শুধু মীনাক্ষী নয়, কপোতাক্ষকে নিয়ে চিন্তায় আহে সূর্যাও। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে সে কৃষ্ণনগর ছুটছে এটা-সেটা টেট করানোর জন্য। দুহাতে টাকা উড়হে তবু ব্যথা কমার কোনো লক্ষণ নেই। সদর হাসপাতালের আরবাবু বললেন, অপারেশন মা। আগামী শুক্রবার আপনারা তৈরি হয়ে আসুন। দুবোতল রাড দরকার হলেও হতে পারে।
অপারেশনের দিন মীনাক্ষীকে হাসপাতালে নিয়ে এল বিদুর আর লাবণী।
সামান্য হলেও ওরাও ঘাবড়ে আছে। কপোতাক্ষর সুস্থ হওয়ায় প্রয়োজন আছে গ্রামের জন্য। এই গ্রামের কথা কেউ ভাবে না, একমাত্র তিনি ছাড়া। গ্রামের নিম্ন বর্গীয় মানুষরা তার চোখের মণি, আরাধ্য দেবতা। এদের অবহেলা করলে নিজেকেই অবহেলা করা হয়।
একমাস পরে গ্রামে ফিরে এলেন কপোতাক্ষবাবু। সুস্থ হয়ে ফিরলেও তাঁকে আরও একমাস বিশ্রাম নিতে হবে। পেটে অপারেশনের কাটা দাগ, দুমাস সাইকেল চালান বারণ। কথা না শুনলে বিপদ ঘটতে পারে যে কোনোসময়।
ঘুরে বেড়ান মানুষ, ঘরে বসে থাকলে ছটফট করে মন। হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি, পুরনো বইয়ের পাতা ঘেঁটে তিনি খুঁজতে থাকেন সাম্যবাদের মন্ত্র।
সুর্যাক্ষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়, বাবা, তোমার কোনো কাজ থাকলে আমাকে বলল, আমি করে দেব।
কপোতাক্ষ হাসেন, আমার কাজটা তোক দিয়ে কি হবে রে? যার কাজ তাকেই করতে হয়, না হলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
–সে আমি জানি। তবু…
–তোর রেজাল্ট কবে বেরবে? ভালোভাবে পাশ করবি তো?
সুর্যাক্ষ মাথা নাড়ল, ভালোভাবে পাশ করলে আমি আরও পড়তে চাই। রুদ্রদার মতো আমারও ইচ্ছে কোলকাতায় গিয়ে পড়ব।
–সবই হত কিন্তু তোর জ্যাঠা আমাকে সর্বশ্রান্ত করে দিয়েছে। এখন যা আছে তাতে সংসারটা কোনোমতে চলছে। কপোতাক্ষ বোঝালেন, যদি কোলকাতায় পড়তে চাস তাহলে আমাকে জমি বিক্রি করতে হবে। আর জমিও তো বেশি নেই, বিক্রি করলে খাব কি?
মনোক্ষুণ্ন হলেও নিরুত্তর থাকল সূর্যাক্ষ। ঘটনাটা সত্যি। নীলাক্ষ তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে নিয়েছেন। তিনি এমনভাবে কায়দা করে ঠকিয়েছেন যাকে বলে পেছন থেকে চাকু মারা।
মন খারাপ হয়ে গেল সূর্যাক্ষর। পাশ করেই তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে চাকরির খোঁজে। চাকরি ছাড়া কোনো গতি নেই। গ্রামে পড়ে থাকলে হাঁড়ি ঠনঠনাবে। মায়ের দুঃখী মুখ সে দেখতে পারবে না। প্রাচুর্যের মধ্যে যাদের দিন কেটে গেছে হঠাৎ অভাবের ঝড় তাদের টলিয়ে দিলেও আভিজাত্যের রং চটে না। সূর্যাক্ষ চেষ্টা করবে আগের সেই সোনালী দিন ফিরিয়ে আনার। ধুলা মাখা গ্রামের মায়া ভুলে সে পাড়ি দিতে চায় শহরে। কষ্ট হবে, তবু কষ্টের মধ্যে থেকে সে খুঁজে নিতে চায় জীবনের রসদ।
.
৫৭.
গরমে আইঢাই করছিল চারপাশ। আগুন হাওয়া ধুলো উঠিয়ে নেয় শুনে, তারপর সেই লাটখাওয়া ধুলোকে আছড়ে ফেলে দেয় নির্জন কোন প্রান্তরে। গোল চরকাটা এই ধুলোকে অনেকে বলে ভূতঘূর্ণি। ছোট বেলায় ভূত ঘুরছে বলে ভয় পেত সূর্যা। এখন আর সেই অবাস্তব ভয় মনের কোণে বিন্দুমাত্রও নেই।
এখন প্রায় রাতেই সূর্যাক্ষ স্বপ্ন দেখছে পরীক্ষার। কখনও ভয়ের কখনও বা আনন্দের সেই সব স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। দ্বীপীর কাছে গেলে পরীক্ষার চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা ওদের গ্রাস করে না। প্রায়ই দ্বীপী মুখ শুকনো করে বলে, আর ভালো লাগছে না রে, বড়ো হাঁপিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে কোথাও ঘুরতে গেলে মনের এই গুমোটটা কাটত।
দ্বীপী ঘরে বসে থাকলেও সকালে-বিকালে টিউশনি করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সে নিয়ম করে পড়তে বসায়। দেবোত্তর বলেছেন, কাজের মধ্যে থাক, মন ভালো থাকবে।
মন ভালো না থাকলেও সময়টা দিব্যি কেটে যায়। গ্রামের টিউশনিতে পয়সা খুব কম। তবু যেটুকু উপার্জন হয় সেটুকুই এই অভাবের সংসারে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।
প্রথম মাসের টাকাটা দ্বীপী বাবার হাতে তুলে দিতে চাইলে দেবোত্তর স্মিত হেসে বলেন, মেয়ের উপার্জনের পয়সা আমি হাতে নেব না। তোর টাকা তুই সযত্নে শুছিয়ে রাখ। শুনছি–আর কদিনের মধ্যেই তোদের রেজাল্ট বেরবে, তখন টাকাগুলো তোর ভর্তির কাজে লাগবে।
সূর্যাক্ষ এলে দ্বীপীর মনে এক ঝাঁক টাটকা বাতাস হুটোপুটি লাগিয়ে দেয়। তার গুছিয়ে রাখা রক্ষণশীল মনটা এলোমেলো হতে শুরু করে। ভালোলাগার স্নায়ুগুলো অদ্ভুত দক্ষতায় দ্বীপীর সরল সুন্দর মুখে আনন্দের ঢেউ বইয়ে দেয়।
সূর্যাক্ষ পরীক্ষার কথা ভুলে দ্বীপীকে সম্মোহনী গলায় বলে, আমি শুনেছি, বেথুয়াডহরীতে ববি বই দিয়েছে। যাবি দ্বীপী?
শিবানী টকিজে সিনেমা দেখার মজাটাই আলাদা। দ্বীপী মাত্র দুবার সিনেমা দেখেছে ওখানে। আর প্রতিবারই দিদিদের সঙ্গে। আগে দল বেঁধে মেয়েরা মাসের কোনো এক রবিবারে সিনেমায় যেত ঘটা করে। তার প্রস্তুতি চলত একমাস আগে থেকে। যে যার জমানো পয়সা নিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে যেত সিনেমায়। পড়ুয়াদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দ্বীপীর তাই যাওয়া হত । মায়ের মন না ভিজলে অনুমতি পাওয়া যাবে না। এ কাজে মাত্র দুবার সক্ষম হয়েছে সে।
সূর্যাক্ষর প্রস্তাবটা অন্তর দিয়ে লুফে নিল দ্বীপী। মনে হল তীব্র খরায় এ যেন হঠাৎ মুষল ধারায় বৃষ্টি। দ্বীপী তার আগ্রহ বশে রাখতে পারল না, ফুটন্ত দুধের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল তার মন, হ্যাঁ রে সূর্য, কখন যাবি? খুব ভালো হয়। চল না রে–