এ সময় বাঁধের ধারটা বেশ জমজমাট, ধুলো মেখে ঝোপঝাড়গুলো বেশ স্ফুর্তিবাজ, সেই সঙ্গে রোদের সাথে মালাম লড়ায় ব্যস্ত। চাপড়াঘাসের শেষ যেখানে সেখান থেকে শুরু হয়েছে টলটলে জল, এখন স্রোতহীন বুড়িগাঙ লম্বা-দিঘির গতর নিয়ে চিতিয়ে-কেতিয়ে আকাশ দেখে হরদম। অথচ বর্ষার মাঝামাঝি এর দাপট, চোটপাট, গতি-গর্জন দেখলে শুকিয়ে যায় কলজে, ভয়-তরাসে বুকটা গেছো ব্যাঙের মতো লাফায়। এই বুড়িগাঙ তখন দশ গুণ চেহারা নিয়ে ভাঙতে আসে ঘর, শুধু ঘর ভাঙে না জলের তোড়ে কাঁদিয়ে ছাড়ে চারপাশ। এখন গো-বেচারা, বুঝি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।
বুনো পাড়ার মুড়োতে ঝাঁকড়া অশোত্থ গাছের ছায়া। গেল বছর এখানে একটা সবজে রঙের টিউকল বসিয়েছে সরকার। তার আগে বেশির ভাগ বুনো পাড়ার লোকে জল খেত বুড়িগাঙের, যাদের ভাগ্য ভালো তারা যেত গাঁয়ের বারোয়ারি কুয়োটায় জল আনতে। দড়ি-বালতি সেখানে ধপাস করে ফেলে দিয়ে জল তোল। খ্যাচাকলের ঘটাং ঘটাং শব্দ, পেশির টানে জলভরা বালতি উঠবে উপরপানে, কষ্ট বলতে চরম কষ্ট। তবু দুর্গামণি যেত মাটির কলসী নিয়ে, লাইন দিয়ে জল আনত। পাড়ার বউ-ঝিউড়িদের টীকা-টিপ্পনী কানে আসত তার। ভালো লাগত না পরনিন্দা পরচর্চা শুনতে। বেশি বয়সে মা-হওয়ার সুখ যেমন জ্বালাও কম নয়। দু-চার শব্দ কানে বোলতার হুল ঢোকায়। তা-ও নেই নেই করে দেখতে-দেখতে রঘুর বয়স ষোল ছাড়াল। চুনারাম সেবার কথায় কথায় বলছিল, আমাদের ঘরের রঘুটা তো গায়ে-গতরে হয়েছে, এবার ওর বিয়ে-থা দিয়ে লেটা চুকিয়ে দাও। আমারও বয়স হচ্ছে, কবে ফুট করে চলে যাব শিবের বাপও টের পাবে না। যেতে তো হবেই, তার আগে মনের বাসনা মিটিয়ে যাই না হলে যে সঙ্গে গিয়েও সুখ পাব না।
দুর্গামণি বুড়োর কথা শুনে অবাক হয়নি, এ বংশের এমনই ধারা। এর মধ্যেই ছেলেটার জন্য মেয়েঘর থেকে লোক আসতে শুরু করেছে। রঘুর এতে ঘোর আপত্তি। বিয়ে মানে বে মতলব জড়িয়ে যাওয়া। হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়া। রঘু চোটপাট করেছে দমতক। তাতেও কাজ হয়নি দেখে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে দুদিন। শেষে আবার গুয়ারাম তাকে খুঁজে আনল দেবগ্রাম স্টেশন থেকে।
সকাল থেকে ঘরে আজ আনাজ বাড়ন্ত। শাক-লতায় মন ভরতে চায় না দাদু-নাতি কারোরই। জলখাবারের মুড়ির বাটি দিতে এসে দুর্গামণি মনে করিয়ে দিয়েছিল কথাগুলো, আজ কিন্তু ভাতের সাথে তরকারি দিতে পারব না। ঘরে কিছু নেই। যা ছিল সব সাঁঝবেলায় করে ফেলেছি।
-কেনে কচুর ডাঁটি, সেগুলো কি সব ফুরিয়ে গেল? চুনারামের জিজ্ঞাসায় দুর্গামণি ঘাবড়ায়নি, না, ফুরোবে কেনে? কিন্তু হররোজ কি কচু মুখে সুয়োদ লাগে? তাছাড়া বুনো কচু কুটকুটায়। তেঁতুল দিয়ে ঠিক করে জব্দ না করলে ওরা দাঁত বসাতে ছাড়ে না।
–তাহলে কি করতে হবে? চুনারামের ফাপড়ে পড়া চোখ-মুখ।
দুর্গামণি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, তাহলে যাও না কেনে বামুন পুকুরে। ওদিকে কাঠ-কুড়োতে গিয়ে দেখেছিলাম নালফুলে ভরে আছে পুকুরের জল। আজ কচুডাঁটির বদলে নালফুলের ডাঁটা-চচ্চড়ি রেঁধে দেব।
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। গুয়ারাম যতদিন ঘর না ধরছে ততদিন এ সংসারের দায়-দায়িত্ব তো সব ওর। ছেলেটার সব কাজে হড়বড়ানো। দু-চার দিন বৃষ্টি দেখেই সে চাষ কাজে চলে গেল। তার এই যাওয়াটা উচিত হয়নি। আষাঢ়ের মেঘ সবসময় যে ঢালবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দিতে পারে না। হলও তাই। দুদিন ঝরেই ঝোর বন্ধ করে দিল মেঘ দেবতা। কিন্তু তার আগে বাবুর পুটলি বাঁধা সারা। ধার-উধার করে ছেলেটা দলের সঙ্গে গাঙ পেরিয়ে চলে গেছে। এদিকে কে কি খাবে পরবে সে চিন্তা তার নেই।
অশোথতলা ছাড়িয়ে এলেই হাঁপু লাগে চুনারামের, গা ভিজিয়ে ঘাম নামে দরদরিয়ে। একটু যে জিরিয়ে নেবে তার জো নেই। রঘুর মুখ চলবে ক্ষুরের মতো। খড়খড়ে হাতে ঘাম মুছে চুনারাম রঘুর দিকে তাকাল, বুঝলি কিনা, তোর বাপের দুড়ুম করে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি।
রঘুনাথ ঢোঁক গিলল। সামান্য বিরক্তি ওর চোখে-মুখে, না গেলে ঘর চলবে কি দিয়ে? এ গায়ে কাজ কুথায়? এখানে তো খরা চলচে।
-যা বলেছিস। হাজার কথার এক কথা। চুনারাম উৎসাহিত হল, সেইজন্যিই তো বলছিলাম ওর এভাবে যাওয়াটা বিবেচকের কাজ হয়নি। আরে যাবি যখন তখন ধার-উধার করে কিছু টাকা ঘরে দিয়ে যা। তা না, কেবল ফক্কা!
-থাকলে তো দেবে। বাপের নিন্দে সহ্য হয় না রঘুর, শুধু মুখ দেখে কেউ টাকা উধার দেয় না। থালা-গেলাস তো সব গিয়েছে। বন্ধকের মাল ফেরত পাওয়া ঝামেলার।
-তা যা বলেছিস। সুদের সুদ বেড়ে ন’ মাসের পোয়াতি হয়ে যায়। চুনারাম হতাশ গলায় বলল, ছেলেটারে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। ঠা-ঠা খরায় দেশ-গাঁ জ্বলচে। সবখানে পাতা পোড়ার বদঘ্রাণ। চোত-বোশেখের মতো ধুলো এখন দামাল। কে বলবে আষাঢ় মাস পেরিয়ে গেল। কবে যে শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাবে বুড়িগাঙ? তখন সারা বুনোপাড়া জুড়ে জলকষ্ট। দল বেঁধে যেতে হবে সেই অশোথ তলার চাপা কলে। সে চরমদিন আসার আগে হড়হড়িয়ে ছেরাক মেঘ। আর ভাল লাগে না। সারা গায়ে বিজবিজানো ঘামাচি ফুটেছে চুনারামের, গা-গতর গোসাপের চামের মতো খসখসে। রাতে ঘুম নেই, দুপুরেও তাই। এভাবে চললে বর্ষা খুন হয়ে যাবে, বীজতলা ঝাঁকিয়ে কাঁদবে। বিধবার সাদা শাড়ির মতো দেখাবে মাঠঘাট।