মাস্টারমশাইরা চলে যাওয়ার পর লিটন সূর্যাকে জিজ্ঞাসা করল, মেঘনাথ বধ কাব্যটা কার লেখা রে? মাইরি কিছুতেই মনে পড়ছে না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
লিখতে লিখতে হাসি আর চেপে রাখতে পারেনি সূর্যা। সে তখন বাপ্পাদিত্যের প্রশ্নটার উত্তর লিখছিল। লিটনের খোঁচা খেয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল। লিটন চাপা গলায় প্রশ্ন করল, কি রে বল, কার লেখা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না?
সূর্যাক্ষ ধমকে উঠল, গাধা, ওটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা। সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসী! যা আর জ্বালাবি নে। আমাকে লিখতে দে।
কথা শেষ হল না, একেবারে দরজার ওপ্রান্ত থেকে জাহাবাজ গলায় ভেসে এল, ডোন্ট টক। ইউ, ইউ, আমি তোমাকেই বলছি! গার্ড দেওয়া শিক্ষকটি এগিয়ে এলেন সূর্যাক্ষর সামনে, গম্ভীর গলায় বললেন, মনে রেখো এটা পরীক্ষার হল, মাছের বাজার নয়। আবার যদি কথা বলতে শুনি তাহলে অন্য জায়গায় বসিয়ে দেব।
সূর্যাক্ষ মুখ নামিয়ে নিল, ওকে সবাই দেখছে। লিটন বেশ মজা পেয়েছে ঘটনাটায়। ঘন হওয়া গোঁফে হাসি মাখিয়ে সে রগড়ের চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে সে শিক্ষকটিকে ডাকল, স্যার, এদিকে একটু…।
শিক্ষক এগিয়ে গেলেন, কি, কি বলতে চাও? আমি কিছু হেলপ করতে পারব না। আমি ফিজি পড়াই। এটা আমার সাবজেক্ট নয়। যতটুকু জান, ততটুকু লেখো। ডোন্ট সাইট।
লিটনও সহজে ছাড়ার ছেলে নয়, স্যার লাস্ট-ইয়ার গণটোকাটুকি হয়েছে। এবছর একটু ঘাড় যোরালেই আপনি চেঁচিয়ে উঠছেন, এটা কি ঠিক? আমরা তো টুকলি করছি না, একটু ডাউট ক্লিয়ার করে নিচ্ছি। এতে দোষ কোথায়? বোর্ডের পরীক্ষায় এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে। শিক্ষক রাগলেন না, বিস্ফারিত চোখ মেলে তাকালেন, ইউ, ইউ, তোমার নাম কি? দেখি তোমার রোল নাম্বার। আই মাস্ট কমপ্লেন এগেনস্ট ইওর নেম। মাইন্ড ইউ! চুপচাপ বসো। ডিসটার্কিং এলিমেন্ট। পরিস্থিতি অনুকুল না দেখে লিটন ধপ করে বসে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবতে মন্দ লাগছিল না সূর্যাক্ষর। এ সময়টা জাতীয় সড়কের চারপাশটা বড়ো মনোরম। রোদ কমে গিয়ে গাছের স্নেহের মতো নরম হায়া নেমেছে। পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আলোর রঙ। পাখির ডাক সেখানে আবহসংগীতের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে।
দ্বীপী সূর্যাক্ষদের দেখতে পেয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ল। কোমল আলোয় ওর মুখটাতে বুঝি শান্তির আগুন জ্বলছে। লালচে হয়ে আছে ওর পুরো মুখ। সামান্য চ্যাটচেটে ঘাম ফুটে উঠেছে সেই মুখে। বেশ বোঝা যাচ্ছিল জ্বালাময়ী এক দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপী সূর্যাক্ষর কোমরের কাছে জোরে চিমটি কেটে জিজ্ঞাসা করল, বটতলায় ঐশীর সঙ্গে তোর কি কথা হচ্ছিল রে? মেয়ে দেখলে একেবারে কাদার মতো লতলতে হয়ে যাস কেন? তোর হ্যাংলামী আর যাবে না।
সূর্যাক্ষ অবাক হল না, সে জানে এটা দ্বীপীর পুরনো রোগ, তুই দেখেছিলি বুঝি?
–দেখব না, আমি কি অন্ধ? ঝাঁঝিয়ে উঠল দ্বীপী।
সূর্যাক্ষ মন খারাপ করে বলল, ওর জন্য কষ্ট হয়। আহারে অত ভালো মুখ যার তারই শেষ পর্যন্ত পক্স বেরিয়ে গেল। মুখে নিশ্চয়ই কালো কালো দাগ হয়ে যাবে। তখন কেমন দেখতে হবে ঐশী কে জানে?
–ওর চিন্তায় তোর দেখছি ঘুম আসছে না। দ্বীপী কটাক্ষ করল।
সূর্যাক্ষ সহজভাবে বলল, পসের জ্বালা তুই আর কি করে বুঝবি বল? যাকে সাপে কামড়ায়নি সে কি সাপের বিষের জ্বালা বোঝে রে। ছোটবেলায় আমার পক্ষ হয়েছিল। এক মাসের উপরে ভুগেছি। মা মাছ-মাংস কিছু খেতে দিত না। সব মনে আছে।
দ্বীপী এসব কথা গায়ে মাখল না, শুধু কটমট করে তাকাল, ঐশী তোকে কি বলল বললি না তো?
ওই রকম অবস্থায় কি কিছু বলা যায়, নাকি বলা সম্ভব?
-ও নিশ্চয়ই তোকে কিছু বলেছে। আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর মতন শয়তান মেয়ে খুব কম আছে। দ্বীপীর সাদা চোখের জমিতে লালচে আভা ফুটে বেরল, তুই জানিস না সূর্য, ও দেখতে সুন্দরী বলে কত ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ায়। ওর কেমিস্ট্রি বইতে আমি দুটো চিঠি পেয়েছিলাম। তোক দেখাতে পারি।
-না, না। আমাকে আর দেখানোর দরকার নেই।
–আমি জানি তুই দেখবি না। তুই তো—
থামলি কেন? বলে ফেল।
-হ্যাঁ, বলছি। ভাবিস না, আমি তোকে ভয় পাই। থানাপাড়ার আকাশদার সঙ্গে ওর প্রেম চলছে। দ্বীপী কথাগুলো বলে শান্ত হল।
কথাগুলো শুনে সূর্যাক্ষ বলল, প্রেম করা কি অন্যায়? সবাই কি তোর আমার মতো বোকা নাকি?
-কি বললি? একথা বলে তুই কি বোঝাতে চাইছিস?
-ই খুব ঝগড়া করার মুডে আছিস আজ। নিশ্চয়ই তোর পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে। দ্বীপী থামল না, তোর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না।
-একটু গুড়াখু দিয়ে দাঁত মেজে নে তাহলে মুড ফ্রেশ হয়ে যাবে।
–ওসব বদ-অভ্যাস আমি কবে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমি তোর মতো নইরে। তোর তো মাঝেমাঝে মুখ দিয়ে বিড়ির গন্ধ বেরয়।
-পুরুষ মানুষের মুখ দিয়ে বিড়ির গন্ধ বেরবে না তো ধুনোর গন্ধ বেরবে? আমাদের মধু খাওয়া মুখ নয় বুঝলি? সূর্যাক্ষর কথাগুলো দ্বীপীর গায়ে চিমটি কাটল।
দ্বীপী চুপ করে থাকার মেয়ে নয়, হাত নেড়ে নেড়ে সে বলল, মধু খাওয়ার ভাগ্য আর তোর কোথায় হল? আর খেলেও নিমফুলের মধু খেয়েছিস। সেইজন্য কথাবার্তার তোর কোনো ছিরি নেই।