে ফেলবে। দরজা খোল। শুধু চোখ নয়, মীনাক্ষীর সমস্ত শরীর দুলে উঠল সেই বিধ্বংসী আওয়াজে। একটু বিলম্ব হতেই দরজাতে দুমদুম লাথি মারছিল সূর্যাক্ষ। এরই মধ্যে ভেসে আসছিল রঘুনাথের প্রাণ কাঁপানো আর্তস্বর। কিছু মাতব্বর স্থানীয় মানুষ বদ্ধপরিকর তারা আজ রঘুনাথের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবেন–তাতে যদি থানা-পুলিশ হয় তো হোক। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীকে আরও বেশি তাতিয়ে দিচ্ছিল নীলাক্ষবাবুর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, মেরে ফেল তোরা। জাতসাপের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। সুযোগ পেলে এ আবার ছোবল মারবে।
সূর্যাক্ষ দরজা খুলতে না পেরে পাগলের মতো হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল, মা, শেষবারের জন্য বলছি-দরজা খোল। যদি দরজা না খোল তাহলে ভোরবেলায় আমার মরা মুখ দেখতে পাবে। শুনে রাখো–আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব। মরব বলেছি যখন মরবই।
সূর্যাক্ষর এই হুমকি কানে যেতেই অস্থির হয়ে উঠলেন মীনাক্ষী। পরের জন্য নিজের সন্তানকে তিনি হারাতে চান না। সত্যি, এ কী বোকামি তিনি করেছেন? জোয়ান ছেলেকে ঘরে শিকল তুলে রাখা তার উচিত হয়নি। যৌবন এই পরাধীনতা মানবে না। আর কদিন পরে সূর্যাক্ষ বাড়ি ছেড়ে চাকরির জন্য ট্রেনিং নিতে মহারাষ্ট্রে চলে যাবে। ঈশ্বরের কৃপায় সব এখনও পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছে। নিজের ভুলের জন্য মীনাক্ষী তা ধ্বংস করে দিতে পারেন না।
এখন আর দরজায় আঘাত করছে না সূর্যাক্ষ। শুধু ভোর রাতের বাতাসের বুকে বান মারার মতো কথাগুলো আছড়ে পড়ছে মীনাক্ষীর কানে। সেই হুমকিভরা কথা শুনে কপোতাক্ষর চোখ ভয়ে ছোট হয়ে এল। মীনাক্ষীকে ঠেলা দিয়ে তিনি বললেন, যাও, ঘরের শেকলটা খুলে দিয়ে আসো। মানুষের জন্য মানুষের মন কাঁদবেই। তুমি শেকল তুলে ভাবছ এটা আটকে দেবে? অসম্ভব।
মীনাক্ষী ত্রস্ত পায়ে উঠে এলেন দোতলায়। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ফুঁসছিল সুর্যাক্ষ। হাত বাড়িয়ে শেকলটা খুলে দিতেই কাঠের দরজায় ঘটাং করে শব্দ হল। আর ঠিক তখন তীরের বেগে মীনাক্ষীকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সূর্যাক্ষ।
ঘরের পেছনের বাঁশবাগানের পথটা সোজা চলে গিয়েছে পুকুরধারে। এক মুহূর্ত সময় আর নষ্ট করতে চায় না সূর্যাগ। রঘুনাথকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। চুরি করার শাস্তি ও পাক, কিন্তু এভাবে কেন? মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কতক্ষণ?
নীলাক্ষবাবু ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন পুকুরপাড়ে, তাঁর দুহাত পিঠের নিম্নদেশে শক্ত করে ধরা। আটপৌরে ধুতি হাঁটুর নিচে লুটানো। গায়ে হাতওয়ালা ধবধবে গেঞ্জি। গেঞ্জির ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল নোংরা হয়ে যাওয়া মোটা পৈতেটা। পাকা গোঁফ নাচিয়ে তিনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন, মার, মেরে শেষ করে দে। আর দেরি করিস না।
ভেঙে পড়া গাছের ডালের মতো সূর্যাক্ষ ছুটে গিয়ে সারা শরীর দিয়ে আঁকড়ে ধরল ক্ষত-বিক্ষত রঘুনাথকে। কাউকে কোনো সুযোগ না দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার, ওকে তোমরা আর মারবে না। যদি মারতে হয় আমাকে মারো। দুহাত বাড়িয়ে নিজের শরীর দিয়ে রঘুনাথকে প্রাণপণে আড়াল করতে চাইছিল সূর্যাক্ষ। যারা প্রহারের কাজে হিংস্র হয়ে উঠছিল তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নীলাক্ষবাবুর দিকে তাকাল।
নীলাক্ষবাবু এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আদৌ তৈরি ছিলেন না। তিনি জানতেন বুনো পাড়ার রঘুনাথের সঙ্গে তার ভাইপোর জানাশোনা আছে, কিন্তু সেই জানাশোনা যে এতদূর তলায়-তলায় বন্ধুত্বের জাল বিছিয়েছে সেটা তাঁর ক্ষুদ্রবুদ্ধির হিসাবের মধ্যে ছিল না।
ভাইয়ের সোমত্ত ছেলের গায়ে হাত তোলা যে উচিত হবে না এই সিদ্ধান্ত তিনি চোখ বুজে নিয়ে ফেললেন। প্রায় ঘণ্টাখানিকের প্রহারে রঘুনাথের উঠে দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতা ছিল না। সূর্যাক্ষ পাগলের মতো রঘুনাথকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, ওঠ, রঘু-ওঠ। ঘর যাবি না? এখানে থাকলে এরা তোকে মেরে ফেলবে।
সূর্যাক্ষর কথাগুলো সম্ভবত কানে গিয়েছিল রঘুনাথের। রক্তে ঢাকা চোখ মেলে বহু কষ্টে সে তাকাবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। তার চোখের পাতা যেন ইটের চেয়েও ভারী হয়ে গিয়েছে, তাই চোখ খুলতে গিয়ে রক্তমাখানো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল দু-চোখের কোণ ভিজিয়ে।
ওর শরীরের রক্ত মাটি ভিজিয়ে জমাট বেঁধে আছে পুকুরধারে। ভোর হয়ে আসছে। গাছের ডালে কাক-পক্ষীদের চিৎকার। পাশের কর্মকার বাড়ির হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকতে ডাকতে পুকুরধারে এসে রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল। মুখ নামিয়ে ওরা সেই জমাটবাঁধা রক্ত পুঁচপুঁচ করে খেতে লাগল। সূর্যাক্ষ চিৎকার করে হাঁসগুলোকে তাড়াতে গিয়ে দেখল জেদি হাঁসগুলো তখনও মন দিয়ে জমাট বাঁধা রক্তগুলো খেয়ে যাচ্ছে। শিউলিফুলের বোঁটার মতো ওদের ঠোঁটগুলো ভরে উঠেছে রক্তের দাগে। ভোরের কুসুম ফোঁটানো আলোয় রঘুনাথকে আঁকড়ে ধরে শেষবারের মতো গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সূর্যাক্ষ, খবরদার, তোমরা কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না। যদি হাত দাও তাহলে পুরো গাঁয়ে আমি আগুন ধরিয়ে দেব।