-পারি গো সব পারি। কেনে পারব নাই। ঢিলি বুক দুলিয়ে হাঁপাচ্ছিল, বেধুয়ার বেটা বেধুয়া হবে এ আর বড়ো কি কথা! এতদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে বুড়া এখন এয়েচে ছেলের খোঁজ করতে। মরতেও দড়ি জোটে না। রাগে শরীরটা তেতে উঠলেও মনিরামের এখন কিছু করার নেই। অসুখ তার ক্ষমতায় থাবা মেরেছে, মানুষের অভিশাপ তাকে আজ অক্ষম করেছে, সারাজীবনের পাপকাজে তার পাপের ডিঙা ভরে গিয়েছে, সে এ জনমের শাস্তি শেষ জীবনে পেয়ে গিয়ে নিজের প্রতি বড়ো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। গাঁয়ের লোক আড়ালে আবডালে বলে, মুনিরাম কুনোদিন মুনিও হবেনি, রামও হবেনি। যে মানুষটা আগাগোড়া শয়তান সে দেবতার সাজ পরলেও মানুষ ঠিক তাকে চিনতে পারে। পাপের বদঘেরাণ যে দুনিয়া ছাড়া! অত মানুষের চোখের জল কি বেথা যাবে।
মাঝে মাঝে দগদগে ঘাগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিয়ে হিসাব কষে মুনিরাম। বামুনপাড়ায় ডাকাতি করতে গিয়ে সে সোনাদানা ছিনিয়ে নিয়েছিল বিধবার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে তুলে দেবে মা। সেই মায়ের স্বপ্ন আর পূরণ হতে দিল না মুনিরাম। জোর করে ছিনিয়ে নিল আঁচলের চাবিগোছা। টিনের বাক্স খুলে বের করে আনল স্যাকরার দোকানে গড়ানন বালা বাউটি চুড় চন্দ্রহার। পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল বিধবা-মা, চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল দুঃখিনীর হৃদয়-সমুদ্র, ওগুলো নিও না গো, এর চেয়ে আমার জান নিয়ে নাও। এই ফালগুনে আমার মেয়েটার বিয়েঘর। ওর বাবা নেই। আমি বহু কষ্টে এগুলো জমিয়ে রেখেছি। এগুলো নিয়ে গেলে আমি পঙ্গু হয়ে যাব, খালি হাতে আমার মেয়েকে কেউ ছোঁবে না গো।
কেউ না নিক, আমি নেব। রানী করে রাখব। দেবে তো বলো।
তোর ওই মুখে পোকা পড়ুক। আমিও বামুনের মেয়ে। কোনোদিন পাপ আমাকে ছোঁয়নি। তোকে আমি শাপ দেব।
–তবে রে মাগী। চিৎ হয়ে শো। আজ রস গোটাব। হাত ধরে বউটাকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিয়েছিল মুনিরাম। তারপর সে পশু হয়ে গেল নিমেষে। ধুতি সামলে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, যা এবার তোকে পাপ ছুঁয়ে গেল। এবার তুই প্রাণভরে আমাকে শাপশাপান্তি দে। আমি জানিরে–শকুনের শাপে গোরু মরে না। এলোমেলো শাড়িতে লজ্জাস্থান ঢেকে বিধবা মা’টি কাঁদছিল, তোকে আমি শাপ দেব, হ্যাঁ, হাজার বার দেব। যার মা-বোন জ্ঞান নেই সে বেঁচেও মরার মতো বাঁচবে। যে হাত দিয়ে তুই আমাকে ধরলি–সেই হাতে তোর কুঁড়িকুষ্ঠি হবে। খসে খসে পড়বে তোর হাত-পা। তুই নুলো হবি, তুই কৃমিকীট হবি। সবাই তোকে দেখে নাক কুঁচকাবে। তোর মুখে থুতু দেবে। পরের দয়া নিয়ে তুই বাকি জীবনটা বাঁচবি। আমি যদি সতী হই, আমার শাপ তোর ঠিক লাগবে।
মাত্র তিন বছরের মাথায় কুঁড়িকুষ্ট ফুটল মুনিরামের শরীরে। অসাঢ় হয়ে গেল শরীরের নিম্নাঙ্গ। তখন সত্যবতী বেঁচে, যৌবন কইমাছের মতো ছড়ছড়াচ্ছে অথচ তার কিছু করার নেই, শুধু পূজ-রক্ত নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া। বামুনবাড়ির বিধবা বউটার কথা মনে পড়েছে মুনিরামের, ভয়ে আঁতকে উঠেছে সে, পাপের ডোবায় সে তখন ডুবে যেতে গিয়ে নিজেকে বাঁচাবার উপায়গুলো হারিয়ে ফেলে। এক ঘনঘোর আচ্ছন্নতা, আত্মধিক্কার, অপরাধবোধ সেদিন থেকে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, এর থেকে নিষ্কৃতি সে আজও পায় নি।
হাঁটতে হাঁটতে বাঁধের গোড়ায় চলে যাবার ইচ্ছে হয়েছিল চুনারামের কিন্তু অতটা খাড়াপথ লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে তার শরীর সায় দিল না। পিটুলিগাছটাকে পাশ কাটিয়ে সে ঘরের সামনের পথটায় এসে দাঁড়াল, ধুলোয় থিকথিক করছে পথটা, পা ফেললেই পায়ের চেটো ধুলোর বিছানায় ডুবে যায়, সারা পায়ে ধুলো জড়িয়ে নিজের পাটাকে আর চেনা যায় না। ধুলোভরা পা দুটো যেন অন্য কারোর।
কঞ্চির বেড়ার উপর ফড়ফড় করে উড়ছে রাজফড়িং; কিছু দূরে একটা কালো কুচকুচে ফিঙে হা-করে দেখছে ফড়িংগুলোর গতিবিধি, একটু সুযোগ পেলেই ফিঙে পাখিটা উড়ে এসে খাবলা মেরে ধরে নেবে রাজফড়িং তারপর উড়ে গিয়ে কোঁত করে গিলে নিয়ে আবার অপেক্ষায় থাকবে দ্বিতীয় শিকার ধরার জন্য। আগড় সরিয়ে চুনারাম গলা খেঁকারি দিয়ে মুনিরামের উঠোনে ঢুকে এল। এ সময় ঢিলির ঘরে থাকার কথা নয়, যথারীতি সে ছিল না, শুধু নূপুর এগিয়ে এল তার গলার আওয়াজ পেয়ে, দাদু, আসো গো।
পথ দেখিয়ে নূপুর সরে দাঁড়াল, নুপুরের ব্যবহারে মুগ্ধ চুনারাম হাঁ-করে তাকাল, ভাই কইরে? নূপুর কিছু না বলে উঁচু জায়গাটা দেখিয়ে দিল, বহু বছর আগে মুনিরাম মাটির ঘর তুলেছিল, ভয়ঙ্কর বন্যায় তা গলে যায়, হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে মাটির ঘরখানা। সেই থেকে জায়গাটা উঁচু হয়ে আছে, ছাগলছানা তিড়িং বিড়িং লাফায় সেই উঁচু ভাঙা কাঁথ দেওয়ালে। শীতকালের সকালে রোদ উঠলে মুনিরাম ওই উঁচু ঢিবি জায়গাটায় গিয়ে বসে, পিঠে রোদ লাগিয়ে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায়, সে নিজেও টের পায় না। বছরের অন্য সময়গুলোতে রোদ সরে গেলে কিংবা রোদের তেজ কমলে মুনিরাম বোরা বিছিয়ে ওখানে বিশ্রাম নেয়। খিদে লাগলে ওখানে বসেই মুড়ি চেবায়, নূপুর পেতলের ঘটিতে জল দিয়ে যায়, বুড়োটা ঢকঢক করে খায় তারপর মুখ মুছে নিয়ে নূপুরকে আশীর্বাদ করে, তুই রাজরানী হবি। তোর মন অনেক উঁচা হবে। তোর মনে দয়া-মায়া উপচে পড়বে। তুই তোর বাপ-মায়ের মান রাখবি। সেদিক থেকে ভাগ্যবান লুলারাম। ওর ছেলে নেই ঠিকই, কিন্তু মেয়ে দুটো ছেলেকেও ছাপিয়ে যায়, সংসারের কাজে ওরা দশভুজা, ক্লান্তি নেই, সারাদিন মেশিনের মতো খাটছে তো খাটছে ফলে ঢিলির অভাবটা কাজের মাধ্যমে পুষিয়ে দিয়েছে ওরা। লুলারাম তাই শান্তিতে ঘোরাফেরা করতে পারে, শুধু বাজারহাট করে দিয়ে সে খালাস। লোকজন হাঁড়ি খুন্তি সব সামাল দেয় ওই দুটি মেয়ে। মুনিরাম চোখের সামনে অষ্টপ্রহর সব দেখে তাই কেউ কিছু ওদের নামে বললে ওর পিত্তি জ্বলে যায়, রাগে মুখ দিয়ে আজেবাজে কথা বের হয়ে আসে।