সকালবেলায় চৌরাস্তার মোড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে মানুষের আনাগোনায়। দোকান-পাট গা ঝাড়া দিয়ে চেষ্টা করছে পথচারীর নজর কাড়ার। এ সময় শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে লরি বোঝাই হয়ে আনারস আসে। প্রমাণ সাইজের আনারসগুলোর স্বাস্থ্য চোখে লাগার মতো। লরি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে মাল আনলোড কছে দুজন কুলি। মালিক চিৎকার করে গুনছে আনারসের সংখ্যা।
কৃশানুর বারুইপাড়ায় ঘর। অল্প বয়স থেকে বিড়ি টেনে তার ঠোঁট জোড়া এখন সেদ্ধ করা পাঠার মেটের রং। জামার পকেট থেকে কলেজ বিড়ি বের করে সে জিজ্ঞাসা করল, খাবি নাকি?
দেখতে ধানী লঙ্কার মতো, গুণেও কম যায় না। সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিল লিটন, দে, ধোঁয়া না গিললে পেট ফেঁপে যাচ্ছে। নেশা করার মহাফ্যাসাদ, মন আনচান করে।
বীরু বলল, বিড়ি রাখ। আজ একটা শুভ দিন। অন্তত আজকের জন্য সিগারেট খা। কি খাবি? নাম্বার টেন না চারমিনার?
-সিজার খাওয়াবি তো বল। পাছায় তুলো দেওয়া হতে হবে।
-ঠিক আছে, তাই খাওয়াব। দাঁড়া। বীরু রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল বটতলায়। আর একটু হলে একটা স্টেটস ওকে পিষে দিত। বীরু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল। ড্রাইভার অনুচ্চ স্বরে গালি দিয়ে বাস হাঁকিয়ে দিল কৃষ্ণনগরের দিকে। সিগারেট নিয়ে বীরু ফিরে আসতেই সাক্ষ ওকে ধমকাল, এখনই মায়ের ভোগে লেগে যেতিস! একটু সাবধানে রাস্তা পার হবি তো?
বীরু দোষ করেছে, তাই কোনো উত্তর করল না। অতনু বলল, বীরু চলে গেলে আমাদের কে সিগারেট এনে খাওয়াত বল তো? আর যাই বলিস–ওর মনটা কিন্তু ভালো। জান বাজী রেখে যেভাবে ও রাস্তা পার হল তাতে মনে হচ্ছে বীরুর চান্স এক্কেবারে পাকা।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে। পরিমল হাসতে হাসতে বলল। সকালবেলায় ঠাকুরের গান চালিয়েছে রেডিও দোকানের মালিকটা। গালে হাত দেওয়া শিশুর সাইনবোর্ডটা রোদে ঝকঝক করে হাসছে। পাশে একটা রেডিওর ছবি,তার নিচে বড়ো বড়ো করে লেখা মারফি রেডিও।
সূর্যাক্ষ দেবগ্রামে এলে এই সাইন বোর্ডটার দিকে একবার তাকাবেই। রেডিও দোকান থেকে ছিটকে আসা ধুপের গন্ধে ম-ম করছে বাসরাস্তা। পাশে হোটেলের মাছ ধুচ্ছে রান্নার জন্য। বাস-লাইনের লোকেরা ওই হোটেলের বাঁধা খদ্দের। একেবারে ঘরের মতো রান্ন। ঢেকুর বা গ্যাস-অম্বল হবার কোনো সুযোগ নেই।
ওরা রাস্তা পেরিয়ে রিকশা-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়াল। এখানে দাঁড়ানো মানে রিকশাওয়ালারা হাঁ-করে তাকাবে। আশ্চর্য, আজ আর ওদের দেখে রিকশাওলাদের কোনো উৎসাহ বা ডাকাডাকি নেই। ওরাও বুঝে গিয়েছে ওরা রিকশায় চড়ার পাবলিক নয়। এরা ফুটো পাটি।
লিটন একটা ফাঁকা রিকশার দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হাসল, দেখলি ওদের আশায় কেমন জল ঢেলে দিলাম।
–আগে তো তুই এত খচ্চর ছিলিস না? সূর্যাক্ষ না থাকতে পেরে বলল।
হাসি থামল না লিটনের, গা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি হলাম মানববিদ্বেষী। বুঝলি? গরিব হয়ে গরিবের মন যুবি, তাই এই বিকৃত খেলা।
-চুপ কর। ধরনী ফেটে গিয়ে সীতার মতন পাতালে ঢুকে যাবি। অতনু খেঁকিয়ে উঠল।
পরিমল হঠাৎ করে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, ঐশী বেশি সুন্দরী না গীতা বেশি সুন্দরী? চোখ বন্ধ করে কৃশানু উত্তর দিল, সীতা।
-কেন? পরিমল জানতে চাইল।
পরিমল সহজভাবে বলল, সীতা লাঙলের ফলায় উঠেছিল। লাঙলের ফলায় পেঁড়ি গুগলি খোলামকুচি ছাড়া আর কি ওঠে বল? মাটির মেয়ে ঐশীর মতো সাজার জিনিস পাবে কোথায়?
-ফাইন! বীরু শেষ পর্যন্ত আক্ষেপ করল, মাইরি, আমার জীবনের একটা সাধ পূরণ হল না। ঐশীকে দেখার পর ভেবেছিলাম ওর সাথে লাইন মারব। কিন্তু আমি বড়ো হওয়ার আগেই আকাশদা ওকে বুক করে নিল। তবে অসম লাভ। দুইয়ে দুইয়ে চার হবে কিনা ডাউট আছে।
অসম ভালোবাসায় রোমাঞ্চ বেশি। লিটন বলল, গ্রামের ভালো ভালো মেয়েগুলোর সব বিয়ে হয়ে যাবে। আমরা শালা হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। আর কপাল বাড়িয়ে দেব ভাইফোঁটা নেওয়ার জন্য। ছ্যাঃ, এটা একটা জীবন!
–তাহলে কি চাস তুই? পঙ্খীরাজ ঘোড়াসমেত রাজকন্যা? পরিমলের ঠাট্টায় রেগে গেল লিটন, তোর শালা মধ্যযুগীয় মনোভাব আর যাবে না। বাইরের বই না পড়ে পড়ে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে গেলি! জীবনটাকে চাখলি কোথায়, যে স্বপ্ন দেখবি?
খোলা তরোয়ালের মতো চুপচাপ শুয়ে আছে টানা রেললাইন, রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ছে আত্মহত্যার জন্য। রোদের এই স্বভাব নজর এড়িয়ে যায় সবার। দুরে তাল গাছ, রঘুনাথের ঝাঁকড়া চুলের মাথার মতো। সিগন্যাল পোস্টটা দাঁড়িয়ে আছে অলস ভঙ্গিতে। মাথা ঝুঁকিয়ে আছে বাধ্য ছেলের মতো। টিকিট কাটার ঘণ্টা হয়ে গেছে কখন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লালগোলা ঢুকবে। সিগন্যাল হয়ে গেছে। ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম, কোনো আব্রু নেই তবু বেশ কিছু মানুষের ব্যস্ততা ঠেলে উঠল বুক চিরে।
সুর্যাক্ষ শেষবারের মতো টিকিট কাটার কথা বলতেই চরম গালি দিয়ে উঠল লিটন। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল সূর্যাক্ষ কিন্তু সঙ্গীরা মজা পেয়ে হেসে উঠল গলা ফাড়িয়ে।
লিটন বলল, তোর যদি টাকা সস্তা হয়ে থাকে আমাকে দিয়ে দে। আমার কাজে লাগবে।
সূর্যাক্ষ কোনো কথা বলল না, কিন্তু অপমানটা বিঁধে রইল ওর মনের ভেতর। পরিমল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, বন্ধুদের কথায় কিছু মনে করতে নেই। মনটাকে জিয়ানো মাছের মতো সাভারের জন্য রেখে দিতে হয়। মন মরে গেলে এ জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে–মনে রাখিস?