নীলাক্ষবাবুর বাড়িতে যে ডাকাতিটা হল তাতে সবাই ধরে নিয়েছে এর পেছনে রঘুনাথের হাত কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। গুয়ারামের মারের বদলা সে না নিয়ে ছাড়বে না। এটা হল সেই বদলা। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকায় থানা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
সেই থেকে বুক ফুলিয়ে বাঁধের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে রঘুনাথ। তার মনে থানা পুলিশ নিয়ে আর কোনো ভয় ডর নেই। সৎপথে থাকলে আবার ভয় কিসের?
সূর্যাক্ষ সাইকেলটা নিয়ে গেটের বাইরে আসতে গেলেই মীনাক্ষী গলা উঁচিয়ে বললেন, রোদে রোদে এখন আবার যাচ্ছিস কোথায়?
কি উত্তর দেবে সূর্যাক্ষ এক মূহুর্ত ভেবে নিল। রঘুনাথের গ্রামে যাচ্ছি এটা বলা উচিত হবে না। রঘুনাথের নামটায় মীনাক্ষীর গায়ে আমবাত বেরিয়ে যাবে–এসব ভেবে সূর্যাক্ষ বলল, গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসি মা। ওদিকটায় অনেকদিন যাওয়া হয়নি।
-নৌকায় যেন চাপবি না। মীনাক্ষী সতর্ক করলেন, বল্লভপাড়ার ঘাটে ফেরি উল্টে গিয়ে তেরোজন মারা গিয়েছে–শুনেছিস নিশ্চয়ই। এখনও অনেকের দেহ পাওয়া যায়নি।
-যারা ডুবে গিয়েছে তারা সাঁতার জানত না।
–সাঁতার জানলেও জলের কাছে কোনো বিদ্যে খাটে না। মীনাক্ষী অসন্তুষ্ট হলেন। যাচ্ছিস যখন যা। তবে দুপুরের আগে চলে আসবি। আমি ভাত নিয়ে বসে থাকতে পারব না।
ঘাড় নেড়ে সাইকেলে চাপতে গেলে মীনাক্ষী গেটের সামনে এসে বললেন, ফেরার পথে তোর জ্যাঠাকে দেখে আসবি। কাল কমল এসে বলছিল ওঁর শরীরটা ভালো নেই। ডাকাতরা যেভাবে ওকে মেরেছে ওভাবে কেউ গোরু-ছাগলকে মারে না।
সূর্যাক্ষর ঠোঁটের কাছে একটা মোক্ষম উত্তর চুলবুল করছিল, কিন্তু সে চেপে গেল। তার জ্যাঠামশাই গুয়ারামের অকাল প্রয়াণের কারণ এটা সে ভালোভাবে জানে। কেউ যদি কারোর মৃত্যুর কারণ হয় তাহলে তাকে সে কারণের জন্য উপযুক্ত খাজনা দিয়ে যেতে হয়। এই জীবনের পাপ অন্য জীবনে পরিশোধ হবে এখন আর তেমন হিসাব খাটে না।
সাইকেল নিয়ে সোজা বাঁধের উপর উঠে এল সুর্যাক্ষা বাঁধের উপর দাঁড়ালে পুরো আকাশটাকে মনে হয় কত আপন! নীল রঙটা তার খুব পছন্দ। দ্বীপীর মন ভালো থাকলে গালে টোল ফেলে সে বলে, তুই নীল রঙের জামা পরলে তোকে মনে হয় ফুলে বোঝাই অপরাজিতা লতা। এক একটা রঙ, এক এক জনকে দারুণ মানায়।
কি তাকে মানায়–এসব নিয়ে ভাবে নি সে। তবে দ্বীপীর কথাগুলো তার শুনতে ভালো লাগে। দ্বীপী তাকে কালীগঞ্জ বাজার থেকে একটা নীল রঙের রুমাল কিনে দিয়েছে। সেই রুমালটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে সূর্যা। কলকাতায় পড়তে গেলে রুমালটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
রোদ মাথায় নিয়ে গাধারের ঝাউগাছগুলো যেন হাতের ইশারা করে ডাকছে সূর্যক্ষকে। সূর্যাক্ষ আপন মনে হেসে উঠল। সাহেব মাঠে আখ কাটা শেষ। মাঠ এখন ফাঁকা। আলসে পুড়িয়ে দেবার পর পড়ে আছে কালো কালো ছাইয়ের পাহাড়। গা-পালানো হাওয়া এলে সেই ছাই হয়ে যায় এক একটা রাগী ক্রোধী ভোমরা। মাথা সমান উঁচুতে উঠে তারা হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকে, তারপর শূন্যে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
এই বাঁধের উপর সূর্যাক্ষর মায়াটা যত দিন যাচ্ছে তত যেন ঘনীভূত হচ্ছে। এই গ্রাম, এই বাঁধ এই চেনা পরিবেশ ছেড়ে সে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। পরীক্ষা দিতে গিয়ে মাত্র পনের দিনে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। দুচোখ যেন খুঁজত কাউকে। কাকে খুঁজত সেটা টের পেল ফিরে আসার দিন। বাঁধে বাঁধে ফেরার সময় কত হালকাবোধ হচ্ছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল যেন নিজের চেনা বিছানায় শোওয়ার জন্য এই উন্মুক্ত প্রকৃতি সব রকম ব্যবস্থা করে রেখেছে–যা দেবগ্রামে ছিল না। তাহলেও নির্জন ছাদে বসে ঘন অন্ধকারে দ্বীপীর সঙ্গে রকেটবাস দেখার অভিজ্ঞতার কথা তার দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
প্রথম রাতে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় রাত্রে সফল হয়েছিল তারা। লম্বা বাসটার মাথায় সাইরেন আর সার্চ লাইট। তার গতি পখীরাজ ঘোড়ার মতো। রাতের স্তব্ধতাকে খানখান করে বাসটা, ছুটে যাচ্ছিল শিলিগুড়ির দিকে। বাসটা চলে যাওয়ার পর একরাশ শূন্যতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের দুজনের মাঝখানে। দ্বীপী মন খারাপ করা গলায় বলেছিল, বাসটাকে দেখতে না পেলে বুঝি ভাল হত।
-কেন?
–জমিয়ে রাখা আগ্রহটা গলে জল হয়ে গেল।
-মানছি। তবে কৌতূহল শেষ হলে নতুন কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। আর এই প্রসেসটা না থাকলে পৃথিবী একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যেত।
-সূর্য, একটা কথা বলব। রাগ করবি না। ধণী গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, পণ্ডিত বিলেরতলায় কি আমরা জানি না। জেনে গেলে কি ভালো লাগবে বল? তেমনি আমরা দুজন যদি দুজনকে জেনে যাই তখন ভাললাগাটা কি আগের মতো কাজ করবে? তোর কি মনে হয়?
মানুষকে জানা-চেনা এক জীবনেও সম্ভব নয়। আমার মা বলে–মানুষ সমুদ্রের চেয়েও বিশাল। পৃথিবীর সব চাইতে মজার আর কঠিন পাঠ মানুষকে পাঠ করা। সূর্যাক্ষ পূর্ণতার হাসি হাসল, তাই বলছিলাম কি প্রতি মুহূর্তে মানুষ নিজেকে সবদিক থেকে বদলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। রোদ্দুরের ভাষা যেমন বোঝা যায় না, তেমনি মনুষ্য চরিত্রও অবোধ্য।
হুম। দ্বীপী খাস ছেড়ে বলেছিল, শেষ পর্যন্ত তুই কি গোরাসাধুর মতন আধ্যাত্মিক লাইনে চলে যাবি?