শুভর মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায়। বনশ্রী জিজ্ঞাসা করেন, কি ভাবছিস? শুভর কথায় সারল্য ধরা পড়ে, মনে হচ্ছে এখন না এলে ভালো হত। কষ্ট হজম করা আমার অভ্যাস আছে, কিন্তু কাউকে অকারণে কষ্ট দিতে মন চায় না।
-বাঃ, বেশ বললি তো? বাংলায় কত পেয়েছিলি? বনশ্রী তির্যক চোখে বিধলেন।
শুভ মনে মনে বিরক্ত হলেও যথাযথ ধীর-স্থির কণ্ঠে বলল, তমালবাবু এবারও আমাকে হায়েস্ট দিয়েছেন। ফিজিল-কেমিস্ত্রির চেয়েও বাংলা পড়তে আমার ভালো লাগে।
-তাহলে আর্টস নিয়ে পড়তে পারতি?
–আমার তো তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অমলকান্তি স্যার বললেন সায়েন্স নিতে।
-কী আশ্চর্য। নিজের ভবিষ্যৎ-এর কথা নিজে ভাববি তো? অন্যের মুখে ঝাল খেলে তোর কি ঝাল খাওয়া হয়ে গেল? বনশ্রীর চোখা চোখা প্রশ্নগুলো বিদ্ধ করছিল শুভকে।
সে মাথা সোজা করে বলল, সায়েন্স নিয়ে পাশ করলে তাড়াতাড়ি চাকরি পাওয়া যায়। হেডমাস্টারমশাই প্রেয়ারের সময় বলছিলেন এখন সায়েলের বাজার।
-ওঃ, ঠিক আছে। বনশ্রী খুশি হলেন না জবাব শুনে।
শুভরও ভালো লাগছিল না, সে ঘাড় তুলে বলল, আমি এবার আসি।
–আসি মানে! তোকে ছেড়ে দিলে আজ সারারাত ও আমার সঙ্গে বাড়া করবে। তুই ওর সাথে একটু দেখা করে যা।
-আমি তো দেখা করতেই এসেছিলাম। শুভ নিঃশ্বাস ছাড়ল।
বনশ্রী কিছু বলার আগেই খাট থেকে নেমে এল মাধুরী। তার টুলটুলু চোখ। যেন ঘুম থেকে উঠে এল। চুল বাঁধা নেই, কাঁধের উপর ছড়ানো। লম্বা চুলগুলো রাত হয়ে শুয়ে আছে। বনশ্রী যাওয়ার আগে বললেন, তোরা বসে গল্প কর। আমি দুধ দিয়ে সিমাই করে আনি। শুভ কতদিন পরে এসেছে বল তো?
অন্ধকারেরও চোখ ধাঁধানো রূপ থাকে। মাধুরীর ফোলা গালে তখনও শেষ বিকেলের রোদের মতো লেপটে আছে অভিমান। সে ভারিক্কী গলায় শুধালো, তুই কেন এসেছিস?
-খুব মন খারাপ করছিল, তাই। শুভ কিছু লুকাল না।
–আমার জন্য তোর মন খারাপ করছে-হাসালি।
–এতে হাসির কি হল? কারোর জন্য কারোর বুঝি মন খারাপ করতে নেই?
মাধুরী বিস্ময়ে ঠোঁট কামড়াল, তোর মন বলে কোনো বস্তু আছে? আমার তো মনে হয়। তুই পাথর।
দ্যাখ, ঝগড়া করবি না, আমি ঝগড়া করতে আসিনি। শুভ বোঝাতে চাইল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল মাধুরী, আর ন্যাকা সাজিস না। তোর মনের কথা আমি জেনে গিয়েচি।
কথা শুনে চোখের তারা কেঁপে উঠল শুভর। মাধুরী কি জেনেছে? শুভ যে প্রথম থেকে মাধুরীর উপর দুর্বল–এটা ক্লাসের সবাই জানে। এই নিয়ে অনেকে আড়ালে হাসাহাসি করে। শুভ মুখ বুজে থাকে। অনেক মানুষ হাওয়া অফিসের মতো আগাম সব কিছু জেনে যায়।
শুভর চোখ চকচক করছিল হ্যারিকেনের আলোয়, তুই এত মুখ ভার করে থাকলে আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি যাচ্ছি।
ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে শুভ পা বাড়াতে গেল। মাধুরী এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরে, কপট রাগে গালে টোল ফেলে বলে, যা দেখি, তোর সাহস কত! হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে শুভকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল মাধুরী, চাপা গলায় বলল, অনেকক্ষণ ধরে তোর অত্যাচার সহ্য করছি, আর কিন্তু করব না। চুপচাপ ভালছেলের মতো চেয়ারটায় বস। তোর কি কি প্রশ্ন আছে আমাকে বল।
শুভ বলল, আমি পরীক্ষা নিতে আসিনি। আমি এসেছিলাম তোকে দেখতে।
-ভালো কথা, চোখ ভরে দেখে নে। ছাপা ফ্রকটা টেনেটুনে, ডল পুতুলের মতো হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল মাধুরী, নে, এবার যত খুশি দেখে নে। তুই ভাবছিস আমি মরে যাব। আমি অত সহজে মরব না। তুই মিলিয়ে নিস আমার কথাটা।
–আজ তোর কি হয়েছে বল তো, সেই সকাল থেকে শুধু মরা-মরা করছিস!
শুভর কথায় ফণা তোলা সাপের মতো মাথা নামিয়ে নিল মাধুরী। শুভ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না, কি বলতে কি বলে ফেলেছি। সেই থেকে অনুশোচনায় জুলছি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। মাধুরী অনড় গলায় বলল, ক্ষমা তো তোর কাছে আমারই চাওয়া উচিত। আমরা স্বার্থপরের মতো তাদের ফেলে চলে গেলাম। কাজটা ভালো হয়নি। এই নিয়ে আমার আফসোসের শেষ নেই। মাধুরী এগিয়ে এল শুভর কাছে, তর্জনী দিয়ে পুতনী তুলে বলল, আমার দিকে তাকা। আমাকে কি তোর ভয়াল, ভীষণ বন্যা বলে মনে হয়?
শুভ চুপ করে থাকল।
অসহ্য লাগতে মাধুরী বলল, চুপ করে থাকবি না। উত্তর দে।
মাধুরী জোর করতেই শুভ আধভাঙা স্বরে বলল, আকাশ আছে বলে তো চাঁদ-সূর্য খেলতে পারে। আকাশ হল তারা-নাদের ঘরবাড়ি। আমার মনে হয় এক একটা ভালো মানুষ এক একটা তারা। তবে তোকে আমি তারা ভাবি না। দুই
আমি কি তাহলে? বল, তোকে বলতেই হবে। মাধুরী একরকম চেঁচিয়ে উঠল।
শুভ ঝকঝকে গলায় বলল, তুই তো আকাশের চাঁদ। তাই সবাই তোকে হা করে দেখতে থাকে।
-কেউ দেখলে আমি কি করব?
–তুই অত সাজবি না। ব্যস, মিটে গেল ঝামেলা।
-অত সহজ নয় রে। আবার ঠোঁট ওন্টাল মাধুরী, আমি এখন বড়ো হচ্ছি। মা কি বলে জানিস? স্কুল যাবার সময় আমি যেন মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটি। শুভ হাসল, তাহলে তো ঠোকুর খাবি!
মেয়েরা তো ঠোক্কর খেতে খেতে বড়ো হয়। মাধুরী কেমন নিরীহ চোখে তাকাল। বাইরে একটা নেড়িকুকুর বিশ্রি গলায় ডাকছিল। টানা সেই স্বরটা অবিকল শ্মশান কুকুরগুলোর মতো। যা শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
মাধুরী ভয় পেয়ে বলল, তোকে তো আবার কোয়ার্টারে ফিরতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।