সূর্যাক্ষ চেষ্টা করছিল স্বাভাবিক হতে, কিন্তু পারল না। দ্বীপী কিছু বলার আগে কপোতাক্ষ বললেন, পাশ করেছিস আনন্দ কর। তোরা ইস্কুলের প্রথম সায়েন্সের ব্যাচ। সবাই যে রেজাল্ট করেছে তাতে ইস্কুলের সুনাম হবারই কথা।
যেমনটা আশা করেছিলাম তেমন হল না, বাবা! সূর্যাক্ষর দীর্ঘশ্বাস বিচলিত করল কপোতাক্ষকে। তিনি সুর্যাকে শান্ত করার জন্য বললেন, আমি সেকেন্ড ডিভিশনে প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ। তোর জ্যাঠার খবর তো সব জানিস। এরপরে তোর মন খারাপ করা অন্যায়। যা, টাকা দিচ্ছি দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আয়। দ্বীপী তুই এখানে খেয়ে যাস। তুই আমাদের গ্রামের গর্ব। এই গ্রাম থেকে আগে কেউ ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। আজ তোর বাবা-মায়ের সব চাইতে আনন্দের দিন।
–আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি। মা-বাবাকে খবরটা দিয়ে আবার আসব। দ্বীপী সূর্যাক্ষর দিকে তাকাল, সূর্য, তুইও আমার সঙ্গে চল। আমাদের ঘরে গেলে তোর আর কোনো কষ্ট থাকবে না। মন ভালো হয়ে যাবে।
দ্বীপীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সূর্যাক্ষর মনে পড়ল রঙিন প্রজাপতির কথা।
যে কোনো পাশের একটা শক্তি থাকে।
দেবোত্তর চক্রবর্তী দ্বীপীর পাশ করার সংবাদে খুশি হয়েছেন। চন্দ্রিকা মেয়ের চিবুক হয়ে বলেছেন, আমি জানতাম আমার সোনা মেয়ে কিছু একটা করবেই। তবে তোর এই পাশের পেছনে সূর্যর খুব হাত আছে। ও পাশে না দাঁড়ালে হয়ত এত ভালো রেজাট তোর হত না।
দ্বীপী কৃতজ্ঞতার ঘাড় নাড়ল। সেবোর চক্রবর্তী বললেন, সায়েন্স বইয়ের যা দাম, আমি তো বই কিনে দিতেই পারিনি। বলতে গেলে মেয়েটা সূর্যর বই নিয়ে পড়েছে। সত্যি, সূর্য সাহায্য না করলে দ্বীপী হয়ত পাশ করত, কিন্তু এত ভালো নাম্বার পেত না।
চন্দ্রিকা সমর্থন করলেন এক বাক্যে। দেবোর চক্রবর্তী গত চারদিন হল মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। মেয়েদের পড়িয়ে কি লাভ হবে, সেই তো পরের ঘরে তুলে দিতে হবে। পরমুহর্তে অন্য ভাবনা তাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। না, এসব কথার কোনো অর্থ হয় না এখনকার দিনে। ধীপীকে যে করেই হোক পড়াতে হবে। একটা গাছ বাড়ছে তাকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেওয়া উচিত। তার ডালপালা কেটে দেওয়া ঠিক হবে না।
দেবোক্তর চক্রবর্তী চন্দ্রিকাকে বললেন, দ্বীপীকে কলেজে ভর্তি করাব, এতে তোমার কি মত?
-এতে মতের কি দরকার। দ্বীপী পড়বে। জানি ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। আমার কিছু গয়না আছে, ওগুলো বেচে দাও। সহজ মনে চন্দ্রিকা বললেন।
-গয়না বেচে পড়ালে অন্য মেয়েদের কি দেবে? দেবোত্তর চক্রবর্তী কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, তিনটে মেয়েই তো আমাদের কাছে সমান। সবাই তোমার পেটে জন্মেছে, কেউ তো পিঠে আসেনি।
-হ্যাঁ, ঠিক। তবে… দুর্ভাবনায় কথা আটকে গেল চন্দ্রিকার।
দেবোত্তর চক্রবর্তী আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, দেখি কি করা যায়। তবে কিছু একটা ব্যবস্থা তো হবেই।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে লহরী আর ঊর্মি বাবা-মায়ের আলোচনা শুনছিল। লহরী স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বলল, বাবা, আমাদের জন্য ভেবো না, দ্বীপীকে এগিয়ে যেতে দাও। আমরা কিছু করতে পারিনি। ও বড়ো হলে শুধু তোমাদের মাথা নয়, আমাদের সবার মাথা উঁচু হয়ে যাবে। গ্রামের মানুষ তখন বোনের জন্য আমাদের সমীহ করে চলবে।
-তা যা বলেছিস। দেবোত্তর ভরসা পেলেন। চন্দ্রিকা বললেন, আমি জানতাম তোরা এই কথা বলবি। আমার মেয়েরা যে অন্য ধরনের সেটা লোক জানুক।
সূর্যাক্ষ যাবে ফর্ম আনতে কৃষ্ণনগরে। গর্ভমেন্ট কলেজে ভর্তি হলে পড়ার খরচ একটু কম হবে। উইমেল কলেজটাও খারাপ নয়। শহর থেকে একু দূরে এই আর কি।
দ্বীপীর শরীরটা ভালো ছিল না। সূর্যাক্ষ বলল, তুই থাক। আমি যাচ্ছি। যদি ফর্ম দেয় তাহলে আমিও ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করব। তবে আমার যা নাম্বার তাতে অনার্স পাওয়া যাবে না।
চাকরি খোঁজার সময় দরকার। অতদিন ঘরে বসে থাকা কি ভালো দেখায়। মীনাক্ষী বলেছেন, তোকে পড়তে হবে সূর্য। ঘরে বসে থেকে বাবার মতো পার্টি করবি–এসব আমার সহ্য হবে না।
কপোতাক্ষ চুপচাপ শুনেছেন। ইদানীং মীনাক্ষীর মুখের উপর তিনি কোনো কথা বলছেন না। তাছাড়া মীনাক্ষী যা বলছে–সেটা তো তারও মনের কথা। ঘরের একমাত্র ছেলেটা পড়াশোনা না করে টো-টো করে ঘুরবে, বাউন্ডুলে হয়ে যাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। চাকরি উঠোনে বাঁধা নেই যে যখন খুশি তাকে উঠিয়ে নিয়ে মনের বাসনা চরিতার্থ করা যাবে। চাকরি এক কুহেলিকা, কুয়াশা। তার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন।
কপোল সূর্যাক্ষকে কাছে ডেকে বললেন, আজই কৃষ্ণনগরে গিয়ে ফর্ম তুলে নিয়ে আয়। তোর মায়ের কাছে টাকা রাখা আছে, নিয়ে যাবি।
-তাহলে চাকরি খোঁজার কি হবে?
চাকরি তো মুখের কথা নয়, তার জন্য তপস্যার প্রয়োজন। কপোতাক্ষ বিরক্ত হবেন।
সূর্যাক্ষ সংকোচ না করে বলল, বাবা, তুমি তো কত মানুষকে সুগার মিলে কাজ পাইয়ে দিয়েছ, আমার জন্য একটু বলে দেখ না। ..
-এখন আর তা হয় না সূর্য। তাছাড়া নিজের জন্য আমি কারোর কাছে হাত পাতি নি। যারা চাকরি পেয়েছেন তারা তাদের নিজের যোগ্যতায় পেয়েছেন। সেখানে হয়ত আমার ভূমিকা ছিল সলতে পাকানোর। মান হেসে কপোতা ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন।
-তাহলে তুমি বলছ আমি কৃষ্ণনগরে যাব? সূর্যাক্ষ নিশ্চিত হতে চাইল।