কটা মাস কিভাবে যে কেটে গিয়েছে সেটা টের পায়নি লুলারাম। পেটের দায়ে তখন তার কুকুর পাগল অবস্থা। ধাবার হোটেলে থালা-বাসন ধোওয়া থেকে শুরু করে বাজারে ঝাড় দেওয়া কোনো কাজ সে বাদ রাখেনি। টাকা এল, ভাত এল কিন্তু মন থেকে গেল হলদিপোঁতায়। হলদিপোঁতাই মনটাকে ঘুড়ির মতো ওড়াল না। পারল না, হেরে গেল সে।
আঁধার নামলে পণ্ডিত বিলের জলপাখিরা নজরে পড়ে না। শুধু দুরের ঝোপঝাড়ে জোনাকির চোখ পিটপিটিয়ে জ্বলতে থাকে মায়ায় ভরা আবহ তৈরি করে। নরম আলোয় চোখ সয়ে যায় রঘুনাথের। ভালো লাগার রেশটা ঈষৎ ঠাণ্ডা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। মাথার উপর দিয়ে গোটা চারেক চামচিকি স্বজাতীয় চিৎকার করতে করতে উড়ে গেলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রঘুনাথ। ঝিঁঝি পোকার টানা ডাক ছাপিয়ে সাইকেলে ঠুনটুন শব্দ তার কানে এসে বেঁধে।
সন্ধের পর ফাঁকা হয়ে যায় বাধ। শুধু মোকামপাড়ার কুকুরগুলো তেঁতুলতলা থেকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসে চক্কর কেটে হাওয়া খেয়ে চলে যায়। ওদের গলায় কোনো শব্দ নেই, সব যেন বোবা।
ঠুনঠুনানো সাইকেলটা রঘুনাথের পেছনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। এ সময় সুর্যাকে দেখতে পাবে ভাবেনি রঘুনাথ। দেখা মাত্র তার শরীরে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। কতদিন সূর্যাক্ষর সঙ্গে দেখা হয়নি তার। নীলাক্ষবাবুর প্রতি অভিমানে সূর্যাকে ভুল বুঝেছিল সে। এমন কি রুদ্রাক্ষের সঙ্গেও তার ব্যবহারটা শোভন হয় নি আদৌ। সেদিন রুদ্রাক্ষ চলে যাওয়ার পর অনুশোচনায় পুড়েছে রঘুনাথ। বাপের দোষ ত্রুটি ছেলে কেন ঘাড়ে বইবে? যার পাপ তাকেই বইতে হয়। নীলার সঙ্গে হিসাব বুঝে নেবে রঘুনাথ। দিন ফুরিয়ে যায় নি, এখনও সামনে অনেকদিন পড়ে আছে।
সুর্যাক্ষ সাইকেল থেকে নামল। তার ক্যারিয়ারের পেছনে লটবহর বাধা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, কালই দেবগ্রামে চলে যাব। ওখানকার হাইস্কুলে সিট পড়েছে। দ্বীপীও আমার সঙ্গে যাবে। আমরা ওখানে দিন পনের ঘরভাড়া করে থাকব। রঘুনাথ নীরবে সব শুনল। পড়াশোনা নিয়ে তার এখন আর কোনো আগ্রহ নেই। তবে সূর্যাক্ষর সব ব্যাপারে তার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। দ্বীপীর মুখটা মনে পড়তেই মুখ ফসকে সে বলে ফেলল, হ্যাঁ রে, সুর্য-দ্বীপী কেমুন আচে রে।
তার কথা বাদ দে, সে পড়ে পড়ে পাগল। সূর্যাক্ষ হাসি-মুখ করে বলল।
–অনেকদিন তোদের গাঁয়ে যাওয়া হয়নি।
–আজই চল। কাল তো চলে যাব। আবার সেই কবে দেখা হবে। সূর্যাক্ষর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।
রঘুনাথ বলল, না রে, আজ আর যাওয়া হবে নি। কি করে যাব বলত? বাপ মারা যাওয়ার পর মা ঘরে একা থাকতে ভয় পায়।
-কেন তোর দাদু থাকে না?
–সে তো থেকেও না থাকার মতন।
তার মানে? সূর্যাক্ষর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। রঘুনাথ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, বুড়া হয়েছে, তার আর কতটুকুই বা ক্ষেমতা। বিছানা নিলে নাক ডাকা শুরু। দশ ডাকেও দায়ে-অদায়ে সাড় আসে
-ওঃ, এই কথা। সূর্যাক্ষ ঠোঁট টিপে হাসল।
কিছুটা আসার পর রঘুনাথ হাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল। ধোঁয়া উগলিয়ে বলল, তোকে আর দিলাম না। বিড়ি খেলে মুখ দিয়ে বদঘেরান বেরুবে। তোর মা টের পেয়ে যাবে।
সূর্যাক্ষ রঘুনাথের ব্যবহারে ভীষণ অবাক হল, সে আর তার সেই বিস্ময়বোধ নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে পারল না, খোঁচা দেওয়া গলায় বলল, রঘু রে, তুই এত বদলে গেলি কিভাবে?
-কেনে, কি হয়েছে?
–কি হয়নি বল? তুই বিড়ি ধরালি অথচ আমাকে একবার যাচলি না।
–তোরা বাবুঘরের ছেলে। বিড়ি খেলে জাত যাবে।
এসব বুলি কি বিদুর কাকার কাছ থেকে শিখেছিস? সূর্যাক্ষ সহজ হতে পারছিল না, জোরে নিবাস ছেড়ে সে রঘুনাথের দিকে তাকাল। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বলল, আমি বাবুঘরের ছেলে ঠিকই কিন্তু তুই তো আমার বন্ধু। তোর কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি।
-রাগ করিস নে, ভুল হয়ে গেছে। মুখ মানুষের ভুল তো হামেশাই হয়। রঘুনাথ ডিবা থেকে বিড়ি বের করে সূর্যাকে দিল।
দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাল সুর্যা। দুটান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে রঘুনাথের দিকে তাকাল, আঃ, শান্তি। পরীক্ষার আগে বিড়ি না খেলে পড়া মনে থাকবে না। আচ্ছা বলতো, বিড়িকে ভদ্রলোকেরা কি বলে?
রঘুনাথ কথাটা জানত কিন্তু মনে করতে পারল না। সূর্যাক্ষ গলার স্বর বদলে হাসতে হাসতে বলল, বিড়ি হলে গিয়ে ইন্ডিয়ান খাকি, মাজায় দড়ি। মুখে লাল টুপি। বিড়ি হল–মেহেনতী মানুষের ঐক্যের প্রতীক। বুঝলি?
রঘুনাথ হাঁ করে শুনছিল, না বুঝতে পেরে বলল, তোর কথার মানে বোঝা যায় না। ওসব হেঁয়ালি কথা শিকেয় তুলে রাখ তো। কাল কখন যাবি? আমার কি তোর সাথে যাওয়ার দরকার আচে?
সূর্যাক্ষ ঘাড় নাড়ল, কাল বাবা আমার সঙ্গে যাবে। দ্বীপীর বাবা-মাও যাবে।
আমরা বিডিও অফিসের সামনে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। পাঁচজনে মিলে থাকব। আমাদের মধ্যে দ্বীপই একমাত্র মেয়ে।
-ওর দিদিগুলান তো ওর সাথে যেতে পারত।
-তা পারত। কিন্তু ওদের যাওয়ার কোনো দরকার নেই। লিটনের মাসী যাচ্ছে আমাদের। সাথে। মাসী আমাদের রান্না বান্নার কাজটা করে দেবে।
-কোন লিটন। রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করল।
সূর্যাক্ষ কপালে ভাঁজ ফেলে অবাক গলায় বলল, লিটনকে চিনিস না? ইল পাড়ায় থাকে। আরে, ওর বাবার ইটালি সেলুন আহে কালীগঞ্জ বাজারে।