-যা আর ঝোল টানতে হবে না। দ্বীপী চোখ বন্ধ করে বলল, তুই যা তো, আমি পড়তে বসব। কাল পরীক্ষা। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে
–তুই তো ভালো মেয়ে, তোর আবার চিন্তা কি?
–ভালো মেয়ে হলেও পড়তে হয়।
–কাল তো বাংলা। অত পড়ার কি আছে?
-ভুলে যাস না, দুশ নাম্বারের পেপার। ম্যাকসিমাম ছেলে-মেয়ে বাংলায় ফেল করে। দ্বীপী গম্ভীর গলায় বলল।
তার কথায় দিশেহারা বা ভীত হল না সূর্যাক্ষ, এবার তোর স্টার বাঁধা।
-হায়ার সেকেন্ডারীতে স্টার মার্কস পাওয়া ছেলের হাতের মোওয়া নয়। দ্বীপী অবজ্ঞায় ঠোঁট ওটাল।
কিছুটা হলেও মনে মনে দুঃখ পেল সূর্যাক্ষ। দ্বীপীকে বাগে আনতে হবে। কথা দিয়ে ওর মন ভুলবে না। মাঝে মাঝে ও খুব গম্ভীর হয়ে যায় তখন কাউকে চেনে না যেন। ওর এই নির্দয় ব্যবহারটা সূর্যাকে বড়ো আঘাত দেয়। সব বুঝেও সে দ্বীপীকে বলল, শুনেছি, এবার খুব চোতা চলবে। সুযোগ পেলে আমিও চালিয়ে দেব। ছাড়াছাড়ি নেই।
তুই দেখছি ঝালেও আছিস, অম্বলেও আছিস। দ্বীপী কষ্ট করে হাসল। সূর্যাক্ষ এবার আর দ্বীপীকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে খপ করে দ্বীপীর হাতটা চেপে ধরল। ওর খোঁপা বাঁধা চুল ছড়িয়ে গেল পিঠে, মুখ কালো হয়ে গেল কষ্টে, ছাড়, ছাড় বলছি।
ছাড়ব না। না ছাড়লে তুই কি করবি?
দ্যাখ সূর্য, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। কেউ যদি দেখে নেয় তো মুখ দেখাতে পারবি না। দ্বীপীর ঠোঁট কেঁপে উঠল।
-আগে আমার কাছে ক্ষমা চা। নাহলে তোর মুক্তি নেই।
–আহারে, কী আমার বীর-যোদ্ধা। মুখ বিকৃত করে ঠোঁট ওন্টাল দ্বীপী।
সূর্যাক্ষ বলল, হাত ছেড়ে দেব। আগে বল তুই ভালো ব্যবহার করবি।
-আমি খারাপ ব্যবহার করলে তোর কি আসে যায়?
-আমার মন খারাপ হয়ে যায়। পড়তে বসলে তোর মুখটা খালি ভেসে ওঠে। সূর্যাক্ষ দিশেহারা চোখে তাকাল।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দ্বীপী, কষ্ট হয় না, ছাই হয়। তোর মনভুলানো কথায় আমি আর গলছি না। যা ভাগ।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্বীপী সুর্যাকে ঠেলা মারল। টাল সামলাতে না পেরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে গেল সূর্যাক্ষর। আর সঙ্গে সঙ্গে কপালটা মার্বেল গুলির মতো ফুলে গেল।
দ্বীগী বিস্ফারিত চোখে দেখল সেই দৃশ্য! ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল তার। কান্না পেল। এ কী সর্বনাশ করল সে। কাল পরীক্ষা। ফোলাটা যদি না কমে। যদি সবাইকে ফেলার কারণটা বলে বেড়ায় সূর্যা? তাহলে সে মুখ দেখাবে কিভাবে? দ্বীপীর গা হাত পা কাঁপছিল ভয়ে। তবু সে সূর্যাক্ষর হাতটা চেপে ধরল গভীর আবেগে, তোর বুঝি খুব লেগেছে। দেখ, আমি ঠিক, ওভাবে …
–ঠিক আছে, বুঝেছি। চুপ কর। সূর্যাক্ষ ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল।
ফাঁকা ঘরে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল দ্বীপী। আর তখনই ভেসে ওঠা শুশুকের মতো দম নিয়ে অষ্টমী বলল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে না! কী মেয়েরে বাবা…!
দ্বীপীর ডাগর চোখের তারায় বিস্ময় লুটিয়ে গেল, ঝোঁক সামলে সে বলল, মাসী, দুপুরে শোওয়ার অভ্যাস আমার নেই। দুপুরে ঘুমালে গা-হাত-পা ম্যাজম্যাজ করে। শরীরটা কেমন খারাপ লাগে।
অষ্টমী কেমন পাংশু মুখে তাকাল, আমাদের লিটনটা তো কথা শোনে না। খাওয়ার পরে ঘুম না দিলে ওর পেটের ভাত হজম হবে না। দুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ছেলেটা কেমন মোটা হয়ে গিয়েছে দেখো। আমি কত মানা করি, তবু ও আমার কথা শোনে না।
এই বয়সে লিটন তার চেহারাটাকে বয়স্কদের মতন করে ফেলেছে। শরীরের ওজন বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। তবু খাওয়া-দাওয়ার উপর ওর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। খাবার দেখলে ওর ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। বয়সকালে লিটনের মা সপ্তমীর খাওয়া-দাওয়ার প্রতি আসক্তি খুব বেশি ছিল। জলঢালা ভাত খেতে সে খুব ভালোবাসত। শীতকালে বেগুনপোড়া আর জলঢালা ভাত তার কাছে ছিল অমৃতসমান। খুব তাড়াতাড়ি সপ্তমী চলে গেল। প্রসব হতে গিয়ে তার রক্তচাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয় ধার-দেনা করে সদরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। লাউগাছটা মরে গেল, জালি রেখে। সন্ধের মুখে সপ্তমী ইস্কুল পাড়ায় এল ছোট লরিতে চেপে, তার সারা শরীর তখন কাপড়ে মোড়ান, আর সেই কাপড় ভিজে গিয়েছে রক্তে। মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে ধরা একদিনের লিটন।
পাড়া-পড়শিরা দুঃখ করে বলল, যা হবার হয়েছে মৃত্যুন, এবার এই ছেলেটার মুখ চেয়ে বাঁচো। সপ্তমী বড়ো ভালো মেয়ে ছিল গো, কখনো মুখ তুলে কথা বলত না। যারা ভালো তারা চটজলদি ভগবানের কাছে চলে যায়। এসব শাস্ত্রের কথা, তুমি-আমি কি করতে পারি বলো।
দুধের শিশু লিটনকে মানুষ করবে কে? এই চিন্তায় কদিন ঘুমাতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। শেষে ঠিক করল শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসবে ছেলেটাকে। ওখানে দশজনের হাতে-গেলে মানুষ হয়ে যাবে ছেলেটা। বছর পাঁচেকের হয়ে গেলে লিটনকে নিজের কাছে এনে রাখবে।
শাশুড়ি-মা তার প্রস্তাব শুনে বললেন, ভালো কথা। কিন্তু শুধু ছেলের কথা ভাবলে চলবে না। তোমার নিজের কথাও ভাবতে হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো–অষ্টমীকে নিয়ে যাও। ওরও তো কপাল পুড়েছে। জলজ্যান্ত জামাইটা আমার পেটে জল জমে মরে গেল। অত বড়ো কাটোয়ার হাসপাতাল, জামাইটাকে বাঁচাতে পারল না। সবই ভাগ্য বাবা, বুঝলে! শাশুড়ির কথা মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে নেমে এল।