–আমি সবার মতো নই, আমি আলাদা। সূর্যাক্ষ জোর দিয়ে বলল।
রঘুনাথ বিষণ্ণ চোখে তাকাল, দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি হয়।
ফিরে আসার সময় সূর্যাক্ষ লিসা করল, আমাদের বাড়িতে কবে আসবি রঘু?
-যাব না রে, তোর মায়ের সামনে কুন মুখ নিয়ে যাব, বল?
–মা সব ভুলে গিয়েছে।
–এসব কথা কেউ কোনোদিন ভোলে না। ভালো কথা সবাই ভুলে যায়। রঘুনাথের গলার স্বর আর্দ্র হয়ে উঠল। মন খারাপের মোড়ক কেটে বেরিয়ে এল সে।
দ্বীপীদের বাড়িতে সূর্যাক্ষর জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময়। বড়ো মেয়েকে দেখতে এসে হীলীকে পছন্দ করে গেল পাত্রপক্ষ। লহরী সেই যে ঘরে ঢুকেছে লজায় আর বেরচ্ছে না।
নিজেকে অপরাধী ভেবে দ্বীপীও বসে আছে মুখ গোমড়া করে। সূর্যাকে দেখে অভিমানে ভেঙে পড়ল সে, তোর এখন সময় হল আসার? এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?
-ধাওড়াপাড়া থেকে ফিরে যেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
–বাঃ, বেশ ভালো। দ্বীপী কথা দিয়ে খোঁচা মারল, এই না হলে ঘরের ছেলে।
–ভুল হয়ে গিয়েছে, প্লিজ আর কিছু বলিস না।
দ্বীপী ঠোঁট শক্ত করে বলল, তুই যদি থাকতিস হয়ত এমনটা হত না।
-যা হবার তা হয়েছে, ভেবে আর কি হবে বল?
–ভাবছি না, তবু ভাবনাটা জোর করে এসে যাচ্ছে। দ্বীপী বড়ো অসহায়, তার চোখ দুটো দুখ আর আক্ষেপে ভরে আছে।
সূর্যাক বলল, তোর কি মত?
–আমি এখনও কিছু ভাবিনি। তবে আগে আমি চাকরি করব তারপর অন্য কিছু।
গ্রামের মেয়েরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই খোকটা তোর মধ্যেও আছে। সূর্যাক্ষ ম হাসল।
দ্বীপী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে সবাই পারে। তুই খুব সাধারণ। আমি ভাবতাম তুই বুঝি বৃত্তের বাইরে।
-তোর কথাটা ঠিক বুঝলাম না? কি বলতে চাইছিস?
–তোকে আর কিছু বলার নেই। দ্বীপী দীর্ঘশ্বাস ভাসাল, তুই জলে নামবি অথচ চুল ভেজাবি–এই তো?
তার মানে?
–মানেটা বুঝে নে। দ্বীপী অবাক চোখে চেয়ে রইল, আচ্ছা সূর্য, তুই কাউকে ভালোবাসিস?
হ্যাঁ ভালোবাসি।
–কি নাম তার?
–তোকে কেন সব কথা বলব? সময় আসলে সব জানতে পারবি।
আশাহত দ্বীপীর চোখে মেঘ এসে জড়ো হল। কাঁদতে পারল না, বুকে চেপে রইল কান্না, তুই এখন যা। আমাকে একা থাকতে দে।
একা থাকলে কী আরও বাড়বে।
–আমার সব সহ্য করার ক্ষমতা আছে। জোর দিয়ে বলতে গিয়ে গলা ব্যানবেনিয় উঠল পীর। চোখেমুখে হাত চেপে সে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
বহু সাধ্য সাধনার পর দরজা খুলল লহরী। সে দ্বীপীকে খুঁজছিল। না দেখতে পেয়ে রাগে-ঈর্ষায় জ্বলে উঠল তার চোখ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মা, ওকে ডাকো। ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।
মুখ ঝুঁকিয়ে ঘরে ঢুকল দ্বীপী, ভয়ে তার বুক হাপর টানহে, সবার সামনে এসে বোবার চোখে তাকাল। তাকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠল লহরী, ওই সময় তোর না গেলে কি চলত না হওয়া কাজটা তোর জন্য সব ভেস্তে গেল।
দ্বীপী ভেবেছিল সে কিছু বলবে না, শুধু চুপচাপ শুনে যাবে, কিন্তু অসহ্য লাগতেই মৃদু স্বরে বলল, মা আমাকে বলল, যা সন্দেশগুলো দিয়ে আয়, আমি তাই ঢুকেছিলাম। যদি দোষ হয়ে থাকে তুই আমাকে ক্ষমা করে দে দিদি।
-ক্ষমা? কিসের ক্ষমা। তুই কোনো দোষই করিসনি। সব বুঝতে পেরে লহরী কামার মতো করে বলল কথাগুলো, ভালোই হয়েছে অমন সম্বন্ধ না হয়ে। ওরা তো রূপের পূজারী, মেয়েদের দুঃখ বুঝবে কি করে? যারা হৃদয়হীন হয় তাদের তো পাথরের সঙ্গে আত্মীয়তা করা উচিত। দ্বীপী, তুই এবার যা সূর্য এসেছে। ওর সাথে কথা বল।
বুকের ভার লাঘব হতেই দ্বীপী আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখ ক্রমে ভরে যাচ্ছিল জলে। তার দুঃখটা যে কোথায় তা যদি সে সূর্যাকে বুঝিয়ে বলতে পারত।
রামনগর থেকে ফিরে এসে চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন কপোতাক্ষ। জানলা দিয়ে হাওয়া কহিল তবু কলকল করে ঘেমে যাচ্ছিলেন তিনি। মীনাক্ষী কাসার মাসে জল এনে তার সামনে দাঁড়ালেন, কী গো, এত ঘামছে যে।
-পেটটা পাকমোড়া দিয়ে উঠছে, প্রচণ্ড ব্যথা।
–এত সাইকেল চালালে ব্যথা তো হবেই। রামনগর তো কম রাস্তা নয়। মীনাক্ষী বুঝিয়ে বললেন, শরীর খারাপ যখন কদিন বিশ্রাম নিতে পারতে।
-বিশ্রামের কথা এখন ভাবলে অন্যায় হবে।
শরীর পারছে না তবু তুমি দৌড়াবে।
–আমার উপর যে সম্মেলনের সব কিছু নির্ভর করছে। আমি বিছানা নিয়ে নিলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। কপোতাক্ষ বুঝিয়ে বললেন, বাইরের জেলা থেকে অন্তত একশ জন ডেলিগেটস আসবে। তাদের খাওয়া-থাকার সব কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে আমাদের লোকাল কমিটির বদনাম হবে। জান তো এখনও সব কালেকশন করে উঠতে পারিনি।
পার্টি নিয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন মীনাক্ষী। এই পার্টি তাঁর এখন সতীনতুল্য। ঘরের খেয়ে মানুষটা বনের মোষ তাড়াক-এটা তার পছন্দ নয়। পাটির নেশা না তাড়ালে ঘরে আর শান্তি ফেরার কোনো আশা নেই।
পেটের ব্যথায় মাঝে মাঝে কাবু হয়ে যান কপোতাক্ষ। কালীগঞ্জের বড়ো ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বললেন, বেটার আপনি একবার সদরে গিয়ে দেখিয়ে নিন। পেট বলে কথা। অবহেলা করবেন না, প্লিজ।
সদরের ডাক্তার পাঁচরকমের পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই তবে একটা অপারেশন করতে হবে। আপনার মাস খানিকের বিশ্রাম প্রয়োজন। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে।