মনের দুঃখে চুনারাম বাঁশি বাজাত বুড়িগাভের ধারে ধারে। তার সেই বাঁশির সুর ছাড়িয়ে যেত আখখেতে। আখখেত ছাড়িয়ে সুর ছুটে যেত কমলাবেড়িয়া, সুজাপুর, নারাণপুর। এখন আর বুড়ো গালে ফুঁ ধরে না চুনারামের।
রঘুনাথকে সে মন দিয়ে বাঁশিটা শিখিয়েছিল। বাঁশিকে ভালোবাসত ছেলেটা। সারাদিন বনবাদাড়ে টো-টো করে বাঁশি হাতে ঘুরত। কমলা মুখে হাসি ভরিয়ে বলত, তোমার বাঁশি কথা বলে গো! কত সোন্দর সুর তোমার ফুঁয়ে ফুঁয়ে।
কমলার হাসির মতো বাঁশিও মুগ্ধ করত রঘুনাথকে। দুর্গামণি সতর্ক করে বলত, দিনের বেলায় বাঁশি বাজাবিনে বাপ। অধর্ম হয়।
সুরে আবার কিসের অধর্ম? এ জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর পেত না রঘুনাথ। চুনারাম হাসত, বাঁশিকে ভালো না বাসলে সে তুরে সুর দিবে নি। সুর হল মেয়ে মানুষের মন গো! যদি সে বুঝতে পারে কেউ তারে অবহেলা করছে তাহলে সে সাতজন্মেও ধরা দিবেনি দাদুভাই।
পলাশ গাছের কুঁড়িগুলোর দিকে অকিয়ে কেমন উদাস হয়ে গেল রঘুনাথ। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর ভাসাল পণ্ডিত বিলের জলের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে একমনে বেজে চলল বাঁশি। চোয়াল আর গালের কাটা শক্ত হয়ে উঠছিল রঘুনাথের। হঠাৎ-ই বলি থেমে গেল তার। কাকার কথা মনে পড়ল হঠাৎ। এই পলাশ গাহের কাছে তুলারামকে কারা যেন পিটিয়েছিল বেধড়ক। শুধু মার নয়, হাত-পা দুটোই ভেঙে দেয় ওরা। সারারাত শীতল ছোঁয়ায় কোনোমতে বেঁচেছিল সুপারাম। সেদিন সে আত্মগোপন পর্ব শেষ করে লালগোলা থেকে বাড়ি ফিরছিল। তখন রাত অনেক। সঙ্গে টাকাপয়সা, মালপত্তর। সব কেড়ে নিল গভীর রাতের ছিনতাইবাজরা। ওদের মুখ ঢাকা ছিল গামছায় ফলে লুলারাম দলের কাউকেই চিনতে পারেনি। তাহলে কি দলটা জানত লুলারাম ফিরছে।
আশেপাশের গ্রামে স্কুলারামের শত্রর কোনো অভাব ছিল না। স্বভাবদোষে সে সবার চোখের বালি। সবাই আড়ালে ফুসত কিন্তু মুখের উপর কেউ কিছু বলত না। আসলে বলার ক্ষমতা ছিল না ওদের। অনেকেই তার ডাকাত দলের খবরাখবর রাখত। সুলারামের হিংস্রতা অনেকেই জেনে গিয়েছিল অল্পদিনে। পরকে জ্বালালে নিজের জ্বলন অনিবার্য। সেদিন লুলারাম ভেবেছিল রাতের আঁধারে চুপি চুপি সে গ্রামে ঢুকে যাবে। সকাল হলে সবাই তাকে দেখলে কোনো ক্ষতি নেই। এটা সেটা কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দিলেই হল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধি করে আর এক।
শেষপর্যন্ত গোরুর পাল খেদাতে নিয়ে যাওয়া রাখালগুলো অচৈতন্য অবস্থায় পলাশতলায় পড়ে থাকতে দেখে পুলারামকে। তাদেরই একজন মাথায় গামছা বেঁধে পাঁচন নিয়ে দৌড়ায়। গায়ে খবর দেয়। খবর পায় রঘুনাথ। দলবল নিয়ে সে পড়ি মড়ি করে ছুটে যায় শিমূল গাছটার কাছে। তারপর ধীরে ধীরে সব খোলসা হয়। সর্বস্ব হারিয়ে লুলারাম চুল চেপে ধরে কোকাচ্ছিল। হাত-পা ভাঙা নড়াচড়ার তার ক্ষমতা নেই।
চুনারাম তার শোচনীয় অবস্থা দেখে বলল, এ ভাঙা হাড় হাড়জোড় গাছের পাতায় ভালো হবেনি। এরে ঝটপট হাসপাতালে নিয়ে যাও। নাহলে এরে বাঁচানো যাবেনি। কথা সত্যি। সদর থেকে হাত-পায়ে প্লাস্টার করে, ওজন বাড়িয়ে ফিরে এসেছে লুলারাম। এখন সে নড়তে-চড়তে পারেনা। রঘুনাথ গিয়ে মাঝেসাঝে তাকে দেখে আসে। লুলারাম তখন বিছানায় শুয়ে নাকি সুরে কাঁদে। রঘুনাথকে বলে, হরিনাথপুরের সার দোকান থিকে বিষ এনে দে বাপ, খেয়ে মরি। এ জেবন আর টানতে ভালো লাগছে না।
কখনও সে ফোঁপায়, অনুশোচনায় ডুকরে ওঠে, কাতর হয়ে বলে, দাদার কাছে লিয়ে চল। তার মতুন মানুষ হয় না। সে আগে চলে গেল। আমি এখুন বসে বসে ডাল ভানচি।
গাঁয়ের কম বেশি সবাই এসে লুলারামকে দেখে গিয়েছে। ভূষণী বুড়ি এসেছিল সবার শেষে। সে এসে দগদগে ঘায়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। হাসতে হাসতে বাণ মারল, হারে বাপ, সবাই এলো, ঝারি কি এসেছিল?
বুড়িটা কি বলতে চায়? বাজিয়ে দেখছে নাকি? নাকি পরখ করতে চায় এখনও টান আছে নাকি? লুলারাম ভূষণীবুড়ির প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। ঝারি তার সুখ নিয়ে সরে গেছে। মুঠো মুঠো স্মৃতি আর দুঃখ দিয়ে গিয়েছে লুলারামকে। সেই গা-চিমটান দুঃখের কথা সে ভুলবে কিভাবে? তার অত মনের জোর নেই। তার মন তো পলকা বাঁশের ঠেক।
প্রায়ই শুরাম শুয়ে শুয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে। সে তখন খুব যত্ন সহকারে কারির মুখটা দেখতে চায়। তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে ঝারির অদৃশ্য চাহনি ছিল। যার উপেক্ষাই তার কাল হল। ওই অপমানের ফাঁদ ছিঁড়ে বেরতে পারল না সে।
মনে মনে জ্বলছিল। শুরু হয়েছিল নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই সব সময় ধরে। ভিকনাথকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিত যে, শুধু ঝারির জন্য পারল না। ভিকনাথ সরে গেলেও তার সমস্যার সমাধান হত না। ঝারির হয়ত শরীর পেত কিন্তু মন পেত না। সোনার মন না পেলে পচা কুমড়োর এই দেহ নিয়ে কি লাভ। সে ভালোবাসার কাঙাল। কেউ তাকে ভিকে দিল না। ভেবেছিল-ঝারি তাকে ছায়া দেবে। মিথ্যে, সব মিথ্যে। ঝারি এখন কাঁটার ঝোপে ফুটে থাকা ফুল। কাছে যাওয়া যায় না, ছুঁয়ে দেখা তো দুরের কথা।
নূপুর আর নোলকের মুখ চেয়ে আঁধার রাতে ফিরে এসেছিল লুলারাম। বুড়িগাঙের পাড়ে বসে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। হলদিপোঁতায় কার জন্য থাকবে সে? ঢিলি ছিল, সেও আজ শূন্য। ঝারি তো থেকেও নেই। মনের দুঃখে হাঁটতে হাঁটতে লুলারাম পৌঁছে গেল দেবগ্রাম স্টেশানে। সেখান থেকে আপ লালগোলা ধরে একেবারে লালগোলায়।