রঘুনাথ উৎসাহিত হল, যাব না মানে? সেই কখুন থিকে আমি ঘুর ঘুর করচি তুর জন্যি। যাক, দেখা হয়ে ভালো হল। রঘুনাথ এগিয়ে গিয়ে সূর্যাক্ষের সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে হাত রাখল, দে, সাইকেলটা আমাকে দে। মাঠ অব্দি আমি চালিয়ে নিয়ে যাবো। তুই পেছনে বসবি।
তুই পারবি? সূর্যাক্ষের চোখে সন্দেহ, পড়ে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। সে দিন একটা চালকারবারী সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে বাঁধের নিচে গড়িয়ে গিয়েছিল। ওর অন্ডকোষে লেগেছে। হাসপাতালে ভর্তি আছে। শুনেছি অবস্থা নাকি ভালো নয়।
অত ভয় পেলে চলবে? রঘুনাথ সাহসী হয়ে উঠল, যা হবার হবে। সবাইকে একদিন তো পটল তুলতে হবেই। দে সাইকেলটা দে।
একরকম জোর করে সূর্যাক্ষের সাইকেলটা কেড়ে নিল রঘুনাথ, তারপর কিছুটা দৌড়ে ধপাস করে সে সাইকেলের সিটে চড়ে বসল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকল, এই সূর্য, বসে পড়, দেখ, বেলা কুথায় চলে গিয়েছে। খপখপ কর। আজ তুই দেরিতে এসে সব কিছু এলেবেলে করে দিলি।
সূর্যাক্ষ বই আঁকড়ে ধপাস করে ক্যারিয়ারে বসে পড়ল, তারপর পাছায় জোরসে চিমটি কেটে বলল, মেয়েদের মতো চালাস নে, জোরে-জোরে চালা। এমন শামুকের মতো চললে কখন পৌঁছাবি?
বাঁই-বাঁই করে সাইকেল ছুটল বাঁধের ধুলো উড়িয়ে, সারা শরীরে স্ফুর্তি এসে গেল রঘুনাথের, সে শিস দিয়ে গান ধরল দুরের দিকে তাকিয়ে। এ সময় বাঁধের ধার অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। এই আলোটাকে লোকে বলে কনে দেখা আলো। কিছুটা আসার পর সূর্য গাঙধারের ঝাউগাছগুলো দিকে তাকাল, দেখ গাছগুলোকে কেমন বড়ো দেখাচ্ছে। রোজ দেখি আর মনে হয় ওরা কত তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছে।
রঘুনাথ সাইকেলের হ্যাণ্ডেল জোরসে ধরে প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে থামল, গাঙধারের বাতাসে গাছপালার বড় বেশি হয়। গাঙের ঘোলাটে জলে পলি থাকে। সেই পলি হাড়গুড়া সারের কাজ করে। আমার দাদু বলে, ঘোলা জলে আয়ু বাড়ে মাছেদের, আর গাছ বাড়ে চড়চড়িয়ে।
সূর্যাক্ষের মধ্যে একটা ভাবুক মন সর্বদা হাডুডু খেলে, কোনোসময় তাকে দুঃখ এসে ছুঁতে পারে না। তার মা তাকে শিখিয়েছে, হাসি হল মানুষের শরীরের একটা মোক্ষম ওষুধ। এই ওষুধে সব রোগজ্বালা ভালো হয়ে যায়, মানুষের কোনো কষ্ট থাকে না।
কথাটা মনে ধরেছে রঘুনাথের, তার খুব ইচ্ছে করে সূর্যাক্ষের বাড়ি গিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প করতে। দুর্গামণির সঙ্গে সূর্যাক্ষের মায়ের বুঝি তুলনাই চলে না। রঘুনাথ তার মায়ের কথা ভেবে মনে মনে কেমন গুটিয়ে যায়, দু’মায়ের ফারাকটা তার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।
সূর্যাক্ষের খোলা হাওয়ার মতো মন, তা না হলে বুনোপাড়ায় আসতে তার বয়ে গেছে। গাঁয়ে মাত্র ক’ঘর বামুনের বাস, তার মধ্যে ওরা বেশ সম্পন্ন। সূর্যাক্ষের মামার বাড়ি কৃষ্ণনগরে, জলঙ্গী নদীর ধারে। বিকেলে সেখানে খোলা বাতাস দৌড়-ঝাঁপ খেলে বেড়ায়, সেই বাতাসের গায়ে থাকে হিমেল সুবাস, জলকণার মিহি আদর। গরমের দিনে জলঙ্গী নদীর বাঁধের উপর দাঁড়ালে শরীর একেবারে জুড়িয়ে শীতল হয়ে যায়, আরামে চোখ বুজে আসতে চায় ঘুমে। কতদিন সূর্যাক্ষের মামার বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তার মা বলেছে–আগে ভালো মতো পাশ কর, তারপর তাকে নিয়ে যাবো। বারোদোলের মেলায় ভিড় বেশি। সে সময় গেলে বেশ আনন্দ হয়।
সাইকেল ঢালু পথ বেয়ে নেমে এল মাঠের উপর। সবুজ ঘাসের উপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে মাঠখানা। ঠিক গোল-পোস্টের পিছনে একটা বুনো জামগাছ। বুড়োটে পাতা শুকনো তেজপাতার মতো ছড়িয়ে আছে মাঠের ভেতর, পাতাগুলো সাতভায়া পাখির মতো উড়ছে হাওয়ায়। সেদিকে হা-করে তাকিয়ে আছে সূর্যাক্ষ। আর একটু পরে খেলা শুরু হবে, তার প্রস্তুতিতে মাঠ সেজে উঠছে। সূর্যাক্ষ আর রঘুনাথকে দেখে এগিয়ে এল তারক। খুব অবাক হয়ে সে শুধোল, তোদের দু জনের এত আসতে দেরি হল যে।
রঘুনাথ কিছু বলার আগেই সূর্যাক্ষ বলল, কালীগঞ্জ থেকে ফিরতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেল। মোকামপাড়ার কাছে এসে সাইকেলের হাওয়া কমে গেল। ওই অত দূর থেকে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে আবার ফিরে গেলাম বাজারে। বাজার ছাড়া তো সাইকেল সারানোর কোনো দোকান নেই জানিস তো। তবে রঘু ধাওড়াপাড়ার কাছে আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিল। হেঁটে এলে রঘু আগে পৌঁছে যেত কিন্তু ও-যে আমাকে ছাড়া আসবে না।
রঘু তোর চামটুলি। গলা ফাড়িয়ে হাসল তারক। তার সেই দরাজ হাসি সংক্রামিত হল রঘুনাথের শরীরে। সেখান থেকে হাসি রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল সূর্যাক্ষের কণ্ঠ। ওরা তিনজন হা-হা শব্দে হাসতে লাগল।
এক সময় হাসি থামিয়ে সূর্যাক্ষ বলল, আজ রঘু ব্যাকে খেলবে। ওকে আমি সাহস দিয়েছি। ওর কোনো অসুবিধা নেই।
ব্যাকে খেলার জন্য রঘুর গায়ের জোরটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সূর্যাক্ষ। ওর গাট্টাগোট্টা চেহারায় যে শক্তি লুকিয়ে আছে তা একটা চামড়ার বলকে শাসন করার পক্ষে মাত্রারিক্ত। রঘুনাথ খেলার খ’ না জানলেও এই লুকিয়ে থাকা শক্তি ওকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। বল খেলার প্রস্তাব সূর্যাক্ষ প্রথম দিতেই রঘুনাথ আকাশ থেকে পড়েছিল, ওসব বল পেটাপেটি খেলা আমার দ্বারা হবে নি।
-কেন হবে না, আলবাত হবে, চল। রঘুনাথের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সূর্যাক্ষ পাকুড়তলায়। তারপর বুঝিয়ে বলেছিল, বল খেলা খুব সহজ রে, একটু বুদ্ধি ঘিলুতে থাকলে যে কেউ খেলতে পারে।