–অত রাত অবধি থাকব, যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়?
–তাহলে গায়ে একটার চাদর জড়িয়ে নে।
–তুই কি গায়ে দিবি?
–আমার দরকার হবে না।
–কেন?
–-তুই আছিস না। তুই থাকলে আমার শীতও লাগে না।
দ্বীপী অবাক না হয়ে পারল না। চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রঘুর চাইতে তুই আরও বড়ো চোর। প্লিজ সূর্য, অন্তত পনেরটা দিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না।
-তুই থাকতে পারবি?
–জানি না, যা। তবে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?
.
৫৫.
সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু রকেট বাস আর দেখা হল না দ্বীপীর। হয়ত বাসটা গিয়েছিল, দীর্ঘ অপেক্ষার ঘুম চোখে আর দেখা হয়নি।
তখন রাত্রি দুটো বা তারও বেশি হবে হঠাৎ ঘুম ভেঙে সূর্যাক্ষ দেখল তার মাথার চুল হিম পড়ে ভিজে গেছে। দ্বীপী খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছে তার বুকে মাথা রেখে। জড়তায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গেলেই সূর্যাগ টের পায় মেয়েদের মাথার চুল কচুরিপানার শেকড়ের চেয়েও ভারী।
মেয়েদের চুলে হাত দিতে নেই তবু গোপনে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল সূর্যা। ঘুমিয়ে থাকলে মেয়েদের রূপটা রাতের শাপলা ফুলের চেয়েও নজরকাড়া। সূর্যাক্ষর চোখের তারা কেঁপে গেল। দ্বীপী এত সুন্দরী, কই আগে তো তার কোনোদিন মনে হয়নি। দ্বীপীকে তার মনে হল ঘন পাতার আড়ালে ফুটে থাকা কাঁঠালীচাঁপা ফুল। সুগন্ধে ম-ম করছে রাতের বাতাস। অকাতরে ঘুমাচ্ছে
তবু তাকে জাগাতেই হবে।
-দ্বীপী, এই দ্বীপী ওঠ।
মুখের দুপাশ হাত দিয়ে ঘষে নিয়ে দ্বীপী স্বপ্নময় আচ্ছন্নতার মধ্যে উঠে বলল, আক্ষেপ বেজে উঠল তার গলায়, ইস, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রকেট বাস কি চলে গিয়েছে?
-জানি না, আমারও তো তোর মতন দশা। তবে বুকটা বড় ব্যথা করছে।
–কেন রে, কি হল আবার?
–কিছুই হয়নি, তোর মাথাটা ভীষণ ভারী।
তার মানে?
–মানেটা নাই বা বললাম। শুনলে তুই খুব অবাক হবি, নয়ত রাগ করবি।
–আমি কোনো দোষ করেছি বুঝি?
–না।
–তাহলে? তুই কি কিছু দেখেছিস?
–হ্যাঁ।
–কি দেখেছিস?
কত কি দেখেছি। সব তোকে বলতে হবে?
মুখ শুকিয়ে গেল দ্বীপীর, কথা আটকে গেল গলায়। লজ্জা এসে রাঙিয়ে দিল ওর কাঁঠালকোয়া মুখ।
সূর্যাক্ষ বলল, শুয়ে থাকলে মেয়েরা আকাশের তারা হয়ে যায়। আজ বুঝতে পারলাম কথাটা কত সত্যি।
দ্বীপী ঠোঁট ওন্টাল কিন্তু ওর দিশেহারা চোখে কোনো ভাষা ছিল না। পৃথিবী নিজস্ব পথে ঘুরছিল তখনও।
বাংলা পরীক্ষা সবারই ভালো হয়েছে, খুবই সাধারণ মানের প্রশ্নপত্র, ছাত্র-ঠকানোর কোনো দুরভিসন্ধি ছিল না। ফাস্ট পেপারটায় বড়ো বেশি লিখতে হল সূর্যাদের, তবে গুছিয়ে লিখলে আরও হয়ত একখানা সুজ সিট কম নিতে হত তাকে।
দ্বীপী রিকশা করে ফিরে এল সেন্টার থেকে। সাদা নীল পাড় শাড়িতে তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। গায়ে গাঢ় নীলরঙের ব্লাউজ, যেন কামড়ে ধরেছে শরীরের মাংস, এমন চেপে আছে শরীরে। লিটন, সূর্যানরা হেঁটে আসছিল জাতীয় সড়ক ধরে।
একটা পরীক্ষা শেষ হওয়া মানে ঘাড় থেকে এমণি বস্তা নেমে যাওয়া। সূর্যাক্ষ হাঁটতে হাঁটতে লিটনকে শুধালো, কেমন হয়েছে রে তোর পরীক্ষা?
লিটন বেশ মুডেই ছিল, ভদভদ করে বলল, এত ভালো কশ্চিন এলে কে খারাপ পরীক্ষা দেবে বল? তাছাড়া মাতৃভাষা সবার ভালো হবে। তাছাড়া তমালবাবু যেভাবে বাংলা পড়ান তাতে ক্লাসেই সবার পড়া হয়ে যায়। ওঁর মতন সবাই যদি যত্ন নিয়ে পড়াতেন তাহলে আর চিন্তা ছিল না।
লিটন যা বলল তাতে কোনো খাদ নেই। সত্যিই তমালবাবুর কোনো তুলনাই চলে না কারোর সঙ্গে। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে নেই অথচ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপর তার যে অগাধ টান, মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসা একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
আজ পরীক্ষার হলে তমালবাবু এসেছিলেন হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। সমস্ত ক্লাস রুম ঘুরে ঘুরে দেখলেন। এমন কি ঐশীর কাছেও গেলেন। ঐশী শুধুমাত্র তাদের স্কুলের নয়, আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে সব চাইতে সুন্দরী মেয়ে। ওর দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া বড়ো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটা এত সুন্দরী তবু তার কোনো রূপের বড়াই নেই। সূর্যাক্ষর মনে হয় ঐশী মৃন্ময়ী দুর্গাঠাকুরের রক্ত-মাংসের সাক্ষাৎ রূপ।
সেই ঐশীর ঘুসঘুসে জ্বরের পর পক্ষ বেরিয়েছে সারা গায়ে, বেশ বড়ো বড়ো জলঠোসার মতো, তার এখন হাঁটতে, কথা বলতে এমন কি বেশি সময় ধরে বসে থাকতে কষ্ট হয়। সে শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে আলাদা ঘরে, ইস্কুলের বাঁ পাশে, প্রাইমারী ক্লাসরুমে তার জন্য ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে মশারি টাঙানো সব সময়, একজন মহিলা পিওন ঘরের বাইরে টুল নিয়ে বসে আছে। ঐশী জল চাইলে তাকে জল দেবে, বাথরুমে যেতে চাইলে মহিলাটি তাকে ধরে ধরে নিয়ে যাবে।
হেডমাস্টারমশাই আর তমালবাবু ঐশীর ঘরে গেলেন, দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তোমার এই অবস্থার জন্য খুব খারাপ লাগছে। তবে মনোবল হারিও না। সবরকম পরিস্থিতিকে যে মানিয়ে নিতে পারে সেই-ই তো আসল মানুষ। তা ঐশী, তোমার বাড়ি থেকে কে কে এসেছেন?
ঐশীদের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো, তাদের একটা টালি কারখানা, পাটের রমরমা ব্যবসা ছাড়া চরে প্রায় দেড়শ বিঘার উপর জমি আছে আর বেশ বড় সড়ো পাকাবাড়ি। বাড়িতে ঢোকার মুখে খান তিনেক গোরুর গাড়ি, একটা লাল রঙের ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে থাকে।