বিকেলে আকাশ জুড়ে কালো কালো হাতির পালের মতো মেঘ। মনে হল, দুর্দান্ত বৃষ্টি নামবে। তবু মাঠে গিয়ে দেখি বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। এক দল হাঁকছে : বিচালিগ্রাম হিপ হিপ হুররে আর এক দল সমানে উত্তর চড়াচ্ছে : ঘুঁটেপাড়া হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে।
ক্যাবলা হঠাৎ আঁতকে উঠল–হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে মানে কী? কখনও তো শুনিনি।
-ওটা ঘুঁটেপাড়ার নিজস্ব স্লোগান। ওরা হিপ-হিপ বলছে কিনা, তাই পালটা জবাব। ওরাও যদি হিপ-হিপ করে, তা হলে এরা বলবে না, এদের নকল করছে? ওরা যদি বলত বিচালিগ্রাম জিন্দাবাদ–এরা সঙ্গে সঙ্গে বলত ঘুঁটেপাড়া মুর্দাবাদ।
–হ্যাঁ, মুর্দাবাদ! নিজেদেরই?
হ্যাঁ, নিজেদেরই। পরের নকল করে অপমান হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভালো বুঝলি না?
-বিলক্ষণ! আচ্ছা বলে যাও।
–এতেই বুঝতে পারছিস, দুটো গ্রামে রেষারেষি কী রকম। দারুণ চিৎকারের মধ্যে তো খেলা শুরু হল। দু-মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলুম, বিচালিগ্রামকে এঁটে ওঠা অসম্ভব। এরা ছজনেই এ-ডিভিশনের প্লেয়ার এনেছে–খেলায় তাদের আগুন ছোটে। আর ওদের গোলকিপার! সে একবারে ছহাত লাফিয়ে ওঠে, তার লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে বল তো বল, বন্দুকের গুলি অব্দি পাকড়ে নিতে পারে।
ঘুঁটেপাড়ায় মাত্র দুজন এ-ডিভিশনের, বাকি চারজনই বি-ডিভিশনের। এ-মার্কা দুজনও ওদের তুলনায় নিরেস। খেলা শুরু হতে না হতেই বল এসে একেবারে ঘুঁটেপাড়ার ব্যাক লাইনে চেপে পড়ল, মাঝ-মাঠও আর পেরোয় না। আর ওদের গোলকিপার শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগল : একটা বালিশ আর শতরঞ্চি দাও হে– একটু ঘুমিয়ে নেব।
আমি আর কী করব- মিডফিলডে দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই আছি। নিতান্তই ঘুঁটেপাড়ার বাকি দশজনই ডিফেন্স লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাই গোল হচ্ছে না কিন্তু দেখতে-দেখতে ওরা গোটা পাঁচেক কর্নার কিক পেয়ে গেল। আর কতক্ষণ ঠেকাবে।
আমি তখনও মা নেংটিশ্বরীকে ডাকছি তো ডাকছিই। এমন সময় আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যে চারদিক অন্ধকার। কিন্তু পাড়াগেঁয়ে লোক, আর কলকাত্তাই খেলোয়াড়ের গোঁ-খেলা দাপটে চলতে লাগল। বল জলে ভাসছে- ধপাধপ আছাড়–এই ফাঁকেও পর-পর দুখানা গোল খেয়ে গেল ঘুঁটেপাড়া। ভাবলুম-যাঃ, হয়ে গেল।
বিচালিগ্রাম তারস্বরে চিৎকার করছে, হঠাৎ এদিকের লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ ফেলে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বললে, শিবতলার পুকুরে ভেসেছে রে– মাঠ ভর্তি মাছ!
অ্যাঁ-মাছ!
দেখতে দেখতে যেন ম্যাজিক। গাঁয়ের লোকে বর্ষায় পুকুর-ভাসা মাছ তো ধরেই, কলকাতার ছেলেগুলোও আনন্দে কেঁপে গেল। রইল খেলা, রইল বিচালিগ্রাম আর ঘুঁটেপাড়ার কম্পিটিশন– তিনশো লোক আর একুশজন খেলোয়াড়, দুজন লাইন্সম্যান সবাই কপাকপ মাছ ধরতে লেগে গেল। প্লেয়াররা জার্সি খুলে ফেলে তাতেই টকাটক মাছ তুলতে লাগল। খেলতে আর বয়ে গেছে তাদের।
এই রে, মস্ত একটা শোলমাছ পাকড়েছি।
আরে–একটা বাটামাছের ঝাঁক যাচ্ছে রে।
ইস–কী বড় বড় কই মাইরি। ধরধর
সে যে একখানা কী কাণ্ড, তোদের আর কী বলব। খেলার মাঠ ছেড়ে ক্রমেই দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবাই। শেষে দেখি, মাঠে আমরা দুজন। আমি আর রেফারি।
রেফারি ওখানকার স্কুলের ড্রিল-মাস্টার। বেজায় মারকুটে, ভীষণ রাগী। দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কী? ইয়ু গো অন প্লেয়িং।
ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, আমি একাই খেলব?
ইয়েস– একাই খেলবে। আমি তো খেলা বন্ধ করিনি।–ধমক দিয়ে রেফারি বললেন, খেলো। প্লেয়াররা মাঠ ছেড়ে মাছ ধরতে দৌড়লে খেলা বন্ধ করে দিতে হবে, রেফারিগিরির বইতে এমন কোনও আইন নেই।
তখন শুরু হল আমার গোল দেবার পালা। একবার করে বল নিয়ে গিয়ে গোল দিয়ে আসি, আর রেফারি ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে আবার সেন্টারে নিয়ে আসে। এই-ই চলতে লাগল।
ওদের দু-একজন বোধহয় টের পেয়ে ফেরবার কথা ভাবছিল, এমন সময় মা নেংটীশ্বরীর আর-এক দয়া। মাঠের কাছেই ছিল সারে সারে তালগাছ। হঠাৎ হু-হু করে ঝোড়ো হাওয়া, আর ঝপাসঝপাস করে পাকা তাল পড়তে লাগল।
তাল পড়ছে– তাল পড়ছে—
যারা ফিরতে যাচ্ছিল, তারা প্রাণপণে ছুটল তাল কুড়োতে।
এর মধ্যে আমি যা গোল দেবার দিয়েছি– মানে গুনে-গুনে বত্রিশটি। আমি গুনছি না, গোল দিতে দিতে আমার মাথা বোঁ-বোঁ করছে, আর ওই ভারি ভেজা বল বারবার সেন্টার থেকে জলের ওপর দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি–চাড্ডিখানা কথা নাকি! একবার বলেছিলুম, অনেক তো গোল দিয়েছি স্যার, আর পারছি না–পা ব্যথা করছে। রেফারি আমায় তেড়ে মারতে এলেন, বিকট মুখ ভেংচে বললেন, ইয়ু গো অন গোলিং–আই সে।
গোলিং আবার ইংরেজী হয় নাকি ক্যাবলা বলতে যাচ্ছিল, টেনিদা একটা বাঘা ধমক দিয়ে বললে, ইয়ু শাটু আপ! যে মারকুটে মাস্টার, তার ইংরেজীর ভুল ধরবে কে? আমি গোল দিচ্ছি আর উনি গুনেই যাচ্ছেন, থার্টি–থার্টিওয়ান-থার্টিটু।
ওরে গোল দিচ্ছে বুঝি– বলে ওদের সেই গোলকিপারটা দৌড়ে এল। সে যে রকম জাঁদরেল, হয়তো একাই বত্রিশটা গোল ফেরত দিত, আমি আটকাতে পারতুম না– বেদম হয়ে গেছি তখন। কিন্তু রেফারি তক্ষুনি ফাইন্যাল হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, খেলা ফিনিশ। তারপর আমাকে বললেন, এখন যাও কই মাছ ধরো গে, তাল কুড়োও গে।