রাতের বেলায় রঘুনাথ কারোর কথা শুনতে রাজি নয়। হাবুল চোর ঘরের চালে ওঠার আগে কী যেন বোঝাতে চেয়েছিল তাকে, রঘুনাথ তার কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল, তুমি থামো তো ওস্তাদ, আমাকে চড়তে দাও। সিদ কেটে ঘরে ঢোকার চাইতে চাল কেটে ঢোকা আরও সহজ।
কথা হল কাঁসার থালা বাসন বস্তায় ভরে দড়ি বেঁধে উঠিয়ে দেওয়া হবে ওপরে, তারপর কুয়ো থেকে জল ভোলার মতো টেনে তুলে নিলেই হবে।
আজ বেশি নয়, মাত্র দুবা হলে কাজ মিটে যাবে। চুনারামের জন্য খাসির মাংস এসে যাবে তার পরের দিন। শুধু মা শীতলবুড়ির দয়া চাই। তার দয়া ছাড়া গাছের পাতাও নড়বে না। রঘুনাথ ধার কাস্তে দিয়ে চাল কেটে দেয়াল বেয়ে কায়দা করে নেমে এল নীচে। বাদুড়ের চিৎকারে ঘাবড়ে গেল সে। এ ঘরটা দিনের বেলায় জমজমাট থাকে কর্মীদের ভিড়ে। সন্ধে সাতটার পর কাঁসা-ছিলা বন্ধ করে দেয় কাঁসারি বুড়া।
শুনসান ঘরে থরে থরে সাজানো কাঁসার থালা বাটি মাস। ছাঁট কাঁসা ভরা আছে কুইন্টাল মাপের বস্তায়। ওদিকে নজর দিল না রঘুনাথ। ছাঁটের দাম কম, খাটুনির মূল্য পোযাবে না। তার চেয়ে তৈরি জিনিস ঢের ভালো। রঘুনাথ ব্যস্ত হাতে ভরতে লাগল বাসন-পত্র।
এক বস্তা ভরে দড়ি ছুঁড়ে দিল কাটা চালের ভেতর দিয়ে। প্রস্তুত ছিল হাবুল চোর। সামান্য শব্দে সে খরগোসের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল। চালের উপর উঠে গিয়ে দড়ি ধরে টান মারল।
ভারী বস্তা ওঠাতে ঘাম ছুটল হাবুল চোরের। তবু সে বহু কষ্টে বস্তা টেনে নিয়ে গেল তেঁতুলতলায়। ছেলেটার এলেম আছে বলতে হবে। এ লাইনে আর দু-পাঁচ বছর থাকলে ঝানু হয়ে যাবে। গাছের পাতা নড়া দেখে বুঝতে পারবে হাওয়া কোনদিকে বইছে।
দ্বিতীয় বস্তাটা ওঠাতে গিয়ে অসাবধানে হাত ফসকে পড়ে গেল মেঝেয়। আর একটু হলে রঘুনাথ চাপা পড়ত তার তলায়। কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে।
কিন্তু সেই স্বস্তির নিঃশ্বাস কাল হয়ে দাঁড়াল তার কাছে। সারিবুড়া বস্তা আছড়ে পড়ার শব্দে হৈ-চৈ না করে ধীর পায়ে এগিয়ে এল ঘরের দরজার কাছে। আগেভাগে ভেজান ছিল দরজা। হাত বাড়িয়ে নিঃশব্দে শেকল তুলে দিল কাসারিবুড়া। আশে-পাশের বাড়িতে গিয়ে মানুষ জনকে জাগিয়ে তুলল সে।
বিপদ বুঝে বস্তা ফেলে পালিয়ে গেল হাবুল চোর। রঘুনাথ দড়ির সাহায্যে চালের উর উঠে এল কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ইট-পাথরের আঘাতে খড়ের চালে শুয়ে পড়তে বাধ্য হল সে। চারজন মিলে তাকে যখন খড়ের ছাদ থেকে নামাল তখন তার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। মাথা ফেটে রক্তে ভরে গিয়েছে মুখ। চুয়ানো রক্ত জমাট বেঁধে লাল কেঁচোর মতো নড়ছে শরীরের কাঁপুনিতে। শুধু মাথা নয়, আঘাত জমাট বেঁধে আছে চোখের নীচে, ফলে বাঁ পাশের চোখটা নারকেল কুলের মতো ফুলে আছে মোটা হয়ে। কিছুটা জায়গা আম ছ্যাচার মতো হেঁচে গিয়ে অনবরত চুঁইয়ে যাচ্ছে রক্ত। কালসিটে দাগটা অন্ধকারেও দেখা যায় স্পষ্ট।
রঘুনাথের দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতা ছিল না, তবু অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় সে সুযোগ খুঁজছিল পালিয়ে যাওয়া যায় কিনা, কিন্তু কোনো উপায় না দেখে ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে নিল সবার সহানুভূতি পাওয়ার জন্য। সহানুভূতি দূরে থাক রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্রোধ বাড়ছিল মানুষের।
দুজন মই নিয়ে এসে পায়ে দড়ি বাঁধল রঘুনাথের। সেই দড়ি ধরে টানতেই প্রায় দশ হাত উছু ছাদ থেকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রঘুনাথ। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কাটা তালগাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে গেল কিছুটা,তারপর এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। আর তখুনি শুরু হল শাবল আর লাঠির বেদম প্রহার। শেষ রাতের বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল রঘুনাথ। সেই চিৎকার পৌঁছে গেল সূর্যাক্ষর দোতলার শোওয়ার ঘরে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। ঘুম জড়ানো চোখে সে শুনতে পেল মানুষের স-উল্লাস চিৎকার, বুনো পাড়ার রঘু ধরা পড়েছে গো….।
একবার নয়, বারবার ভেসে এল সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর। আতঙ্ক আর দুঃশ্চিন্তায় ঘুম ছুটে গেল সূর্যাক্ষর। টেবিল ল্যাম্পের সলতে উসকে সে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সতর্ক হতেই শুনতে পেল উন্মাদ মানুষের কণ্ঠস্বর, ঢ্যামনাটাকে শেষ করে দে। ওকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। বড়ো হলে এ নির্ঘাৎ হাফিজ ডাকাত হবে।
শাবল আর লাঠির আঘাত শুরু হল পর্যায়ক্রমে। বাতাস বিদীর্ণ করে ভেসে এল আর্তস্বর, মরে গেলাম গো, আর মেরোনি গো-ও-ও-ও। মরে যাবো গো-ও-ও-ও। তবু প্রহারের শব্দ স্তব্ধ হল না।
সূর্যাক্ষ অস্থির হয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। পুকুরপাড়ে সময়মতো না পৌঁছাতে পারলে ওরা রঘুনাথকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। দশের মার একা সে কঁহাতক সহ্য করবে?
দরজা খুলতে গিয়ে বাধা পেল সূর্যা। রঘুনাথ ধরা পড়ার পর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মীনাক্ষীর। কপোতাক্ষকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে ছুটে এসেছিলেন দোতলায়। শেকল তুলে দিয়ে নেমে গেছেন চুপিসারে। কেন না তিনি জানতেন আর একটু পরেই পুকুরপাড়ে বিচার করার জন্য হাজির হবেন নীলাক্ষ এবং সেই বিচার যে কত নির্মম হবে তা মীনাক্ষীর অজানা নেই। এ সময় ঘর থেকে সূর্যাক্ষ বেরিয়ে গেলে বিপদ আসন্ন। সূর্যাক্ষ বাধা দিলে মোটও খুশি হবেন না নীলাক্ষ। এর প্রভাব এসে পড়বে দুটি পরিবারে। মীনাক্ষী দরজায় শেকল তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মনে মনে অনুতপ্ত হলেও তার এই যন্ত্রণার কথা তিনি ঘরের মানুষটিকে ছাড়া আর কাউকেই বলে বোঝাতে পারবেন না।