সূর্যাক্ষ বোকার মতো আফসোস করে বলল, তাহলে খড়ো নদীর ব্রিজটা দেখা যাবে না?
-কেন, ওখানে কি তোর ইয়ে থাকে? দাঁত বের করে খিঁচিয়ে উঠল লিটন, এ মাইরি দেখছি একেবারে ভাবুক সাগর! কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। শালা, যারা মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেশে তারাই দেখছি কেমন মেয়েলী হয়ে যায়।
লিটনের কথা বলার ভঙ্গিতে হাসির ফোয়ারা গড়িয়ে পড়ল ট্রেনের কামরায়। সেই হাসির ধাক্কায় মুখটা শুকিয়ে গেল সূর্যাক্ষর, কোনোমতে ঢোঁক গিলে সে বলল, বড়ো বকবক করছিস, দেখা যাবে। মেয়েরা না হলে ছেলেদের এক-পাও চলে না। মেয়েরা হল ছেলেদের ভিটামিন, অনুপ্রেরণা।
-এই রে, কি সব কঠিন কঠিন কথা বলছে, শুনলি? লিটন সবাইকে দলে টানতে চাইল।
পরিমল তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ওসব অনুপ্রেরণা-ফেরনা এখনকার বাজারে আর চলে না। এখন ইয়াহিয়ার জামানা। ধরো আর জবাই করো। মেয়েদের সাথে মেশো, আর ব্লটিং পেপারের মতো মধু চুষে নিয়ে ছেড়ে দাও। এই তোরা ববি দেখেছিস, হাম তুম এক কামরা মে বনধ হো। পরিমল ঘাড় নাড়িয়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে খি-খি করে হাসল।
লিটন না থাকতে পেরে বলল, তোরা মাইরি, একেবারে যাচ্ছেতাই। মেয়েদের নিয়ে এমন ভাবা অন্যায়।
–আহা রে, কোথাকার কোন রামমোহন এসে গেলেন? পরিমল খোঁচা মারতে ছাড়ল না, পিতামহ ভীষ্মের নাম শুনেছিস। মহাভারতে আছে পড়ে নিস। ওঁর জীবনে কত মেয়ে আসল, একটারও হাত ধরল না। একেবারে টাটা স্টিলের মতো ক্যারেকটার। যাই বলিস, লোকটার ক্যালি ছিল। সারা জীবন মেয়ে ছাড়া কাটিয়ে দিল। তোরা পারবি? তোদের বুকে অত দম নেই।
ধুবুলিয়া পেরতেই গেটের কাছে চলে এল ওরা। লিটন সতর্ক করে বলল, মোটে হড়বড় করবি নে। হড়বড় করলেই গড়বড়। শালা, লালগোলা ট্রেন হল অজগরের হাঁ-এর মতো, নিঃশ্বাসে টেনে নেয় মাইরি! একবার তলায় ঢুকে গেলে ডাইরেক্ট যমনগরের টিকিট কাটা হয়ে যাবে।
ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল বাহাদুরপুরে। মাঠের মধ্যে ছোট স্টেশন। কোনো আভিজাত্য নেই, মাঠকুড়োনী মেয়ের মতো সাদাসিধে। ডান পাশে নয়, বাঁ পাশের দরজা দিয়ে নেমে এল ওরা। প্ল্যাটফর্ম না থাকাতে নামতে বড় অসুবিধা। বিশেষ করে মেয়েরা নামতে গেলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে রাস্তা, দুপাশে ঝোপঝাড় আর ঘাসহীন জায়গা। এখানকার মাটির রঙ ঘিয়ে বর্ণ। অদ্ভুত দৃষ্টি আকর্ষণী ক্ষমতা রাখে এই রং। চোখে নেশা ধরায়। একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে পথের মাঝখানে শিবঠাকুর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সূর্যাক্ষ। একটা বাস এসে থেমেছে পাকা রাস্তায়। পিলপিল করে লোক ছুটে যাচ্ছে বাসটাকে ধরবার জন্য। কেউ উঠতে পারল, কেউ আবার পারল না। দূরে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগল না সূর্যাক্ষর। দৌড়াল না সে, ধীরে ধীরে হেঁটে এল রাস্তা পর্যন্ত। লিটন খোঁচা দিয়ে বলল, এমন হাঁটছিস যেন তুই নমাসের প্রেগনেন্ট। আজ তোর কি হয়েছে বল তো?
সূর্যাক্ষ হালকাচালে বলল, কি আর হবে? বলতে পারিস বাড়ি থেকে প্রথম একা একা বাইরে আসা। মনটা হঠাৎ করে খাঁচা ভাঙা পাখি হয়ে গেল, তাই মনের আনন্দে উড়ছি।
একটা স্টেটবাস এসে থামল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাইন বোর্ডটার কাছে। হুড়মুড়িয়ে সবার সাথে উঠে এল সূর্যাক্ষ। বেশ লম্বা বাস। পিছনের সিটে বসার জায়গা পেয়ে গেল ওরা। বারুইপাড়ার কৃশানু হাতে টাকা নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে, তারপর জোর করে হেসে বলল, কাকু, টিকিট না দিলেও চলবে। আমরা গভমেন্ট কলেজের মাঠের সামনে নেমে যাব।
জলঙ্গী নদীর ব্রিজটা বেশ সুন্দর। লোহার ব্রিজ দিয়ে ট্রেন গেলে বিয়ে বাড়ির ব্যান্ডপার্টির মতো ঝর ঝর শব্দ হয়। বাস যাতায়াতের ব্রিজটা যেন বোবা মেয়ে, শত অত্যাচারে ওর মুখে কোনো কথা নেই, শুধু পিষ্ট হওয়ার ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে। হাত পঁচিশ নিচে জল কখনো কাজলাবরণ, কখনো বা স্বচ্ছ জলে হাবুডুবু খায় মেঘের সংসার। খুব ভালো করে দেখলে জলের শ্যাওলা-ভেজা শরীর মনটাকে আরও সবুজ করে দেয়।
মহিলা কলেজ থেকে দ্বীপীর জন্য ফর্ম নিয়ে সূর্যাক্ষ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল কলেজমাঠে। ছোটখাটো মেলার মতো ভিড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাঠের উপর। সামনের চার্চটা মাথা তুলে স্পর্শ করতে চাইছে আকাশ।
প্রায় কুড়িটা যুবক ছুটতে ছুটতে মাঠের এক প্রান্তে গিয়ে থামল। ওরা হাঁপাচ্ছিল। ওদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে বেছে নিলেন অফিসার। ওরা চেস্ট মেজারমেন্টের সেকশনে গিয়ে দাঁড়াল।
মাঠের মাঝখানে টাঙানো হয়েছে খাকি রঙের তাবু। এছাড়া রোদ আটকানোর জন্য মাঠের মাঝখানে পোঁতা হয়েছে বিরাট বৃত্তের রঙিন ছাতা। এর বড়ো, এত সুন্দর ছাতা সূর্যাক এর আগে দেখেনি। সত্যি, শহর কত আজব জায়গা, এখানে এলে কত কি যে দেখা যায়!
ছাতার নিচে টিনের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন জলপাই রঙের পোষাক পরা চারজন অফিসার। মোচসমেত মুখগুলোয় গাম্ভীর্য এবং কাঠিন্য যেন একটা মূল্যবান প্রসাধন। কেটলিতে করে চা-দিয়ে বেড়াচ্ছে জলপাই পোষাক পরা একজন সৈনিক। মাটির ভাড় ফেলার জন্য তাবুর সামনে রাখা হয়েছে অস্থায়ী একটা ডাস্টবিন। উচ্চতা মাপার মেজারিং বারটা রাখা হয়েছে তাঁবুর পাশে। ওর ঠিক হাত পাঁচেক দূরে ওয়েট-মেসিন। লাল রঙের একটা রেজিস্টার নিয়ে পেনের ঢাকনা খুলে বসে আছেন একজন ফৌজি অফিসার। লাইন দিয়ে একে একে এগিয়ে যাচ্ছে যুবকরা। ওদের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে হাফ-প্যান্ট। কারোর পরনে আবার শুধু গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট। একজন ফৌজি চিৎকার করে রিডিং বলছে, অন্যজন তা লিখে রাখছে রেজিস্টারে।