গাঁওবুড়ার কথা মেনে নিয়েছে সবাই। সেই সঙ্গে সবাই একবাক্যে বলেছে, গাঁয়ের ধুলোয় পাপ মিশেছে। যে পাপ করছে সে ভেবে দেখুক বারবার। একার পাপে হাজার কেন কাঁদবে। কথা শেষ হলে পুরো সভা মুনিরামের দিকে তাকিয়েছে। আর তাতেই চমকে উঠেছে কুষ্ঠরোগী মুনিরাম। বারবার ঢোঁক গিলে সে খড়খড়ে গলায় বলেছে, আমাকে দোষ দিও নি গো, আমি আর সাতে-পাঁচে নেই। ওসব কু-বিদ্যে আমি ছেড়ে দিয়েছি বহুৎ দিন হল। আমি এখন আমার মতো করে বাঁচি।
-তুমার কথা বলচি নে মুনি। সভার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি মুনিরামের দিকে তাকিয়ে কাশল, সন্দেহ পাকমোড়া মারছে তার পুরো শরীরে, মুনিভাই তোমার কথা হচ্ছে না, হচ্ছে তুমার ছেলে লুলার কথা। ওর চলন-বলন ভালো ঠেকছে না আমাদের। খবর আছে ফি-রাতে ও ঘরে থাকে না।
মুনিরাম তেনা জড়ানো শরীর হেলিয়ে খুক খুক করে কাশল, আমি যত দূর জানি ব্যাটা আমার কু-কাজ করতে বেরয় না। সে এখন ঘরেই থাকে। আমার ঘরের বউটা তাকে রাত-বেরাতে যেতে দেয় না। বউয়ের কোল ছেড়ে লুলা আমার কেন যাবে বলো? ওপরওয়ালার দয়ায় আমার কি খাওয়া-পরার অভাব আচে? সে সব তো তুমরা নিজের চোখে দেখচো।
–দেখচি বলেই তো এত কথা বলা। সভা গমগমিয়ে উঠল, লুলার স্বভাব-চরিত্তির ভালো নয়। ভিকনাথের বউটার সাথে লটঘট চলছে। অনেকে ওদের আঁধার রাতে বাঁধের ধারে ঘুরঘুর করতে দেখেচে। বল, এসব তো ভালো নয়। এটাও তো সেই অনাচারের মধ্যে পড়ে। কী বলো?
মুনিরামের মুখে যেন এঁটেল মাটির কাদা লেপে দেয় গ্রামসভা। কথা হারিয়ে বুড়োটা ভ্যালভ্যাল করে তাকায়। বুকের ভেতরটা তার টিসটিস করে ভয়ে। যৌবনে তার সামনে এমন কথা বলার হিম্মোত কেউ রাখত না। তখন ঘোড়ায় চেপে বাঁধের ধারে টহল দিত মুনিরাম। তার কালো ঘোড়াটা হাওয়ার গতিতে ছুটত, দেবগ্রাম পৌঁছোতে সময় নিত বিশ মিনিটেরও কম। এ গ্রামের মানুষ সেই প্রথম আরবী ঘোড়া দেখে। মুনিরাম ঘোড়াটা কিনেছিল পলাশী মনুমেন্টের এক সাহেবের কাছ থেকে। কালো রঙের তেল চুয়োনো ঘোড়াটা সাহেবের বিশেষ পছন্দের ছিল। কিন্তু দেশে ফেরার সময় ঘোড়া নিয়ে তো উড়োজাহাজে চড়া যাবে না, তাই জলের দামে বেচে দেওয়া। সাহেবঘোড়ার মেজাজ ছিল সাহেবের মতো, ছোলা ভুষি গুড় কচিঘাস ছাড়া সে আর কিছু খাবে না। যে কেউ তাকে ছুঁলেই পেছন পা দিয়ে লাথ ছুঁড়ে দিত সজোরে, চিঁ-হিঁ-হিঁ শব্দে পিলে চমকানো ডেকে উঠত তার অনিচ্ছা জানিয়ে। সেই জাঁদরেল ঘোড়াকে শেষ পর্যন্ত বশে এনেছিল মুনিরাম। চাবুকের ভয় পশুরও আছে। এক টানা দশ মাইল দৌড়ে ঘোড়াটাকে জব্দ করেছিল সে। পরে এই ঘোড়া তার অবস্থা ঘোরাতে সাহায্য করে। অমাবস্যা রাতে গাছপুজো সেরে মুনিরাম চলে যেত পরের দোরে ডাকাতি করতে। তার ঘাড়ে চামড়ার প্লেটের সাথে টাইট করে বাঁধা থাকত ছররা বন্দুক। কাজ শেষ করে ওই বন্দুক সে লুকিয়ে রাখত খড়গাদায়। থানা থেকে পুলিশ এলে টের পেত না কোনো কিছু। চোরাই মাল পুকুরে বস্তায় বেঁধে রেখে আসত মুনিরাম। জলের তলায় মাসের পর মাস পড়ে থাকত বাসন-কোশন সোনা দানা। তখন ছিল সুখের সময়, তখন চোখ টাটাত মানুষজন। আজ কত বদলে গেছে হলদেপোঁতা ধাওড়াপাড়া, তবু মানুষের মন থেকে ঈর্ষার কঠিন আঁচড় মুছল না। লুলারামের পেছনে লেগেছে সবাই। ছেলেটার বদনাম করতে পারলে ওরা আর কিছু চায় না। ভিকনাথের কচি বউটাকে নিয়ে এসব গল্পকথার কোনো মানে হয়? কষ্টে বুক ভেঙে যেতে থাকে মুনিরামের, তবু সে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। পরক্ষণে তার মনে হয় লুলারামকে তার বিশ্বাস নেই। যৌবন গঙ্গার পাড় ভাঙা ঢেউয়ের মতো, উপর থেকে কিছু বোঝা যায় না, তলায় তলায় চাকু শানায়। দশ লোকে যে কথা বলে তা কি আর ভুল হবে? যা রটে তা কিছু না কিছু বটে। এবার থেকে চোখে-চোখে রাখতে হবে ছেলেটাকে। বউটা আর পেরে ওঠে না, ওরও তো মাথার কোনো ঠিক নেই, গরম চড়লে ঘিলু গলে যায়, শুরু হয় পাগলামী। ইংরেজি দাবাই করিয়ে এ রোগের কোন সুরাহা হবে না, আয়ুর্বেদ কিংবা তুকতাক ঝাড়ফুঁকে একে জব্দ করার ওষুধ আছে। মুনিরাম তার বিশ্বাস নিয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। ঢিলি গাছগাছড়ার ওষুধ খায়, কিন্তু কোনো সুফল পায় না। প্রভাবুড়ি রোজ সকালে এসে তাকে ঝাড়ফুঁক করে যায়, সেই সঙ্গে মন্ত্রণপাড়া জল খাইয়ে যায় কিন্তু এতেও কোনো ফল হয় না। আসলে বিধি মারলে ওষুধ মেলা ভার। ঢিলি তাই বুনো হাওয়ার মতো দৌড়ে বেড়ায়, তার রাত-বেরাত নেই, খরা-বর্ষার ধার ধারে না। সে স্বাধীন জলের ধারা। তাকে ঠেকানো যায় না, আটকানোও যায় না।
সভা শেষ হলে মুনিরাম একা হয়ে যায়, কানের ভেতর ঝাঁ-ঝাঁ বোলতার কামড় নিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সে পাড়ায় ফিরে আসে। ধারে-কাছে সে লুলারামকে দেখতে পায় না। ঢিলি মাটিতে পা-থেবড়ে বসে খোলামকুচি দিয়ে আঁচড় কাটছিল। মুনিরাম তার দিকে এগিয়ে গেলে সে চিল্লিয়ে ওঠে, খবরদার, এদিক পানে আসবে না। আমি ঝারির পুতুল গড়িয়েচি গো। ওর বুকে আমি হলাবান মারব। ওকে আমি নাগবান মেরে বিষ ঢালব। ও মাগী আমার সব খেল গো। ওর জন্যি আমি আজ ভাতার ছাড়া।
মুনিরাম কী বলবে কথা খুঁজল। সে কিছু বলার আগেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল ঢিলি, ধুলো হাতটা ছাপা শাড়িতে মুছে সে ছাতা ধরা দাঁত বের করে খ্যা-খ্যা করে হাসল, বুড়ার আবার মরণ দেখো, ছেলের হয়ে বলতে এয়েচে। ছ্যা- ছ্যা! ও আবার ছেলে নাকি? ওতো ছেলি–প্যাঠা। বদা গো, বদা! বুঝেনি। হা-হা-হা! থুতু ছিটিয়ে হাসি ছড়াল ঢিলি। লাঠিতে ভর দিয়ে কিছুটা তফাত-এ দাঁড়াল মুনিরাম, লুলারে দেখেচো, সে কুথায় গেল বলতে পারো?