দ্বীপী মেয়ে হয়েও মুগ্ধ চোখে দেখছিল ঐশীর পেখমতোলা রূপ। শুধু সে নয়, বাসের প্রত্যেকেই চোরাচোখে ঐশীকে স্পর্শ করছিল বারবার।
পাল কোম্পানীর এই বাসটা কৃষ্ণনগর যাবে দেবগ্রাম ছুঁয়ে। এ সব নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না দ্বীপীর। সঙ্গে সূর্যাক্ষ থাকলে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে সে বড়ো বেশি মাথা ঘামায় না।
ঐশী এতক্ষণ সূর্যাক্ষকে দেখতে পায়নি, চোখাচোখি হতেই আনন্দে টগবগিয়ে উঠল যে, ওঃ, তুইও এ বাসে আছিস, বাঃ কি মজা। দারুন ভালো লাগছে। কোথায় যাবি রে সূর্য?
বেথুয়া। ফটো তুলতে।
–কি ব্যাপার হঠাৎ ফটোর দরকার পড়ল?
–এমপ্লয়মেন্ট একসচেঞ্জে নাম লেখাতে হবে। পাশ করার পর আমার ইচ্ছে চাকরি করার। সূর্যাক্ষ লাজুক গলায় বলল, ভাবতেই খারাপ লাগছে যে আর কোনোদিন আমার পড়া হবে না।
-হঠাৎ যে চাকরির কথা ভাবলি? ঐশীর গলায় চাপা জিজ্ঞাসা।
সূর্যাক্ষ উদাস হয়ে বলল, না ভেবে উপায় নেই ঐশী।
-আমি তো শুনেছিলাম তোদের অবস্থা গ্রামের মধ্যে ভালো।
–হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তবে সব শোনা কথা কোনো না কোনো সময় আর সত্যি থাকে । সময়ের সাথে সাথে মানুষের অবস্থারও বদল ঘটে। সেই যে বলে না-নামে তালপুকুর, অথচ ঘটি ডোবে না। এর মানে এই নয় যে কথাটা মিথ্যে। আগে হয়ত তালপুকুরে ঘাট ডুবত, এখন হয়ত ডোবে না। সূর্যাক্ষ বেশ ধীরে ধীরে ঐশীকে বুঝিয়ে বলল কথাটা।
ঐশী সমব্যথীর চোখে তাকাল, সব ঠিক হয় যাবে, ওই নিয়ে ভাবিস না। তোর সাথে কি দ্বীপী যাচ্ছে?
-হ্যাঁ, ও আর কার সাথে যাবে? এতদিন তো আমিই ওকে বয়ে বেড়াচ্ছি।
–একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? দ্বীপীর সঙ্গে তোর কি কোনো।
সূর্যাক্ষ হাত নেড়ে থামিয়ে দিল ঐশীকে, যা, ঠিকই অনুমান করেছিস। দ্বীপী আমাদের গ্রামের মেয়ে। আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়।
অপ্রস্তুত ঐশী আশেপাশে তাকাল। উত্তর শুনে লজ্জা পেয়েছে সে। তবু নিচু গলায় বলল, তোদের মেলামেশা দেখে আমি অন্যরকম ভাবছিলাম।
-এটা তোর অন্যায় নয়, সবাই ভাবে।
–তুই খুব ম্যাচিওরড হয়ে গেছিস। ঐশী ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসল।
-হব না, আঠার বছরে পা দিলাম। এখনও ছোট বললে লোকে নাক টিপে দেখবে দুধ বেরচ্ছে কিনা। সূর্যাক্ষ উঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, আমার কথা বাদ দে এবার তোর কথা বল।
-আমার কথা? আমার কথা লম্বা কথা। বাসের মধ্যে বলা যাবে না। সবাই শুনছে। ঐশীর চোখের তারায় খুশির আলো নেচে গেল, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, জানিস, ও এসেছে। এই বাসেই আছে।
–আকাশদা এসেছে? কই? দেখতে পাচ্ছি না তো?
ড্রাইভার কেবিনে বসে আছে। নামলে দেখতে পাবি। ঐশীর সারা শরীরে খুশির ঢেউ। সে তার আবেগ বাঁধ দিতে পারল না কিছুতেই, আমার অসুখের খবর পেয়ে ও এসেছিল। তারপর পনের দিন থেকে ও আবার দিল্লি ফিরে গেল। এবার এসেছে-কোলকাতায় কি একটা কাজ আছে সেই জন্য। এতদূর এসে বাড়ি আসবে না তা কি হয়?
-তা ঠিক। তোরা এখন কোথায় যাচ্ছিস?
ঐশী হাসল, সিনেমায়। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী। দারুণ বই। যা গান আছে না!
-ওঃ! তুই কি এর আগে দেখেছিস?
–হ্যাঁ, মার সাথে একবার এসেছিলাম। আজ আবার ওর সঙ্গে আসতে হল। উপায় নেই।
ঐশী কেমন চোখে তাকাল।
সূর্যাক্ষ দেখল দ্বীপী মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। ফসল শূন্য মাঠে সাদা বক গায়ে থান জড়িয়ে বসে আছে। রোদ নৃত্য করছে তার সামনে। পুকুরের জলে মেঘ ভাসছে, কত রকমের মেঘ। দ্বীপী কি এসবই দেখছে নাকি অন্য কিছু ভাবছে। মেয়েদের কপালের রেখা কুঁচকে গেলে ওদের ভাবনার গভীরে হিংসা ঢুকে পড়ে। তখন আর স্বাভাবিক দেখায় না তাদের।
সূর্যাক্ষ দ্বীপীর ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য ঘাবড়ে গেল। আজকাল পান থেকে চুন খসলে রেগে যায় দ্বীপী। তখন ও যে কি বলে ঠিক থাকে না নিজেরই।
দ্বীপীর মাথা গরম হয়ে গেলে অস্বাভাবিক ব্যবহার করে। তখন ওকে কিছুতেই বোঝানো যায় না।
সূর্যাক্ষ ভয় পেয়ে আস্তে করে মুখ নামিয়ে ডাকল, দ্বীপী।
-এ্যা! চমক ভেঙে দ্বীপী বাসের মধ্যে তাকাল, কিছু বলছিস?
–তোর কি ঘুম পাচ্ছে?
–ধ্যাৎ! দুপুরবেলায় আমি কোনোদিন ঘুমাই না বুঝলি?
–তা ঠিক। তবে অনেকের বাসে বসলে ঘুম পায়। বাসের দুলুনীতে ঘুমপাড়ানী ছন্দ আছে।
–কবিত্ব রাখ তো। দ্বীপী বিরক্তিতে উষ্ণ হয়ে উঠল।
ঐশী মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আমি হয়ত তোদের ডিস্টার্ব করে দিলাম।
-না, তা কেন? দ্বীপী জোর করে বলল, আজ কালের মধ্যে রেজাল্ট বেরবে। এই সময় সব পরীক্ষার্থীই ডিস্টার্ব থাকবে। রেজাল্ট বেরনোর টেনশানটাই আলাদা। বিডিও অফিস পেরিয়ে বাস বেথুয়াডহরীতে ঢুকল। ঐশী ঢিল ফেলা পুকুরের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল, আমি যাই, ও নাহলে খুঁজবে।
ড্রাইভার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। কে বলবে মাস তিনেক আগেও এই মেয়েটা অসুস্থ হয়ে মশারির মধ্যে বন্দী ছিল।
.
৫৮.
সপ্তাহের শেষে রেজাল্ট বেরিয়ে গেল সূর্যাক্ষর। দ্বীপী ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। দুর্ভাগ্য, সূর্যাক্ষ মাত্র দশ নাম্বারের জন্য ফাস্ট ডিভিশন পেল না। মন খারাপ করে দেবগ্রাম থেকে ফিরে এল সে। খবরটা শুনে দ্বীপী নিজের আনন্দ চেপে সূর্যাকে বলল, রেজাল্টই সব কথা নয়, তুই ভালো ছেলে এটা সবাই জানে। মন খারাপ করিস না। তুই গম্ভীর হয়ে গেলে আমার চারপাশ গুমোট হয়ে ওঠে।