খাওয়ার কথায় গায়ের জোর ফিরে পায় রঘুনাথ। সে খেলার কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝে নিয়েছে–বল কোনোমতে গোলের দিকে যেতে দেওয়া যাবে না। যে আসবে বল নিয়ে তাকে ক্ষামি করে ফেলে দিতে হবে ফলে তার আর সাহস হবে না পুনরায় বল নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবার। গায়ের জোরে সে যে এদের হারিয়ে দেবে-এ ব্যাপারে সে একশ ভাগ নিশ্চিত। সূর্যাক্ষ কেন ক্লাবের অনেক ছেলেই তার পায়ের শট পরীক্ষা করে দেখেছে। রঘুনাথের এক শটে বল চলে গিয়েছে বাঁধের ওপিঠে, যা অবিশ্বাস্য এবং চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড়। যার শটে এত জোর সে কি মামুলি খেলোয়াড় নাকি। রঘুনাথের কদর বেড়ে গিয়েছে সেই থেকে।
উৎসাহীদের ভিড় বাড়তেই খেলা শুরু হয়ে গেল রেফারির বাঁশি বাজার সাথে সাথে। সূর্যাক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলছে, ওর ডান পায়ের কাজ নিখুঁত, লক্ষ্যভেদ করতে পারে প্রতিকূল পরিবেশেও।
ব্যাক পজিশনে দাঁড়িয়ে সূর্যাক্ষের খেলা দেখছিল রঘুনাথ, হঠাৎ ওর পা গলে বল এসে পড়ল পেনাল্টি লাইনের কাছাকাছি, তাই দেখে শরীর নিয়ে কটাশের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রঘুনাথ, গায়ের জোরে সে লাথ কষাল বলের মাঝখানে, ঘাস ছিলে গেল সেই শটের জোরে, বল গিয়ে পড়ল অন্য প্রান্তের গোলরক্ষকের হাতে। হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকমহল। ওদের আনন্দ ভাসিয়ে নিয়ে গেল রঘুনাথকে।
খেলা শেষ হল দুই শূন্য গোলে। রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই সূর্যাক্ষ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল রঘুনাথকে, কী দারুণ খেললি রে তুই! আজ তোর উপর অসুর ভর করে ছিল।
.
০৪.
তারকের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, রঘুনাথ সবাইকে দেখিয়ে দিল ফুটবল কীভাবে খেলতে হয়। উরিব্বাস; ও যে ভাবে খেলল–তা কেবল স্বপ্নেই ভাবা যায়! রঘুর পিঠ চাপড়ে দিল তারক, আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি মদনদা রঘুকে দেখা করতে বলেছে। ও আজকের খেলার সেরা প্লেয়ার পুরস্কার পাবে। আঃ, যা লাগছে না আমার! তারক আর একবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। ওর যে ব্যস্ততার শেষ নেই। পুরস্কার বিতরণী সভা শেষ হতেই সাঁঝ নেমে এল বাঁধের ধারে। ধাওড়াপাড়ায় একা একা ফিরে যেতে হবে রঘুনাথকে, আজকে আর সূর্যাক্ষদের বাড়ি যাওয়া হবে না কোনো মতে। রাত করে ঘর ফিরলে দুর্গামণি ঘর-বার করবে, চুনারাম লাঠি হাতে অন্ধকারে বাঁধের উপর উঠে এসে ছানিপড়া চোখে দুরের গাঁখানার দিকে তাকাবে।
খাড়া পথ বেয়ে বাঁধের উপর রঘুনাথ উঠে এল। বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা। বিরাট কোনো কিছু করে ফেলেছে এমন একটা অনুভব তার স্নায়ুতন্ত্রকে টান টান করে মেলে ধরতে চাইছে। ভালো লাগার অনুভূতিগুলো খ্যাপলা জালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের রক্তজলে। এ সময় গাঙধারের ঝাউবনগুলোর দিকে তাকানো যায় না, মনে হয় ওরা গাছ নয়, এক একটা ঝাঁকড়া মাথার আগোলদার। ওদের হাতে লাঠি, কোমরে ফেট্টি দেওয়া ধুতি। পায়ের দশ আঙুল শেকড়ের মতো ছড়িয়ে আছে মাটির ভেতর।
রঘুনাথ ভাবছিল সূর্যাক্ষর সঙ্গে যাওয়ার সময় দেখা হলে ভালো হোত। ও যে কোথায় চলে গেল ওকে আর দেখতে পায় নি সে। মনটা খারাপ লাগছিল রঘুনাথের। আর ঠিক তখনই ফিকে আঁধারে সূর্যাক্ষ দৌড়াতে দৌড়াতে তার সামনে এসে হাজির হল, কী ব্যাপার তুই যে চলে যাচ্ছিস?
রঘুনাথ শান্ত চোখে তাকাল, ঘর তো যেতেই হবে। ঘর না গেলে মা খুব ভাববে। তাছাড়া বাবা ঘরে নেই। দাদু রাতে ভালো চোখে দেখে না। আমাকে যেতে হবে।
-যাবি মানে? আজ মা তোর জন্য রাঁধবে! আজ তুই আমাদের ঘরে যাবি। মাকে সেইমতো বলে এসেছি। সূর্যাক্ষ অবুঝ হয়ে উঠল।
রঘুনাথ মিনমিনে গলায় বলল, বললাম তো ঘরে যেতে হবে, ঘরে না গেলে মা চিন্তে করবে।
–ঠিক আছে, আমিও তোর সাথে যাবো।
–মিচিমিচি কেনে যাবি? রঘু বোঝাতে চাইল, পরে একদিন তোদের ঘরে যাব। আজ বাদ দে।
-তুই দাঁড়া, আমি আসছি। সূর্যাক্ষ রকেটগতিতে মাঠে নেমে গিয়ে সাইকেলটা বেল বাজাতে বাজাতে মাঠে নিয়ে এল, ওঠ।
–আমাকে চালাতে দিবি নে বুঝি? রঘুনাথ প্রশ্ন করল।
সূর্যাক্ষ আদেশের ভঙ্গিতে বলল, তোর এখন আরামের দরকার। চুপচাপ সাইকেলের পিছনে গিয়ে বসে পড়। তুই কি করে ভাবলি আমি তোকে একলা ছেড়ে দেব অন্ধকারে। যদি তোর কিছু হয়ে যায়?
–আমার কিছু হবে নাই। আঁধারে আমার চোখ জ্বলে। রঘু দাঁত বের করে হাসল। কিছুটা আসার পর মাঠ-পালানো হাওয়া আছড়ে পড়ল তার গায়ের উপর, সেই হাওয়া সারা গায়ে বুলিয়ে দিল শীতলতার চাদর। ধবধবে খড়ি ফোঁটা চালকুমড়োর মতো চাঁদ ফুটেছে আকাশে, ধীরে ধীরে অপসারিত হচ্ছে সাঁঝবেলার অন্ধকার, পোকামাকড়ের আজব ডাকে চেনা পৃথিবীটা জেগে উঠছে চোখের সামনে। আঁশশ্যাওড়া ঝোপের ভেতর থেকে একটা শেয়াল মোটা লেজ ফুলিয়ে মাঠের দিকে চলে গেল। রঘুনাথ বুঝতে পারল শেয়ালটা আখখেতের আল ধরে সোজা চলে যাবে বুড়ি গাঙের ধারে, ওখানের কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে কাঁকড়া ধরে খাবে। মরা-কাঁকড়ার খোলা পায়ে লাগলে কেটে যায়, রক্তপাত ঘটতে পারে, তাই খালি পায়ে বুড়িগাঙের ধারে গেলেও রঘুনাথ খুব সতর্ক হয়ে চলা ফেরা করে।
পাকুড়তলায় এ সময় বুড়োথুড়োদের জটলা হয়, বিড়ির ধোঁয়ায় তৈরি হয় কৃত্রিম মেঘ, তার অনেকক্ষণ পরে রঘুনাথের ভেতরটা বিড়ি ফুঁকবার জন্য পুলিয়ে ওঠে। খুব ছোটবেলা থেকে সে নেশা-ভাং করছে, চুনারাম খুশি হয়ে তার মুখে মদ ঢেলে দিত, পাঁচুই ঢকঢক করে খাইয়ে দিয়ে বলত, খা দাদু, খা। হাড় শক্ত হবে।