চন্দ্রিকা এসব কথা শুনছিলেন না। মেয়ের পরীক্ষা নয় তো যেন তারই পরীক্ষা। কপালের ঘাম কমালে মুছে তিনি দ্বীপীকে বললেন, সাবধানে থাকবি। কোনোদিন বাইরে থাকিল নি, আমার ভয় করছে।
দ্বীপী হাসল, ভয়ের কি আছে?
-তুই মা হলে বুঝবি।
লজ্জায় এত লোকের মাঝখানে দ্বীপী যেন জল লাগা সন্দেশের মতো গলে গেল। গালে রাঙা টোল পড়ল তার। কথা শুনে সূর্যাক্ষ পিটপিটিয়ে হাসছিল। দ্বীপী তার দিকে কটমট করে তাকাল।
কয়লার আঁচে ভাত বসিয়েছিল অষ্টমী। এতক্ষণ গমগম করছিল ভাড়া ঘর। ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরটাতে ফাঁকা হাটের নীরবতা নেমে এল। চন্দ্রিকা যাওয়ার আগে দ্বীপীকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে দিয়েছেন–শরীর খারাপ হলে বিদেশে কীভাবে তা সামলাতে হবে।
দ্বীপী খুব বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু তার কিছু করার নেই। মায়ের মুখের উপর সে একটাও কথা বলতে পারে না। তাছাড়া মা যা বলেন-তা তো ভালোর জন্যই বলেন।
চন্দ্রিকা এ-ও বললেন, ঘুমোনোর সময় মাসীর কাছে ঘুমিও। তোর ঘুম খুব খারাপ। ঘুমালে বড় এলোমেলো হয়ে যায়ে তোর জামাকাপড়। এসব কথা চন্দ্রিকা বলতেন না কিন্তু না বলেও তার কোনো উপায় নেই। সূর্যাক্ষ তাদের ঘরের ছেলের মতন। ওর কথা আলাদা। কিন্তু বাকি আরও তিনজন আছে। তারা দ্বীপীকে আর কতটুকু চেনে! ওদের মনে একটা খারাপ ধারণা জন্মালে সহজে তা মুছবে না। দ্বীপীর এখন নজরকাড়া চেহারা। চুল থেকে পায়ের নখ সবখানে উপচে পড়া যৌবন। এটেল মাটির মতো গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। কথা বললে কলকল ঢেউ ওঠে জলের। শুধু ঠোঁট নয়, দিঘল চোখ দুটো কথার তালে তালে নাচে। ডাগর বুকের সে কি দুর্নিবার আকর্ষণ–দেখলেই পানকৌড়ি পাখির মতো ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে চাইবে যুবক সত্তা। তবু মেয়েটাকে এক সাথে না রেখে উপায় নেই। এত টাকা ঘরভাড়া তাদের একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। পাঁচজনে মিলে দিলে ভাগে কম পড়বে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
ওরা চলে যেতেই শুনশান হয়ে গেল ঘরগুলো।
সূর্যাক্ষ লোভী চোখে ঘরটার চারপাশে তাকাল। পাঁচিলঘেরা ঘর, সামনে একফালি জমিতে ফুলগাছ যেমন আছে, তেমনি আছে ইউরিয়া দেওয়া পুইগাছ। এ এলাকায় ঢোলকলমী গাছের ছড়াছড়ি। এখন হোট হোট মাইকের মতো ঈষৎ গোলাপী সাদা ফুল ফুটে আছে। গাছগুলো রোগা ডাল নিয়ে দোল খাচ্ছে হাওয়ায়।
সূর্যাক্ষ ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটার দিকে তাকাল। তার মনে হল ওই খোলা ছাদে কত রহস্য বুঝিবা লুকিয়ে আছে। ফুরসত মতো ছাদে গিয়ে হাওয়া খেতে হবে। ছাদ থেকে চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়ক নিজের বুকের হাড়ের মতো স্পষ্ট দেখা যায়।
অষ্টমীর রান্না শেষ। এ বেলাটা সেদ্ধ খেয়েই কাটাতে হবে। ও বেলার রান্না নিয়ে কারোর মনে কোনো সংশয় নেই। সবাই যে যার থালা নিয়ে লাইন করে বসে গেল মেঝেতে। দ্বীপী এল না। সূর্যাক্ষ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল, মাসী, দ্বীপীরটাও বেড়ে দাও। আজ অন্তত সবাই একসাথে খাই। তুমিও আজ আমাদের সঙ্গে খেয়ে নাও।
-তা হয় না, বাবা। আমার অভ্যাস সবার শেষে খাওয়া।
-ও তো বাড়িতে করতে। এখানেও কি তাই করবে? সূর্যাক্ষর প্রশ্নে অষ্টমী বিরক্তির চোখে তাকাল।
দ্বীপী এগিয়ে এল, আমি তোদের সঙ্গে বসছি। মাসী পরে খাক। কেন না কারোর কোনো কিছু দরকার হলে এঁটো হাতে কে বেড়ে দেবে?
-তাই তো! সমস্যাটা বুঝতে পেরে সূর্যাক্ষ মাথা ঝাঁকাল।
খাওয়া-দাওয়া চুকে গেলে দ্বীপী ওর ঘরে চলে গেল। জাতীয় সড়ক কাঁপিয়ে একের পর এক ট্রাক বাস ম্যাটাডোর ছুটে যাচ্ছে। বিরামহীন তাদের চলা। এখান থেকে ট্রেনের শব্দ স্পষ্ট কানে আসে।
এত শব্দ তবু জায়গাটার একটা শান্তশ্রী ভাব আছে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই পরিশ্রমী। যুদ্ধের সময় শিকারপুর বর্ডার পেরিয়ে এরা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কলোনীর পরিবেশ গড়ে উঠেছে চারধারে। পাকা বাড়ির সংখ্যা খুব কম চোখে পড়লেও যে কটা পাকাবাড়ি আছে তা একেবারে নজর এড়িয়ে যাবার মতো নয়।
সবার খাওয়া শেষ, লিটন তখনও ওঠেনি। অষ্টমী তার পাতের গোড়ায় বসে আছে চুপচাপ। পাকা চুলের গোড়া কুটকুটালে সে তর্জনী দিয়ে চুলকে নিচ্ছে জায়গাটা।
কি ভেবে সূর্যাক্ষ দ্বীপীর ঘরে ঢুকে এলে তার মনে হল কাজটা উচিত হল না। এক অপ্রতিরোধ্য সংকোচ তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখল। গ্রামে থাকতে এই জড়তা তার কোনোদিনও অনুভব হয়নি। কোনো কিছু না বলেই সে দ্বীপীর ঘরে ঢুকে যেত মুক্ত বাতাসের মতন। আজ এখানে কে যেন ভেতর থেকে বলল, যেও না। এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় সূর্যাক্ষ দ্বীপীর দিকে নীরব চোখে তাকাল।
দ্বীপী প্রশ্ন করল, এখানে কি করতে এসেছিস?
-একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি বলবি?
–ন্যাকামো করিস না। বল কি কথা?
কাকিমা তোকে আড়ালে ডেকে কি বলল রে?
মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই দ্বীপীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল, মা যা বলেছে-সব কথা তোকে বলতে হবে নাকি?
–তুই তো আমার কাছে কিছু গোপন করিস না।
–দেখ সূর্য, পাগলের মতো বকছিস কেন? তোর কি কোনো কাজ নেই। যা তো
–তাড়িয়ে দিচ্ছিস?
–তাহলে কি ফুলবেলপাতা দিয়ে পুজো করব তোকে? দ্বীপী কপট রাগে চোখ পাকাল।
সুবিধা হবে না বলে সূর্যাক্ষ নরম গলায় বলল, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। একটু আগেও তুই ঠিক ছিলিস। এখন বদলে গেলি। মেয়েরা গিরগিটির চেয়ে তাড়াতাড়ি নিজেদের বদলে নেয়। ছেলেরা অতটা পারে না।