চেস্টে এক ইঞ্চি কম হওয়াতে বাদ চলে গেল অতনু। দৌড়ে বাদ গেল লিটন। পরিমলের ওজন কম দু-কেজি। পাকা কলা আর চিড়ে খেয়েও সে ওজন বাড়াতে পারল না। আক্ষেপে মাথার চুল আঁকড়ে বলল, পারলাম না। হেরে গেলাম। মাঠ জুড়ে জমে উঠেছে চাকরির খেলা। এ-ও এক আজব খেলা যে খেলার কোনোদিন শেষ নেই। রান দিয়ে এসে গাছের ছায়ায় হাঁপাচ্ছিল সূর্য। পরপর তিনজন বাদ যাওয়াতে ওর মনটা খারাপ হয়ে আছে তখন থেকে। দশজনের মধ্যে দৌড়ে রান থেকে ছিটকে গেল লিটন। সেভেনথ হয়েছে সে। সূর্যান্য সবার আগে, ফাস্ট। ঘর থেকে বড়োগঙ্গার ঘাট রোজ সকালে দৌড়ে যেত সে। তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে ভেজা শরীরে দৌড়ে দৌড়ে ফেরা। কোনো কাজ বুঝি বিফলে যায় না, আজকের ঘটনা তাই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করে ছাড়ল।
মন খারাপ কাটিয়ে লিটন এল গাছের ছায়ায়, ওর চোখে-মুখে আর কোনো দুঃখ বা আফসোস নেই। সূর্যাক্ষর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, সাবাস বন্ধু, সাবাস! গ্রামের মুখ রাখলি তুই আর কৃশানু। আমরা পারলাম না, তার জন্য কোনো দুঃখ নেই। তাদের আনন্দটাই আমরা সবাই মিলে ভাগ করে নেব। সূর্যাক্ষর খারাপ লাগছিল, তবু সে জোর করে বলল, মন খারাপ করিস নে। তোদের জন্য হয়ত আরো ভালো চাকরি অপেক্ষা করছে।
-হাসালি! ওদের কি হবে জানি না, কিন্তু আমার কপালে চাকরি নেই। লিটন কষ্ট করে হাসল।
বিকেল ঢলছে পশ্চিমে, মাঠ ফাঁকা হচ্ছে ধীরে ধীরে। মোট ত্রিশ জন এই মাঠ থেকে ট্রেনিংয়ে যাবে পুনেতে। অফিসার-ইন-চার্জ স্পষ্ট বাংলায় বললেন, যাদের নাম ডাকা হল তারা সবাই সিলেকটেড। বাড়িতে চিঠি যাবে। চিঠিতে সব জানতে পারবে।
সূর্যাক্ষ আর কৃশানুর পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল লিটন। মন খারাপের ঘোর কাটিয়ে সে বলল, চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিল। ভেবেছিলাম চাকরিটা পেলে বাবাকে আর চুল কাটতে দেব না। মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। ছ্যাঁ!
.
৫৯.
খাঁ-খাঁ করছে মাঠ, বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। ধুলোর ঝড়ে যেন ঢাকা পড়ে যাবে পুরো পৃথিবী। মাঠ থেকে ফিরে রঘুনাথের আর ভালো লাগছিল না কিছু। শেয়ালকাঁটা গাছের মতন মনটা এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে। হাতে টাকা না থাকলে পুরুষ মানুষের কিছু ভালো লাগে না, আঁধার হয়ে যায় দুনিয়া। নিজেকে হীন মনে হয়। চেয়ে চিন্তে আর যাই হোক, সংসার চলে না।
চুনারাম দিন দশেক হল উঠতে পারে না বিছানা ছেড়ে। গা-হাত-পা ফুলে গিয়েছে, শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে প্রচণ্ড। কাশলে টিন পোনোর শব্দ হয় বুকের ভেতর। সকালবেলায় রঘুনাথকে কাছে ডেকে বলল, দাদুরে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না। খাসির মানসো খেতে মন করছে, দেখ না যদি হাট থেকে আনতে পারিস।
গাঁয়ে খাসি কেটেছিল হপ্তাখানিক আগে। লাঠি নিয়ে কি একটা দরকারে চুনারাম গিয়েছিল গ্রামের ভেতর। রাস্তার ধারে কাটা খাসিটা তার লোভ বাড়িয়ে দেয়। হল হাড়ান তাগড়াই মিটার সারা শরীরে তখন রক্তের ঘাম। থিরথির করে নড়ছিল লালচে মাংসগুলো। অত একটা গন্ধ এসে টোকা মারছিল নাকে। এমন চেনা গন্ধ জল এনে দেয় জিভে। যার খাসি সে হাড়-কৃপণ। মোটও ধার দেবে না। এমন কি নাড়িভুঁড়িটা ফেলে দেবে, শ্যাল-কুকুর খাব তবু হতে তুলে চুনারামকে দেবে না। আজকাল নাড়ি-ভুড়িও মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। গরম জলে সিজিয়ে নিয়ে সাফসুতরো করে কাটলে একটা ভুড়িতে কমের উপর সের খানিক ছালচামড়া হবেই হবে। গোল আলু দিয়ে ঝোল রাঁধলে তার স্বাদও ভোলা যায় না।
গাঁ থেকে ফিরে এল চুনারাম, কিন্তু লোভটা তার সঙ্গে এল। দুপুরবেলায় ভাত আর কুমড়োর ঘাট খেতে গিয়ে জবাফুলের চেয়ে টকটকে লাল মাংসর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার, আর তখনি সেই অদ্ভুত গন্ধটা ছড়িয়ে গিয়েছিল তার চারপাশে। জিভে জল চলে এল তার।
রঘুনাথ পাশে বসে মুখ লুকিয়ে খাচ্ছিল। তখনই মাংসর গল্পটা লোভে পড়ে বলে দেয় চুনারাম। তার এই আব্দার শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট উল্টায় দুর্গামণি। রঘুনাথ খাওয়া থামিয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকায়। শেষবেলায় নোলা বাড়ে মানুষের। চলে যাবার আগে আশ মিটিয়ে যেতে চায় সবাই।
যে করেই হোক সের খানিক মাংস আনতে হবে রঘুনাথকে। হাতে টাকা থাকলে কালই হাট থেকে মাংস কিনে আনত সে। কিন্তু টাকা না থাকলে মনের জোর তলানীতে গিয়ে ঠেকে। তাছাড়া এ বাজারে কেউ খালি হাতে ধার দেয় না। বাঁধের উপর হাবুল চোরের সঙ্গে দেখা হল তার সেদিন। হাবুল চোর আফসোস করে বলল, আর দিন চলছে না গো, এবার মনে হয় শুকিয়ে মরতে হবে। হাতে কাজ না থাকলে পুরো দেশ-দুনিয়া আমার কাছে মরুভূমি মনে হয়।
তখনই ঠিক হয় কাঁসারিদের বাড়িতে আজ রাতেই সিঁদ কাটবে রঘুনাথ। হাবুল চোর তার পাশে থাকবে সাহায্য করার জন্য। যা হবে আধাআধি ভাগ। চোরাই মাল জলপথে চলে যাবে কাটোয়ায়। সেখানে মাল বেচার কোনো অসুবিধা নেই। কাটোয়া হাবুল চোরের পুরনো জায়গা। মহাজনরা সব তার জানাশোনা।
সিঁদ কাটতে গিয়ে ঘরের চাল কাটল রঘুনাথ। পুরনো দিনের মাটির ঘর, দেওয়াল আড়াই হাত চওড়া। কাঁসারিবাড়ির মাটি যেন পাথরের খাদান।
শব্দহীন পায়ে এক বোঝা দড়ি নিয়ে খড়ের চালে উঠে গিয়েছিল রঘুনাথ। তেঁতুলগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাবুল চোরের বুক এখন ধুকধুক করছে ভয়ে। বিড়ি ধরাবে সে ক্ষমতাও তার নেই। বিড়ির ধোঁয়া যদি কাঁসারি বুড়ার নাকে গিয়ে লাগে তাহলে কেস গুবলেট হয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার নব্বই ভাগ সম্ভাবনা।