একদিন শ্বশুরঘরে কাটিয়ে একমাত্র শালী অষ্টমীকে নিয়ে ফিরে এল সে। সেই থেকে উনিশ বছর ইস্কুল পাড়াতে কাটিয়ে দিল অষ্টমী। লিটন তাকে ছোট মা বলে ডাকে। তার এই সবোধনে কোনো খাদ নেই। অষ্টমী দু দিনের শিশুকে মায়ের মতো লালন-পালন করেছে। লিটন কাদলে নিজের ভরন্ত দুধহীন স্তনবৃন্ত ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেটার মুখে। মা হতে না পারার যন্ত্রণাটা ভুলিয়ে দিয়েছে লিটন। অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়ে বাঁচার অনেক জ্বালা। মৃত্যুঞ্জয় দেবতার মতো মানুষ। কোনোদিন তার প্রতি লালসার চোখে তাকায়নি। একই ঘরে শোওয়া বা খাওয়া পরা–তবুও। অথচ পাড়ার লোকে ভুল বোঝে। প্রথম প্রথম চোখ টাটাত। জ্বর ধনুক বাঁকিয়ে বলত, আগুন আর বি পাশাপাশি থাকলে গলবেই। কেনে মিহে কথা বলছো মৃত্যুনা। তোমার আর কতটা বা বয়স? এই বয়সে বউ মরলে লোকে চার-চারটা বিয়ে করতে পারে।
জিভ কেটে মুখ নামিয়ে নিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়, তা নয় গো ভাই, তা নয়। সবাই যা ভাবছে তা ভুল। ঘা শুকোতে সবার একই সময় লাগে না। কারো কারোর ঘা গভীরে থাকে, বাইরে থেকে তা চট করে দেখা যায় না। দেখা না গেলেও ঘা তো ঘা-ই।
অষ্টমী তার ক্ষুদ্র জীবনে অনেক মানুষ দেখেছে, কিন্তু জামাইবাবুর মতো অমন সজ্জন, চরিত্রবান মানুষ সে আর দুটি দেখেনি। এক একটা পুরুষমানুষের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, নারীমন কার্তিকমাসে শ্যামাপোকার মতো দন্ধে মরে। অষ্টমী উনিশটা বছর দন্ধে দন্ধে মরল, কোনোদিন মৃত্যুঞ্জয় তাকে দুর্বল সময়েও ইশারা করে ডাকল না। অথচ দেখতে শুনতে সে কখনও মন্দ ছিল না। আখের আলসের মতো গায়ের রঙ, মাথাভরা চুল ঢলঢল করে নাচত পিঠের উপর, শিরদাঁড়ার ভেতরে প্রায়সময়ই বইয়ে দিত উষ্ণস্রোত। নারীত্বের পাশাপাশি তার এই ভরাট শরীরের দীপ্তমান বক্ষশোভা যেন জাহির করে দিত গোপন যৌবনসত্তা। ঢেউ খেলান শরীরে এখন চর্বি জমলেও জ্যোৎস্নার ঘোলাটে রঙ ধুয়ে গিয়ে ফুটে উঠেছে। কামিনীকাঞ্চন। বয়সটাকে বুঝি ঢাকতে পারে যৌবন। এখনও তার ছোট্ট কপালে লাউ আঁকসির চেয়েও সুন্দর চুলগুলো দোল খায় যখন-তখন। তখন ওই হাড়ভাঙা খাটুনির মুখটাকে মনে হয় শ্রীময়ী। দুকানে বিয়েতে পাওয়া সোনার দুটি বেলকুঁড়ি আজও ফুটে আছে, ঝরে যায়নি। হাতের শাখা ভেঙেছে প্রায় বছর কুড়ি আগে, এখন শুধু সোনার কলি কব্জির নিম্নদেশে খেলা করে, আর রোদে ঝলসায়। আর সেই ঝলকানি শরীরে পড়লে তেতে ওঠে গা-গতর। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এখন সব মানিয়ে নিয়েছে অষ্টমী। সে জেনেছে পাতলা ঠোঁটের যাদুতে সে পুরুষের হৃদয় অবশ করে দেবে, তাতে লাভের চাইতে যে ক্ষতি বেশি–এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। তাই এই সুরভিত শরীরটাকে নিয়ে তার এখন আর কোনো গর্ব নেই, সে শুধু চায় ভালোয় ভালোয় বাকি দিনগুলো কাটিতে দিতে। লিটনের মধ্যে তার আগামী দিনের সব সুখ যেন গন্ধদানীর আতরের মতো লুকিয়ে আছে।
দ্বীপী এসব গল্পের কিছু জানে না। লিটনকে সে ইস্কুলে দেখেছে কথার পিঠে কথা বলে যেতে। ওর মুখে সর্বদা যেন খই ফোটে। হেডমাস্টারমশাই ওর ব্যবহারে তিতিবিরক্ত। দ্বীপীও একদিন রাগের মাথায় সঞ্জয়কে বলে দিয়েছিল, শুন্য কলসি বাজে বেশি। ওই জন্য সবাই তোকে লিটন না বলে নিউটন বলে।
দুপুরবেলায় জানলা টপকে রোদ এসে শুয়ে পড়েছে মেঝেয়। আলোর গোল গোল ফুটকিগুলো বড়ো বেশি ভ্রাম্যমাণ এখন। ওরা বুঝি এক জায়গায় স্থিতু হতে জানে না। দ্বীপী হাঁ-করে অষ্টমীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মন পড়ে আছে সূর্যাক্ষর কাছে। একটু আগে সে যা ব্যবহার করেছে তা কখনও সমর্থনযোগ্য নয় তার নিজের কাছে। ইদানীং নিজেকে নিয়ে সে বেশি চিন্তিত।
দেবোত্তর চক্রবর্তী সংসারের হাল ফেরাতে গিয়ে ফুটো নৌকোর মতো টলছেন। শিবমন্দিরের পুরোহিতের ভাগ্যে আর কটাকা দক্ষিণ জোটে? পুজোর শাড়ি গামছা দোকানেও কিনতে চায় না। কত আর ওগুলো জমিয়ে রাখা যায়? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বীপীর মন ভেঙে যায়। পাশ করে তাকে কিছু করতেই হবে। এ নিয়ে সূর্যাক্ষর সঙ্গে তার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। দ্বীপী বলেছে, হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে পিএসসি পরীক্ষায় বসবে।,কেরানীর চাকরি খারাপ নয়। যদি সে চাকরি যোগাড় করতে পারে তাহলে বাইরে থাকতেও তার কোনো অসুবিধা হবে না। সংসারের জন্য অর্থ চাই। সেই অর্থ তাকে শ্রমের বিনিময়ে যোগাড় করতে হবে। সে জানে পড়াশোনার রাস্তাটা দেবগ্রামের সেন্টার অবধি এসে থেমে যাবে। এর জন্য মন খারাপ হয় না তা নয়। মন খারাপ করলেও আর কোনো উপায় নেই।
সূর্য এসব শুনে তাকে অভয় দিয়ে বলেছে, তুই এত ভাবিস নে, আমি আছি, আমি তোদের সংসার চালিয়ে দেব।
-তুই চালাবি? আশ্চর্য!
–কেন, আমি বুঝি তোদের কেউ নই?
–না, না। তা নয়। তবে
–তবে কি?
–এটা বাস্তব নয়। বাস্তব বড়ো কঠিন। তুই আমাদের সংসারে টাকা দিলে সেটা তোর বাবা-মা মেনে নেবো কেন? দ্বীপী বুঝিয়ে বলল, মন তো অনেক কিছু চায়, কিন্তু বাস্তবে কি তা করা যায়?
-বাস্তবে যা করা যায় না, তা অনেক সময় করে দেখানো যায়।
–এটা তোর জেদের কথা।
-জেদ নয়, এটা আমার মনের কথা। তুই আমার পাশে থাকলে আমি অনেক কঠিন কাজ সহজে করতে পারব।