পড়ন্ত রোদে চুনারাম খাটো ধুতি গুছিয়ে মুনিরামের মুখোমুখি বসল। পাশাপাশি ঘর তবু অনেক দিন হল এদিকটায় তার আসা হয়নি, এমনকি খোঁজ খবরও নেওয়া হয়নি। অসুস্থ ভাইয়ের উপর চুনারামের একটা চোরাটান আছে যা সে কখনও কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। বাপ ঢুলিরাম গত হবার সময় তার হাত ধরে বলেছিল, আমার সময় হয়েছে বাছা, ইবার আমাকে যেতে হবেখন। তোর ভাই থাকল, তারে তুই দেখিস। বড় ভাই তো বাপের সমান।
ঢুলিরামের কথাগুলো আজও মাঝে মাঝে মনে পড়ে চুনারামের, তখন মনটা কেমন কঁকিয়ে ওঠে, ব্যথায় নীল হয়ে যায়। দেশ-দুনিয়া, এ জগত কিছু ভালো লাগে না, মুনিরামের ঘেয়ো শরীরটা যেন তার শরীরের ভেতর ঢুকে যায়, কিছুতেই এই ব্যাধিটাকে ঠেলে বের করে দেওয়া যায় না। কালীগঞ্জ হাসপাতালের মোটা টিকাদারবাবু মুনিরামকে দেখে বলেছিলেন, ঘরে বসে থাকলে এ অসুখ সারবে না। হাসপাতালে যেও, ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে দেবেন। হাসাপাতালে এ রোগের চিকিৎসা হয়।
-পাপরোগের চিকিৎসা হয়? যেন আকাশ থেকে পড়েছিল মুনিরাম। সেদিন পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল চুনারাম। টিকাদারবাবু মুনিরামকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, পাপরোগ বলে কোনো রোগ হয় না। কুষ্ঠ কোনো অভিশাপ নয়, ওটা একটা রোগ। যে-কারোর হতে পারে। সব কুষ্ঠরোগ ছোঁয়াচে নয়। নিয়ম করে দেখালে এ অসুখ সেরে যায়, এ রোগটাকে ভয় পাবার বা লুকোবার দরকার নেই। জ্বরজ্বালা, মাথা ব্যথার মতো এটাও একটা অসুখ।
তবু টিকাদারবাবুর কথায় ভরসা রাখতে পারে নি চুনারাম আর মুনিরাম। ওই মাঝ বয়েসী মানুষটা বলে কি! এমন কথা কি বিশ্বাস করা যায় যে কুষ্ঠরোগটা কোনো বিধির অভিশাপ নয়? পাপের ফল নয়? গ্রামসমাজের চাপে পড়ে মুনিরামকে আলাদা করে দিয়েছে লুলারাম। তার জন্য আলাদা একটা ঝুপড়ি বানিয়ে দিয়েছে পণ্ডিতবিলের ধারে। চাপা গলায় সতর্ক করে বলেছে, এদিকপানে এসো না, গাঁয়ের কেউ দেখে নিলে আমার ঝামেলা হয়ে যাবেন। তুমার যখন যা দরকার হবে আমাকে বলবে–আমি দিয়ে আসব।
দুকুরবেলায়, সাঁঝবেলায় তাহলে কুথায় খাবো? মুনিরামের গলা বুজে এসেছিল কান্নায়। বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল সে।
–আঃ, মন খারাপের কী আছে? আমরা তো তুমার পাশে আছি, শুধু ঘরটা যা আলাদা। লুলারাম ধমক দিল।
নিজের হাতে বানানো ঘরে নিজে থাকতে পারব না! ওঃ, এ যে কী মা শীতলা বুড়ির মহিমা কিছু বুঝতে পারি না। এর চেয়ে শ্মশানঘাটে চলে গেলে ভালো হত। ওখানে সমাজের লাল চোখ নেই। কোঁকড়া চুলগুলো সজোরে চেপে ধরে হা-হুতোশ করে মুনিরাম। খড় আর ছিটে বেড়ায় বানানো ঝুপড়িটাকে সে মন থেকে মেনে নিতে পারে না, কষ্ট হয়, বুক মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের কোণে থিকথিক করে জল, বুঝতে পারে সে এ সংসারে এখন একটা এঁটো পাতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু চুনারাম আসে, মাঝে মধ্যে তার খোঁজখবর নিয়ে যায়, ভালো-মন্দ কিছু হলে সে ছোটভাইটার জন্য পাঠিয়ে দেয়। একা খেতে মন সায় দেয় না। বাবার কথাটা মনে পড়ে, বড়ো ভাই তো বাপের সমান।
আজ দাদাকে দেখে মুনিরাম উৎসাহিত বোধ করল, আয়, ছিমুতে সরে আয়। কদিন পরে এলি বল তো? আমি তো পথের দিকে হাঁ-করে চেয়ে থাকি। বুড়াটার খোঁজ নিতে কেউ আসে না। আর আমার কাছে আসবেই বা কেন? মধু যা ছিল সব আমি যে নিংড়ে দিয়েছি।
-চুপ কর ভাই। চুনারামের চোখে ব্যথার সর পড়ল, কেউ না আসুক–আমি সময় পেলে ঠিক আসব। তুই ভাববি নে। তা এখুন কেমুন আচিস ভাইরে…?
-ভালো নেই, ভালো নেই রে! ডানে-বাঁয়ে নিয়ন্ত্রণহীন ঘাড় দোলায় মুনিরাম, ক্ষয়ে যাওয়া, ঘেয়ো হাতটার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতরটায় ডানা ভাঙা প্রজাপতির মতো ফড়ফড় করে, খুব কষ্ট হয় রে, এবার চলে গেলে বুঝি ভালো হত। শীতলাবুড়ির কবে যে দয়া হবে কে জানে। আমি তো হররোজ দু-বেলা তারে ডাকচি।
–সব ঠিক হয়ে যাবেখন। চুনারাম মিথ্যা আশ্বাস দিতে চাইল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুনিরাম ভাবুক হয়ে গেল, আর ভালো হবে না রে, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এবার পুটলি বাঁধার সময় হয়েছে। আর তা ছাড়া, আমিও আর বাঁচতে চাইনে। এ জীবনটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে, হাঁপসে গেছি আমি, আর ভাল লাগে না ভাই, আর ভাল লাগে না। মুনিরাম থামল, চোখ রগড়ে নিয়ে নির্লিপ্ত তাকাল, লুলাটাকে নিয়ে আর পারিনে। বউটারে সে ভেষণ জ্বালাচ্ছে। ভিকনাথের বউটার সাথে সে নাকি ঢলাচ্ছে। ছিঃ, ছি, আমি কুন দিকে যাই বলদিনি। এই বয়সে এসব কি মানায় রে। শরীলটা এট্টু জুঁৎ হলে আমি ভাবছি বউটার সাথে টুকে দেখা করব। ওরে বুঝিয়ে বলব। দেখি কুনো কাজ হয় নাকি?
-প্রেমবোগ কুঠরোগের চেয়েও খতরনাক। খবরদার তুই ওই রাড়ুয়া ম্যায়াঝিটার কাছে যাবি নে। আমি শুনেচি–সে বড়ো মুখরা। তুর মান-সম্মান রাখবে নি। চুনারাম বোঝাবার মতো করে বলল কথাগুলো। মুনিরাম মন দিয়ে শুনে শুধুমাত্র ফুঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর কেমন হাওয়া বেরনো বেলুনের মতো চুপসে গেল।
.
কালীগঞ্জ থেকে ইস্কুল সেরে সাইকেল নিয়ে ফিরছিল সূর্যাক্ষ, রঘুনাথ তাকে পাকুড়তলায় ধরে ফেলল। সূর্যাক্ষ সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল, গালে টোল ফেলে হাসল সে, কোথায় থাকিস রে রঘু, তোর যে আর টিকির নাগাল পাওয়া যায় না। ভুলে গিয়েচিস-আজ ফুটবল ম্যাচ আছে। যাবি না?