তার মানে?
–মানেটা আমি নিজেও জানি না এখনও।
সেদিনের আলোচনাটা আর বেশি দূর গড়ায়নি। দ্বীপী মনে মনে খুশি হয়েছিল সূর্যাক্ষর কথা শুনে। এমন কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা ডুমুরের ফুলের মতো লুকানো। যা বাইরে এলে মুগ্ধতার রেশ কেটে যাবে। দ্বীপী আর দাঁড়াল না। যে ভুল সে করেছে, তার জন্য ক্ষমা চাওয়া দরকার। অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও সূর্যাকে তার একান্তে পাওয়া দরকার। ভুল বোঝাবুঝি ব্যাঙাচির লেজের মতো যত দ্রুত খসে পড়বে ততই মঙ্গল।
সন্ধেবেলায় আলো ছিল না, চৌমাথা থেকে মোমবাতি কিনে এনেছে সাক্ষ। তিনটি ঘরে এখন মোমবাতি জলছে। অষ্টমী হ্যারিকেনের কাচ মুছছিল মন দিয়ে। দ্বীপী তার পাশে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলবে মা?
-না, এমনি…দেখছি।
-হ্যারিকেনের কাচমোছা কেউ দেখে বুঝি? অষ্টমী সহজভাবে হাসল, তোমার মনটা খুব ভালো, খুব নরম।
–কি করে বুঝলে? কৌতূহলী হল দ্বীপী।
অষ্টমী বলল, বোঝা যায় মা, বোঝা যায়। নদীর দেশের মেয়েরা পলিমাটির চেয়েও নরম হয়।
কথাটায় ভালোলাগা ছিল, ভালোবাসা ছিল। দ্বীপী মুগ্ধ চোখে তাকাল, মাসী, তোমার জীবনটা বড়ো কষ্টের, তাই না?
কেন একথা বলছে? কষ্ট ভাবলে কষ্ট, না হলে কিছু নয়। অষ্টমী কোনো জটিলতায় গেল না, বিয়ের ছমাসের মধ্যে স্বামী মারা গেল। মানুষটাকে চিনতে না চিনতেই চলে গেল সে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভাবলাম এবার হয়ত আমার পালা। দেখো, কেমন বেঁচে গেলাম এতদিন। বাপের দোরে আর হাত পোড়াতে হল না। একটা ঘর পেলাম, ছেলে পেলাম। জানো লিটনকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু লিটন আমার সব। আমি জানি এই ছেলেই আমার মুখে আগুন দেবে।
দ্বীপী আশ্চর্য হয়ে গেল কথা শুনে, গলা নামিয়ে বলল, যা মাগী, তোমার কথাই ঠিক। লিটন বড় ভালো ছেলে। ওর ভেতরে একটা প্রতিবাদী মন আছে। আমার ওই মনটাকে ভালো লাগে।
খুশী হল অষ্টমী, কাছে সরে এসে ঘনিষ্টস্বরে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি মা। লিটনকে যেন ভুল করেও বলো না। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে দেবগ্রামের পাশটা হয়ে গেলে লিটনের বিয়ে দিয়ে দেব। তা তোমার নজরে তেমন কোনো ভালো মেয়ে আছে? থাকলে বলল। আমি যোগাযোগ করব।
-সে কী মাসী, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবে?
–কেন বিয়ে দিলে ক্ষতি কি?
–ওর চাকরি-বাকরি নেই, কিছু করে না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও।
–চাপ না পড়লে কেউ বাপ বলে না-বুঝলে? অষ্টমী ঘন দাঁত বের করে হাসল। দ্বীপী আর এ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া লোডশেডিং দৈত্যের আলোচনায় মেতে উঠল, দেখো তো, কী ঝামেলা। এ সময় লাইট গেলে আমরা পড়ব কখন?
অষ্টমী ক্রোধিত হয়ে বলল, সব কানা, বিবেকহীন। না হলে পরীক্ষার আগে কেউ বাতি কেটে দেয়। পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ডুবে আছে মনে হচ্ছে। এদিক থেকে ভালো হয়েছে–আমাদের ঘরে এসব ঝামেলা নেই। হ্যারিকেন-ডিবরিতে আমাদের চোখ সয়ে গেছে।
সাড়ে আটটার পরে অন্ধকার খুন হল। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে এল ওরা। দ্বীপী সবার পেছনে, লিটন সবার আগে। সিঁড়ির বাটা লালচে আলো ছড়িয়ে জুলছিল।
অষ্টমী ওদের আসার অপেক্ষায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিল, আলো এসেছে, এবার তোরা সবাই খেয়ে নে। আবার কখন বাতি চলে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যা হাত-মুখ ধুয়ে আয় কলতলা থেকে। আমি ভাত বেড়ে রাখছি।
সূর্যাক্ষ হাত নেড়ে বলল, এত তাড়াতাড়ি খাওয়া কি ঠিক হবে মাসী, যদি ভোরের দিকে খিদে পেয়ে যায়?
খিদে পেলে খাবি। টিনে মুড়ি আছে। মুড়ি খেতে দোষ কোথায়?
এবার আর কোনো আপত্তি টিকল না কারোর। কলতলায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল ওরা। নতুন টিন কেটে বানানো হয়েছে কলতলার দরজা। আলো পড়ে চকচক করছে টিন। টিন নয় যেন ধাতুর-জ্যোৎস্না।
খাওয়ার পর দুঘণ্টা টানা পড়ে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল দ্বীপী। পাশে বসা সূর্যাক্ষকে চিমটি কেটে বলল, ঘুম পাচ্ছে, ছাদে যাবি, সূর্য?
-এত রাতে?
–আমার ভালো লাগছে না। ভীষণ মন খারাপ করছে বাড়ির জন্য।
–সে কি রে, একদিনেই এত?
–যার হয়, একদিনেই হয় না হলে জীবনভর হয় না।
সূর্যাক্ষ অবাক হয়ে শোনে দ্বীপীর কথাগুলো। নরম কথা কিন্তু নেশা ধরে যায় মনে। দ্বীপী অস্থির হয়ে বলল, যাবি তো চল। আমার আর ভালো লাগছে না।
-আমরা একা যাব?
–একা কোথায় রে, আমরা তো দুজন আছি।
–হ্যাঁ, দুজন আছি। কিন্তু আমরা দুজন মানে তো একজন।
–অঙ্কে তুই নির্ঘাত ফেল করবি। এই যদি তোর হিসাব অন হয় আমি তোকে কি বলব বল। দ্বীপী আনমনে আঙুল কামড়াতে লাগল, চল না রে সূর্য, আমার যে ছাদে যেতে মন করছে।
-যেতে পারি, কিন্তু আমি যতক্ষণ বলব ততক্ষণ তোকে ছাদে থাকতে হবে।
সূর্যাক্ষর শর্তটা উপভোগ করল দ্বীপী, এবার হাসি ফুটল তার ঠোঁটে, ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু একটা কথা বল তো, এতক্ষণ ছাদে থেকে কি হবে?
–রকেটবাসের নাম শুনেছিস? হাইওয়ে দিয়ে বাসটা রোজ যায় গভীর রাতে। তার মাথায় থাকে সার্চ-লাইট। বাসটা রকেটের গতিতে দৌড়য়। দিনের বেলায় বাসটাকে দেখা যায় না, এ হল রাতের রানী।
সূর্যাক্ষর কথায় দ্বীপী অবাক হল, তুই এত সব জানলি কি করে?
–জানতে হয়। বিজ্ঞের মতন ঘাড় নাড়াল সূর্যাক্ষ, মোমবাতি কিনতে গিয়ে সব শুনে এসেছি। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে আজ রাতেই রকেট বাস দেখার আশাটা পূর্ণ হয়ে যাবে।