সেই ছেলেটি ডাকে, এদিক দিয়ে নামুন, বলে মাদারির মার কোণ দিয়ে, ড্রাইভারের দরজার পাশ দিয়ে নামার রাস্তাটি দেখায়। দেউনিয়া একটু লজ্জিত মুখেই মেয়েদের ভিড়ের ভেতর দিয়ে পা ফেলে-ফেলে সেই কোণটায় আসে তারপর ঝুঁকে দেখে নেয় কী ভাবে নামতে হবে। তার সামান্য হাসিতে বোঝা যায়, এই পথটা তার কাছে নিরাপদ ঠেকেছে। ডান হাতে ড্রাইভারের চালের পেছনটা আর বা হাতে ড্রাইভারের দরজার ওপরটা ধরে দেউনিয়া যেই দুই ধাপ নেমেছে, সামনের ট্রাকটা চলা শুরু করে। এই ট্রাকের লোকজন চিৎকার শুরু করে–হে তালই, উঠি আসেন, উঠি আসেন। দেউনিয়া তাড়াতাড়ি আবার যেই ড্রাইভারের দরজার ওপরটা ধরে ধাপে বা পা দিয়েছে, তার পায়ের ধুতিটা পেছনে আটকে যায়। ততক্ষণে সেই ছেলেটি মুখ বাড়িয়ে বলে, আপনি যান, গাড়ি যাবে না, যান। দেউনিয়াকে প্রধানত ধুতির কারণেই নামতে হয়। ছেলেটি আশ্বাস দেয়ায় রাস্তায় নেমে একটু সরে গিয়ে বসে পড়ে।
ততক্ষণে সামনের ট্রাকটা অনেকখানি চলে গিয়ে বা দিকে ঘুরে গেল। পেছনের ট্রাক হর্ন বাজাচ্ছে। সামনের পুলিশ হাত দিয়ে ডাকছে। ছেলেটি ডালার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পুলিশকে হাত দেখিয়ে ইশারা করে।
ট্রাকের ভেতর থেকে আবার চিৎকার ওঠে, হে-এ তালই, বাকিখান এইঠে করিবেন, চলি আসেন। রসিকতা করে ড্রাইভারই বুঝি হর্ন দিয়ে বসে। আর, দেউনিয়া উঠে দাঁড়ায়, তাড়াতাড়ি ঘুরে ট্রাকের দিকে মুখ করে কাপড় নামায়। তারপর দৌড়ে এসে ড্রাইভারের দরজা ধরে পাদানিতে ওঠে।
দেউনিয়া ট্রাকের ভেতর নামলে সেই লিডার ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ড্রাইভারের দরজার ওপরের টিনে আওয়াজ করে বলে, চালান।
একটু চালিয়ে ক্যাম্পটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ এসে বলে পারমিট? :
ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে চালসার শ্লিপ দেখায়। কতজন আছেন, একজ্যাক্ট নাম্বারটা বলুন–পুলিশের লোকটি না-তাকিয়ে বলে। ছেলেটি সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই গুনতে শুরু করে। গোনা হচ্ছে এটা বোঝার পর সকলেই একটু সোজা হয়ে বসে। একবার গোনা শেষ হলে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে, কেউ নীচে নেই ত? ড্রাইভারের ওখানে কজন আছে? বলে, আর-একবার গোনা শুরু করে–সাতাশি। তারপর মুখ বাড়িয়ে বলে, এইটি সেন।
পুলিশ পাশের ছেলেটিকে বলে, এইট্টি সেন। তারপর একটা বড় কাগজ এগিয়ে দেয়, এইটা, কাঁচে লাগিয়ে নেবেন, নইলে ট্রাক ঢুকতে দেবে না। ছেলেটি হাত বাড়াতেই পুলিশের পারে ছেলেটি একটি ব্যাজের বান্ডিল এগিয়ে দিয়ে বলে, প্রত্যেককে পরে নিতে বলবেন, নইলে এনক্লোজারের ভেতর ঢুকতে দেবে না। আর, একটু দাঁড়ান।
সেই ফাঁকে পুলিশ বড় কাগজটি ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশের পাশের ছেলেটি একটা ঝুড়ি, তুলে ধরে বলে, টিফিন। সাতাশিটা আছে, নামিয়ে নিয়ে ঝুড়িটা দিন, ঝুড়িটা দিন।
ছেলেটির হাত থেকে ট্রাকের কয়েকজন ঝুড়িটা তুলে নেয়। তারপর ইতস্তত করে, কোথায় রাবে। সেই লিডার ছেলেটি বলে, ওখানেই ঢেলে রেখে ঝুড়িটা ফেরত দিয়ে দিন।
ট্রাকের ভেতর একটু জায়গা করে দেয় সবাই। ওরা ঝুড়িটা উপুড় করে বাইরে ফেরত দেয়। ট্রার্কের ভেতরটা আলু আর আটার গন্ধে ভরে যায়। ট্রাক চলতে শুরু করে। মানাবাড়ির ধাক নেয়।
ট্রাক যখন আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতর ঢোকে মাদারি ও মাদারির মার মনে হয় তারা যেন আবার শ্যাওড়াঝোরায় ফিরে আসছে।
সেই সময় মাদারির মা ব্যাজ পায়, সঙ্গের সেফটিপিন দিয়ে সেটা ফোতার ওপর বুকের কাছে এটে নেয়। টিফিনের ঠোঙা পায়। কয়েক শতাব্দী পর যেন মাদারির মা তার জিভে মানুষের তৈরি গম ও সেই গম থেকে তৈরি আটার স্বাদ পায়। কয়েক সহস্রাব্দী পর মাদারির মা জিভ দিয়ে জানে–পৃথিবীতে স্বাদের বৈচিত্র কতটাই। মাদারির মার মুখের ভেতরে আলু আর রুটির টুকরো মুখবিবরের সহস্র গ্রন্থিমুখ থেকে নিঃসৃত লালায় যখন ভিজছে, ভিজছে, আর মুখের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখন সে দেখে আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত এক নদীকে আড়াআড়ি ভাগ করে এক দেয়াল যেন আকাশের দিকেই ছুটে যায়। তিস্তা ব্যারেজ।
.
২১৪.
নেতা আর মিছিল
ব্যারেজের চারটে স্লুইস মাত্র সম্পূর্ণ হয়েছে। তাতেই এখন এই উদ্বোধন করাতে হচ্ছে ব্যারেজের সবগুলো স্লুইস না-হলে তার কোনো অর্থই নেই কিন্তু এখানে উদ্বোধনের জন্যে তিস্তা ব্যারেজকে সাজানো হয়েছে বেশ কৌশল করে।
তৎসত্ত্বেও লোকজনকে স্লুইস খোলার ঘটনাটা দেখানো দরকার যাতে সবাই বোঝে তিস্তাকে আটকে তার মূলখাতে ফিরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বলতে আসতে কী বোঝায়। কিন্তু সারা বর্ষা ত তিস্তা নির্দিষ্ট খাতেই বয়ে গেছে। এখন ত আর উদ্বোধনের সুবিধের জন্যে তার জলকে ভাটি থেকে ফিরিয়ে এনে যাকে বলে রিজার্ভেয়ার সেখানে ঢোকানো যাবে না।
সেই কারণে, উদ্বোধন-অনুষ্ঠানের জন্যেই বিশেষ করে, ব্যারেজের উত্তরদিকে তিস্তার জলকে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে দিয়ে পুব পারের দিকে, আপলচাঁদ ফরেস্টের দিকে, সরিয়ে আনা হয়েছে। উদ্বোধন হয়ে গেলে, এই বাধ ভেঙে আবার জল ছড়িয়ে দিতে হবে, নইলে ব্যারেজের কাজ এগবে না। বাধ মানে, বন্যা-ঠেকানো বাধ নয় জল-সরানোর বাধ। সেজন্যে গত প্রায় মাসখানেক, বিশেষত দিনবিশেক, ব্যারেজের সব কুলিকে এই বাঁধের কাজে লাগানো হয়েছে। একটু ওপর থেকে কোনাকুনি এনে বাঁধের মুখটাকে ব্যারেজের প্রথম দুটি সুইসের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। চারটে স্লুইস সম্পূর্ণ হলেও, স্লুইস, দিয়ে জলের প্রবাহ যদি দেখাতে হয় তা হলে দুটো স্লুইস দিয়েই জল ছাড়তে হবে। চারটে স্লুইস দিয়ে সমান তোড়ে ছুটে হারিয়ে যাবে–তিস্তায় এখন এত জল, নেই।