.
৫৪.
কালকাসুন্দি গাছের ছায়া মানুষের কোনো কাজে লাগে না। গাছ শুকিয়ে যাবার পর জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার হয় ওগুলো। তবু শীতের আগে যখন ওইগাছে ফুল আসে তখন ফুলগুলো দেখার জিনিস হয়ে ওঠে।
সঞ্জয় হালদার কালাকাসুন্দি গাছ নয় কিন্তু তার ওই উখান অনেকটা ওই গাছের মতন।মৃত্যুঞ্জয় সব জানে তবু ছেলেকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলে, পরীক্ষায় মোটে ভয় পাবিনে। মনে না পড়লে মা বুড়োমার নাম স্মরণ করবি, মা বুড়োমা তোকে সব মনে করিয়ে দেবে। বড়ো জাগ্রত দেবী। আমি মানত করেছি–তুই বড়ো পরীক্ষায় পাশ হয়ে গেলে ঢাক বাজিয়ে পুজো দেব।
দেবশ্রামের ভাড়া বাড়িতে হাঁ করে শুনছিল সায়। বিয়ে চোখের পাতা পড়ছিল না তার। এমনিতে সরে চেহারা ভালো, নাদুস নুদুস। খেয়াল করে দেখলে মনে হবে ফুলে রুগী। আসলে মাত্রাতিরিক্ত যাওয়ার এতাব। সয়ের সব ভালো ও খাওয়ার ওপর তার কেননা নিয়ন্ত্রণ নেই। খেতে পারলেই সে পৃথিবীর সব চাইতে খুশি মানুষ। ফি-বিয়ে বাড়িতে বাজি ধরে সে কম সে কম পঞ্চাশটা রসগোল্লা খাবেই খাবে। সের খানিক মাংস তার জন্য বাধা। পিকনিকে গেলে সে একার চাঁদা দিয়ে ডবল মিল খাবে। এ নিয়ে কেউ রাগারাগি করলে তার ভীষণ অপছন্দ।
সঞ্জয় যার ভালো নাম, ডাক নাম তার লিটন। মাথায় তার ঝাঁকড়া চুল, গা-হাত-পায়ের গড়ন শিলনোড়ার চেয়েও মজবুত। লোকে বলে, লিটনের যেমন চেহারা তেমন খ্যাটন। আর খাবে না কেন সারাদিন তো টো-টো করে ঘুরছে। ঘুরলে শরীলের ক্ষয় হয়, ইঞ্জিন ডিজেল-পেট্রল চায়। নতুন বাসাবাড়িটায় ছ-সাত জনের ভালোমতন ঠাঁই হয়ে যাবে। মৃত্যুঞ্জয় ছেলের মুখোমুখি বসে আছে বারান্দায়। সঞ্জয় ওরফে লিটন মুখ ফাঁক করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। সে যে টেস্টের নদীটা পেরতে পারবে এমন মনের জোর তার ছিল না। হেড-মাস্টারমশাই বলেছিলেন, এ বছরটা ড্রপ দে লিটন। এক বছরে পাকা হয়ে উঠবি। তারপর বোর্ডের পরীক্ষায় বসে যা। তোর ভালো হবে।
বাবার কথা ভেবে লিটন হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা কানে তুলল না, স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলল, পড়াশোনা পুরনো ঘিয়ের মতো নয়, মাস্টারমশাই। পড়াশুনো হল খরালীকালের ডিমের মতো। বেশিদিন রেখে দিলে ভেতরে-ভেতরে পচে গিয়ে বাসনা ছাড়বে।
-তোর যা ইচ্ছে তাই কর। বিরক্ত হয়ে হেডমাস্টারমশাই বলেছিলেন, আমি তোকে দেবগ্রামের সেন্টার অবধি পাঠিয়ে দেব। নদী পেরনো তোর কাজ।
ভাড়াবাড়িটার চারধারে গাছপালায় ঢাকা। সূর্যাক্ষ দ্বীপীকে নিয়ে গিয়েছিল কিছু কেনা-কাটা করতে। ফিরে এসে দেখল কপোতাক্ষ বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে দ্বীপীর বাবা-মা। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। ওদের আলোচনায় ভাড়া বাড়ির প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল।
অষ্টমী বেশ খুশি হয়েছে ঘর দেখে। স্কুল পাড়ায় তাদের মাটির ঘর, ঘরের উপরে খড়ের ছাউনি। পয়সার অভাবে খড় পচে ছাইবর্ণ হয়েছে, এখনও পাল্টান হয়নি।
অষ্টমীকে সবাই কম বেশি চেনে। মাঝের গাঁ, হলদিপোঁতায় যেতে গেলে এ পথ ধরে বাঁধের উপর উঠতে হবে। জগৎখালি বাঁধের গায়েই পাশাপাশি তিনটে গুয়োবাবলার গাছ। ওদের বয়সের কোনো গাছপালা নেই। প্রকাণ্ড খসখসে ছালওঠা শুড়িগুলোই বলে দিচ্ছে ওরা বয়স্ক।
অষ্টমী শাড়ি গুছিয়ে নিজেকে ভদ্রস্থ করে বলল, এ বেলায় রান্না হবে, আমি আঁচ ধরিয়েছি। আপনারা তাহলে দুটো সেদ্ধ ভাত এখান থেকে খেয়ে যাবেন। সবার প্রথমে বাধা দিলেন কপোতাক্ষ, না, না,তা হয় না। দেবগ্রামে ভালো হোটেল আছে–আমরা সেখানে খেয়ে নেব। তোমার ব্যস্ত না হলেও চলবে। অষ্টমী স্নান হাসল, ব্যস্ত নয় গো, এটা আমার কর্তব্য। ঘরে থাকলে আপনাদের কি না খাইয়ে ছাড়তাম।
এটা ঘর নয়, ভাড়াবাড়ি। দেবোত্তর বললেন, যেখানে যেরকম, সেখানে সে রকম। বুঝে-শুনে পনেরটা দিন চালিয়ে নিও। ছেলে-মেয়েগুলোকে একটু শাসনে রাখার চেষ্টা করো, অষ্টমী। ওরা যেন বায়োসকোপ দেখতে যেতে না পারে।
অষ্টমীর কঠিন ঘাড় ডানে-বাঁয়ে নড়ে উঠল। বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে বলল, আমার শাসন ভীষণ কড়া। আমি এদের রাস্তার ওদিকে যেতে দেব না। টাইমে খাবে, টাইমে ঘুমুবে, মাঝখানে শুধু পড়াশোনা।
–ঠিক বলেছো, এই তো চাই। দেবোক্স চক্রবর্তী অষ্টমীর কথাকে সমর্থন করলেন। এই সমর্থন অষ্টমীকে ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ করে দিল। তার সাহস বেড়ে গেল হাজার গুণ। লিটনকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলল, ভালো করে শুনে রাখ, প্রতিদিন রাত বারোটা পর্যন্ত পড়তে হবে। পড়ার সময় দুলুনী বা ঘুম কোনোটাই চলবে না। সকাল ছটার মধ্যে উঠতে হবে। আমার কথার অবাধ্য হলে আমি নালিশ ঠুকে দেব।
মুখের উপর কথা বলার স্বভাব লিটনের। অন্য জায়গায় হলে সে মাসীকে মুখের মাপে জবাব দিয়ে দিত। ভাড়াঘরে অনেকেই উপস্থিত। বিশিষ্ট লোকজনের মাঝখানে তার কোনো উত্তর দেওয়া সাজে না। সেটা বরং খারাপ দেখায়।
বাধা না পেয়ে অষ্টমী বলল, বেলা অনেক হয়েছে, এবার আপনারা যেতে পারেন। আমাকে ভালো করে ঘর দুটো গুছিয়ে নিতে হবে।
-হ্যাঁ, তা তো ঠিক। অনেকক্ষণ পরে অষ্টমীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলল মৃত্যুঞ্জয়, ভালোভাবে থেকো সব। আমি সময় পেলে আবার এসে দেখা করে যাব। কপোতাক্ষ বললেন, হ্যাঁ, বেলা অনেক হল। এবার আমরাও উঠব। এরপরে গেলে হোটেলে আর ভাত পাওয়া যাবে না। তখন দুপুরবেলায় জল-মিষ্টি খেয়ে থাকতে হবে।