-আমি একদিন আগে কি হবে তাই জানি না। অত বছর পরের কথা বলব কি করে? আমার লক্ষ্য কি জানিস? আমার হাতের মুঠায় যে দিনটা আছে সেই দিনটাকে শুধু উপভোেগ করা, চিনে রাখা।
হলদিপোঁতা ধাওড়ার চেহারাটা মাঠ কুড়োনীর চুলের চেয়ে এলোমেলো। খড় পচে যাওয়া ঘরগুলোয় কত শান্তি আদৌ তা বোঝা যায় না। পাকুড় তলায় গোল্লাছুট খেলছিল ছেলে-মেয়েরা। সূর্যাকে সাইকেল থেকে নামতে দেখে ওরা খেলা থামিয়ে তাকাল।
টগরী সাহস করে এগিয়ে এসে বলল, তুমি রঘুদাকে খুচ্ছো তাই না? রঘুদা ঘরে আচে-যাও। একটু আগে পাকুড়তলা থেকে সে ঘরে গেল।
পুরো পাড়াটায় মাকড়সার জালের মতো অভাব তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। ভাঙা বেড়াটা সারিয়ে নেবার ক্ষমতা বুঝি রঘুনাথের ছিল না। ঘরে বসে সে ভাবছিল-সামনের দিনগুলো চলবে কি ভাবে? আখ কাটার পর ফাঁকা মাঠে এখন কোনো কাজ নেই। ট্রাক্টর দিয়ে লাঙলের কাজটা সারছে মালিকরা। এক কোপে অনেকগুলো রোজ বরবাদ হয়েছে মানুষের। দুলাল গালে হাত দিয়ে বলছিল, আর বাঁচা যাবে না। গাঁয়ে থাকা তো ভাগ্যে হল না, এবার ভাবছি শহরে পেলিয়ে যাব।
এই আক্ষেপ নিয়ে বছরের পর বছর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। রঘুনাথ নিজের ভবিষ্যৎ-এর কথা ভাবতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিল। দুর্গামণি ইদানীং খুব কম কথা বলছে তার সঙ্গে। গুয়ারাম গত হবার পর থেকে মনটা তার ভালো নেই। সে একটা দম দেওয়া পুতুলের মতো হয়ে গেছে। হাসি শুষে নিয়েছে শোক। জীবনে কোনো ছন্দ নেই। বেঁচে থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।
রঘুনাথ এক কাপ চায়ের জন্য উশখুশ করছিল, বাবু-ভদ্রলোকের নেশাটা তার ভেতরেও শেকড় চারিয়েছে। চায়ের কথা বলতেই দুর্গামণি ফুঁসে উঠল না কিন্তু এমন ভাবে তাকাল যাতে অবজ্ঞা ফুটে উঠল চৈত্রের রোদ্দুর হয়ে। রঘুনাথ অবাক করা চোখে তাকাল মায়ের দিকে। দুর্গামণি বিতৃষ্ণার মুখ তুলে বলল, ঘরে চা-পাতাও নেই। গুঁড়া দুধও নেই। চিনি ছিল, তা-ও শেষ। চা-কি হাত-পা সিজিয়ে বানিয়ে দেব?
এমন কথা বলা দুর্গামণির উচিত নয়, সামান্য এক কাপ চায়ের জন্য এত কথা? রঘুনাথ সব বুঝতে পেরেও চুপ করে রইল।
দুর্গামণি কি ভেবে বলল, চা খেতে যখন মন হয়েছে, করে দিচ্চি। যাই, বারির কাছ থিকে চা-পাতা উধার লিয়ে আসি।
ঘর থেকে বেরতেই সূর্যাকে দেখতে পেল দুর্গামণি। অমনি পুরনো রাগটা হোবল মারল মাথার ভেতর। মুখে কড়া শব্দ এসে জড়ো হল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। কোনো কথা না বলে আগড় খুলে বেরিয়ে গেল দুর্গামণি।
সূর্যাক্ষকে এ সময় দেখতে পাবে স্বপ্নেও আশা করেনি রঘুনাথ। উঠে দাঁড়িয়ে সে তাকে ডাকল, আয়, ভেতরে আয়।
বাইরে রোদ ফুটেছে কড়া ধাতের। হাওয়া থাকলেও তার জোর নেই একফোঁটা। ওমোট হয়ে আছে চারপাশ। এ সময় বাঁধের উপর ধুলো ওড়ে। শুষ্ক দেখায় মাঠঘাট। এমন কী গাছের পাতায় সবুজভাবটা ফিকে হতে থাকে। পণ্ডিতবিলে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়।
সূর্যাক্ষর প্রথম কথাটা অভিমানের স্তর ছুঁয়ে এল, হ্যাঁ রে রঘু, তুই একবার দেবগ্রামে যাওয়ার সময়ও পেলি না। আমি ভাবছিলাম আর কেউ না আসুক অন্তত রঘু আসবে।
রঘুনাথ আফসোসের সঙ্গে বলল, যেতে তো মন চেয়েছিল কিন্তু যাই কি করে বল তো? হাত বেবাক খালি। পায়ে হেঁটে গেলেও এই খরানীতে তোকে এট্টা ডাবও কিনে দিতে পারতাম নি।
–তাতে কি হয়েছে, তুই যেতে পারতিস।
–খালি হাতে যেতে মন টানল না। রঘুনাথ শুকনো মুখে বলল, বড়ো টানাটানি চলচে রে! কবে যে এ অভাব ঘুচবে মা শীতলাবুড়িই জানে।
সূর্যাক্ষ সব শুনল মন দিয়ে, তার মুখে কোনো ভাষা নেই। সাহেব মাঠে পুরো দমে কাজ শুরু না হলে ধাওড়া পাড়ায় কাবোর মুখে হাসি ফুটবে না। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে অভাব ইকরাবে।
চা খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। একটা চারা জামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রঘুনাথ জিজ্ঞেস করল, হারে দ্বীপী কেমন আছে রে?
দ্বীপীর প্রসঙ্গ উঠতেই চমকে উঠল সূর্যাক্ষ। আজ লহরীকে দেখতে বেলডাঙা থেকে পাত্রপক্ষের লোক আসবে। দ্বীপী বলেছিল, আজ তাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতে।
বেমালুম ভুলে গিয়েছে সূর্যাক্ষ। কাকা-কাকিমা কি ভাববেন? দ্বীপীই বা কি ভাববে? এত দূর এসে ফিরে যাওয়া পোষায় না। সূর্যাক্ষ নিজেকে চাপমুক্ত করে বলল, কুশল মাস্টারের সঙ্গে তোর কি আর দেখা হয়েছে?
কথা শেষ হল না, রঘুনাথ মন খারাপ করা গলায় বলল, মাস্টরকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
তার মানে? সূর্যাক্ষর ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল।
রঘুনাথ সংক্রামিত হল না, ঠাণ্ডাভাবেই বলল, কেসনগরের পুলিশ তাকে ধরেচে। মারধোর করেছে শুনেছি। কিন্তু গিয়ে যে দেখে আসব তেমন সুযোগ আর হয়নি।
-মনে হচ্ছে এভাবেই সরকার আন্দোলনটাকে শেষ করে দেবে? বিড়বিড়িয়ে উঠল সূর্যাক্ষ। রঘুনাথ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, কি রে কী হল তোর?
-না, কিছু না। অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। সূর্যাক্ষ প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল, জানিস রঘু, রেজাল্ট বেরলে আমি আর গ্রামে থাকব না। হয় কোলকাতা, না হয় বহরমপুর চলে যাব।
-ভালো কথা। রঘুনাথের মন খারাপ হয়ে গেল, তখন তোর সাথে আর দেখা হবে না।
মাঝে মাঝে আসব, তখন দেখা হবে।
এরকম অনেকেই বলে, পরে ভুলে যায়।