-হ্যাঁ, অবশ্যই যাবি। তোর বাবা এখনও মরে যায়নি। তুই পড়। যতদূর মন চায়–তুই পড়। বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বললেন কপোতাক্ষ।
মীনাক্ষী তার সেই কথার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিলেন, তোর উপর আমাদের অনেক আশা। আমরা কখনও জোর করিনি তোকে ফাস্ট ডিভিশনেই পাশ করতে হবে। তুই পাশ করেছিস এতেই আমরা খুশি। তুই মানুষ হ, এর বেশি আমাদের কিছু চাওয়ার নেই।
মীনাক্ষীর কথাগুলো সূর্যাক্ষের অন্তরে গিয়ে বিধল। কপোতাক্ষর জীবনযাত্রা সে নিজের চোখে কাছ থেকে দেখছে। শুধু মানিকডিহিতে নয়, আশেপাশের দশটা গ্রামে তাঁর সুখ্যাতি কানে এসেছে সূর্যাক্ষর। বাবার জন্য গর্ববোধ হয় তার।
ইচ্ছে ছিল সকাল সাড়ে সাতটার বাসে সরাসরি কৃষ্ণনগরে যাবে সে কিন্তু দেবগ্রামে বাস পৌঁছাতেই পেছনের একটা চাকা বাস্ট হয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে সব যাত্রীরা নেমে এল চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়কে।
বাস ছাড়তে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে। ড্রাইভার কন্ডাক্টর চা খাবে। সকালের টিফিনটা দেবগ্রামে সেরে বাসে উঠবে। সূর্যাক্ষ ভাবছিল কি করা যায়, তখনই লিটন এসে তার পিঠের উপর হাত রাখাল, কোথায় যাচ্ছিস রে সূর্য?
-ফর্ম আনতে কৃষ্ণনগর যাব।
-বাঃ, ভেরি গুড। চল এক সাথে যাওয়া যাক। লিটন বলল, কলেজ মাঠে মিলিটারিতে লোক নেবে। আমি অতনু আর বীরু যাচ্ছি লাইন দিতে।
-তোরা আর পড়বি না? ফ্যাকাসে গলায় জিজ্ঞাসা করল সূর্যাক্ষ।
নিঃশব্দ হাসি খেলে গেল লিটনের ঠোঁটে, চাকরি পেলে কেউ আবার পড়ে নাকি? আকাশদাকে দেখলি না চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেল। আরে, চাকরি হল দিল্লিকা লাড়ু। এই দিল্লির লাড়ু বাগাতে হবে বলে তো পড়াশোনা করা।
-তা ঠিক। তবে।
-দেখ সূর্য, আমরা তোর মতন অত ভালো ছেলে নই। আমরা সো-সো। মিলিটারিতে না হলে পুলিশে ঠিক মাথা গলিয়ে দেব। এখন পুলিশের চাকরিতেও বিয়ে করা যায় বুঝলি? পাশ করার পর লিটনের কথা বলার গতিবেগ আরও বেড়ে গিয়েছে। সে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখন পাঁচ ফুট আট, ওজন সিটি টু। চেস্ট পার্টি ফোর প্লাস। ছুটতে পারি, হাই জাম্প লং কাপ মারতে পারি তাহলে মিলিটারিতে যাওয়ার আর অসুবিধা কোথায়?
-তুই যা যা বললি, আমারও তো তই আছে। সুর্যাম কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবল, তাহলে তোদের সঙ্গে আমার যেতে আপত্তি কোথায়?
তোর বাবা-মা মিলিটারিতে হড়বে? মিলিটারি মানে এক বুলেটে জীবন বাঁধা। বাড়ির একমাত্র ছেলে তুই। ডিসিশন নেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে দেখ। লিটনের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল।
সূর্যাক্ষ অস্থির হল না তার কথায়, শুধু অবজ্ঞায় ঠোঁট ওন্টাল, যুক্তি দেখিয়ে বলল, তুইও তো ঘরের এক ছেলে। তোর বাবা যদি তাকে পাঠাতে পারে তাহলে আমার যেতে অসুবিধা কোথায়?
-তোর বাবা শিক্ষিত। আমার বাবা মূর্ধ। মুখ বাবারা মিলিটারি কি, পুলিশ কি তা বোঝে না। তারা দেশসেবা বোঝে না, বোঝে চাকরি।
-তাহলে তোর কি মত?
-মন চাইলে চল। আমি বাধা দেব না। লিটন ঠাণ্ডা মাথায় বলল, অবশ্য গেলেই যে হবে তার কোনো মানে নেই। হাজার হাজার ছেলে আসবে লাইন দিতে। মাপজোক ঠিক হলে একটা চাল থাকবেই।
-তাহলে চল বাস ধরি। অতনু আর বীরুকে তো দেখছি না?
–ওরা বাথরুমে গিয়েছে। আসল বলে। চল চা খাই।
তখনই একটা বহরমপুর-কৃষ্ণনগর বাস এসে দাঁড়াল জাতীয় সড়কে। সূর্যাক্ষ অস্থির হয়ে বলল, থ্রু বাসে গেলে ভালো হত।
-তোর মাথা খারাপ? বাসে কেন যাব? যে পয়সা বাস ভাড়া দেব, ট্রেনে গেলে সেই পয়সায় হোটেলের খরচটা হয়ে যাবে।
-অর মানে?
লালগোলা ট্রেন তো মামার ট্রেন। মামার ট্রেনে ভাড়া লাগে নাকি?
–যদি স্পেশাল চেকিং থাকে?
-ওসব আগে থেকে জানা যায়, বুঝলি? কলেজে ভর্তি হলে তুই ভেবেছিস আমি মাহলি করব-কখনো নয়। ডবলু-টিতে যাব আর আসব।
ডবলু টি?
ডবলু টি বুঝিস না? উইদাউট টিকিট।
সূর্যাক্ষ চেহারায় বড়ো হলেও ওর ভেতরে একটা ভয় আছে। অন্যায় করা তার ধাতে সয় না। হয়ত এই কারণে দ্বীপী তাকে ভীরু বলে। তার ধারণায় ভীরু মানুষ পাপ করতে গেলে হাজারবার ভাববে। ভীরুরা নিঠুর হতে পারে না, যার জন্য ওরা সবখানে সমালোচিত। সূর্যাক্ষ ঢোঁক গিলল। বীরু তাকে দেখে বলল, গুরু কি ব্যাপার? কানের পাশ দিয়ে তোর ফার্স্ট ডিভিশনটা বেরিয়ে গেল। তোর বাবা নিশ্চয়ই বহুৎ ঝেড়েছে তোকে।
-মোটেই না। প্রতিবাদ করল সূর্যাক্ষ।
বীরু কেমন মিইয়ে গেল, মাইরি বলছি–আমার বাবাটা না একটা মক্ষিচোষ। কোথায় পড়াবে, তা না ঠেলে পাঠিয়ে দিল লাইন দিতে।
অতনু বলল, আমার মনে হয় মেসোমশাই ঠিক করেছেন। তুই যা মাল, থার্ড ডিভিশনে পাশ করে কোথায় ভর্তি হবি?
-আরে শালা, আর্টসে থার্ড ডিভিশন পাওয়া আর সায়েন্সে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া একই কথা। ভাবিস না একেবারে বেফালতু। আমাদের জন্য বেলডাঙ কলেজের গেট খোলা আছে।
-এই নাম্বারে বেলডাঙাতেও চাল হবে না।
–তুই দেখছি সবজাভা দাড়িওয়ালা! চুপ কর বে। আজ যদি লাগিয়ে দিতে পারি তাহলে কিস্তিমাত। তাহলে আর কষ্ট করে বইয়ের পাতা ওল্টাতে হবে না। তখন ওই থুতু লাগিয়ে টাকা গুনব।
বাস-স্ট্যান্ডের দোকানে চা খেল ওরা। উজ্জ্বল রঙের রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছিল পথের ধুলোয়। মাত্র কয়েক হাত দূরে টেলিফোনের তারে কাক বসে ডাকছিল কা-কা স্বরে। সূর্যাক্ষর মনটা বিষিয়ে উঠছিল সেই ডাক শুনে।