ভূষণীবুড়ি এই বয়সে একা আছে, ঘর সামলায়, স্বপাক খায়। শরীর ভালো বুঝলে সে ভিখ মাঙতে যায় পাড়ায়-পাড়ায়। দশ ঘরের চাল ফুটিয়ে না খেলে তার খিদে মরে না। আসলে অভ্যেস, স্বভাব দোষ যাবে কোথায়। দুলালের বাপ গত হবার পর ভিক্ষাই ছিল তার একমাত্র জীবিকা, এত দিনের অভ্যাসকে সে তাই ভুলতে পারেনি, কেউ বাধা দিলে সে ফোকলা মাড়ি বের করে বলবে, ভিখ মাঙাটা অক্তে ঢুকে গিয়েচে গো, ঘরে হাত মুড়িয়ে বসে থাকলি পরে শরীলটা ম্যাজম্যাজ করে, সুখের ভাত হজমাতে চায় না। শুনলে হাসবে-ভিখ মাঙতে না গেলে রাতে আমার নিদ হয় না।
রঘুনাথ বেজার মুখে ঘর ফিরে এসে চুনারামকে কথাটা উগলে দিয়ে আর দাঁড়াল না, এক ছুটে টেরি বাগিয়ে বাঁধের গোড়ায় গিয়ে কদমছায়ায় দাঁড়াল। সূর্যর আসার সময় হল, সে গেলে সাইকেল ঠনঠনিয়ে এ পথ দিয়ে যাবে, এবং অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করে যাবে। সূর্য লাখুরিয়ার হাই ইস্কুলে পড়ছে, অথচ রঘুও ওই ইস্কুলে পড়তে পারত, কিন্তু তার বাবার জন্য বড় ইস্কুলে শেষঅব্দি পড়া তার হল না। প্রধান বড়ো মুখ করে বলেছিল, বুনোঘরের কোনো ছেলে যদি পড়তে চায় তার সবরকম খরচাপাতি তিনি সরকার থেকে পাইয়ে দেবেন। কথাটা গুয়ারামের কানে পৌঁছেছিল। কিন্তু গুয়ারাম রাজি হল না, ওর সাহসেও কুলাল না কেন না এর আগে সে এরকম বড়ো বড়ো কথা শুনেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটাই তাদের কপালে জোটে নি। ছেলেকে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিতে সে রাজি নয়, তার চেয়ে নিজের কাজে লেগে যাক। দু-পয়সা কামাক, তা সংসারের দায়ে-অদায়ে লাগবে। মায়ের সঙ্গে পাড়ার সব গোরু নিয়ে চরাতে যেত রঘুনাথ, দুর্গামণির কেঁচড় ভর্তি মুড়ি, যার জন্য ভরদুপুরেও ঘর আসত না তারা, বুড়িগাঙের জলে মুড়ি বাঁধা গামছা ভিজিয়ে পাটালি কিংবা ভেলিগুড় দিয়ে দুপুরের আহারটা সেরে নিত তারা। গোরু চরানোয় যে এত সুখ আগে জানত না রঘুনাথ, পরে যত দিন অতিবাহিত হল–এই সুখ একদিন নেশায় পরিণত হল, সেই সঙ্গে খুলে গেল মনের জানলা-দরজা। বাবুদের গোরু চরাতে এসে কৃষ্ণনগরের কুশল মাস্টারের সাথে তার পরিচয়। এত ভালো মানুষ তাদের আশেপাশের দশ-গাঁ ঘুরে এলেও পাওয়া যাবে না। কুশল মাস্টারের কথায় জাদু আছে যে জাদু হরিনাথপুরের কদবেলতলা ধাওড়াপাড়ার বিদুর রাজোয়ারের আছে। শুধু বিদুর নয়, তার স্ত্রী লাবণি রাজোয়ারও কম যায় না, ওরা এখন সব ধাওড়াপাড়ায় গিয়ে মিটিং-সভা করে বেড়াচ্ছে, বিচারসভার গাঁওবুড়োকে ওরা কোনো পাত্তাই দিতে চায় না। ওদের কথা মন দিয়ে শুনলে গায়ের খুন গরম হয়ে যায় রঘুনাথের। একা থাকলে সেসব কথা মনে পড়ে ওর, মাছ ঘাই দেওয়ার মতো তোলপাড় করে দেয় মন, বাবুদের তখন মনে হয় কালীপুজোর তুচ্ছ শ্যামাপোকা, ওদের ভয় করে কি হবে, ওদের না আছে হুল, না আছে তেজ-বিষ। ওরা টোড়া সাপেরও অধম, শুধু চেহারায় দশাসই রাবণ। ওদের সাথে মিশে বাবুদের আর ভয় পায় না রঘুনাথ, বাবুরা উল্টা-সিধা বললে সে মুখের উপর জবাব দিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে মনের ভেতর আনন্দ এসে জড়ো হয়, আর সেই অন্তর্গত আনন্দটা জিয়োল মাছের মতো রক্তের পুকুরে বেঁচে থাকে ঢের দিন। এখন সময় পেলেই সে হাঁটতে হাঁটতে কদবেলতলার ধাওড়াপাড়ায় চলে যায়। বিদুর আর লাবণির সঙ্গে গল্পগুজব করে ফিরে আসে সাঁঝের বেলায়। দুর্গামণি বকাঝকা করলে সে দাঁত বের করে হাসবে, ও তুমি বুঝবে না মা। সব কতা সবার মগজে কি ঢোকে গো।
-আমার ভয় করে বাপ। শুনেছি ওরা মানুষ ভালো নয়, সুযোগ পেলে মানুষ খেপায়, মানুষ তাতায়। হাসি মিলিয়ে যায় দুর্গামণির শুকনো মুখের। ভয় এসে রাতচরা বাদুড়ের মতো খামচায় মুখের চামড়া।
গুয়ারামের কথা ভেবে চুনারামের রাতের ঘুম উধাও। গুয়ারাম ভিন গাঁয়ে গিয়ে কী খাচ্ছে, কোথায় শুচ্ছে এই নিয়ে যত চিন্তা। বাপকে নিয়ে রঘুনাথের কোনো মাথাব্যথা নেই, সে জানে তার বাবা যেখানে থাকবে ভালো থাকবে। মানুষের ঘাড়ে দায়িত্ব না চাপলে সে ভার বইতে পারে না, এমনকী সিধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সেদিক দিয়ে দুলাল যা করেছে ভালো করেছে, অন্তত কটা দিন ওই কুঁড়ে মানুষটা কাজের মধ্যে থাকতে পারবে যা তার নিজের জন্য মঙ্গল তো বটে, পুরো সংসারের জন্যও সুখের।
চুনারাম বিকেলের দিকে ঘর ছাড়লে হাতে একটা বেতের লাঠি আঁকড়ে ধরে। আজ সে যে লাঠিটা নিয়েছে সেটা তার দাদুর আমলের। শুনেছে এই লাঠিটা দেবগ্রামের গোরুর হাট থেকে কেনা, এই তেলতেলা লাঠিটার বয়স শ’বছরের কম হবে না। লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটলে শুধু শরীরের নয়, মনের বয়সও বেড়ে যায়। তখন বাঁধের ধার দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগাঙের চেয়েও নিস্তেজ মনে হয় নিজেকে। অথচ এই লাঠিটা আঁকড়ে ধরলে শরীরে একটা টগবগে স্ফুর্তি আসে, আত্মবিশ্বাস প্রজাপতির মতো ফুরফুর করে ওড়ে মনের বাদাড়ে।
এখন আলোর রঙ সর্ষেফুলের চেয়েও নজরকাড়া। লাখুরিয়া থেকে উড়ে আসা মেঘটা ছুটে চলে গিয়েছে গাঙের দিকে। ফাঁকা বাঁধের উপর দাঁড়ালেও মেঘের রংটা বোঝা যায় না। এবছরটা খরা জ্বালাবে গাঁ। নামসংকীর্তনের দল খোল-করতাল বাজিয়ে গ্রাম ঘুরবে ভোরবেলায়। ললিত রাগিণীর সুর ভাসবে বাতাসে, হারমোনিয়ামের ব্লো টেনে কৃষ্ণনামের সুর ভাসবে সারা গাঁ-ময়। চুনারাম শুনেছে আজ থেকে দু’ক্ষেপে হবে নামগান। ভোরবেলা আর সাঁঝবেলায়। গাঁওবুড়া গ্রামসভা ডেকে বলেছে, তুলসীমঞ্চে ঝারা বাঁধো সব্বাই। মা তুলসী শেতল হলে পুরা ধরণী শেতল হবে। নামগানের জোরে মেঘ ঝরবে, এছাড়া কুনো গত্যন্তর নেই।