তবু আশ্বস্ত হতে পারে না সরস্বতী। তার বুকের ব্যাঙ লাফানিটা বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর চোখের তারা কেঁপে উঠল। ব্যস্ত হয়ে সে বলল, মা, আমি যাচ্ছি। তুমি কাকুর সঙ্গে এসো। অনুমতির অপেক্ষা করল না সে। অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
ইঁদুরে গর্ত করে, সাপে তা ভোগ করে। চুনারামদাদুর কথাগুলো মনে পড়ল তার। এসময় রঘুনাথ তার পাশে থাকলে মনের সাহস বাড়ত। ওদের গাঁয়ে ভালো ওঝা আছে। সুফল ওঝার নাম দশ গ্রামের মানুষ জানে। সে নাকি সাপেকাটা মানুষ ঝাড়-ফুকে সরিয়ে তোলে। এমন অনেক গল্প সে নানান মানুষের মুখে শুনেছে। শোনা কথায় বিশ্বাস কি। যেসব কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরে সেসব কথায় বিশ্বাসের মাটি কতটা এ নিয়ে শুভর মনে বরাবরের সংশয় আছে। ওঝা গুণিনের উপর তার একেবারে আস্থা নেই। তবু অবনী বাধ্য করায় তাকে এসব শোনার জন্য।
এখনও কারেন্ট আসেনি হাসপাতালে। কথা চলছে মাস ছয়েকের মধ্যে সুইচ টিপলে আলো জ্বলবে। মাঠে মাঠে শাল খুঁটি পুঁতছে ঠিকেদারের লোক। দিন রাত খাম্বা পোঁতার কাজ চলছে। তিনটে হ্যারিকেনের আলোতে এত বড়ো হাসপাতালের কোণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার দূর হয় না। ম্যাড়মেড়ে অন্ধকার সাদা-কালোয় মিলেমিশে থাকা ভেড়ার লোমের মতো শুয়ে আছে আনাচে-কানাচে। শুভ হন্তদন্ত হয়ে টানা বারান্দা পেরিয়ে ও.টির ভেতর ঢুকে গেল। বন্যার পর হাসপাতালের চেহারাটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই। এখনও জলের গন্ধ প্রায়ই নাকে এসে লাগে। মাঝে মাঝে আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। তখনই গা গুলিয়ে ওঠে ডলি দিদিমণির। তার যুবতী রসালুর মতো শরীর পকমোড়া দিয়ে ওঠে ঘেন্নায়।
শুভ দেখল ওটি ফাঁকা। হাই-বেঞ্চে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। লাল আলো ছড়িয়ে। শুধু ডিউটিরুমে জনা চারেক মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছিল। সিস্টারদের চেয়ারটায় গা হেলান দিয়ে বসে আছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর পরনে পায়জামা, গায়ে সাদা হাফ-হাতা জামা, জামার উপরে গাঢ় নস্যি রঙের একটা হাফ-হাতা সোয়েটার।
ডলি দিদিমণি শুভকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, আয়।
-বাবা কোথায় পিসি? শুভর কণ্ঠস্বরে ব্যাকুলতা।
ডলি দিদিমণি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, অবনীদা বাথরুমে গিয়েছে। একা যায়নি, সঙ্গে তোর সুবীরকাকু গিয়েছে। তোদের কে খবর দিল?
–জয়কিষাণ কাকু কোয়ার্টারে গিয়েছিল। তার মুখে শুনলাম।
–তোর মা আসেনি?
–মা ঘর বন্ধ করে আসছে।
-শোন শুভ, অত চিন্তা করার কিছু নেই। তুই চুপচাপ বোস। ডলি দিদিমণি বসবার জন্য একটা কাঠের বাক্স দেখিয়ে দিলেন। শুভ বসল না, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মনে কত রকমের চিন্তা এসে ভিড় করছে। এই হাসপাতালে সে দেখেছিল হরিনাথপুরের একটা বউকে চোখের সামনে মরে যেতে। ঘুমন্ত অবস্থায় সাপে কামড়েছিল বউটাকে। একেবারে কাঁধের কাছে কামড়ে দেয় সাপটা। কামড়ে দিয়েই সাপটা ঢুকে যায় দেওয়ালের ফাঁকে। জ্বালাপোড়া করতেই ঘুম ভেঙে বউটা শুধু সাপের লেজটাকে দেখে। ভয়ে তার জিভ শুকিয়ে যাবার উপক্রম হয়। ঘরের লোক তাকে বাঁধন দিতে পারে না। কাঁধে কামড়ালে বাঁধন দেবে কোথায়? ফলে খাটিয়ায়। করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল তারা।
হাসপাতালে সব রকম চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না বউটাকে। শেষের দিকে কথা জড়িয়ে গিয়েছিল তার। সারা শরীর ভেঙে ঘুম ঘুম আচ্ছন্নতা। কেউ বুঝি জিভ টেনে ধরছিল ভেতরের দিকে। মুখের দুপাশে গ্যাজলা উঠিয়ে বউটা চিরকালের জন্য চোখ বুজল। এই দৃশ্য অনেক দিন আগের, তবু এখনও মনে পড়ে শুভর। সেদিনের সেই দৃশ্যটা আজ কেন মনে পড়ছে বারবার।
ডলি দিদিমণি অভয় দিয়ে বললেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যতদূর মনে হচ্ছে অবনীদাকে বিষাক্ত সাপে কামড়ায়নি। পায়জোনাল সাপের দাঁত খুব ঘুচলল। ওরা কামড়ালে মাংস তুলে নেয় না। শুধু ছোট ছোট ফুটো হয়। সেটাই মারাত্মক। অবনীদার বেলায় দেখলাম সবটাই উল্টো। ক্ষতস্থানে বেশ রক্ত দেখলাম। ডাক্তারবাবু এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, অবশেষে ডলি দিদিমণির বক্তব্যকে তিনি সমর্থন করলেন, চিন্তা করিস নে। দু-তিন ঘণ্টা অবজারভেশনে রেখে ছেড়ে দেব। শুধু একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। দেখবি তোর বাবা যেন ঘুমিয়ে না যায়। চেয়ারে হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, হাই তুলে বললেন, আমি এখন আসি সিস্টার। অ্যাবনরম্যাল কিছু দেখলে সুবীরকে কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবেন। আমি দশটা অবধি জেগে থাকব।
ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর শুভর মুখে রাত্রির যাবতীয় অন্ধকার বিছিয়ে গেল। আর তখনি চিৎকার করতে করতে আলুথালু শরীরে ডিউটিরুমে ঢুকে এল সরস্বতী। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করল, ও কোথায় গেল দিদিমণি, ভালো আছে তো?
সরস্বতীর চোখের জল হেমন্তের কুয়াশার চেয়েও ভারী হয়ে নেমে এল। ডলি দিদিমণি নিস্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বললেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি চুপচাপ বসো তো বৌদি। ডাক্তারবাবু সব দেখেছেন। উনি নিশ্চিন্ত হয়ে কোয়ার্টারে এই মাত্র ফিরে গেলেন।
তবু মনের দিক থেকে শান্ত হতে পারছিল না সরস্বতী, নিজেকে শান্ত করারসবরকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল সে। নাড়িকাঁপানো টানটা এই মুহূর্তে উন্মুক্ত হয়ে উঠল ভেজা মাটির বুক থেকে উঁকি দেওয়া অন্ধকারের মতো। ঝগড়াঝাটি, মানসিক টানাপোড়েন ভুলে সে অবনীর আরোগ্য কামনায় অস্থির হয়ে উঠল।