–তুই দেখছি উত্তরকুমারের ডায়লগটা ঝেড়ে দিলি! লিটন হাসতে হাসতে বলল। পরিমল উৎসাহিত হল, এটা উত্তমকুমারের ডায়লগ নয় রে, এটা কালীগঞ্জ বাজারের.ডায়লগ! সব জায়গার কিছু স্পেশ্যাল ডায়লগ থাকে।
এই মনোযোগটা পড়াশুনায় দিলে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে যাতিস। তোর মধ্যে স্পার্টস ছিল। শুধু ব্রেক আর ক্ল্যাচ না থাকায় টসকে গেলি! লিটন বাহাদুরী নেওয়ার জন্য তাকাল। দুর্ভাগ্য তাকে কেউ বেশি গুরুত্ব দিল না।
অতনু এগিয়ে গিয়ে পাগলা চীর দিকে তাকাল। কুলী পাকানো ধোয়া নজরে পড়ল তার। বুক হালকা করে বলল, এই, সাবধান ট্রেন আসছে। শোন, হটোপুটি করবি না। সবাই মিলে এক কামরায় উঠব তাহলে চেকার আমাদের কিছু বলতে সাহস পাবে না।
লিটন বলল, টিকিট চাইলে বলবি স্টুডেট। দেখবি তাহলে আর কিছু বলবে না।
-যদি আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চায়? সূর্যাক্ষ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল।
সবাই মুখ শুকিয়ে আছে, লিটন বলল, বলবি ফাস্ট ইয়ার। আইডেনটিটি কার্ড এখনো কলেজ থেকে দেয়নি।
–যদি বলে কোন কলেজে পড়ো-তাহলে?
লিটন সঙ্গে সঙ্গে বলল, বলবি কমার্স কলেজে। কমার্স কলেজের ছাত্রদের নাম আছে। ওদের চট করে কেউ ঘাঁটাবে না।
সূর্যাক্ষ কথাগুলোকে মুখস্থ করার চেষ্টা করছিল। একটা উত্তেজনা ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছিল তার ভেতরে। অস্বাভাবিক গরম লাগতে সে বুঝতে পারল কপালে তার অবাঞ্ছিত ঘাম জমেছে।
নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য কপা এগিয়ে এল সে। ট্রেনের শব্দটা বাড়ছে ক্রমশ। টানা হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। যেন মনে হচ্ছে বাঁশি থেমে গেলেই খেলা শুরু হবে।
কপালের ঘাম মুছে নিয়ে সিমেন্টের বেঞ্চিটার দিকে তাকাল সূর্যাক্ষ। অন্ধকার গায়ে মেখে তখনও কজন মানুষ বসে আছে ঝিম ধরে। ট্রেন আসছে বলে ওদের কোনো হেলদোল নেই। অদ্ভুত নির্বিকার ওরা।
মাটি কাঁপিয়ে ট্রেন ঢুকে আসতেই প্ল্যাটফর্মের ওপর বেড়ে ওঠা কলকে ফুলের গাছ থেকে উড়ে গেল জোড়া শালিক। কটা পাতিকাক চেঁচিয়ে উঠল তারস্বরে।
বাতাস নোংরা হয়ে উঠছে ধোঁয়া আর চিৎকারে। যেন ঝাল লেগেছে স্টিম ইঞ্জিনটার, শুধু ঝোল টানার হিসহাস শব্দ। ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরতেই সূর্যাক্ষর মনে পড়ল দ্বীপীর মুখটা। যেন একটা রাজহংসী পুকুরের পাড়ে গায়ে রোদ লাগিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ট্রেন চলার শব্দে অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে যা অক্ষয়কুমার বড়াল বা জসিমুদ্দিনের কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। চলমান বাংলার ছবি ট্রেনের জানলার ভেতর দিয়ে দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে যায় সূর্যাক্ষর। ভালো কিছু দেখলেই চকিতে দ্বীপীর মুখটা রূপালি কোনো মাছের মতো মনের জলাশয়ে ঘাই দিয়ে হারিয়ে যায়।
নানা ধরনের গল্পে মেতে উঠেছে লিটনরা, বিশ্বপ্রকৃতির খোলামেলা চেহারা দেখার তাদের ফুরসৎ নেই। রেল লাইনের দু-পাশে ফসলের মাঠ, ছোট ছোট ডোবা-পুকুর, বাঁশঝাড়, ঘরবাড়ি, গোরু-ছাগল, ঝোপঝাড় সব যেন শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত ছবি।
অনেকক্ষণ পরে লিটন তার সিট থেকে উঠে এসে সূর্যাক্ষর পাশে এসে বসল, কিরে, একা-একা গালে হাত দিয়ে কি ভাবছিস? সুকান্ত হয়ে গেলি নাকি?
সূর্যাক্ষর চমক ভাঙল, অপ্রস্তুত চোখে তাকাল সে; বাইরের দৃশ্যগুলো কত চমৎকার–তাই বল? চোখ আটকে যায়, ভীষণ ভালো লাগে রে। কেমন সন্দেহের মন নিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকাল লিটন, তারপর চিৎকার করে অতনুদের ডাকল, এ্যায়, দেখ রে, এ শালা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গিয়েছে। দেখ মাইরি, কবিতা করছে।
শুধু অতনু নয়, পরিমল আর বীরু উঠে এল ওদের সঙ্গে। প্রত্যেকের ঠোঁটে লেপটে আছে শব্দময় হাসি। অতনু সূর্যাক্ষর চোখের দিকে ম্যাটম্যাট করে তাকাল, কি হয়েছে রে সূর্য? পাগলের মতো কি সব বলছিস শুনলাম?
-না রে, বাইরের দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে–তাই বলছিলাম। এরা না পেছনে লেগে মাথাটা খারাপ করে দেবে। সূর্যাক্ষ নিরীহ গলায় বলল।
অতনু হাসল না, বেশ গম্ভীর হয়ে গেল কথা শুনে, তোকে দেখছি গরীবের ঘোড়ারোগে ধরেছে। ভাইরে, এ রোগ বড়ো ডেঞ্জারাস। সারে না, বুকের ভেতরে টিবির জীবাণুর মতো বাসা বাধে। অবশ্য তোর দোষ নেই। তোর ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তোর বাবা তো ঝোলা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় দেশান্ধারের জন্য।
অতনু এমন ভঙিতে কথাটা বলল যে দুঃখ পেল সূর্যা। সূর্যাক্ষ মুখ ফুটিয়ে কোনো প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করে কি হবে? তাহলে ওরা বাক্যবাণে আরও অস্থির করে ছাড়বে। আসলে ওরা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। জানে না কখন কি বলতে হবে।
লালগোলা মুড়াগাছা ছাড়ার পর ট্রেন পাত কাঁপিয়ে ছুটছে। বেথুয়াডহরীর জংগলমহল দুচোখ ভরে দেখল সূর্যা। আহা, কত যে গাছ আছে ওখানে, যদি সব গাছের নাম সে জানত তাহলে দ্বীপীকে সঙ্গে নিয়ে গল্পের ছলে চিনিয়ে দিতে পারত। প্রকৃতির পাঠশালায় সে এখন নিতান্তই শিশুশ্রেণীর ছাত্র।
লিটন ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল, আমরা কৃষ্ণনগর অবধি যাব না, বাহাদুরপুরে নেমে যাব। কৃষ্ণনগরে প্রায় দিন চেক থাকে। ওখানে নামা রিসকের হবে। ওখানকার মামাগুলো ভাগনেদের কোনো ক্ষমা করবে না। ধরতে পারলে ভাগনে আদরে একেবারে শ্রীঘরে ভরে দেবে। তাছাড়া যদি ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং থাকে তাহলে তো আর কথা নেই। স্টুডেন্ট বলেও কেঁদে কেটে, হাতে পায়ে ধরে পার পাওয়া যাবে না। তোরা সব রেডি হয়ে নে, ধুবুলিয়ার পরই বাহাদুরপুর ঢুকবে।