রঘুর তবু আড়ষ্টতা কাটে না, ছোটবেলায় বাতাবীলেবু নিয়ে বহু খেলেচি। সে খেলা ছিল মজার খেলা। মাঠে নেমে খেলতে যাওয়ার মানে দশ লোক হা-করে দেখবে। খেলা ভালো হলে হাততালি দেবে, খেলা খারাপ হলে গালমন্দ। আমার এমনি-তে মাথা গরম, কার সাথে ঝুট-ঝামেলা হয়ে যাবে। তার চেয়ে আমি মাঠের বাইরে থাকবখন, সেটা আমার জন্যি ভালো হবে।
তোর ভালো-মন্দ তোর বুঝে কাজ নেই। যা বোঝার আমরা বুঝব। বুঝলি? সূর্যাক্ষের দাবি রঘুনাথ ঠেলতে পারে নি। বামুনবাড়ির এই ছেলেটাকে তার মন্দ লাগে না, ওর মধ্যে কোনো উপরচালাকি নেই, পুরনো কুয়োর জলের চাইতে ঠাণ্ডা এবং উপাদেয়। এমন মনের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় অনায়াসে। এরপর সূর্যাক্ষ রঘুনাথের বন্ধু হয়ে গেল। ইস্কুল যাওয়া আসার পথে রোজ ওদের দেখা হয়, রঘুনাথ বেলা দশটা বাজলে সূর্যাক্ষর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে কদবেল তলায়। দুর্গামণি তার এই পাগলামী দেখে সতর্ক করে বলছিল, বুঝে-শুনে মিশবি বাপ। বাবুঘরের ছেলে মেয়েরা বড্ড চালাক হয়। ওরা সুযোগ পেলে তুর সব নিয়ে, তাপ্পর ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তাই বলচি বাপ, হিসেব করে পা ফেলিস। গড়বড় হলে নড়বড়ে হয়ে যাবে তুর জেবন, তখন কেঁদেকেটে কুনো পথ পাবি না। মায়ের কথা সবসময় যে সত্যি হয় তা নয়। সূর্যাক্ষের মন তার চেয়েও ভালো। প্রায় সে চরানীমাঠে দেখা করে রঘুনাথের সঙ্গে। তার গলায় অবুঝ আব্দার, চল তোকে আজ বাড়ি নিয়ে যাবো। আমার মা বলেছে তোকে ঘরে নিয়ে যেতে।
-ধ্যাৎ, তুর ঘরে গিয়ে কী হবে?
-কেন থাকবি খাবি গল্প কবি। সূর্যাক্ষর কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্ব উছলে ওঠে, আমার মা যে কত ভালো তা তুই নিজের চোখে দেখতে পাবি। ওখানে একবার গেলে তোর আর আসতেই মন করবে না।
–যাব, সময় করে ঠিক যাবো।
–না, আজই চল। আজ মা পায়েস রেঁধেছে। তুই খাবি। সূর্যাক্ষ জেদ করল।
-ধুর, পায়েস আমরা হররোজ খাই। রঘুনাথ অবাক হল না মোটে, জাউভাতে গরম দুধ ঢেলে দিলে পায়েসভাত হয়ে যায়। আমার মা বলে পায়েস ভাত খেলে গতরে শক্তি আসে। তখন ভালো মুনিষ খাটা যায়। বাবুরা খুশি হয়ে দু-পাঁচ টাকা বকশিস দেয়। রঘুনাথ নিজের বিশ্বাসে অনড় থাকে। তাকে বোঝাবার ক্ষমতা সূর্যাক্ষের নেই, সে শুধু অবাক হওয়া চোখে তাকায় আর বোকার মতো হাসে। মানুষ এখনও কোথায় পড়ে আছে ভাবলে অবাক হয় সূর্যাক্ষে। তার বাবা কপোতাক্ষ বলেন, মানুষকে অন্ধকার থেকে টেনে তুলতে হবে। সবার চোখে শিক্ষার আলো দিতে হবে। স্বাধীনতার চব্বিশ বছর পরেও মানুষ অন্ধকারে ডুবে আছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা ওদের গ্রাস করছে। ওদের সচেতন করার দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে সূর্য। শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়ে তোমাদের এ শিক্ষা পূর্ণ হবে না। চোখ-কান খোলা রেখে মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে তোমাদের। ধনী দরিদ্র ছোট বড়ো সবাইকে কাছে টেনে নিতে হবে। তবেই আমাদের এই মহান দেশ প্রগতির পথে অগ্রসর হবে।
মাঠের মধ্যে রঘুনাথের দিকে তাকিয়ে সূর্যাক্ষ চঞ্চল হয়ে উঠল; এই রঘু, যা করার তাড়াতাড়ি কর। দেখ, মোকামপাড়ার দল আগে-ভাগে মাঠে নেমে গিয়েছে। ওরা গা-ঘামাচ্ছে। তুই ঝটপট ড্রেস করে নে। আজ ওদের ছাড়ব না, গো হারা হারাবো। তারক রঘুনাথের বরাদ্দ সাদা কালো জার্সিটা এগিয়ে দিল, জামগাছের আড়ালে গিয়ে এটা পরে আয়। আর হ্যাঁ, প্যান্টের নীচে তোর জাঙ্গিয়া আছে তো?
রঘু ঘাড় নাড়ল, জাঙ্গিয়া কি সে জানে না, ঘোর কাটিয়ে সে তাকাল, প্যান্টের নীচে ল্যাঙ্গোট পরে এয়েচি।
–তুই এই বয়স ল্যাঙ্গোট পরিস? সূর্যাক্ষ হাসি আটকাতে পারছিল না, ল্যাঙ্গোট তো রামনগর সুগারমিলের বিহারী দারোয়ানগুলো পরে। ওরা ল্যাঙ্গোট পরে রোজ সকালে মালাম লড়ে। আমি বাবার সাথে গিয়ে দেখেছি।
তারক তার কথাকে সমর্থন করল, হ্যাঁ, সূর্যর কথাটা ঠিক। আমিও ল্যাঙ্গোট পরা কুস্তিবীর দেখেছি। জানিস ওরা গায়ে কত্তো তেল মাখে!
রঘুনাথের এসব কিছু দেখা হয়নি, সে ধাওড়াপাড়া ছেড়ে পলাশী সুগারমিলের দিকে কোনোদিনও যেতে পারেনি। গুয়ারাম তাকে যেতে দেয় না, বেশি জেদ ধরলে বলে, হারিয়ে যাবি বাপরে। গাঙের ধারে ছেলেধরা ঘোরে। লালগুলার ওদিক পানে টেরেন যাওয়ার লোহার পুল হচ্ছে, সেখানে নরবলি না দিলে পুল খাড়া হবে নি। তাই ছেলেধরা বড়ো বোরা নিয়ে ঘুরচে ছেলে ধরতে। ওদের হাতে লাল গুলাপফুল থাকে। সেই গুলাপফুল মন্ত্ৰপুড়া। একবার নাকে শুঁকিই দিলে একেবারে রামছেলির মতুন হয়ে যাবি। অমনি খপ করে বোরায় ঢুকিয়ে নিবে তুরে, মা বলে চেঁচাতেও সময় পাবিনে। গুয়ারামের কথায় ভয়ে গায়ের নোম চেগে উঠত রঘুনাথের, মাকে জড়িয়ে ধরে শুলেও ভয় কাটত না, চোখ বুজলেই সেই জাদুকর আলখাল্লা পরা ছেলেধরাকে দেখতে পেত সে, ভয়ে হিম হয়ে যেত শরীর, কথা আটকে গিয়ে ঘড়ঘড় করত গলা।
বুনো জামগাছের আড়ালে হাফ-প্যান্টুলুন ছেড়ে কালো প্যান্ট আর রঙচঙে জার্সি পরে নেয় রঘুনাথ। পোশাকটা পরার সাথে সাথে তার মনে হয় সে যেন জাতে উঠে গেল। এই পোশাক পরা অবস্থায় তার মা যদি একবার দেখতে পেত তাকে তাহলে পুত্রগর্বে বুক ভরে যেত মায়ের। মনে মনে সে ভাবল খেলা শেষ হয়ে গেলে এই পোশাকটা সে চেয়ে নেবে। গোল-পোস্টের সামনে চুন দিয়ে দাগ কেটে রেখেছে ক্লাবের ছেলেরা অনেক আগেই। শুধু গোল-পোস্টের সামনে নয়, খেলার মাঠের চারধারে চুনের দাগ লম্বা হাড়ের মতো শুয়ে আছে। গাঁ-ভেঙে লোক এসেছে খেলা দেখতে। আজকের খেলাটায় যে জিতবে সেই দলকে একটা কাপ আর সের পাঁচেক ওজনের খাসি উপহার দেওয়া হবে। যারা হারবে তারা খাসি পাবে না, শুধু পাবে ছোট একটা রানার্স কাপ। সূর্যাক্ষ এসব কথা পাখি পড়ানোর মত করে শিখিয়েছে রঘুনাথকে, ভালো করে খেলবি, আজ জিতলে রোববারে ফিস্ট হবে ক্লাব ঘরে। সেদিন খাসি কাটা হবে। তোরও নেমতন্ন থাকবে।