বলছিলাম কি, তুই কি আমার উপর খুব রেগে আছিস? আত্মসমর্পণের চোখে তাকাল শুভ।
আলতো হেসে মাধুরী মায়াবী স্বরে বলল, শুভ এইটুকু কথা বলার জন্য রাত মাথায় নিয়ে চলে এলি? তোর কি মাথায় ছিট আছে?
কথাগুলো খারাপ শুনতে লাগলেও খুব খারাপ লাগে না শুভর। অন্য কেউ এমন ঠেস দেওয়া কথা বললে সে খুব রেগে যেত। তাকে ছেড়ে কথা বলত না। দুচারটে কথা অবশ্যই শুনিয়ে ছেড়ে দিত। তার সঙ্গে মাধুরীর হিসাবটাই অন্য যা ক্লাসের অন্য কেউ টের পায় না।
হাওয়ায় পর্দা উড়ছিল জানলার, মাধুরী জানলার দিকে মুখ করে তাকিয়ে ছিল বাইরের দিকে, চাপ বাঁধা ঘন অন্ধকারের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছিল চোখের দৃষ্টি। মাধুরী আর কারোর কাছে হারবে না। শুভ তাকে রোজ রোজ হারিয়ে দেবে এমন হয় না। গলা চড়িয়ে সে বলল, ইস্কুল কবে খুলবে বলতে পারিস? ঘরে আর মন বসছে না।
শুভ ভেবে নিল, তারপর বলল, এখনও সবাই ঘরে ফিরে যায়নি। বন্যার ঘা কি সহজে কায় বল?
-জানি না। মাধুরী মুখ ফিরিয়ে নিল।
শুভ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, রাত হচ্ছে, এখন আমি যাই। কাল আবার তোর সাথে দেখা করে যাব।
-মা যে তোর জন্য টিফিন বানাতে রান্না ঘরে গিয়েছে।
–ওঃ, হো! আফসোস ভাসিয়ে দিল শুভ, ঠিক আছে, আর একটু অপেক্ষা করে যাই।
দুটো সাদা প্লেটে সিমাই নিয়ে ঘরে ঢুকলেন বনশ্রী। শুভর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোদের রাগ পড়েছে? দুজনেই চুপ করে থাকল, উত্তর দিল না কেউ।বড়োদের এই আদিখ্যেতা মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। ওদের সব কথাতে হয় উপদেশ না হয় তিরস্কারসহ খেচা। যুগটা যে পাটাচ্ছে তা ওঁরা বুঝতে চায় না। এরা সবাই বুঝি পিছিয়ে পড়া মানুষ।
মাধুরী বিরক্তি চেপে বলল, মা, তুমি যাবে?
-কেন আমি থাকলে তোদের কি অবিধে? আমি তো কারোর পাকা ধানে মই দিদিই না। গজগজ করতে করতে চলে গেলেন বনশ্রী।
দ্রুত সিমাই খেয়ে শুভ বলল, এবার আমি আসি।
-যাবি? সত্যি? নরম দৃষ্টি মেলে কাতর কবুতরের মত তাকাল মাধুরী। তারপর ঠোঁটে হাসি ভরিয়ে বলল, তোর হাতটা একটু ধরব?
-তুই কি পাগল হলি?
আহত হল মাধুরী, চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, হয়েছি। তাতে তোর কি?
-ঠিক আছে,নে। দুহাত পদ্মপাতার মতো মাধুরীর সামনে বিছিয়ে দিল শুভ। মাধুরী কি করবে বুঝতে পারল না। হাত দুটো মুঠো করে ধরে বুকের কাছে আনতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোদের ফেলে আমাদের এভাবে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি। আমার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। শুভ, তুই বল–আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস? বিশাস কর, তোর কথা ভেবে আমি করাত যে ঘুমাই নি। আচ্ছা, আমার কেন এমন হয় বলতো।
-তোর আবেগটা বেশি।
–ধুর, আবেগ নয়রে, আমার রক্তটাই অন্য!
-আমি এসব কিছু জানি না। শুভ ঘরের দিকে পা বাড়ালে মাধুরী আবার তার হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে, দাঁড়া। আমি এক্ষুনি আসছি।
মাধুরী এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেল। ফিরে এল টর্চ-লাইট হাতে নিয়ে। অবশেষে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, সাবধানে যাবি। আজ অনেক কথা বলার ছিল, বলা হল না। দেখি, চিঠি দিয়ে যদি জানাতে পারি। মাধুরীর কথাগুলো যেন উত্তরের বাতাস, কেঁপে গেল শুভ। টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে সে বলল, ভালো থাকিস, তুই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব-বুঝলি? ঘাড় নেড়ে অন্ধকারে শুকতারা হয়ে গেল মাধুরী।
.
৫২.
মনে খুশির হাজার ঢেউ। টর্চ জেলে পথ হাঁটছিল শুভ। সারাটা পথ মাধুরী তার সঙ্গে আছে। স্মৃতির জাবর কাটা আর শেষ হয় না।
ঘরে পৌঁছাতেই সরস্বতী বলল, এত দেরি করলি, আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল।
–আমি মাধুরীদের বাড়ি হয়ে এলাম।
ভালো করেছিস। মেয়েটা যাওয়ার সময় কেমন ভেজা-ভেজা মুখ করে চলে গেল। আমার ভালো লাগেনি। তখনই ভেবেছিলাম, তুই ঘরে আসলে ওর কাছে পাঠাব। সরস্বতী আশ্বস্ত চোখে তাকাল।
শুভ অবনীকে খুঁজছিল। ঘরে না দেখে তার মনে দানা বেঁধে উঠল সন্দেহ। বাবা আবার পদ্মর কাছে চলে গেল নাতো? কোনো বিশাস নেই মানুষটাকে। যে মানুষটা ভালোবাসায় অ, সে তো অন্ধকারেও পথ দেখতে পায়।
শুভ অবনীকে মন থেকে মুছে দিতে পারল না। টানা শাস নিয়ে থালো, মা, বাবা কোথায়?
-আমাকে কিছু বলে যায়নি। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়াল সরস্বতী। কিছু সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে।
জয়কিষাণ আজই দশটার বাসে সদর থেকে ফিরেছে। দুলারী বন্যার আগে হাসপাতালে ছিল না। প্রায়ই ছুটি নিয়ে কৃষ্ণনগরে চলে যায়। এই গ্রামে তার নাকি মন বসে না।
জয়কিষাণ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বারান্দায় দাঁড়াল, চিৎকার করে বলল, শুভ বেটা, এ শুভ বেটা বাইরে আয়। তোর বাপকে সাপে কেটেছে।
সাপ শব্দটায় একটা কিলবিলান, রুদ্ধশ্বাস ভয় কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। শুভ বাক্যহারা চোখে তাকাল। তার মুখের কথা হারিয়ে গেল, সে ভ্যালভেলিয়ে জয়কিষাণের মুখের দিকে হকচকিয়ে তাকাল। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি বেড়ে গেল শতগুণ।
-তোর মা কুথায়? জয়কিষাণের প্রশ্ন শেষ হল না, রান্নাঘর থেকে ঝড়ের বেগে বারান্দায় ছুটে এল সরস্বতী, দাদা, সে কোথায়? কিভাবে সাপে কাটল তাকে?
হাঁপাচ্ছিল সরস্বতী। জয়কিষাণ ঠাণ্ডা গলায় বলল, অত চিন্তা করার কিছু নেই। তোমরা আমার সাথে চল। ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এসেছেন। দাবাই ইনজেশন সব চলছে।