টলমল পায়ে বাথরুম থেকে ফিরে এল অবনী। তার সঙ্গে সুবীর। সরস্বতী পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন বুঝতে গো?
ভয়ের রেণুগুলো এখন অবনীর দুচোখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, মান হেসে সে কোনোমতে বলল, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এক ঘণ্টা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে ঢোঁড়া।
-ঢোঁড়া হোক আর হেলে হোক সাপ তো সাপই। সরস্বতী কটাক্ষর চোখে তাকাল।
অবনী আশাহত হল। এই সময় সে সমবেদনা আশা করেছিল। সরস্বতীর মনমেজাজ বোঝ দায়। ওর জোয়ার-ভাটা খেলা মন। বোঝা যায় না। বিরক্তিতে মুখ নামিয়ে নিল অবনী।
অবনীর দুর্বলতায় পর হয়ে ওঠে সরস্বতীর ঠোঁট, স্থান কাল পাত্র ভুলে বিরক্তির সঙ্গে সে বলল, পথ হাঁটার সময় কি চোখ কপালে তুলে হাঁটে। রাস্তাঘাট দেখে শুনে হাঁটতে হয় জানো না বুঝি? আজ যদি টোড়া না হয়ে খরিস হত তাহলে?
–চলে যেতাম। ভালো হত। কাটা ঘুড়ির মতো লাট খাওয়া গলায় বলল অবনী।
-তুমি তো চলে যেতে, আমাদের কি হত? সরস্বতী ঝাঁঝিয়ে উঠল।
আঃ, থামবে বৌদি। এটা হাসপাতাল, ঘর নয়। ডলি দিদিমণি ধমক দিয়ে উঠলেন সরস্বতীকে। ধমক খেয়ে সরস্বতী কেমন নিরীহ চোখে তাকাল, দুদণ্ড তাকিয়ে থাকার পর ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল সে, ওর জন্য আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। ও আমার মরামুখ না দেখে শান্তি পাবে না। আপনারা জানেন না দিদি, ও কি ভয়ঙ্কর মানুষ। ওর মতো ঘরজ্বালানী পরভুলানী মানুষ খুব কম আছে।
-বৌদি, প্লিজ চুপ করো। ডলি দিদিমণির কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল উত্তেজনায়। শুভর অসহ্য লাগছিল এসব নাটক। চোয়ালে চোয়াল ঘষে সে চাপা অথচ গম্ভীরভাবে বলল, মা, চুপ করো। আর ভালো লাগছে না।
পাশের কোয়ার্টারের সুবীর জ্ঞান দিয়ে বলল, বৌদি, বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ নাও। এখন অশান্তি করলে লোক হাসবে। এমনিতে আমরা ছোট পোস্টে কাজ করি। কত লোকে কত কথা বলে তার জন্য।
একরকম চাপে পড়ে মুখে কুলুপ আঁটল সরস্বতী। অবনী আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো চেষ্টা করল না, টুলের উপর মুখ ঝুঁকিয়ে বসে থাকল চুপচাপ। ডলি দিদিমণি একবার মুখ তুলে দেওয়ালের পেণ্ডুলাম ঘড়িটার দিকে তাকালেন, সময় দেখে অবনীকে শুধোলেন, তোমার কি ঘুম ঘুম পাচ্ছে অবনীদা? ঘুম পেলে বলল। ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে হবে তাহলে।
অবনী না-সূচক ঘাড় নাড়তেই আশ্বস্ত হলেন তিনি। তারপর আপনমনে বললেন, ভগবানকে অনেক ধন্যবাদ ফাড়াটা অল্পের উপর দিয়ে গেল।
সুবীর ওভাদি দেখিয়ে বলল, ঢোড়াসাপে কামড়ালেও বিষ হয় দিদি। শনি-মঙ্গলবারে সব সাপেরই বিষ হয়। শুনেছি ঢোড়াসাপ কামড়ালে গোবর ছোঁয়া নিষেধ।
কেন? ডলি দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলেন কৌতূহলবশত।
সুবীর চোখ মটকে হাসল, বিষ কেন হয় জানেন না বুঝি? সেই যে অমৃত মন্থনের সময় ঢোঁড়া সাপ বিষ নিয়ে গিয়ে গোবরে লুকিয়ে রেখেছিল–সেই জন্য। পরে গিয়ে দেখে সব বিষ গোবরে মিশে গিয়েছে। আর কিছু করার নেই। সেদিন থেকে টোড়াসাপ বিষহীন বুঝলেন?
ডলি দিদিমণি হয়ত এই গল্পটা জানতেন তাই হালকা হেসে বললেন, রাতের বেলায় আর সাপের গল্প করে লাভ নেই। এবার অন্য কথা বলে।
সুবীর কথা হাতড়াচ্ছিল। শুভ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কাকু, বাবা কখন বাড়ি যাবে?
-দশটা না বাজলে যাওয়া উচিত হবে না। সুবীর জোর দিয়ে বলল।
সরস্বতীর অসহ্য লাগছিল, সে শুভর দিকেকটমট করে তাকাল,বসে থাকলে কি গা চুলকাচ্ছে? চুপচাপ থাক। ঘরে কি হাতি ঘোড়া বাঁধা আছে যে যাবার জন্য লাফাচ্ছিস? কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলেও শুভ আহত চোখে তাকাল। মায়ের ব্যবহার দিন দিন বিলি হয়ে যাচ্ছে। সবার সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষাটাই বুঝি ভুলতে বসেছে। কোনোরম তর্কের মধ্যে না গিয়ে শুভ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাচের ওপিঠে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। এখন পৃথিবী জুড়ে শুধু তরল অন্ধকার, আঁধার সমুদ্র।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পথে মরা চাঁদের ক্ষীণ জ্যোৎস্না বাসি সজনে ফুলের মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে মন খারাপের কোনো ভাইরাস বেঁচে ছিল না। বাড়ির কাছে পৌঁছে অবনী অন্ধকারকে শুনিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, যাক, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
.
৫৩.
বাঁধের ধারে একটাই পলাশগাছ। বেঁটে খাটো গাছটার গাম্ভীর্যই আলাদা। বকফুলের মতো কুডি এসেছে শাখা প্রশাখায়। শীত চলে যাবার পর রঘুনাথ এই গাছটার দিকে অবাক করা চোখে তাকায়। বালিকা থেকে কিশোরী হওয়ার সৌন্দর্য গাছটার সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে। আর কদিন পরে কনে বউয়ের মতো সেজে উঠবে পলাশরঙে। পাতা ঝরার দিন শেষ হচ্ছে দিনে দিনে।
অনেকদিন পরে বাঁশিটা চাল থেকে নিয়ে এসে রঘুনাথ বাঁধের ধারে পা ছড়িয়ে বসল। অনভ্যাসে অব্যবহারে ধুলো জমে গিয়েছে বাঁশির ছিদ্রে। অথচ এই বাঁশি তার কত সখের ছিল। চুনারাম ছাতার বাঁট কেটে শিক গরম করে বানিয়েছে এই বাঁশি। প্রতিটি ছিদ্র তৈরির সময় তার যত্নের শেষ ছিল না। পাশে বসে অবাক চোখে রঘুনাথ দেখেছিল সেসব।
যৌবনে শখের যাত্রায় নাম লিখিয়েছিল চুনারাম। ডাক আসলে ভিনগাঁয়ে যেত যাত্রা করতে নামমাত্র টাকায়। যাত্রাদলে থেকেই বাঁশিটা শিখেছিল চুনারাম। শখের যাত্রার দিন শেষ হয়ে গেল কলকাতার যাত্রার আগ্রাসী থাবায়। সব দিকে পিছিয়ে গেল গ্রামীণ যাত্রা।