-বুঝতে পেরেছি। রঘুনাথ হাসল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা হলদিপোঁতা খাওড়ার কাছে চলে এল। অন্ধকার এর মধ্যে কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে চত্বর জুড়ে। এখানটায় দাঁড়ালে মিষ্টি বাতাস এসে গায়ের উপর আছড়ে পড়ে। পাকুড়তলায় আগের মতো আর আসা হয় না রঘুনাথের। সময় হয় না, ইচ্ছেও করে না। একরাশ অবসাদ মনের ভেতর বুনো হাওয়ার মতো ছটফটাচ্ছে। চুনারাম এই বয়সে মাঠের কাজে ঘাম ঝরাতে পারে না। তবু চেষ্টার কোনো তার জুটি নেই। বনবাদাড় থেকে সে সের পাঁচেক বুনো আলু তুলে এনেছে। পন্ডিত বিলের ধারে ধারে রসকর ডাঁটিগুলো বেশ চোখে লাগার মতো হয়েছে। ওগুলো কেটে আনলে দিন তিনেকের তরকারির চিন্তা আর করতে হবে না।
সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শক্তভাবে ধরে সূর্যাক্ষ বলল, রঘুরে, এবার আমি যাই। রাত হচ্ছে। ঘরে গিয়ে সব গোছগাছ করে পড়তে বসতে হবে। পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে। জানি না শেষপর্যন্ত কি হবে।
–কি আর হবে। যা হবে সব ভালোই হবে। রঘুনাথ বিজ্ঞের গলায় কথাগুলো বলে হাসল।
সূর্যাক্ষ রঘুনাথের দিকে অন্ধকারে ধার চাকুর দৃষ্টি মেলে তাকাল, তারপর অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রঘু, একটা সত্যি কথা বলবি?
রঘুনাথ চমকে উঠল, তোর কাচে কুনোদিন সত্যি বই মিথ্যে বলিনি।
–আমার দাদা এসেছিল? সূর্যাক্ষ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল।
ক্ষণিকের জন্য ইতস্তত করে রঘুনাথ ঢোঁক গিলল, হ্যাঁ, সে একদিন এসেছিল। তখন আমার বাপ মরেচে। মাথার ঠিক নেই। সে রাতে এল। তাকে দেখে আমি মাথার কুনো ঠিক রাখতে পারিনি। মুকে যা আসল তাই বললাম। সে বেচারি মন খারাপ করে চলে গেল। আমি তারে আর বাধা দিইনি।
–দাদাকে দেখে তোর কি মনে হল? দাদা ভালো আছে তো?
রঘুনাথ পাল্টা প্রশ্ন করল, কেনে তুর দাদা ঘর যায়নি? সে আমারে বলল-মাকে দেখতে এয়েছে। তাহলে কি ঘর যাওয়ার সে সুযোগ পায়নি?
-ঘরে গিয়েছিল সে কিন্তু ঘরে গিয়ে সে জেঠুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। জেঠুকে শাসিয়ে গিয়েছে। সেই থেকে জেই ভয়ে ভয়ে আছে। এখন আর আগের মতো চোটপাট করে না। নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। সূর্যাক্ষর কথায় রঘুনাথ বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। সে জানে–শয়তানের ছলনার অভাব হয় না। এই নাটকের কোনো প্রয়োজন আছে কি? রাগে রঘুনাথের সারা শরীর উথাল-পাতাল করে উঠল। এ প্রসঙ্গে তার আর কথা বলার কোনো ইচ্ছে হল না।
বাঁধের নিচ থেকে ভেসে আসছে ভূঁইলতা ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ। সবুজ পাতায় ঢাকা লতানে গাছগুলো মাটিকে মায়ের মতো ভালোবেসে তার কোলেই মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। অপুর্ব গোলাপি রঙের থোকা থোকা ফুলগুলোয় সারাদিন মৌমাছির দল উড়ে বেড়ায় মধু সংগ্রহের জন্য। পাঁচ বছর আগেও এই গাছগুলোর বাড়বাড়ন্ত দশা ছিল না, বড়ো বানের পর থেকে এরা ভূমি জুড়ে বিস্তার করেছে আধিপত্য।
সূর্যাক্ষ চলে যাবার পর বিষয় ছেয়ে ধরে রঘুনাথকে। তবু ঘরে ফিরে যেতে তার ইচ্ছে করে না। কাকার কাছে গেলে নানা ধরনের গল্প শুনতে পাবে সে। এককালের গা কাঁপানো মানুষটা আজ গাঁয়ের মধ্যে অথর্ব হয়ে পড়ে আছে। এখন আর তার সেই টাকার জোর নেই। লালগোলায় গত মাসে যা কামিয়ে ছিল তার সবটাই কেড়ে নিয়েছে সেদিন গভীর রাতে। সেই থেকে মানুষটার ঝিমিয়ে আছে সংগত কারণে। টাকা না থাকলে এখন আর কিছু হয় না।
নূপুরটা কমাসেই চোখে লাগার মতো হয়ে উঠেছে। শাপলাফুলের চেয়েও সুন্দর তার গায়ের রঙ। নাক চোখ মুখ ভালো। গায়ের লাবণ্য পণ্ডিত বিলের রস কচুর পাতাগুলোর চেয়েও ঝকঝকে সুন্দর। একমাথা ঘনচুল পিঠ ছাপিয়ে কোমরের কাছে কিংকং খেলে। নূপুরের ভরন্ত শরীর খলবলানো কইমাছের মতো সুন্দর। তাকে যে দেখবে, পছন্দ তার হবেই।
দিন সাতেক আগে মাটিয়ারি থেকে তাকে দেখবার জন্য লোক এসেছিল তিনজন। চুনারাম তাদের পাকুড়তলা থেকে পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। মা মরা নাতনিটার উপর তার টানও কম নেই।
অতিথির দেখাশোনার কাজটা দুর্গামণি সব এক হাতেই করল। নূপুরকে দেখে পছন্দ করে গিয়েছে মাটিয়ারির লোকেরা। ছেলে পড়াশোনা জানে। হাসপাতালের কোম্পান্ডার। ফরিদপুর-পাঁচপোতা এলাকায় ধাওড়াদের অমন শিক্ষিত ছেলে আর দুটি নেই।
পাত্রপক্ষ সুন্দরী মেয়ে খুজছিল, পেয়েও গেছে। কিন্তু চুনারাম সলজ্জ গলায় নিজেদের অসহায়ত্বের গল্পটি বলে দিল সংক্ষেপে, তা বুঝলে বাপু, আমাদেরও কুনো অসুবিধা নেই। এত করে বলচো যখন, তখুন একবার পাঁচপোতায় যাবই। তবে শুভ কাজ কবে নাগাদ হবে আগাম তা বলতে অক্ষম। আসলে হাতে এখুন নগদ পয়সা নেই। যা ছিল বানবন্যায় সব খেয়ে নিল। এখন ঠনঠনানো ফাঁকা ঘি-শিশির মতো আমরা বেঁচে আছি গো! শিশি আচে অথচ ঘি নাই। টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যাই হবে না ওরা বলে গেল। মানুষ হিসাবে পাত্রপক্ষের ওরা খারাপ নয়। চুনারাম-মুনিরাম দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নূপুরের বিয়ে ঘরটা ওখানেই হবে। একটু সুখ পাক মেয়েটা। অল্পবয়স থেকে দায়িত্ব নিয়ে কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। ওর মুখে হাসি ফুটাতে চায় সবাই। রঘুনাথ জোর দিয়ে বলেছে, আমার বুনের বিয়ে মাটিয়ারিতেই হবে। আমি নিজে ফুরসত মতো ফরিদপুর-পাঁচপোতা যাব। সব দেখে-শুনে আসব। তারপর তুমরা গিয়ে পাকা কথা বলে এসো। বুনের বিয়ে বলে কথা। হড়বড়ানোর কোনো দরকার নেই। যা হবে দেখে-শুনে হবে। লাখ কথার এক কথা। চুনারাম ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল রঘুনাথকে।