–যাব বলেই তো তোর কাছে এলাম। সূর্যাক্ষর কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে নিচু হয়ে এল, শোন, ঘরে সত্যি কথা বলে গেলে হবে না। বলবি দেবগ্রামে যাচ্ছি ফটো তুলতে। রেজাল্টের পর ফর্ম ভরার সময় কাজে লাগবে।
–ভালো যুক্তি। দ্বীপী লাফিয়ে উঠল।
সূর্যাক্ষ ওকে সতর্ক করল, আনন্দে কাসি হারিয়ে ফেলিস নে। যতক্ষণ না যাচ্ছি, ততক্ষণ কোনো বিশ্বাস নেই। যা বললাম-মনে থাকবে তো?
-হ্যাঁ, তাঁ। বেশ মনে থাকবে। তুই কখন আমাকে নিতে আসবি?
–আমি ঠিক এগারটায় আসব। তুই খেয়ে-দেয়ে তৈরি থাকবি। সূর্যাক্ষ চলে গেল।
ঠিক এগারটার সময় সে এসে হাজির হতেই লহরী মুখ গম্ভীর করে বলল, তোরা কি ভেবেছিস বল তো? এখন আবার ফটো তোলার কি হল?
ফটো না হলে কোনো কাজ হবে না, দিদি। এমপ্লয়মেন্ট একসচেঞ্জের কার্ড করাতে গেলেও ফটো লাগবে, আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া-। সূর্যাক্ষ আরও কিছু ফিরিস্তি দিতে যাচ্ছিল লহরী বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
উর্মি পাশে দাঁড়িয়ে বলল, সাবধানে যাবি। যা রোদ। দ্বীপীর তত রোদে বেরলে গলা শুকিয়ে যায়।
-তোমার কোনো চিন্তা নেই, ঊর্মিদি। আমি ওকে লেবু লজেন্স কিনে দেব। লেবু লজেন্স চুষলে গলা ভেজা থাকবে। সূর্যাক্ষ বুঝিয়ে বলল।
চন্দ্রিকার মন ছিল না মেয়েকে এভাবে একা ছাড়ার। ঊর্মিকে তিনি বলেছিলেন সঙ্গে যাওয়ার জন্য। দ্বীপী তা মেনে নেয়নি। মাকে বুঝিয়ে বলেছে, সেজদি গেলে আমাদের সবাইকে হেঁটে যেতে হবে। একটা সাইকেলে তিন জনের হবে না। সূর্য তিনজনকে নিয়ে এই রোদে সাইকেল চালাতে পারবে না। হাঁপিয়ে উঠবে ও।
দ্বীপীকে সমর্থন করল ঊর্মি। তা ছাড়া বোনকে নিয়ে দেবগ্রামে ফটো তুলতে যাওয়ার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্র ছিল না। শুধু শুধু সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে কোনো লাভ হবে না জেনে সে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি যাওয়ার জন্য।
ধুলো ওড়া দুপুরে সাইকেলের সামনের রডে পা ঝুলিয়ে বসেছিল দ্বীপী। সূর্যাক্ষর শরীরের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল সে। এই সুখ আর কদিন তার ভাগ্যে লেখা আছে কে জানে। রেজাল্ট বেরলেই ছিটকে যেতে হবে দুজনকেই। কার ভাগ্যে যে কি লেখা আছে কেউ জানে না। একটা দায়িত্বের ভূত সূর্যাক্ষ বয়ে বেড়াচ্ছে কমাস থেকে। পড়ার সুযোগ না পেলে ঘরে বসে সে কি করবে? চাকরি তো ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে চাইলেই পেয়ে যাবে। চাকরির জন্য পড়াশোনার দরকার। এই সামান্য যোগ্যতায় কোথায় সে পা রাখবে? সাইকেল চালাতে গিয়ে নানান চিন্তায় টনটনিয়ে ওঠে সূর্যাক্ষের কপাল। হঠাৎ সাইকেল থেকে নেমে পড়ল সে। দ্বীপী অবাক চোখে তাকাল, কি হল তোর?
সূর্যাক্ষ সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বলল, কিছু হয়নি। ঘরের কথা মনে পড়তেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল।
-কাকা কেমন আছেন? অনেকদিন তাকে দেখিনি।
–দেখবি কি করে? বাবাকে ডাক্তারবাবু সাইকেল চালাতে নিষেধ করেছেন।
উনি যা মানুষ, এ নিষেধ তার পক্ষে মানা তো খুব কষ্টের হবে।
-কষ্ট হলেও জীবনের জন্য তা মানতে হবে। সূর্যাক্ষ হঠাৎ পণ্ডিত যিলেরর পাড়ে সাইকেল থামিয়ে দ্বীপীর মুখের দিকে উদাস হয়ে তাকাল, জানিস দ্বীপী, আমার মনে হয় আর পড়া হবে না। বাবা বলছিল–আমাদের অবস্থা আগের মতো নেই।
–সে কি রে, তোদের এত জমিজমা বিষয় সম্পত্তি।
–সব জেঠু তার নিজের নামে করে নিয়েছেন।
–এটা কি করে সম্ভব?
-সম্ভব। বাবা যা খামখেয়ালি মানুষ। সংসারের উপর একটুও নজর নেই। মা প্রায়ই রাগারাগি করে। মাকে এখন প্রায়ই কাঁদতে দেখি। এর আগে আমি কোনো দিন মায়ের চোখে জল দেখিনি। কথাগুলো বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল সূর্যা।
দ্বীপী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কোনো কিছুই আর ঠিক হবে না দেখিস। যা হারিয়ে যায়, তা আর চট করে কি পাওয়া যায় রে?
আমি তো আছি, তুই ভাবছিস কেন? ঘোরের মাথায় কথাগুলো দ্বীপ ফসকে বেরিয়ে এল, না, বলছিলাম কি-তোর পাশে আমি সবসময় থাকব।
-সে তো তোকে থাকতেই হবে। প্রকাশ্য দিনের আলোয় জল সাক্ষী রেখে দ্বীপীর হাতটা চেপে ধরল সূর্যা।
দ্বীপী হাতটা সরিয়ে নিল না, সরে এল আরও পাশে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সে বলল, তোকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে আমি জানি না।
–আমি জানি।
–তুই জানিস।
–হ্যাঁ।
–তাহলে বল।
সব কথা বলা যায় না। কিছু কথা আছে যা ঝিনুকের পেটে মুক্তোর মতো লুকিয়ে রাখতে হয়।
-দ্বীপীর গলার স্বর মধুর হয়ে এল, আমারও কিছু কথা আছে–যা সময় এলে বলব।
কালীগঞ্জ বাজারে সাইকেল রেখে ওরা বাস ধরল বেথুয়াডহরী যাওয়ার। বারোটার বাসে ঠাসা ভিড় থাকে। তবু বসার একটা জায়গা পেয়েছে দ্বীপী। সূর্যক্ষ বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখোমুখি। কালীগঞ্জ জায়গাটাকে সূর্যাক্ষের ভালো লাগে, হৈ-চৈ নেই অথচ সব কিছুই হাতের কাছে ছড়িয়ে আছে। এত বড়ো বারোয়ারীতলা আশেপাশে আর কোনো গ্রামে নেই। দোতলা পাকাঘরগুলো তাদের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আজও। বাঁধের ধারে গম পেষা মেসিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ এখনও কানে লেগে আছে সূর্যাক্ষর। অনেকটা রূপকথার মতো মনে হয় তার এই গ্রামটাকে। এই গ্রাম হাতে ধরে টেনে আনছে উন্নয়নকে। এর সংস্কারমুক্ত ভাবনাটা অনুভব করতে পারে সূর্যা।
বাস ব্ৰহ্মাণীতলা ছাড়িয়ে যাবার পর নিজের সিট ছেড়ে দ্বীপীর কাছে উঠে এল ঐশী। ওর সারা গায়ে চিকেন পকসের দাগগুলো জম্মতিলের মতো বিছিয়ে গেছে। ডালডা ঘিয়ের চেয়েও উজ্জ্বল ত্বকে সেই ছিটিয়ে যাওয়া তিলগুলো অন্য একটা সৌন্দর্য এঁকে দিয়েছে। ঐশী ওর টানা চোখের জ্ব কুঞ্চিত করে সাদা শাপলার মতো হাসল, কোথায় যাচ্ছিস, দ্বীপী? আঃ, কত দিন পরে তোর সাথে দেখা হল। ঐশীর গলা কাঁপিয়ে ঝরে পড়ল আন্তরিকতার ঝর্ণা।