সূর্যাক্ষর আর লড়াই-ঝগড়াতে মন ছিল না, সে চাইছিল সন্ধি। অনেকটাই আপোষের সঙ্গে সে বলল, আচ্ছা তুই কি চাইছিস বল তো?
-আমি যা চাই তা তো আগেই বলেছি। দ্বীপী হাঁপাচ্ছিল, তুই ঐশীর সঙ্গে মিশবি না। আর যেন কোনোদিন ওর সঙ্গে কথা বলতে না দেখি। ও ভালো মেয়ে নয়, আমাকে হিংসা করে।
সূর্যাক্ষ অনেক কিছুই বলতে পারত কিন্তু সে চুপ করে থাকল। ওদের মধ্যে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এল লিটন, ঝামেলা মিটল তোদের? পরীক্ষা দিতে এসে এসব মান-অভিমানের পালা আর ভালো লাগছে না। আমাদের ইস্কুলটার তোরাই বদনাম করে ছাড়বি।
কথা নয় যেন অ্যাসিডের ছিটে, জ্বলে উঠল দ্বীপী, তোর সাহস তো কম নয়, এ কথা তুই বলতে পারলি? কেন বললি বল? কি দেখেছিস?
নিমেষে বেলুন চুপসান চুপসে গেল লিটন, ঢোঁক গিলে বলল, কথাটা মুখে এল তাই বলে ফেললাম। মনে কিছু করিস না।
–জুতো মেরে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করা যায়? দ্বীপীর রাগ তখনও পড়েনি।
সূর্যাক্ষ শান্ত করল তাকে, চুপ কর। ও তো ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।
ক্ষমা চাইলেই সব হয়ে যায়? দ্বীপী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কথাটা। খিরিষগাছের পাশ দিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে বাঁ দিকে। তার কিছু দুরে পরপর দাঁড়িয়ে আছে নিরীহ কটা তালগাছ। তালগাছের হাত পাঁচেক দুরে টলটলে জলের বড়ো একটা পুকুর। হাড়মটমটি ঝোপের পাশ দিয়ে দেখা যায় দেবগ্রামের গোরুর হাট। ঘাসহীন জায়গাটায় রবিবারে গোরর ক্ষুরে ধুলো ওড়ে। গোরু-মোষের চিৎকারে, মানুষের ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তায় জায়গাটা জমজমাট থাকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত। মানিকডিহি থেকে সাইকেল চালিয়ে সূর্য আর তার বন্ধুরা হাট অবধি আসত গল্পে-গল্পে। এসব বেশি দিনের কথা নয়, সুর যেন সব পর পর মনে পড়ে যায়।
রবিবার ছাড়া হাটের দিকে তাকালে মন খারাপ হতে বাধ্য। ফাঁকা মাঠটা তখন ঘুমোয়, বিশ্রাম করে। গোরর পায়ের ক্ষুরের দাগগুলো ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায় তখন।
সূর্য থাকতে না পেরে বলল, দ্বীপী, জানিস গোরুর হাটের কাছে একটা বরফ কল আছে। ওখানে লাল-সাদা-হলুদ রঙের আইসক্রীম পাওয়া যায়। এখন ওখানে দুধমালাইও বানাচ্ছে। আগে দুধমালাই বেলডাঙা থেকে আসত।
দ্বীপীর এসব ছেলেভুলানো কথা শোনার কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না সে চুপচাপহাঁটছিল। তার চোখ টেলিগ্রাফ তারের উপর। গোল খুঁটির উপর তারগুলোকে ধরে রেখেছে সাদা কাঁপের মতো দেখতে চীনামাটির ইনসুলেটর। টান টান তারের উপর বসে আছে পিচের চেয়েও কালো রঙের একটা ফিঙে পাখি। পাখিটার নজর উড়ে বেড়ান ঘাসফড়িংগুলোর দিকে। ডানা কাঁপিয়ে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে ফড়িং ধরায় বুঝি অনেক সুখ, পড়ন্ত বেলায় আহারের জন্য এই সান্ধ্য-শিকার ফিঙে পাখিদের কাছে বুঝি রীতিমতো উপভোগ্য।
দ্বীপীর ভালো লাগে না এই জবরদখল। চোখ সরিয়ে নিয়ে সে নিজেকে স্বাভাবিক করার খেলায় মেতেছে। আগামীকাল কোনো পরীক্ষা নেই। অথচ চিন্তামুক্ত হতে পারছে না সে। হোটহোট ঘটনায় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মনটা। আর কপা হাঁটলেই ভাড়া বাড়িটাতে পৌঁছে যাবে ওরা। দ্বীপী ভাবল আজ আর সে ছাদে যাবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে একটু গড়িয়ে নেবে বিছানায়। সারাদিন যা ধকল গেল টনটন করছে শিরদাঁড়া। টানটান হয়ে ঘুমালে শুধু শিরদাঁড়া নয়, মনটাও তার জুড়াবে।
সন্ধের পর থেকেই গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত বেড়ে যায় রাস্তায়। ভারী ট্রাকের শব্দে কাঁপতে থাকে মাটি। যেন মৃদু ভূমিকম্পে নড়ে উঠছে ঘরবাড়ি।
হালকা টিফিন খাওয়ার পর থেকে যে যার মতো বই নিয়ে বসে গিয়েছে পড়তে। অষ্টমী রান্নার কাজে এদিকে আর আসার সময় পায় না। এতগুলো মানুষের রান্নাবান্না নিয়ে সে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে।
বাথরুমে যাবার নাম করে লিটন উঠে গিয়েছে মিনিট দশেক আগে। টানা পড়ার অভ্যাস তার কোনোদিনও ছিল না। এভাবে বসে থাকলে তার মাথায় ঘুঘরোপোকা ঘোরে।
লরির শব্দটা হাইওয়ে থেকে মিলিয়ে যেতেই হঠাৎই গোঙানীর একটা শব্দ বাথরুম থেকে ভেসে এল সূর্যাক্ষর কানে। কেউ গলা টিপে ধরেছে এমন ঘড়ঘড় আওয়াজ।
সূর্য, দ্বীপী এবং অন্যান্যারা একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর সন্দেহ হতেই দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে। অষ্টমীও না থাকতে পেরে তাদের পেছন পেছন গেল।
বাথরুমের কোণে হতভম্ব শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েছিল লিটন। সারা গায়ে হরলিকসের গুড়ো। ঢাকনা খোলা নতুন শিশিটা পড়ে আছে সামনে। সেদিকে কোনো লক্ষ্য নেই লিটনের। জোরে জোরে শ্বাস টেনে সে গোভানীকে এখন নিজের বশে আনতে অক্ষম। বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার কষ্টটা সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে।
-তোর কি হয়েছে? সবার আগে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে গেল দ্বীপী। তার চোখে মুখে ভয়। নিজেকে সামলে নিয়ে সে লিটনের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। লিটনের মুখের চারপাশে ঘাম আর লালায় চ্যাটচেটে হরলিকস। ঠোঁটেও তার ছোঁয়া, যেন শেতী হয়েছে।
শাসকষ্টে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আমার উপক্রম হল লিটনের। সেইসঙ্গে বাড়ছিল গোঙানীর মাত্রা। নিদারুণ কষ্টে টলটলিয়ে উঠল ওর চোখের তারা। শুধু মুখ নয়, সারা শরীরে ফুটে উঠল সেই অস্বাভাবিকতা। বুক চাপা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল লিটন। বেশিক্ষণ বসে থাকার ক্ষমতা ছিল না তার, একসময় শরীর এলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে ভেজা বাথরুমে।