অষ্টমী এসব দেখে হাউ হাউ কান্নায় আলগা করে দিল নিজেকে। বুকের কাপড় সরে গেল তার অসাবধানে। চুল আছাড় দিয়ে পড়ল মুখের উপর। এই অবস্থায় কোনোমতে টলতে টলতে সে ছুটে গেল ঘরের দিকে। হাতপাখা আর এক জগ জল নিয়ে ফিরে এল সে দ্রুত। এখন আর শব্দ নেই, শুধু চোখ বেয়ে অনর্গল ধারা নামছিল অষ্টমীর, মা বুড়োমা, মাগো মা, একি করলে? কাঁপতে কাঁপতে নিজের তর্জনী জোর করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল লিটনের মুখের ভেতর। বহু কষ্টে বের করে আনল লালা থুতু আর কফ মিশ্রিত হরলিকস।
সূর্যাক্ষ ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিছুটা আন্দাজ করে সে বলল, মনে হয় শাসনালীতে হরলিকস আটকে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে খেতে গেলে অনেকসময় এমন বিপদ হয়।
কথা বলো না গো, ছেলের কিছু হলে আমি যে শেষ হয়ে যাব। সুর করে ডুকরে উঠলঅষ্টমী। মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দলা পাকানো হরলিকসগুলো বহু কষ্টে বের করে আনল অষ্টমী। তার কপালে ফুটে উঠল বোদের মতো বিন্দু বিন্দু ঘামের দলা। প্রায় আধ ঘন্টা পরে অষ্টমী আর দ্বীপীর যৌথ প্রচেষ্টায় লিটনের গলার ঘড়ঘড়ানী আওয়াজটা বন্ধ হল। তখনও উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না তার।
অষ্টমী তাকে চায়ের চামচে জল খাওয়াল। দ্বীপী তার বুক ডলে দিতে দিতে একসময় জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন মনে হচ্ছে তোর?
ভ্যালভেলিয়ে চারপাশে দৃষ্টি যোরাল লিটন, আস্তে আস্তে বলল, আগের চেয়ে একটু ভালো। আমার হাতটা ধর তো, উঠে বসি। পিঠে বড়ো ঠাণ্ডা লাগছে। অষ্টমী বুক হালকা করে শ্বাস ছেড়ে লিটনের মুখের দিকে তাকাল, হরলিকস খেতে মন চায় তো আমাকে বললি না কেন? আমি বানিয়ে দিতাম।
-ওটা তো সূর্যর হরলিকস। লিটন অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, বাবাকে বলেছিলাম একটা কিনে দিতে। বাবা পয়সার অভাবে পারেনি। অথচ গুঁড়ো হরলিকস খেতে আমার খুব ভালো লাগে।
-ভালো জিনিস তো খেতে ভালো লাগে, তা বলে এই ভাবে? অষ্টমী ধীরে ধীরে তেতে উঠছিল, বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে সে এবার ছেলেকে শিক্ষা দেবার জন্য ব্যস্ত, শেষপর্যন্ত তুই খাওয়ার জন্য চুরি করলি? ছিঃ। তোর বাবা কত কষ্ট করে তোকে পড়াচ্ছে। তার মূল্য তুই এভাবে দিলি?
অষ্টমী যা বলছে তা সত্যি। তবু কথাগুলো কানে লাগছে দ্বীপীর। সে চাপা গলায় সতর্ক করল অষ্টমীকে, আঃ মাসী ছাড়ো তো এসব কথা। এখন এসব কথা বলে কোনো লাভ হবে কি?
-লাভ-ক্ষতির কথা নয়, চুরি করে খেতে গিয়ে ওর যদি কিছু হয়ে যেত? কষ্টে চোখবন্ধ হয়ে এল অষ্টমীর। মনের দুঃখে কেঁদে ফেলল সে।
লিটন মেঝেতে দুহাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বুকের কাছে ব্যথাটা পুরোপুরি মেলায়নি এখনও। গলাটাও চিরে আছে, সেখানেও ব্যথা।
নীরবে লিটন হেঁটে গেল ঘরের কাছে। হাত উঠিয়ে ডাকল, এই সূর্য, শোন।
–শোনার কিছু নেই। তুই একটু রেস্ট নে।
দ্বীপী সমর্থন করল, সূর্য ঠিকই বলেছে। আর কথা বলিস না তুই। বিছানা পেতে শুয়ে পড় তো।
আমি ঠিক হয়ে গিয়েচি, আর ভয় নেই। লিটন জোর করে বলল, সূর্য, তোর কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম।
বন্ধুর কাছে ঋণী হলে কিছু যায় আসে না। সূর্য হাসল। লিটন হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলল ঝরঝরিয়ে। লিটনের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সূর্য। এমন দৃশ্যে দ্বীপী খুঁজে পেল তার হারানো মাটি।
.
ফেরার দিন কালীগঞ্জের বাসটা ভরে গিয়েছে যাত্রীতে। কেমন যেন মন খারাপ করছিল স্যার। কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটল ওদের। শেষের দিন অমলকান্তিবাবু এসেছিলেন। তাঁর কেসটা মিটে গিয়েছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ফিরে এসেছেন তিনি। শিবনাথবাবু এখন লজ্জায় আর তার দিকে তাকাল না।
অমলকান্তিবাবু সূর্যাক্ষদের পরীক্ষার পরে ডাকলেন, বেশ আবেগঝরা গলায় বললেন, এবার থেকে তোমাদের আলাদা জীবন শুরু হবে। স্কুলের গণ্ডি আজ তোমাদের শেষ হল।
সূর্যাক্ষ ভাবছিল অন্যকথা। সব কি শেষ হয়ে যায় নাকি শেষ হয়ে শুরু হয় আবার।
বাসটা ছেড়ে দিতেই ধুলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলার উপর। দেবগ্রাম ছাড়িয়ে বাস ছুটছিল হাটগাহার দিকে। দুপাশে ছড়ানো মাঠ। মাঠ ভরে আছে আখের পাতায়। আলসের ভেতর হাওয়া ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়। হাওয়া মানে মুঠো মুঠো অক্সিজেন।
দূর মাঠে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শুকনো পাতায়। পড়পড় করে পুড়ছে পুরনো হাল বাকল। এখন আর পাতা নয় শুধু দেখা যাচ্ছে আগুন আর আগুনের শিখা।
আগুনের আরাধনায় মানুষ হয়ে উঠবে আগুনের পদ, অবশেষে পদাবলি। যাত্রাপথের শুরুতেই সূর্যাগ টের পায় মাটি তেতে ওঠার আগেই বৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন।
১২. আগুনের পদাবলি
৫৬.
কাঠটগর গাছের পাতাগুলো আলকেউটে সাপের ফণার চেয়েও চওড়া। এই গাছটার কাছে দাঁড়ালে সুর্যার মনে হয় প্রখর রৌদ্র দিনেও ছাতার কোনো প্রয়োজন হবে না। এর মোটা পাতাগুলোর শিরা-উপশিরা দেখা যায় স্পষ্ট। ঈষৎ কালচে সবুজে মেশান পাতাগুলো বুঝি রঘুনাথের গায়ের রঙকে মনে করিয়ে দেয়।
রঘুনাথের কথা মনে পড়তেই সাক্ষর মনের ভেতরে কেমন একটা অপরাধবোধ জেগে উঠল। পরীক্ষার ব্যস্ততায় রঘুনাথের সঙ্গে অনেকদিন তার যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। মীনাক্ষীও চান না তার ছেলে বখাটে হয়ে যাওয়া ধাওড়াপাড়ার ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। রঘুনাথকে তিনি ভেবেছিলেন নিষ্পাপ সরল সাধাসিধে একজন ছোকরা। ধীরে ধীরে তার সব গুণ প্রকাশ হল। গ্রামে থাকলে সব কথা কানে আসে তার। আর আসবেই না কেন? রঘুনাথ যে এখানে দুচারবার রাত্রিবাস করে গিয়েছে। গ্রামের মানুষ চোখ বুজে থাকে না। সুযোগ বুঝে তারাই সমালোচনার ঝড় তুলেছে।