- বইয়ের নামঃ তিস্তাপারের বৃত্তান্ত
- লেখকের নামঃ দেবেশ রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ আদিপর্ব – গয়ানাথের জোতজমি
০০১.
হাটের পথে
একই হাটে একসঙ্গে দুটো সাইনবোর্ড যাচ্ছে–এ বড় একটা দেখা যায় না।
একটা বেশ লম্বা-চওড়া, বড়, নতুন। হলুদের ওপর কাল, সরকারি সাইনবোর্ড যেমন হয়, শিলমোহর আঁকা, কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র। আরো কী সব। টানতে লোকটির বেশ কষ্ট, একবার ঝুলিয়ে নেয়–কিন্তু তাতে রাস্তায় ঠুকে যায়। বগলেও নেয় দু-একবার–তাতে কাত হয়ে বেড় পাওয়া যায় না। অবশেষে মাথায়। সেটাই সবচেয়ে সুবিধের। এক হাতে মাথার ওপর সাইনবোর্ডটা ধরা, আর-এক হাতে নাইলনের জুতোজাড়াটা ঝোলানো«পেছনের ঝোরা পেরতে খুলতে হয়েছিল, সামনে আছে পায়ে ও ফেরিতে পার-হওয়ার আরো নদী, বার তিন-চার। নাইলনের, পান্টটাও হাটুর তলা পর্যন্ত গোটানো, বেশ ভাজ করে করে, যেন নদীগুলোর জলের মাপের একটা আন্দাজ আছে।
আর একটা সাইনবোর্ড, ছোট। কালর ওপর শাদা–কিন্তু মনে হয় বহুকালের। শিলমোহর আঁকা। বেশ বড় বড় হরফে, হলকা ক্যাম্প। থলির সঙ্গে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে বিড়ি খেতে-খেতেই যাওয়া যাচ্ছে। বিড়ি না খেলে আর-এক হাতে করবেটা কী? ধুতিটা হাঁটুরও ওপরে-নদী-নালা-কাদাবালি পেরিয়ে যাওয়ার মত। পায়ের নতুন নীল ব্যান্ডের হাওয়াই স্যান্ডেলটার সোল আছে শুধু আঙুলের সঙ্গে খানিকটা। এতটা ক্ষইয়ে দিতে বেশ কয়েক বার নতুন ব্যান্ড পরাতে হয়েছে। পায়ের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে গেছে যে, খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিতে গেলে খসে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। পা থেকে খসাতে গেলে, পায়ের পাতাও যেন কিছুটা খসে আসবে। এটা খুললে চলার এই শব্দটা থেমে যাবে। তা হলে আর চলাই যাবে না।
‘কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’ এখন তার জুতোজোড়াটাও সাইনবোর্ডটার ওপর ফেলে, দুই হাতে সাইনবোর্ডের দুটো দিক ধরে, বেশ দুলে-দুলে তাড়াতাড়িই ছুটছে–এতক্ষণে যেন সে তার চলার একটা গতি বের করতে পেরেছে। অত বড় সাইনবোর্ডের টিনে ডডং-উং ডডং-ডং আওয়াজ উঠছে। ওপরে জুতো জোড়াটাও লাফাচ্ছে। তার চলার ছন্দটা বেশ, টিন পেটাইয়ের আওয়াজে সব দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চার পাশ এত নির্জন, আওয়াজ বড় হলে কেমন ছড়িয়ে মিশে যায় বেশ।
চারপাশ নির্জন, শুধু এই রাস্তাটুকু দিয়ে লাইন বেঁধে লোক চলছে। আজ ক্রান্তির হাট। হাইওয়েতে বাস থেকে নেমে কেউ-কেউ রিক্সাও নেয়। তারপর রিক্সাঅলার সঙ্গেই ছোট-ছোট নালা ঠেলেঠুলে রিক্সা পার করে। ফেরিতে রিক্সাঅলাই নৌকোতে মাল তুলে দেয়। ওপারেও রিক্সা আছে আজকাল। বড়বড় মালপত্র যাদের, তাদের ত রিক্সা লাগেই। কাটাকাপড়, গেঞ্জি, লুঙি, শার্টপ্যান্টের দোকানিরা সাইকেলের সামনে ঝুলিয়ে, পেছনে বেঁধে, কাজ সেরে নেয়। কিন্তু আলুর বা এলুমিনিয়ামের বড় দোকানির ত রিক্সা না হলে খরচা বেশি পড়ে যায়–এক রিক্সার মাল কয়েক জনের মাথায়-মাথায় নিয়ে যেতে।
কিন্তু বেশির ভাগই হেঁটে চলে–মাথায় বা বাকে বোঝা ঝুলিয়ে। বাসে হাইওয়েতে নেমে, বাসের মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে, রিক্সায়-রিক্সায় কয়েক মাইল দূরের হাটে যাওয়ার সুবিধে। কিন্তু যারা দক্ষিণে, চকমৌলানি থেকে বা উত্তরে সেই হায়হায়পাথার থেকে টাড়ি বাড়ি-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, নদী-নালা, পেরিয়ে-পেরিয়ে, বাকে বা মাথায় বোঝা নিয়ে, বা গরু-ছাগল তাড়িয়ে-তাড়িয়ে রাস্তা ছোট করতে করতে আসে, তাদের আর এই পাকা রাস্তাটুকুতে রিক্সার দরকারটা কী। চিলতে রাস্তাটুকুতে যেন নদীর বেগ এসে যায়, একটু তলার দিকের পাহাড়ী নদীর বেগ, হঠাৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য একটা বান বয়ে যাচ্ছে যেন। রিক্সাও বেশ ছুটে চলে, হটনও দেয়। পায়ের তলায় পাকা রাস্তা পেয়ে বোঝা-মাথায় বা বাককাঁধে মানুষের পায়েও বেগ এসে যায়। কেউ কারো দিকে তাকায়ও না, কথাও বলে না। তাড়াতাড়ি হাটার বা মাল বইবার ফলে মানুষজনের দ্রুত নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। চার পাশ এত নির্জন যে মানুষের শ্বাস নেয়া-ছাড়ার মত প্রায় নিঃশব্দ আওয়াজও মিশে যেতে পারে না, আলাদা হয়ে থাকে।
কিন্তু হাটে যাবার এখন শেষবেলা বলেই হোক বা এই রাস্তাটুকু পাকা বলেই হোক ভিড়টা ছুটতে থাকলেও কেমন জমাট থাকে। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একই দিকে যাচ্ছে–এতেই ত তাদের ভেতর বেশ একটা মিল পাওয়া যায়। তদুপরি, একজনের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড আর আর-একজনের পিঠে বহু পুরনো এক ছোট সাইনবোর্ড যেন এই ভিড়টাকে আরো বেশি এক করে দিতে চায়–নিশান আর ফেস্টুনই যেমন মিছিল বানায়।
এখন, এই রাস্তার যে-ভিড়টুকু এদের দুই সাইনবোর্ডে বাধা পড়েছে, তার ভেতর দিয়ে হর্ন আর বেল বাজাতে বাজাতে রিক্সা আর সাইকেল একে বেঁকে বেরিয়ে যায় বটে কিন্তু তার পরেই ভিড়টুকু আবার জমাট। একজন একটিমাত্র ছোট খাশি নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে। খাশিটার বোধ হয় আগেই কিছু অভিজ্ঞতা আছে বা ভয় পেয়েছে–এক পা-ও ফেলে না। লোকটিও বেশ নিশ্চিন্ত মনেই তাকে টানে। যেন জানে এভাবেই যথাসময়ে সে হাটে পৌঁছে যাবে। খাশিটা মাঝেমধ্যে রাস্তার ভেতর বসে যাচ্ছে। লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ছে। খাশিটাকে টানছেও না, সাধছেও না। খাশির, পেছনেই, এদিককার ছোট বড় সব হাটেরই সেই চা-ওয়ালা ছেলেটি, তার কাঠের বাক্স মাথায়, ওরই ভেতর উনুনকয়লা চাবানানোর অন্য সব সরঞ্জাম। খাশিটা বসে গেলেই সে খাশির ঠিক পেছনে ছোট করে লাথি মারছিল আর খাশিটা কয়েক পা দৌড়য়। ছেলেটি কখন হাত বাড়িয়ে একটা কঞ্চি টেনে নিয়েছে। এখন আর লাথি মারতে হয় না, লম্বা কঞ্চিটা দিয়ে যথাস্থানে খোঁচা দিলেই খাশিটা একটু ছোটে। তিনটে ছোট-ছোট মুরগি উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লুঙিপরা একজন। মাঝখানে একটি বাচ্চা ছেলের মাথায় বেশ বড় সাইজের কুমড়ো। খুব ছোট টাইট হাফপ্যান্ট, পাতলা নেটের গেঞ্জি, মোজা-কেডস পরে একজন খালি হাতেই চলেছে। যতবার নদী-নালা পার হচ্ছে–ততবার জুতো-মোজা খুলছে আর পার হয়ে, পরছে। এদিকের ন্যাওড়া নদীর পুবের, বাগানের মজুররা ক্রান্তিহাটে খুব একটা যায় না। ক্রান্তিহাটের পশ্চিমে ত প্রায় শুধুই চা বাগান–হাটে তাদের একটা ভিড় হয়। এ হয়ত কোথাও গিয়েছিল, ফিরছে। বা হাটে কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আছে। তেল কুচকুচে কোকড়ানো চুল। পাতলা নাইলনের গেঞ্জির ভেতর থেকে শরীরের রং চিকচিকচ্ছে। তার বেশ ক্যাপ্টেনি মেজাজ—চলনে। এক ঝাক হাঁস খাঁচায়। একটা বাকের এক দিকে একটা লাউ আর-একদিকে একটা বড় বস্তা ছোট করে বাধা। এক জনের মাথায় সের দশেক পাট। ছিটের হাফশার্ট, চেক লুঙি, রবারের পাম্পসু, কাঁধে গামছা, ঘাড়ে-গর্দানে পিঠে-কোমরে বেশ পেটানো মাংস। জোতদার ত বটেই, বেচাকেনার ব্যাপারিও বোধহয়। হয়ত,লোক দিয়ে গরুর গাড়ি ভর্তি করে বেচার মাল পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই। নয়ত, কিছু বেচার নেই, কিনতে যাচ্ছে। বা, হয়ত হাট বলেই যাচ্ছে, দর-ভাও জানতে, তেমন কোনো কাজ নেই। ফোতা-পরনে একখানা বেটি-ঘোওয়ার মাথায় কলার ডোঙা ভাজ করে বানানো পাত্রে মাছ, সারাদিন ডোবায় ধরে এখন বেচতে যাচ্ছে। মাঝারি সাইজের এড়ে বাছুর অনেকক্ষণ ধরে আসছে–গলায় নতুন দড়ি। তার মানেই হাট। কিন্তু গোহাটা ত বসে সকাল থেকেই। যারা বেচে আর যারা কেনে তারা সারাদিন ধরেই প্রায় ঘুরে-ফিরে দেখে আর দাম করে আর নজর রাখে, কেউ যেন তার পছন্দটা কিনে না ফেলে। শেষ হাটে আসে চোরাই গরু। দামও পড়ে শস্তা। হাট পর্যন্ত যেতে হয় না অনেক সময়ই। রাস্তা থেকেই বেচা-বিক্রি হয়ে যায়। ক্রান্তির হাটটা অবিশ্যি, সেদিক থেকে চোরাই গরু বিক্রির খুব ভাল জায়গা হতে পারত। পুবে হাইওয়ে থেকে দশ মাইল ভেতরে, মাঝখানে। এক খেয়া, চার খাল। পশ্চিমে বিশাল আপলাদ ফরেস্ট আর চা বাগান আর পাহাড়ি চড়াই সেই বাগরাকোট কয়লাখনি আর শেভক ব্রিজ পর্যন্ত–কোনো বর্ডার পার করে ময়নাগুড়ি দিয়ে এনে এই রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলেই হত। কিন্তু তার পর? এই চার খাল–এক খেয়া পার হবে কী করে? গরু বেচিতে রাখোয়াল ফক্কা। তাই বর্ডারের চোরাই মাল আর আসে না। এদিক-ওদিক থেকে দুটো-একটা চোরাই গরু ফরেস্টের ভেতর বেঁধেটেধে রেখে সময়-সুযোগ মত হাটের রাস্তায় এনে বেচে দেয়।
এখন এই রাস্তা জুড়ে সেই শেষ হাটার যাত্রীরা চলেছে–
পয়লা হাটাত দোকানিয়া বেচে
মাঝা হাটাত দেউনিয়া বেচে
শেষো হাটাত ঘরুয়া বেচে।
হাটের প্রথমে ব্যবসায়ীদের বড় বড় কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়। তখনই হাটের সারা দিনের দরদাম ঠিক হয়, পাট-তামাক এই সব কত করে যাবে। আজকাল ধান-চালের ত আর বড় কেনাবেচা হয় না–তার দামও আর এই সব হাটের ওপর ওঠানামা করে না। বড় বড় কেনাবেচা হয়ে গেলে গরুর গাড়িতে, আজকাল ত তেমন-তেমন সময় ট্রাকও আসে, মাল সারাদিন ধরে যেতে থাকে।
হাটের মাঝবেলায় আসে জোতদার-দেউনিয়া। সংসারের জিনিশও কেনে, চাষ-আবাদের জিনিশও কেনে। আবার বেচেও দেয় সংসার আর চাষ-আবাদের নানা জিনিশ। আর একেবারে শেষ হাটে আসে ঘর-গেরস্থালির মানুষ জিনিশ বেচতে–একটা কুমড়ো, একটা হাঁস, চারটি ডিম, একটা খাশি–এই সব।
এখন এই রাস্তাটুকু দিয়ে সেই শেষ হাট চলছে। চলতে গেলেই লাইন বাধা হয়ে যায়। আর লাইন বাধা হয়ে যায় বলেই আকাশের দিকে ফেরানো কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’, আর পিঠে-ঝোলানো হলকা ক্যাম্প যেন এই পুরো লাইনটিরই পরিচয় হয়ে উঠতে চায়। যেন, এই পুরো লাইনটাই গিয়ে ঢুকবে গো-প্রজননের কৃত্রিম ব্যবস্থায় বা, সেটলমেন্টের হলকা ক্যাম্পে।
.
০০২.
ন্যাওড়া নদীর খেয়া
গাছগাছালি, বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে এই পাকা রাস্তাটা শেষ হয়ে যায় নদীর পাড়ে। ন্যাড়া নদী। খেয়াটা ছাড়ছে। খেয়ায় উঠতে মাঝখানে আর-একটা হাঁটুজল পেরতে হবে। সবাই সাইনবোর্ড টাঙানো লাইন ভেঙে, গড় গড় করে গড়ান বেয়ে নেমে, হে-ই’ হে-ই করতে করতে শেয়ার দিকে ছু চলে। খাশিটাকে মুহূর্তে লোকটা কাঁধে তুলে নেয় আর কাঁধে উঠেই খাশিটা লেজ তুলে নাদি-কোতে থাকে, যেন অপেক্ষাতেই ছিল। লোকটাও যেন জানতই। কাঁধের ওপর এমন ভাবে খাশির চার পা গুটনো যে নাদিগুলো সবই বাইরে পড়ে, লোকটির গায়ে লাগে না। লোকটির গায়ে নাদি ফেলতে না পেরেই খাশিটা তারস্বরে চিৎকার তুলে শরীর ঝাঁকানোর ষ্টো করে যাতে কাধ থেকে ছিটকে যেতে পারে। কিন্তু লোকটি কাঁধের ওপর দুই হাতে খাশিটির চার পা আঁকড়ে লাফিয়ে গিয়ে খেয়ায় ওঠে। সাইনবোর্ড দুটো নিয়ে লোকদুটিও এমন ছোটে যে মুহূর্তে মনে হয়, তারা বুঝি এই সাইনবোর্ড-দুটিই বেচতে যাচ্ছে হাটে, যেন এখন এই সাইনবোর্ড-বেচার সিজন।
কিন্তু বড় সাইনবোর্ডটা নৌকার ওপর খাড়া দাঁড় করানো হলে, আর ছোট সাইনবোর্ডটা পিঠেই ঝুলিয়ে লোকটি দাঁড়ালে মনে হয় সত্যিই পুরো নৌকোটা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র’ ও হলকা ক্যাম্প।
লোকটা ত ঘাট থেকে নৌকো আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। এদের চিৎকারে লগিটা আর ঠেলে নি। এরা পাড়ের জলকাদা ডিঙিয়ে এসে কোনোরকমে নৌকোয় উঠেছে। নৌকোর পাটাতন ভেজাই ছিল। এরা আরো একটু ভেজায়। সবাই উঠতেও পারে নি। কিন্তু তোক বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে মাঝি লগি ঠেলে নৌকোটা সরিয়ে নিয়েছে। লগির আর দু-এক ঠেলাতেই ত ওপারে পৌঁছে যাওয়া যাবে–এতই ছোট নদী। হয়ত হেঁটেও পার হওয়া যায় কোথাও-কোথাও। কিন্তু সব জায়গায় ত সব সময় এক জল থাকে না। আবার ওপর থেকে ছোটখাট বানও এসে থাকতে পারে। সেই কারণেই নৌকোয় পার হওয়া।
নৌকোয় সবাইই দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই এদিককার সবচেয়ে বড় জোতদার নাউছার আলম। ওয়াকফ এস্টেটের মালিক। হাজার-হাজার বিঘার চুকানদার। ডুয়ার্স যখন প্রথম বন্দোবস্ত দেয়া হয় তখন থেকে নাউছার আলমরা এখানকার সব জমির মালিক। খাশ জমির আইন পাশ হওয়ার পর গত পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর ধরে নাউছার আলমের সঙ্গে সরকারের মামলা লেগেই আছে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অনেকগুলি কেস গিয়েছে, তার অনেকগুলোতে আলম জিতেছে, সরকার হেরেছে। তা ছাড়া অসংখ্য জমিতে ইনজাংশন হয়ে আছে দশবার-পনের-বিশ বছর। ইনজাংশনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত সেই সমস্ত জমির ফসল আলমের গোলাতেই উঠছে। সরকার আলমের জমির ঘাসও ছুঁতে পারে নি–এরকমই সবার ধারণা। আলমের জমির কোনো-কোনো অংশে আধিয়াররা মাঝে-মধ্যে ভাগ দেয় নি বা সরকারের কাছে জমির পাট্টা চেয়েছে। কখনো পেয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে তেমন ঘটনা খুব বেশি নয়। নাউছার আলম লোকটি বেঁটেখাট। শাদা হাফশার্ট আর ছোট মাপের একটা পায়জামা পরনে। হাতে ছাতা। সবাইই সেলাম দিচ্ছে। নাউছারও তাদের সেলাম জানাচ্ছে। নাম ধরে ধরে সবার খোঁজখবর করছে। এদিককার বড় বড় সব হাটে নাউছার কিছুক্ষণের জন্য গিয়ে বসে। সবার সঙ্গে দেখাশোনা খোঁজখবর হয়।
নাউছারের কাছেই, কিন্তু একটু যেন দূরত্ব রেখে, দাঁড়িয়ে যোগানন্দ মন্ত্রী। প্রফুল্ল ঘোষ যখন মাস তিনেকের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল–প্রথম যুক্তফ্রন্টের পর, তখন যোগানও মন্ত্রী ছিল; বোধ হয় মাস-দুই। তার পর থেকে তার নামই হয়ে আছে যোগানন্দ মন্ত্রী। ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে যোগানন্দও ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে। নাউছার আলম যোগানন্দকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, মন্ত্রীমশাই, ঐ বড় সাইনবোর্ডে কী লিখা আছে? যোগানন্দ আগেই দেখেছিল। বলল, ঐ হরিয়ানার বলদের–
ও, নাউছার বুঝে যায়। এ অঞ্চলে সেইই প্রথম কৃত্রিম গো-প্রজনন শুরু করেছিল–তাও বছর কয় আগে। এখন তার বাথানে ত হরিয়ানা ছাড়া অন্য কোনো গরু নেই বললেই চলে। বাসে যেতে-যেতেও ফরেস্টের পাশের জমিতে মোষের সাইজের গরু চরতে দেখলে অনেকেই বলে দিতে পারে, নাউছারের গরু। নাউছার আবার জিজ্ঞাসা করে, আর ঐঠে কী লিখা মন্ত্রীমশাই, ঐ যে মানষিটার পিঠত?
যোগানন্দ বলে, কালি থিকা ত এইঠে হলকা ক্যাম্প বসিবে–
ও–নাউছার বুঝে যায়। একটু চুপ করে থাকে। তারপর যেন আপন মনেই বলে, হলকা ক্যাম্পত জমি দিবে আর পশু হাসপাতাল বলদ দিবে, তবে ত মোর এইঠে সোনার সংসার হবা ধরিবে। কথাটা কেউ-কেউ শুনতে পায়, কেউ-কেউ একটু হাসেও। নাউছারের মাথায় এই দুটো সাইনবোর্ডের ব্যাপারটা খেলে গেছে বলেই সে কথাটা বলে। কথাটার মধ্যে কোনো ঝাঁঝ ছিল না। দূর থেকে একজন একটু চেষ্টা করেই নাউছারের নজরে পড়ে, তার পর দূর থেকেই সেলাম জানায়। নাউছার আলম জিজ্ঞাসা করে, কী, বিবি হাসপাতালঠে ফিরি আইসছে? লোকটি হেসে ঘাড় কাত করে। বেশ বেশ বলে নাউছার তার পাশের লোকটিকে কিছু বলতে মুখ ঘোরায়।
নৌকো পাড়ে ভিড়ে গেছে। নাউছারের পাশে পাড়ের দিকে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা আস্তে নেমে যায়, নৌকো দুলিয়ে লাফায় না। পেছনে যারা ছিল, তারাও কেউ হুটোপাটি করে নামে না। নাউছার আলম আস্তে-আস্তে নৌকো থেকে মাটিতে নামে। নেমে নৌকোর দিকে তাকিয়ে হেসে যেন ধন্যবাদ দেয়, বুড়া মানষি, আর লাফাঝাপা করিবার না পারি, আসেন, নামেন এ্যালায় সব। ততক্ষণে যে যার মোট তুলে নিয়েছে। সবাই একে-একে নামতে শুরু করে।
যোগানন্দ পেছনের দিকে ছিল। সে ধীরেধীরে নামে। হাটে তার কোনো কেনা-বেচারকাজ নেই। মাঝে-মাঝে হাটে এলে সবার সঙ্গে দেখাশোনা হয়, কথাবার্তা হয়, দেশগায়ের ভাব বোঝা যায়। তা সে কথাবার্তা ত খেয়ানৌকোর ওপরও হতে পারে, নেমে পড়েও হতে পারে।
এছাড়াও অবশ্য যোগানন্দের অন্য একটা ভয় ছিল। যদি নাউছার আলম তার সঙ্গে চলতে শুরু করে তা হলে ত সে আর-কিছু করতে পারবে না। কিন্তু হাটসুষ্ঠু লোক দেখবে যোগানন্দ এখন নাউছার আলমের সঙ্গে হাটে আসে। সেটা সে চায় না। সে নাউছার আলমকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেয়।
কিন্তু পাড়ে উঠে দেখে পাকা রাস্তায় রিক্সার ওপর নাউছার আলম বসে এদিকে তাকিয়ে। চোখ ফেরানোরও কোনো উপায় নেই। কাছে যেতেই নাউছার বলে, কী মন্ত্রীমশাই, আর ত রিক্সা নাই এইঠে, আপনি কি মোর পাকে আসিবেন, নাকি এদিকে কামকাজ আছে?
নাউছার আলমও কি তার সঙ্গে যেতে চায় না, নাকি? না, আপনি যান, আমার একটু দেরি হবে। খালপাড়াঠে একোজনের আসিবার কথা।
আচ্ছা, আচ্ছা। নাউছার জবাব দিতেই রিক্সাওয়ালা চালাতে শুরু করে দেয়। নাউছার আলম যেন সব সময়ই আইন মেনে চলে। আর-একটা রিক্সা থাকলে সে যোগানন্দের জন্যে পাড়াত না। কিন্তু তাই বলে যোগানন্দকে সে জোর করে ধরে তার রিক্সাতে তুলবে না। তার সঙ্গে রিয়ায় যাওয়ায় মন্ত্রীর যে-অসুবিধা তাও যেন নাউছার বোঝে। কিন্তু সে ডাকলে ত যোগানন্দ না করতে পারবে না। তাই কথার মধ্যেই ফাঁক রেখে দেয়ইচ্ছে করলে যোগানন্দ না-ও আসতে পারে। কিন্তু মাত্র একটা রিক্সা আছে দেখেও নাউছার আলম চলে যেতে পারে না, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হয় কতকাল আগের মাস-তিনেকের এক সরকারের মাস-দু-একের মন্ত্রীর জন্য। এই ঘাট থেকে হাটটা খানিকটা হাঁটা পথ। কিন্তু এপারে লোকজনের চলমান ভিড়টা জমাট বাধে না। এদিককার নানা টাড়ির, গায়ের, লোকজন হাটের দিকে চলেছে। মাঠঘাট দিয়ে অনেককেই চলতে দেখা যায়। নানা রাস্তা, নানা মাঠঘাট দিয়ে, সব দিক থেকে সবারই যেন এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর তাড়া, যে যার মত। গো-প্রজনন আর হলকা ক্যাম্প-ও কখন একসময় সেই রাস্তার ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাটের দিকেই ছুটেছে।
.
০০৩.
‘সত্যমেব জয়তে’
পিঠে হলকা ক্যাম্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রিয়নাথ একটু এগিয়ে দেখল তাদের জিপ গাড়িটা এসেছে কি না! আসে নি। আসার কথাও নয় সন্ধ্যার আগে। সুতরাং সাইনবোর্ডসহ তার থলিটা পাশে নামিয়ে সে চা-মিষ্টির দোকানটার রাস্তার পাশের বেঞ্চিটাতে বসল। তার পেছনে চিতা-সাইজের দুই উনুনে, মানুষ ভাজা যায় এমন দুটো কড়াইয়ে নিমকি ভেজে পাশের ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে। সেঝুড়িটা উল্টে নিলে হাত-পা গুটিয়ে ভিতরে ঢুকে থাকা যায়। ঝুড়িটা একটা সাইজমাফিক গামলার ওপর বসানো–তেল যাতে চুঁইয়ে যায়। ভাজা নিমকির গন্ধ নাকে এসে লাগে। তার পেছনে ঐ উনুনের সামনে লম্বা টেবিলে একটা বছর চোদ্দর ছেলে খালি গায়ে চা বানিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়নাথ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদা, দুটা নিমকি, একটা চা।
আগামীকাল থেকে চা-নিমকি প্রিয়নাথ নিজের পয়সায় খাবে না। আগামীকাল কেন, আজ একটু পরে হাটে ঢোলাই দেয়ার পরই, আর তাকে নিজের পয়সায় চা-মিষ্টি-সিগারেট খেতে হবে না। হয়ত এই দোকানিই তাকে ডেকে-ডেকে খাওয়াবে। আজকাল ত ঘোষরাই জমি কেন বেশি। এখন গিয়ে এই সাইনবোর্ডটা দেখালে এই নিমকি-চাটাও বিনে পয়সায় হতে পারে। কিন্তু তা সে করতে যাবে কেন? সে ত সরকারি লোক। সেটেলমেন্টের পিয়ন। তাকে দুটো-তিনটে দোকান সাধবে, দু-তিনজন লোক পেছনে-পেছনে ঘুরবে, তবে, সে একজনের কাছ থেকে চা খেলেও খেতে পারে।
কাল থেকে এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে। সে-খবর এখানকার সবাইই জানে। ফর্ম এর ইস্তাহার আগেই বিলি করা হয়ে গেছে, ৫৬ ধারার নোটিশও জারি করা হয়ে গেছে–আপন আপন পর্চা জমাবন্দি থাকিলে তাহা সহ উল্লিখিত মৌজায় হাজির হইয়া…। খানাপুরি বুঝারতের নোটিশও পড়েছে। আজকের হাটে একটা ঢোলাই দিতে হবে। সেই জন্য প্রিয়নাথ আগে চলে এসেছে। সাহেব তাকে বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে জিপেই চলুন, আমরা না হয় একটু আগে-আগে বেরব। কিন্তু সাহেবদের জিপে এলে প্রিয়নাথ বাসে আসার টি. এটা পেত না। সাইনবোর্ডটা এনেছে বলে রিক্সাভাড়া বাবদ এক টাকা তার প্রাপ্য। সেটাও পেত না। আর হাটে ঢোলাই বাবদ তিন টাকা–সবসুদ্ধ টাকা পাঁচেক তার ক্ষতি হত। সুতরাং সে যে রাস্তায় বাসে নেমে হেঁটে এল, সাহেবরা সেই রাস্তায় সোজ গিয়ে বয়ে ঘুরে মাল-ওদলাবাড়ি হয়ে আবার বায়ে ঘুরে মোট মাইল বিশেকের পাক দিয়ে এখানে আসবে।
নিমকির তেলে তার হাতের আঙুল ভেজা। প্রিয়নাথ মাথায় মেখে নিল। তারপর দুই হাত ঘষল। সে বসেছে একেবারে রাস্তার পাশে–যারা চা খেয়েই সরে পড়ে, বড় জোর নিমকি খায় তারাই এখানে বসে কিংবা দাঁড়ায়। এর পরে মাঝখানের সারিতে যারা বসে তারা চা খায়, নিমকি খায়, জিলিপিও খায়। তাদের সামনেই খোলা চৌকিতে জিলিপির পাহাড়। আর পাশে বড় বড় টিনে চানাচুর। আর, যারা বড় বড় মিষ্টিটিষ্টি খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে তারা সব বসেছে দোকানের একেবারে ভেতরে, সারি সারি টেবিল-চেয়ারে যে যত পারে ভেতরে সেঁদিয়ে। ভেতরের ঐ সব জায়গাতেই ত বড় বড় হাটে আসল বেচাকেনা সাব্যস্ত হয়। শুধু হাটের জিনিশ বেচাকেনাই নয়, আগামী বছর কোন জমি কে বেচবে, কে কিনবে, সে-সবের কথাবার্তাও এখান থেকেই শুরু হয়। কাল থেকে ক্যাম্প। কাল থেকেই লোকজন ত প্রিয়নাথকে নিয়ে যত পারে দোকানের ভেতরে ঢুকতে চাইবে। পারলে ওদিকের দেয়াল ভেঙে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে চাইবে। কাল থেকে? তার ব্যাগটা আর সাইনবোর্ডটা হাতে তুলে নিয়ে আর-একবার দোকানটা দেখে ভাবে–এই ঢোলাইটা হয়ে গেলেই ত শুরু হবে, দাদা, দাদা। না, আজকে নয়। আজ ঢোলাইয়ের পর এখানে এসে, এখানে বসে, সবার সামনে সে আবার দুটো নিমকি ও এককাপ চা খেয়ে উঠে যাবে। হাটের লোকে দেখুক সেটেলমেন্টের পিয়ন নিজের পয়সাতেই চা-নিমকি খায়, খেতে পারে।
এবার প্রিয়নাথ ঝোলাটা কাঁধে আর সাইনবোর্ডটা হাতে ঝোলায়। তারপর রাস্তাটা কোনাকুনি পেরিয়ে হাটে ঢুকবার সময় রাস্তা থেকে একটা কাঠি কুড়িয়ে নেয়।
এদিকটায় ছাউনিঅলা দোকান। কোনো-কোনো ছাউনি ভামনির, একটা ছাউনি পেটানো টিনের, আর বেশির ভাগই প্লাস্টিকের চাদরের। ঐ দিয়ে মালপত্র বেঁধে নিয়ে এসেছে। ঐটাই মাথায় টাঙিয়েছে। এদের বেশিরভাগ দোকানেই জামাকাপড় আর গেঞ্জি-প্লাস্টিকের ঠোঙায় ভরা, আবার, কাগজের বাক্সও আছে। ঠিক পেছনেই খোলা বাজার। সেই ভোলা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা দিয়ে টিনের সাইনবোর্ডটাকে সামনে এনে পেটায়। কেমন একটা ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ হয়। তাই প্রিয়নাথ আবার পেটায়। এবার সামনের ও পাশের দোকানদাররা চোখ তুলে তাকায়। আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটের হাটখোলাতে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। দলিলপত্রসহ সবাই যথা মৌজায় যথাসময়ে হাজির হইবেন। হইবেনটা বেশ টান দিয়ে শেষ করে প্রিয়নাথ। আবার হাটে। দু পা এগিয়ে তার মনে পড়ে অপারেশন বর্গার কথাটা বলা হল না। পরের জায়গায় বলবে। কিন্তু কিছুতেই তার মনে থাকতে চায় না। হলকা মানে জোতদারের ব্যাপার। কে তার জমিতে বর্গা করে তার লিস্টি সেটেলমেন্টের হবে কেন। প্রিয়নাথ জলপাইগুড়ি শহরের মাইল-সাত দক্ষিণে বিঘা পাঁচেক জমি কিনে আধিতে দিয়েছে বছর বার। বাড়ির ছ-মাসের ধানটা আসে ওখান থেকে। তার আধিয়ারও কি রেকর্ড করাবে নাকি।
কাটা কাপড়ের দোকানের সারির মাঝখান দিয়ে প্রিয়নাথ সোজা পশ্চিমে যাচ্ছিল। মাঝখানে এক চৌপত্তির পর ডাইনোয়ে মশলার দোকান। ওদিক থেকে একজন, বেঁটে-এক ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। ঘোড়র ওপর বসেও নোকটার মাথা হাটের চালাগুলো পর্যন্ত পৌঁছয় না। হয়ত ফরেস্টের ভেতরে বা চরের খুব ভেতরে কোথাও থাকে। ঘোড়া ছাড়া যাতায়াতের উপায় নেই। প্রিয়নাথ সরে গিয়ে ঘোড়ার যাওয়ার পথ ছেড়ে দেয়। কিন্তু সরে দাঁড়ানোর পরই পাশ থেকে ঘোড়ার চেহারা দেখে প্রিয়নাথের আত্মসম্মানে লাগে। মনে হল এই ঘোড়াটারই উচিত ছিল তার জন্য পথ ছেড়ে দেয়া,নইলে প্রিয়নাথকে ত এর পর গরুর জন্যও পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং ঘোড়া তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই প্রিয়নাথ তার হলকা ক্যাম্প দিয়ে ঘোড়ার পেছনে এক ধাক্কা মেরে পথে নামে। সেই ধাক্কাতেই ঘোড়ার কোমর থেকে পেছনটা একবার টাল খায় আর পেছনের ডান পা, যেটা প্রিয়নাথের দিকে, হাঁটুতে ভাজ হয়ে দুমড়ে পড়ে প্রায়, যেন বৈশাখ মাসের ঝড়ের মুখে হাটের চালাঘর। প্রিয়নাথ : এক লাফে আবার রাস্তার পাশে সরে যায়, পাছে ঘোড়াটা দুমড়ে-মুচড়ে তারই ওপর ভেঙে পড়ে। আর ঘোড়াটা তখন তাকে ছাড়িয়ে বা পাশের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ধুত, বলে প্রিয়নাথ পথে নামতেনামতে দেখে ঘোড়ায় চড়া লোকটি একটা লাঠির মাথায় বাধা ঝোলা এগিয়ে দিচ্ছে। ঘোড়া থেকে না নেমেই হাট করা।
মশলার দোকানগুলোর শেষে হাটটা ডাইনে বায়ে ছড়িয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ আবার কাঠি দিয়ে তার সাইনবোর্ড পেটায়। আওয়াজ এত ঢ্যাপ ঢ্যাপ যে প্রিয়নাথকেও একবার সাইনবোর্ডটা তুলে টিনটা পরখ করতে হয়। যেন নিজের কীর্তির দিকে তাকিয়ে দেবে। হাটে ঢোলাই দেওয়ার কাজ হলকার সাইনবোর্ড পিটিয়ে সেরে-সেরে সে ঢিনাটকে প্রায় ফাটিয়ে এনেছে। পাছে টিনটি আরো ফেটে যায় এই ভয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা জোরে মারতে পারে না। একবার ডাইনোয়ে তাকিয়ে, টিনটাতে ছোট করে একটা কাঠি মেরে, মুখের কাছে হাত তুলে চেঁচাল, আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। আপনার দলে দলে যোগদান দিন।
হঠাৎ প্রিয়নাথের চেঁচানো শুনে পান আর শুকনো তামাকের দোকানদাররা মুখ তুলে তাকায়। হাটে ত নানারকম লোকই আসে। পুরনো হাটে ভিখিরি-পাগল এরাও চেনা হয়ে যায়। দোকানদাররা পাছে তাকে নতুন ভিখিরি বা পাগল ভাবে এই ভয়ে প্রিয়নাথ তার সাইনবোর্ডের লেখা-দিকটা ঘুরিয়ে দিল। কাঁধে ঝোলা আর সামনে সাইনবোর্ডলোকজনের এতে আরো সন্দেহ হওয়ার কথা। তাই প্রিয়নাথকে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সাইনবোর্ডটা আবারও দেখতে হয়। না, সরকারি চিহ্ন আকা আছে, সত্যমেব জয়তে, মুছে গেলেও বোঝা যায়। সত্যমেব জয়তে নিয়ে ত আর কেউ পাগলামি করে না।
.
০০৪.
ঢোলের বদলে মাইক
প্রিয়নাথ ত এখন এই ঢোলাই দেওয়া বন্ধ রেখে, ফিরে গিয়ে, ঘরদোর গোছানো ঠিক আছে কি না দেখে সাইনবোর্ডটা টাঙিয়েও দিতে পারে। তার এই নতুন অফিসারটাকে সে যে এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। একেবারেই নতুন এসেছে, বিশেষ করে নাকি অপারেশন বর্গার জন্যই সরকার পাঠিয়েছে। কিন্তু সি-পি-এম নয়, নকশাল। আগেই নাকি নকশাল ছিল। তার পর অফিসার হয়েছে। জোতদার দেখলেই খেপে যায়। জোতদার নিজচাষ রেকর্ড করাতে চাইলেই বলে, হাত দেখি। হাতের কড়া গোনে। এখানকার ক্যাম্পে নিজেই থাকবে। কতজন গিয়ে বলেছে তাদের বাড়িতে থাকতে, চা বাগানের মালিকরা বলেছে বাগানের বাংলোতে থাকতে। এদিককার এইই রীতি। কিন্তু সাহেব কারো কথা শোনে নি। এখানে এসেই যদি শোনে ঢোলাই দেয়া হয় নি, তখন ত ধরা পড়ে যাবে–কোনো হাটেই কোনোদিন প্রিয়নাথ কাউকে ঢোলাই দিতে ডাকে নি। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।
আর দেরি করা কোনো কাজের কথা নয়। প্রিয়নাথ একবার আন্দাজের চেষ্টা করে মুদি বা গালামালের দোকানগুলো কোনদিকে হতে পারে। মিষ্টির দোকানের পাশের বড় দোকানটার বাইরে যেন টিনের বাণ্ডিল দেখে ছিল। সেখান থেকে একটা টিন চেয়ে নিয়ে এলে তাড়াতাড়ি সারা হাটে একবার পিটিয়ে ঘুরে আসতে পারে। প্রিয়নাথ বাইরের সেই দোকানটায় যেতে পিছন ফিরল।
কিন্তু হাট থেকে বেরবার মুখটাতে দেখে বা দিকের বড় উঁচু ডাঙাটায় মদেশিয়াদের একটা দল–একজন ঢোল বাজাচ্ছে, আর একদল মেয়ে হাত দিয়ে এ ওর কোমর ঘিরে নাচতে লেগেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ একটু ভাবে যে এই সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে ওর কাছ থেকে ঢোলটা চাওয়া যায় কি না। তা হলে ত ছেলেটাকেই বলতে হবে ঢোলাই দিতে। তার মানেই পয়সাটা হাতছাড়া। কিন্তু যদি বলে সেটেলমেন্টের পিয়ন–তোমার ঢোলটা দাও, ঢোলাই দিয়ে ফেরত দেব। ওরা নিশ্চয়ই চা বাগানে কাজ করে। সুতরাং সেটেলমেন্টের পিয়নকে খুব একটা কেয়ার না-ও করতে পারে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা, ওকে ত বোঝাতে হবে-তোমকো ঢোলঠো দোও, হাম ঢোলাই দেগা! ঢোলওয়ালা চাই না, কিন্তু তার ঢোলটা চাই–এ রকম একটা কঠিন কথা বোঝাতে অনেক হিন্দি বলতে হবে। আর অতগুলো মদেশিয়া মেয়ে অনেকসময় একসঙ্গে হেসে ওঠে। প্রিয়নাথ মুদির দোকানের খোঁজেই বেরল।
এখন যেন হাটটা এই রাস্তাতেও ছড়িয়ে-ছাপিয়ে পড়ছে। একবার উঁকি মেরে দেখে নিল তাদের জিপটা এসে গেছে কি না। তার পরই সেই মাড়োয়ারির দোকানের দিকে চলল। গিয়ে দেখল, তার আন্দাজ ঠিক নয়, বাইরের ওগুলো কেরোসিন তেলের ব্যারেল। দোকানটা মালের কেরোসিন ডিলার, শর্মার।
আচ্ছা এখানে মুদির দোকান কোন দিকে?
এই রাস্তা ধরে বেঁকে যান, ডান হাতিতে।
প্রিয়নাথ রাস্তা ধরে ডানহাতিতে বেঁকল। মুদির দোকান। অনেক টিন আছে। হাঁফ ছেড়ে প্রিয়নাথ।
দাদা, একটা টিন দিবেন!
কিসের? ডালডার না বিস্কুটের?
একটা হলেই হল।
ফুল সাইজ সাত টাকা, হাফ সাইজ চার টাকা।
অ্যাঁ? না, মানে আমি আবার ফেরত দিয়ে যাব।
ফেরত দিয়ে যাবেন? করবেন কী?
কাল থেকে ত এখানে হলকা ক্যাম্প বসিবে—
কিসের ক্যাম্প?
সেটেলমেন্টের
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলে দিল, ওসব আমাদের দরকার নেই। হবে না। প্রিয়নাথ একটু হকচকিয়ে যায়। সরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এরকম একটা দোকান চালাচ্ছে লোকটা হাটের মধ্যে আর এখানে জমিজমা করে নি? নাকি লোকটা মালিক নয়, কর্মচারী? প্রিয়নাথের একবার মনে হয় জিজ্ঞাসা করে, আপনাদের মালিক কে? সে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা তাকে সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে সাহেবকে বলবে ঢোলাই দেওয়া হয়েছে। তার পর যদি সাহেবের সন্দেহ হয়–তখন দেখা যাবে। এখন বরং সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে ঘরটা ঠিকঠাক করে নেয়া দরকার।
এই হাট কমিটির হাতে নাকি কোন কো-অপারেটিভের তিনটে ঘর ছিল–তার ভেতর দুটো ঘর ক্যাম্পের জন্য পাওয়া গেছে। প্রিয়নাথ এখন সেই ঘর খুঁজতে চলল। যেতে-যেতেই তার মনে হয় সে মিছিমিছি এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল। সাহেবের কি আর-কোনো কাজ নেই যে এসেই জনে-জনে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করবে হাটে ঢোলাই হয়েছে কি না। সে ত তাও দু-জায়গায় সাইনবোর্ড পিটিয়ে চেঁচিয়েছে। মিষ্টির দোকানটাতেই জিজ্ঞাসা করা ভাল, হাট কমিটির ঘরটা কোথায়, ভেবে, দোকানটাতে ঢোকে। আর তখনই মাইকে ধীর, শান্ত, গম্ভীর গলায় শুনতে পায়, ভাগ্যের চাকা ত সব সময়ই ঘুরছে। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। আমরা ভাগ্যের হাতে পুতুল। কিন্তু ভাগ্য ত সবসময় খারাপই হয় না। ভালও হয়। পুরুষের ভাগ্য দেবতারাও জানেন না। মেয়েদের ভাগ্যও দেবতারা জানেন না। কিন্তু কর্ম না করলে ত আপনি ভাগ্যের ফল পাবেন না। কর্ম আপনাকে করতেই হবে। পাঁচ টাকা নয়, দশ টাকা নয়, মাত্র এক টাকা দিয়ে লটারির একটা টিকিট কিনুন। প্রতি সপ্তাহে একবার খেলা। কে জানে, এবার হয়। ত আপনার টিকিটেই ফার্স্ট প্রাইজ উঠবে এক লক্ষ টাকা। এক টাকা দিয়ে এক লক্ষ টাকা। কিন্তু একটা টাকা দিয়ে টিকিটটা ত আপনাকে কাটতে হবে, আপনি ত আর অন্যের কাটা টিকিটে প্রাইজ পাবেন না। আসুন। এক টাকা দিয়ে একটা টিকিট কাটুন।
দোকানদার বলে দিল, হাটের একেবারে পেছন দিকে হাট কমিটির শেড। সেদিকে যাওয়ার আগে প্রিয়নাথ লটারির টিকিটের রিক্সাটার দিকে যায়। তাকে দেখে ছেলেটি মাইকেই বলে ওঠে, আসুন দাদা, কখানা?
না, শোনেন দাদা, টিকিট না, অন্য একটা কথা আছে।
কী কথা দাদা, বলুন। কথাও বলুন, টিকিটও নিন। মাত্র এক টাকায়—
ছেলেটি তার কথা মাইকেই বলে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয়নাথের গলা মাইকে শোনা যাচ্ছিল না। ফলে প্রিয়নাথের কেমন অপ্রস্তুত লাগছিল। সে তাড়াতাড়ি বলল, মানে, কাল ত এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে।
কী ক্যাম্প?
হলকা ক্যাম্প। সেটেলমেন্টের। এই জমিজমা মাপামাপি হবে। কোন জমি কার এইসব। তার ওপর কোন জমিতে কে চাষ করছে সেসব রেকর্ড হবে। এই কথাটা যদি মাইকে একটু বলে দেন সবাই জানতে পারবে।
মানে, কোনো কালচারাল ফাংশন হবে?
কী? ফাংশন?
হ্যাঁ, মানে কোনো আর্টিস্ট আসবে?
আরে না না, এ ত সরকারের ব্যাপার, আইনের ব্যাপার, ফাংশন না।
তা হলে সবাইকে বলতে বলছেন যে?
বললাম ত, জমিজমা মাপামাপি হবে, রেকর্ড হবে, অপারেশন বর্গা।
সে ত পার্টির ব্যাপার স্যার, আমরা কোনো পার্টিফার্টিতে নেই দাদা। একটা টিকিটের দাম মাত্র এক টাকা। কিন্তু এর বদলে আপনি এক লক্ষ টাকা পেতে পারেন–ছেলেটি একই গলায় ঘোষণা করে যায়। তার পর থেমে হঠাৎ প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ফাংশন না হোক, লোকজন আসবে ত?
সে ত আসবেই। সবাই যাতে জানতে পারে সে জন্যই আপনাকে একটু অ্যালাউন্স দিতে বললাম।
সে করে দিচ্ছি। কিন্তু কাল আমাদের একটু চান্স দিতে হবে। টিকিট বিক্রি করব।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, সে আপনারা কাল সকাল থেকেই আসবেন।
তা হলে বলুন, কী ক্যাম্প?
হলকা।
হলকা? এ কি দাদা একটা নাম হল! একটা ইংলিশ নাম দিলে পারতেন।
কিসের?
এই ফাংশনের।
সে আমরা দেব কী করে? এ তো গবর্মেন্টের নাম। বরাবর তো হলকা ক্যাম্পই বলে।
ও আচ্ছা, আমি ভাবছিলাম নতুন জিনিশ। গবর্মেন্টেরও ত কত নতুন জিনিশ হয়, তা বলুন কী বলতে হবে। ভাইয়ো অউর বহির্নো, তগদির এক চিজ অউর তগদির কা খেল অউর এক চিজ, ছেলেটি হিন্দিতে লটারির টিকিট বিক্রি শুরু করে। প্রিয়নাথ একটু অপেক্ষায় থাকে। থামলে বলে, বলতে হবে আগামীকল্য হইতে এইখানে ক্রান্তির হাটে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। আধিয়ারি রেকর্ডও করা হইবে। আপনারা সকলে দলিলপত্র লইয়া উপস্থিত থাকিবেন।
ধুত দাদা, এসব ত কীরকম পুলিশ পুলিশ শোনাবে। সবাই ভাববে আমরা সরকারি লোক। কেউ আর টিকিট কিনতে আসবে না।
না। ওটাই বলতে হবে তা নয়। ওটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দিলেই হবে। এই যে এইটা দেখে নিন। হাতে কোন একটা নোটিশ না ইস্তাহার ছিল–সেটা এগিয়ে দেয়। ছেলেটা দু-চার লাইন পড়েই উল্টে শাদা পিঠটা দেখে। তার পর আবার ছাপাটা দেখে। আবার উল্টোয়। এ কি দিাদা, এ ত আমি কেন, আমার মামাও বুঝতে পারবে না। প্রিয়নাথ তাড়াতাড়ি বলে, ঐ সব মিলিয়ে-মিশিয়ে বলে দেন দাদা, একটু উপকার হয়। ছেলেটি একটু থেমে কিছু ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা শুনুন বলছি, এতে হবে কি না দেখুন। তারপর সেই গলাতেই বলে যায়, জীবনে কত কী ঘটে যাচ্ছে সব সময়। সবই ত নতুন। এইমাত্র আমাদের এক দাদা আমাদের এক নতুন জিনিশ শেখালেন, হলকা, হলকা ক্যাম্প। কাল সকাল থেকে নাকি এই ক্রান্তির হাটে এই হলকা ক্যাম্প বসবে। আপনারা নিশ্চয় সবাই সেই ক্যাম্পে আসবেন। ঘুরবেন। দেখবেন। এর আগে আমরা কখনো হলকা শুনি নাই। তেমনি আগামী কালের খেলার শেষে যখন আপনার দরজায় টেলিগ্রাফ পিয়ন এসে বলবে আপনি পশ্চিমবঙ্গ লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছেন–তখন আপনিও বলবেন লটারি যে কেউ পায় তা প্রথম জানলাম। তাই বলছিলাম জীবনে সব সময়ই ত নতুন কিছু ঘটছে। কালকের হলকা ক্যাম্প নতুন। তেমনি আপনার ফাস্ট প্রাইজ নতুন। কিন্তু একটা, একটা টিকিট ত আপনাকে কাটতে হবে। কী দাদা, চলবে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ ত খুব ভাল বলছেন। কিন্তু হলকা ত নতুন ব্যাপার নয়। এটা
আচ্ছা, আচ্ছা, ওটা ম্যানেজ করে দেব।
আর, ঐ নাকিটা বলবেন না?
নাকি? মানে? নাকি বলব না! এখন মনে হতে লাগল মাইকে কোনো নাটক হচ্ছে। বা ঝগড়াও হতে পারে। দু-একজন লোক ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, একজন এগিয়ে আসে। আসুন দাদা, মাত্র এক টাকার বিনিময়ে লক্ষ টাকা। কিন্তু লোকটা টিকিট না কিনে করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিয়নাথ দেখে ছেলেটি তার দিকে আর তাকাচ্ছে না। আসুন, পশ্চিমবঙ্গ লটারি-মাঝখানে প্রিয়নাথ বলে বসে, ঐ যে বললেন না হলকা ক্যাম্প নাকি বসবে, ওখানে বলতে হবে হলকা ক্যাম্প বসিবেই! ছেলেটি কোনো জবাবও দিল না। প্রিয়নাথের ভয় হল ছেলেটি বলে বসবে, মাইকে কিছুই বলতে পারবে না। তাই, তাড়াতাড়ি ঠিক আছে বলে সরে যেতে নেয়। পেছন থেকে ছেলেটি বলে, আমরা বলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের রিক্সা কাল আপনাদের ক্যাম্পে এলে তখন যেন পুলিশ ঝামেলা না করে।
আরে না না, আপনারা আমার কাছে যাবেন। আমি ত থাকব। প্রিয়নাথ হাট কমিটির অফিসের দিকে যেতে শুরু করে। পেছনের মাইকে শুনতে পায়, জীবন মানে ত পদ্মপাতার জল, কিন্তু যা হওয়ার তা ত…
ক্যাম্প মানে ত কাল এখানে কিছুই না। কে-বির [খানাপুরী বুঝারত, মাঠখশড়া ফিল্ড-সার্ভে] কাজ ত মৌজায়। যাক, আসুক ত।
খানিকটা গিয়ে প্রিয়নাথ দাঁড়িয়ে পড়ে, ছেলেটি সত্যিই বলে কি না শুনতে। না বললে তার কিছু। করার নেই। বললেও তার কিছু করার নেই। ক্যাম্পে লোকজন জমলে লটারির রিক্সা আর আসবে না কেন, নিজের থেকেই আসবে। তাতে প্রিয়নাথেরও কিছু করার নেই। ছেলেটি একবারও বলে কিনা এইটি সে জেনে তবে সেই ঘর খুঁজতে যাবে।
কটি দাদা?
তু বল না কঠো?
তু বল মাইকে মদেশিয়া মেয়ের রিনরিন গলা।
লে লে শুন। তু আঁখ বুজা কর। উসকো বাদ ই টিকিটপর হাত লাগা দে। যো উঠবেক, উ আমি কিন লিব। লে আখ বুজা কর। খিলখিল হাসিটাও মাইকে এসে ব্রজে। চা বাগানের কোনো মাতাল মজুর-মজুরনির কাণ্ড। এই দেখুন, লটারির টিকিট কিনতেও লটারি হচ্ছে। চোখ বুজে যতগুলো টিকিট উঠবে, ততগুলোই কিনবে এই, বলে ছেলেটি থেমে যায়, এরা, আসুন, যা, চোখ বন্ধ করুন। আবার মাইকে খিলখিল হাসি।
.
০০৫.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাট কমিটি
হাট কমিটির ঘরের সামনে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে, দূর থেকে প্রিয়নাথ দেখল। সাহেবরা এসে গেছেন। সে হটার গতি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাড়াতাড়ি হাঁটার প্রধান অসুবিধে তার স্যান্ডেল। ঐ হাওয়াই-এর খাপে খাপে তার পা এমনই মিশে আছে যে, যেরকম হাঁটলে গোড়ালির বাইরে সোলের মাথা-অংশটা তার পায়ের পাতার সঙ্গে ফর ফর করে লাগতে পারে, তার চাইতে বেশি জোরে হাঁটলেই স্যান্ডেলটা আটকে যায়। তখন আঙুলের তলায় সোলের যে অংশটুকু, তাও বেরিয়ে আসতে চায়, যেন স্যান্ডেলটা উল্টে আঙুলের সামনে চলে যাবে বা ফিতেটা তলা থেকে খুলে আসবে। ফিতেটা যাতে তলা থেকে খুলে না আসে সেজন্যে আবার সেফটিপিন দিয়ে আটকানো বটে কিন্তু সোলের সেই অংশটা ছিঁড়েও ত সেফটিপিনটা খুলে যেতে পারে। সুতরাং তেমন তাড়া থাকলে স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়াই ভাল। কিন্তু এ-দূরত্বটা এত বেশি নয় যে অতটা করার দরকার হবে। সে ত সব নিয়মমাফিকই করেছে তা হলে আর দৌড়াদৌড়ির দরকার কী? কিন্তু তার স্যান্ডেলের জন্য প্রিয়নাথ জোরে হাঁটতে পারে না অথচ তার পদক্ষেপে সেই দ্রুত হাঁটার বেগ এসে যায়–এই দোটানায় প্রিয়নাথের এইরকম হাটার সময় তার কোমরটা সমনে এগিয়ে যায় আর পা-টা থাকে পেছিয়ে। স্যান্ডেলের সঙ্গে পায়ের দোটানায় হাঁটুতে সব সময়ই একটা মোচড় আসে, যেন প্রত্যেকবার পা ফেলার সময় হাঁটু দুটো একটা করে পাক খায়।
প্রিয়নাথের সাহেব মাঠের ভেতর একটা চেয়ারে বসে ছিল। তার সামনে, কিন্তু কিছু দূরে, জিপ গাড়িটা দাঁড়িয়ে। প্রিয়নাথ পেছন থেকেই বলে, স্যার, এসে গেছেন!
সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে দেখে বললেন, আরে, প্রিয়নাথবাবু। আপনি একেবারে মাইক-টাইক জোগাড় করে ফেললেন কোত্থেকে?
প্রিয়নাথ একগাল হেসে ফেলল–তা হলে স্যার আপনারা বেশিক্ষণ আসেন নি। তা স্যার ঘরদোর সব বলে বারান্দার দিকে তাকায়। বারান্দায় তাদের অফিসের লোকজন আর আরো দু-একজন। বারান্দায় উঠতে-উঠতে প্রিয়নাথ দেখে ঘরদোর সবই গোছানো, পরিষ্কার, ধোয়া। মালপত্র একটা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো।
এই যে প্রিয়নাথদা, তোমাকে পাঠানো হল আগে যে সব বন্দোবস্ত করে রাখবে আর আমরা এসে দেখি প্রিয়নাথদা নোপাত্তা। শেষে নিজেদেরই সব করে নিতে হল। অনাথ বলল।
পাঁচ মিনিট আগেও দেখে গেছি স্যার, আপনারা আসেন নি, এর মধ্যে হুস করে এসে পড়লেন। অনাথের কথার জবাব না দিয়ে প্রিয়নাথ সাহেবকে বলে। ঘর তিনটি পর পর দেখে প্রিয়নাথ ফিরে আসে, এ ত সব পাকা বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে।
সে কী? এ-সব তুমি করো নি? আমরা ভেবেছি তুমিই সব ঠিকঠাক করে রেখেছ– বিনোদবাবু বললেন।
তা হলে ত আমাকে কাল ছাড়তে হত বাবু। আজ রওনা দিলাম এই আপনাদের আগে বাসে, আর পৌঁছলাম ত মাত্র ধরেন ঘণ্টাখানেক আগে।
তাও আবার আপনার ঐ স্যান্ডেল, এবার পেছন থেকে জ্যোৎস্না এসে বলে, আমরা ত ভাবলাম আপনি না এলেও আপনার স্যান্ডেল ঠিক আসবে।
দাঁড়ান, এই সাইনবোর্ডটা আগে লাগিয়ে নেই, বলে প্রিয়নাথ আবার বারান্দা থেকে মাঠে নামে।
আচ্ছা রাখো, তোমার সাইনবোর্ডটা পরে লাগালেও চলবে। এখন দেখো, রাত্রির রান্না ত চাপাতে হবে। কালকের বাজারটাও করে রাখো। ফিরে এসে সব গোছগাছ করা যাবে। বিনোদবাবু বললেন।
হ্যাঁ চলুন, আমি আর প্রিয়নাথবাবু হাটটা ঘুরে আসি, বলে সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। যে-ভদ্রলোক তিনজন এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা এগিয়ে এসে বললেন, আমাদের অনুরোধটা একটু রাখবেন না? এ ত স্যার আমাদের এখানকার ব্যাপার। এ ত বরাবরই আমরা করে থাকি।
না, না, আপনারা যেটুকু করেছেন সেটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। আমরা এতজন আছি, ঠিক করে নিতে পারব। কোনো অসুবিধে হল বরং আপনাদের জানাব। আজ হাটের দিন, আপনাদের ত আবার কাজকর্ম আছে।
না। সে সব ত হয়া গেছে। কিন্তু কথাটা হইল, মোদের এই ক্রান্তি হাট কুনো বাইরের পার্টি, সে সরকারের হবা পারে, আবার, ধরেন কেনে প্রাইভেট পাটিও হবা পারে, সে কুনোদিন এ্যামন হয় নাই যে তারা নিজেরা রান্না করিবার ধরিসে। এ ত মোদের একখানা সুনাম-দুর্নামের বিষয়।
ভদ্রলোক প্রৌঢ়, রাজবংশী। তিনি যখন কথা বলছিলেন সুহাস খুব মন দিয়ে শুনছিল। অথবা যেন সুহাস তাকে দেখছিলও। এই একটা অনুজ্জ্বল, ডাল, বিস্কুট রঙের জামা, সুহাস এদের ভেতর আরো অনেককে পরতে দেখেছে। এগুলো কি এদিকে তৈরি হয়, নাকি, শস্তা? সুহাস ভদ্রলোককে যে তাকে কথাটা শেষ পর্যন্ত বলতে দেয় সে কি তার কথা বলাটাই দেখছিল বলে। তার এখানকার, এই আঞ্চলিক ভাষা তিনি কী ভাবে মেশাচ্ছেন ভদ্রলোকদের ভাষার সঙ্গে। একবারের জন্য সুহাসের মনে হয়, আজকে রাত্রির জন্য এঁদের আতিথেয়তা মেনে নিয়ে কাল থেকে নিজেদের বন্দবস্ত করে নেয়াই ভাল কি না। তাতে অকারণ টেনশন হত না। এরাও খুশি হতেন, তার অফিসের লোকজনও খুশিই হত–পয়সাটা বাচত। আর এটা বোধ হয় তার পক্ষে একটু বাড়াবাড়িও হচ্ছে। সুহাস কোনো নীতিবাগীশ কারণে ত আর এদের আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করছে না। তাকে ত সরকার টাকা দেয় খাওয়াদাওয়ার জন্য। সে-টাকাটা না নিয়ে ওদের কাছে খাওয়া যায়। কিন্তু অত হাঙ্গামা সে করবে কেন?
আসলে ভয় পায়–এদের আতিথেয়তা মেনে নিলে তার পর আবার কোনো চাপ তৈরি না হয়। সে এক নিজের জন্য রান্নার ব্যবস্থাটা রেখে বাকিদের ইচ্ছে মত ব্যবস্থা করতে বলতে পারে। কিন্তু তা হলেও ত এরা যার যার, বাড়িতে বা সাহায্যে, খাওয়া-দাওয়া করবে তাদের জন্য সুবিধে সুহাসের কাছ। থেকে আদায় করে দিতে পারে।
অগত্যা তাকে বলতে হয়, দেখুন, আমাদেরও ত একটা সুনাম-দুর্নামের ব্যাপার আছে। আমাদের কাজকর্ম চলুক। আমরা ত বেশ কিছুদিন এখানে আছি। সব চুকেবুকে যাওয়ার পর আমাদের না-হয় আপনারা একদিন ভাল করে খাইয়ে দেবেন। তবে এটা আমার কথা। আমি ক্যাম্পেই খাব। আপনারা এদের সঙ্গে কথা বলুন। এঁরা যা বলেন, এদের ব্যবস্থা সেই মত হবে। চলুন প্রিয়নাথবাবু, হাটটা ঘুরে আসি। সুহাস পেছন ফিরে হাটের দিকে রওনা দেয়।
পেছন থেকে বিনোদবাবু বলেন, স্যার, অনাথও আপনাদের সঙ্গে যাক না, একা প্রিয়নাথ। কথার উত্তর না দিয়ে সুহাস এগিয়ে যায়।
.
০০৬.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের নাচ
এ হাটটা বেশ বড় হাট, না? সুহাস জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, স্যার, এদিককার সবচেয়ে বড় হাট।
কী কী বিক্রি হয়, মানে পাইকারি বিক্রি?
ঠিক তা ত বলতে পারব না স্যার, তবে যেরকম পাহাড়ের মত শুকনো লঙ্কা আর পাট তাতে পাইকার ছাড়া আর অত মাল কে কিনবে?
শুকনো লঙ্কা? শুকনো লঙ্কা এদিকে কোথায় তৈরি হয়, মানে এখানে কি শুকনো লঙ্কা এত-শুনি নি ত?
প্রিয়নাথ হাটটার একটা আন্দাজ পেয়ে গিয়েছিল। সেই দোকানপাতির সদর রাস্তা আর এই হাট কমিটির ঘরের লাইন এই দুটো বোধ হয় পুব-পশ্চিমে। এখন তারা উত্তরের মাঠটা দিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়বে, সেখান থেকে হাটে ঢুকবে। মাঠ দিয়ে তারা খানিকটা এগবার পর বোঝে, ঘাস দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে আর একটু এগতেই মাঠের মধ্যে দুটি-তিনটি কুপি জ্বলছে, দেখা যায়। ওখানে হাড়িয়া বিক্রি হচ্ছে। সুতরাং সাহেবকে নিয়ে প্রিয়নাথ আর-একটু উত্তরে যায়। ঘুরতেই ঢোলকের আওয়াজ। নাচটা এখনো চলছে? ওরা কতক্ষণ নাচবে?
নাচছে স্যার।
কারা?
এই চা বাগানের কুলি-মজুর, হাটের দিন পেট ভরে হাড়িয়া খেয়েছে আর ঢোল বাজিয়ে নাচছে।
হ্যাঁ, এখানে চা-বাগান ত প্রচুর, ট্রাইব্যাল পপুলেশনওকথাটা শেষ করে না সুহাস, থেমে যায়। সাহেব আরো কিছু বলেন কি না অপেক্ষা করে প্রিয়নাথ বলে, হ্যাঁ স্যার।
দাঁড়ান, দেখি। তাদের সামনে তখন নাচটা। তারা নাচের পেছনে। মুখটা হাটির দিকে। নাচের মুখটাও হাটের দিকে। যেমন দেখা যায় ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, অবিকল তেমনই–এ-ওর কোমরে হাত দিয়ে জড়িয়ে একটা বন্ধনীর মত করে একই তালে দু-পা এগচ্ছে আর এক-পা পিছচ্ছে আর সেই আগু-পিছুর মধ্যেই দলটা একটু ঘুরে যাচ্ছে। এ রকম করে করে পুরোটাই তারা ঘুরবে আর ঘুরতে থাকবে। আর যে ঢোলক বাজাচ্ছে সে ঐ বন্ধনীর দুই মাথার মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাতে–ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, যেমন হয়। সুহাসদের সামনে কিছুদূরে হাটের দোকানপাট, চালাঘর। তাতে আলো জ্বলছে। চালাঘরের ছায়া যেন বাতাসে পড়েছে, বা ওখানে কিছু কিছু গাছও ত আছে। এখানে মাথার ওপরে আকাশ। সেই অসম্পূর্ণ বৃত্তের এগনো-পিছনোর সময় কখনো আকাশের শেষ আলো এসে পড়ছে, কখনো সামনের হাটের ছায়াতে সেই প্রায়বৃত্ত হারিয়ে যাচ্ছে। নাচটীর আবর্তনকে দেখাচ্ছে, যেন কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার মত। এত কাছ থেকেই দেখছে, তবু ঢোলের আওয়াজটাকে মনে হয় যেন পাহাড়-টিলাবনের ভেতর থেকে আসছে।
স্যার, চলুন না সামনে, নাচ দেখবেন। চেয়ার নিয়ে আসি।
সুহাস প্রায় শিউরে উঠে বলে, না না, চলুন হাটে যাই
সুহাস আবার চলতে শুরু করে। প্রিয়নাথ পেছনে।
.
০০৭.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের মাইক
সেই মিষ্টির দোকানটাতে তিন-চারটে হ্যাজাক। প্রিয়নাথ দেখে লটারির রিক্সাটাতেও মোমবাতি, আসুন, এক টাকার বদলে লক্ষ টাকা। সুহাস একটু এগিয়ে গেছে দেখে প্রিয়নাথ দৌড়ে লটারিঅলার সামনে গিয়ে বলে, এখন একটু বলুন না দাদা, আমাদের সাহেব এসেছেন। বলে আর দাঁড়ায় না, দৌড়ে আবার সুহাসের পেছনে পৌঁছে যায়। আপনাদের এই হাটে ত কত কী-ই ঘটছে রোজ। হ্যাঁ কটা? দুটো, এই যে নিন দাদা। এই ত কাল এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে
প্রিয়নাথ সুহাসকে ডাকে, স্যার।
বলুন।
আমাদের ক্যাম্পের অ্যালাউন্স দিচ্ছে।
সেই ক্যাম্পে ত আপনারা সবাই আসবেন। আপনাদের জমিজমার বিচার হবে। কিন্তু এই হাকিমের চাইতেও এক বড় হাকিম আছে। সেখানে বিচার হয় আমাদের তগদিরের, ভাগ্যের। কে জানে, আপনার জন্য কী বিচার হয়ে আছে?
মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সেই বিচার আপনারা জানতে পারবেন। কে জানে, আপনিই হয়ত এক লক্ষ টাকার প্রাইজটা পাবেন। কিন্তু টিকিট না কাটলে ত আর পাবেন না।
সুহাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তারপর হেসে ফেলল, এ আপনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন?
স্যার, দেখলাম এখানে কোনো ঢোলঅলা নেই। এমনকি টিনঅলাও পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে স্যার…ওরা রাজি হল, কিন্তু রেটটা একটু হাই নিল।
তা ত নেবেই। মাইক বলে কথা।
ওরা দশ টাকাই চেয়েছিল, আমি বলেকয়ে সাত টাকায় নামিয়েছি।
তা হলে আর এমন-কি বেশি?
স্যার, আমার কাছে ত অত টাকা ছিল না। বললাম, আপনারা এলে দিয়ে দেব।
বিনোদবাবুর কাছ থেকে এনেছেন? তা হলে দিয়ে আসুন সে ত ভুলে গেলাম স্যার।
সুহাস তার ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে বলল, এখন দিয়ে আসুন। পরে, বিনোদবাবুর কাছ থেকে নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।
তা হলে আপনি একটু দাঁড়ান স্যার, আমি দিয়ে আসি।
সুহাস দাঁড়িয়ে থাকল। তার সামনেই প্রিয়নাথ লটারির রিক্সাটার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। দাদা, আমাদের সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। এই দুটো টাকা রাখুন, চা-সিঙাড়া খাবেন।
ছেলেটি মাইক সামনে নিয়েই রেগে উঠল, ধুত মশাই, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হয় আপনি এনে খাওয়ান, আমাদের হাতে টাকা ধরাচ্ছেন কেন? মাইকে এত জোরে কথাটা হওয়ায় প্রিয়নাথ চমকে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সুহাস এদিকেই তাকিয়ে।
আচ্ছা দাদা, আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, টাকাটা ভাঙিয়ে দিন।
সামনের চায়ের দোকানটাতে গিয়ে দুটো টাকা দিয়ে বলল, ঐ লটারির রিক্সাতে তিনটে চা আর সিঙাড়া পাঠিয়ে দেন। টাকা দেয়া, বিশ পয়সা ফেরত নেয়া এই সবের ভেতরে প্রিয়নাথ সাতটি টাকা পকেটে রেখে দিল। দাদা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন বলে দৌড়ে সুহাসের কাছে যেতে গিয়ে তার স্যান্ডেলের মাথাটা ভাজ হয়ে যাওয়ায় একটা হোঁচট খেল। সামলে, হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে বলল, স্যার, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হল, বলে এক টাকা কুড়ি পয়সা সুহাসকে ফেরত দিল। সুহাস বলল, এটা আর বিল করবেন না। ঐ সাত টাকা নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।
আপনি একটু বলে দেবেন স্যার, উনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।
না না, করবেন। আমরা সবাই ত ঢুকতে-ঢুকতেই মাইকে শুনলাম।
স্যার, এই দিকে–প্রিয়নাথ সুহাসকে হাটে ঢোকার পথ দেখায়।
.
০০৮.
হাট কত রকমের
হাট বসা, জমে ওঠা ও ভাঙার একটা যেন বাধা গৎ আছে।
কিন্তু সব হাটের এক রকম নয়। এদিকে চ্যাংমারির হাট বা বড়দিঘির হাট সপ্তাহে একদিন বসে–মোটামুটি সংসারের কেনাবেচার জন্য। গায়ের লোকজনই কেউ কেউ দোকান দিয়ে আসছে। বড়দিঘির হাটে চাবাগানের মজুররাও একটা বড় খদ্দের। তাদের কেনার মত জিনিশপত্রও আসে। কিন্তু সেসব হাট বসে বিকেলের দিকে। তার পর সন্ধ্যার একটু পরেই ভাঙতে থাকে।
ওদলাবাড়ি-লাটাগুড়ি হাট এখন বেশ বড়। বাস রাস্তার ধারে বলে তাড়াতাড়ি বসে আর দেরিতে ভাঙে। নদীর বাঁধের কাজকর্মের জন্য দুদিকেই প্রায় সারা বছর মাটিকাটা-পাথরভাঙা লোকজন থাকে। তাছাড়া ফরেস্টের লোকজনের সংখ্যাও নেহাত কম হবে না। ৬৮সালের বন্যায় যেসব ফরেস্টের গাছ-গাছড়া ভেঙে বা ভেসে গেছে-সেইসব ফরেস্ট এখন সরকার পুরো ফাঁকা করে দিচ্ছে। হয়ত ওখানে নতুন করে বন তৈরি হবে। বা, এখন ফেলে রাখবে। ফলে, সারা বছরই প্রায় ফরেস্টের গাহ চলছে। গ্রামে বিদ্যুতের জন্য শালের খুঁটিও বিক্রি হচ্ছে গত কয়েক বছর। তার জন্যেও ত প্রায় সারা বছরই ফরেস্টে কাজ। তাই ওদলাবাড়ি আর লাটাগুড়ির হাট বেশ বড়। কিন্তু সেও ত কেনাবেচার হাটই আসলে ব্যবসার হাট নয়। বসে দুপুরের দিকে, তার পর চলতে থাকে। গেল বছর লাটাগুড়ির হাটে টিনের শেড তুলে সাইকেলের দোকান দিয়েছে ছচ্ছড়িয়া। হাটবারের দিন, বুধ আর শনিত, খোলে। ওদলাবাড়িতে ত সাইকেল-রেডিওর দোকান আগে থাকতেই আছে। কিন্তু যত বড়ই হোক, এসব হাট তখদ্দের বুঝে চলে। খদ্দেরের হাতে টাকা ত হাট জমল। খদ্দেরের হাতে টাকা নেই ত হাট ফাঁকা। ঐ-সব হাট-বাজারের মত, দোকানের মত। কিন্তু হাট বললে ত এই ক্রান্তির হাট, ধূপগুড়ির হাট, চালসার হাট। এ-সব হাটে যেন খদ্দের নেই, দোকানদারও নেই, শুধু হাটটাই আছে। হাট জমবেই হাটের মত, আর খদ্দের-দোকানদাররা হাটের সঙ্গে নিজেদের শুধু মানিয়ে নেবে। হাটের ভূগোল যে জানে সে হয়ত গলিখুঁজি দিয়ে ঢুকতে পারে বেরতে পারে, কিন্তু যে চেনে না সে কোনো এক দিক দিয়ে ঢুকতে পারলেও–বেরবার সময় রাস্তা আর খুঁজে বের করতে পারবে না। যেন হাটটা তাকে গিলে খেয়ে শেষে উগরে দেবে।
এ হাটগুলো যে কখন বসে কেউ টের পায় না। হাটের ওখানে পাকাবাজার ত একটা আছেই। তাতে রোজকার বাজার চলে। তা ছাড়াও পাকাঘর, পাকাদোকান, পাকাগুদামে রেশন, মিষ্টির দোকান, ওষুধের দোকান, কাপড়ের দোকান, শুকনো মশলার দোকান-গুদাম, এফ-সি-আই-এর গুদাম, সারের এফ-সি-আই-এর গুদাম ও দোকান, কোঅপারেটিভ খানতিন-চার, গোটা দুয়েক কিশোর বা যুব সজল-এ সবও ত রোজকারই।
ধূপগুড়ি হাটের একটু দক্ষিণে পাঞ্জাবি ড্রাইভারদের একটা ধাবাও হয়েছে। ওভারসিং রায়ের বাড়ির পশ্চিমে আগেকার দারিঘরটার জায়গায়, এখন লম্বা-খোলা ঘর। সামনে সারি-সারি খাঁটিয়া পাতা। রাবণের সাইজের একটা উনুন। ঐ শেডেরই এক কোণে পাঠা আর মুরগি বাধা। ধূপগুড়ি দিয়ে ডাইনে থেকে আসামে চলে যায় দূরপানার ট্রাক। ওভারসিং রায় জায়গাটা ভাড়া দিয়ে, টান বাঁশের বেড়ায় তার বাড়িটা আলাদা করে নিয়েছে। তার পর বাড়ির উত্তরে দারিঘর বানিয়ে বাড়ির ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ক্রান্তি, চালসা, মেটেলিতে ধাবা নেই বটে, তবে ধাবা সাইজের মিষ্টির দোকান আছে, আর ট্রাক আছে। এই সবে ত এসব হাট, হাটবারের দিন ছাড়াও, জমজমাটই থাকে।
তাই হাটবারে বোঝাই যায় না, কখন হাটটা বসে। আগের দিন দুপুর থেকেই বাশের গাড়ি আসতে শুরু করে। ট্রাক অবিশ্যি সব সময় হাটবার মিলিয়ে আসে না। কিন্তু হাটবারের আগে গুদাম ত ভরতেই হয়। ফলে হাটবারের আগের দিনই কোনো-এক সময় থেকে শুধু গুরুর গাড়ির ক্যাচক্যাচ আওয়াজ উঠতে থাকে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে এই আওয়াজেই যেন পরের দিনের হাটবারটা কাছে আসে। আর তখন থেকেই একটু-একটু করে বাতাস ভারী হয় মানুষের গলার আওয়াজে। বনে বৃষ্টি হলে বাতাস। যেমন ভারী হয়ে গায়ে লাগে, এই হাটগুলো লাগার আগে তেমনি মানুষের স্বরে ভারী বাতাস কানে লাগতে থাকে। এই আওয়াজটাই বাড়তে থাকে প্লেনের মত। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর ধীরে-ধীরে আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে মিলিয়ে যায়, শেষে আবার গুঞ্জন। কিন্তু প্লেনের মত ত মাত্র কয়েকটি মিনিটে এটা ঘটে না–ঘটে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে। ফলে গুঞ্জনটা শুরু হলে হয়ত বোঝা যায়, কিংবা গুঞ্জনটা শুনবার মত হয়ে উঠলে। তার পর, সেই গুঞ্জনটা ত বিরতিহীন চলতে থাকে, বাড়তে থাকে। কখন যে সেটা উঠছে তার কোনো চিহ্ন দেয়া যায় না, কিন্তু কোনো এক সময় যেন মনে হয় সারা দুনিয়া, জুড়ে হাটের ঐ আওয়াজটাই উঠছে, মাথার ওপর প্লেনের মত বা ফরেস্টের ভেতর ঝিঁঝির ডাকের মত। তার ওপর কোনো এক সময় নিশ্চয়ই গুঞ্জনটা আবার নামতে শুরু করে। কিন্তু নামার সেই সময়টা ত ধরা যায় না। ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরেই নামতে থাকে। হঠাৎ যখন খেয়াল হয়, তখন, দেখা যায় তার আগেই অনেকটা খালি হয়ে গেছে, যেন রোজকার চেহারায় ফিরে আসছে। বোঝাই যায় না এত বড় হাটটা কখন এত ফাঁকা হয়ে গেল।
এই প্রায় সব হাটের প্ল্যান যেন একরকম। সদর রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারি বাধা ঘর, দোকান। হাটটা সব সময় সেই সব ঘরের পেছনে পড়ে যায়। দুই দোকানের মাঝখানের ফাঁকগুলো দিয়ে হাটের ভেতরে ঢুকতে হয়। যেন, একসঙ্গে পাশাপাশি দুই মানুষ ঢোকা যায় না এমন সব ফাঁক দিয়ে হাজারে হাজারে মানুষ ভেতরে ঢুকে বসে আছে। গরুর গাড়িগুলোর ভেতরে যাওয়ার একটা রাস্তা থাকে, সেটা হয়ে দাঁড়ায় হাটের পেছন। হাটের জন্যেই হয়ে যে-দোকানগুলো হাটটাকে আগলিয়ে সদর রাস্তার মুখোমুখি থাকে, সেই দোকানগুলোই যেন হাটটাকে দাবিয়ে প্রধান থাকতে চায়। মিষ্টির দোকানগুলোতে বাইরে তক্তপোশের ওপর শাদা চাদর পেতে জিলিপির পাহাড় ওঠে। কাপড়-গামছার দোকানে ও বারান্দায় কাপড়-গামছা ঝোলে। এমন কি, সাইকেলের দোকানে রাখা সাইকেলও দোকান উপছে রাস্তায় এসে পড়ে। আর, এই সবের ঘনিষ্ঠ আড়াল থেকে মানুষের সমবেত কণ্ঠ প্রবল হয়ে ওঠে। সেই কণ্ঠের কোনো আওয়াজের কোনো অর্থ করা যায় না, কোনো একটি ধ্বনিকে আলাদা করা যায় না, সমস্তটাই হয়ে ওঠে ধ্বনির প্রবাহ, প্রায় নদীস্রোতের মত। নদীস্রোতের মতই নেপথ্যের সেই প্রবল বর্ততান তার উচ্চতম কোলাহলের জোরেই একটা অস্তিত্ব হয়ে ওঠে ও আঘাতে-আঘাতে হাটের বাইরের এই দোকানের সারিকেও হাটের অন্তর্গত করে ফেলে। দোকানগুলোও হাটের ভেতরে ঢুকে যায়।
.
০০৯.
এই হাটটা কেমন
সন্ধ্যার পর হাটের একটা চেহারা এসে যায়। সারাদিন ধরে হাটটা যত পারে খুলেছে, সধ্যা হওয়ার পর সেটা যত পারে ছোট-ছোট টুকরোয় ভাগ হয়ে যেতে থাকে। আর এই টুকরোগুলো তৈরি হয় উজ্জ্বল আলোককেন্দ্রগুলোকে ঘিরে।
এখন, এই হাটের পাইকারি বাজারের দিকটা যেন খালি। গো-হাটার দিক ত প্রায় অন্ধকার। মাটির হাঁড়িকলসী বিক্রির বিরাট এলাকা হাটের পশ্চিম সীমা জুড়ে, তাতে যে শুধু খদ্দের নেই, তা-ই নয়, দোকানদাররাও কেউ-কেউ উঠে পড়েছে। তরি-তরকারির বাজারে ভিড়টা আছে–শেষ দিকের ঘরুয়া হাটের মানুষের ভিড়, শস্তায় নানারকম জিনিশ এখন পাওয়া যায়। জামাকাপড়ের দোকানগুলোতেও ভিড় লেগে আছে, বিশেষ করে নাইলনের গেঞ্জির দোকানে।
আলো কোথায় বেশি আর কোথায় কম এই নিয়ে যেন হাটটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একেবারে উত্তরে, এক কোণে, একটা চালাঘরে চায়ের দোকানের মুখ হাটের দিকে। সেখানে হ্যাজাক জ্বলছে। চালাঘরটা এই হাটের যেন শুরু। কিন্তু তার বাইরেটা যত পরিষ্কার দেখা যায়, ভেতরটা তত দেখা যায় না। সামনে দাঁড়ালেও মানুষকে মনে হচ্ছে ভেতরের অন্ধকার থেকে বাইরের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের আর জামার এক-একটা অংশ একটু উজ্জ্বল বাকিটা অন্ধকারে মিশে আছে। সামনে কতকগুলো বেঞ্চ। তাতেও অনেকে বসে। তাদের ছায়াও সেই চালাঘরের ভেতরের দিকে পড়ায়, ভেতরটা আরো অন্ধকার।
তার সামনে এমনি কিছুটা অন্ধকারের বিস্তার, যেন মনে হয় কিছুটা জলের ওপারে ঐ চালাঘর। সেই কিছুটা অন্ধকার পেরিয়ে দুটো লম্বা সারির আলোর গলি। দুটো গলি না তিনটে গলি বোঝা যায় না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক দোকানেই হ্যাজাক থাকায় মনে হয় ওখানে একটা বেশ বড় বেচকেনা চলছে। জামাকাপড়ের দোকান। সবগুলো আলোই হ্যাজাকের নয়, মাঝে-মাঝে কার্বাইডের আলোও আছে। হ্যাজাকের লালচে আলোর পুঞ্জগুলির মধ্যে কার্বাইডের আলোর নীল শিখাগুলি ও সেই শিখাগুলির বিচ্ছুরিত আলোর ঠাণ্ডা বৃত্ত রঙের কেমন একটা নকশা তৈরি করে কমলায়-নীলে-ফিরোজার।
সেই আলোর নানা রঙের মিশেলের ওপর, আবার কুপি জ্বালানো অন্ধকারের চাকের পর, ঐ কাপড়হাটির সমকোণে লম্বা হাঁড়িহাটি। সারি-সারি উল্টনো হাঁড়ির ওপর কুপি বসানেলাইন করে, যেমন জলের ভেতর চরের নিশানা থাকে, একটু পরপর। কুপির আলোর বৃত্তের মধ্যে পোড়ামাটির লালচে। তেমনি পোড়ামাটির লালচে বৃত্ত, পর পর, পর পর, অনেক দূর। লম্বা সারির নির্জনতায় কুপির শিখা কাপে, মাটির হাঁড়িতে লালচে বৃত্ত দোলে, গোল-গোল মাপ-মত ছায়ারা হাঁড়ির বর্তুলে ছলকে-ছলকে যায়–যেন অন্ধকার, জলের মত তরল। ফলে, মনে হয়–এই দৃশ্যটা সাজানো। বা, এ যেন ঠিক হাটের ভেতরের দৃশ্য নয়।
হাঁড়িহাটির পরেই গো-হাটা, অন্ধকার, এক-একটা টর্চের আলো আচমকা ঝলসে যায়। এক-একটা হা-ম্বা ডাক অন্ধকার থেকে উঠে অন্ধকারেই আবার মেশে। ডাকের শেষটুকু একটা রেশ হয়ে যায় বলেই মিশে যেতে পারে। গো-হাটার কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু হঠাৎ এই হাম্বা-ডাকে কেমন যেন, মনে হয় ওখানে অন্ধকারে কাদায় পা ডুবিয়ে নীরবে যেন অন্ধ হয়ে আছে আরো পশুপাখি, মোষ, মুরগি, হাঁস, পায়রা, পাঠা। তারা এখন অন্ধকারে ক্রমেই অন্ধ ও নীরব হতে থাকবে।
গো-হাটিকে ডাইনে রেখে বয়ে বেঁকলে, আবার একটা সমকোণে, একটু ডাঙামত জায়গায় ক্রমেই দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে গেছে এই হাটের সব চেয়ে বড় বাজার–পাইকার-হাটি। এখন সেই বিস্তারটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা ডাঙা বলেই, ক্রমেই উত্তর থেকে দক্ষিণে ডাঙা বলেই। এখন সেই ডাঙাটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা প্রায় একেবারে ফাঁকা বলেই, ক্রমেই বেশি কাঁকা আর যত দক্ষিণে তাকানো যায়, তত বেশি ফাঁকা। এই ডাঙাটার মধ্যে বা শেষে কোথাও আর বেশি আলোর কোনো দোকানপাট বা বাজার নেই। তাই এই ডাঙাটায় ছড়ানো কুপি, মোমবাতি আর লণ্ঠনের আলোয় যেন মনে হয় নদীর ভেতরে ছড়ানো-ছিটনো আলোজ্বালানো নৌকোর নদী। সেই একই রকম উজ্জ্বলতার আলো অতটা জায়গা জুড়ে ডাঙা হয়ে ছড়িয়ে আছে। তকতক করে বারবার ঝাড় দেয়া মাটি। তবু বর্ষা বলে কালচে। আর তাতে ছোট-ছোট ঢিবি, বেশির ভাগই শুকনো লঙ্কার, অনেকগুলো আলুর, মনে হতে পারে শুকনো লঙ্কা আর আলুই এদিককার প্রধান জিনিশ। পাইকারি হাটটায় আলু আর শুকনো লঙ্কা, আলু আর শুকনো লঙ্কা আর মাঝে-মাঝে পেঁয়াজের পাজাই ফাঁকায় ফাঁকায় ছড়িয়ে। এক-একটা পঁজার জন্য অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দেয়া। বেচাকেনায় অনেকখানি জায়গা দরকার। মাঝে-মাঝে মোটা বাশের চারটে খুটিতে কাঠের বিরাট-বিরাট পঁড়িপাল্লা ঝুলছে। সেই বিরাট সাইজের পাল্লাগুলোর একটা দিকে ভার বসানো। আর-একটা দিক বাতাসে দোলে। মোমবাতি আর কুপির শিখার আলোতে ঐ বিরাট কাঠের পাল্লা আর লম্বা নাইলনের দড়ি অতিকায় ছায়ায়-হায়ায় পাক খায়।
পাইকার-হাটির পুব সীমা ধরে, হাটের দিকে মুখ করে বসা পাটহাটি! একটা সারিই এদিকে মুখ করে। তার পেছনের অংশটা মাঠেই ছড়িয়ে। সেখানে গরুর গাড়ির সারি, ওপরে পাটের বোঝা। গাড়ি ধরেই বিক্রি। এখনো গাড়িই আছে। আর গরুর গাড়ির আনাচকানাচে সামনে-পিছনে মানুষজনের আসাযাওয়া। গরুর গাড়ির চাকার ফাঁক দিয়েও দেখা যায়-ওদিককার কিছু মানুষজনের বসে থাকা বা চলাফেরা। পাটহাটির গরুর গাড়িগুলোতে লণ্ঠনই বেশি। আবার রাস্তা ধরে যেতে হবে। মাঝে-মাঝে শুধু টর্চ ঝলসায়।
পাইকার-হাটির দিকে মুখ করে বসা, পাটহাটির প্রথম লাইনটার শেষে দক্ষিণ সীমায়, মাটির ওপরই ছড়িয়ে রাখা হাল আর হালের আল। হালই বেশিফরেস্টের বিনি পয়সার কাঠে বানানো–বেশ বড়, শক্ত, হাল। ছোট রাস্তার ওপর ছড়ানো চা বাগানের চোরাই কলমকাটা ছুরি, দা কোদালি, ফাড়য়া। তার পাশে কামারের তৈরি দাকুড়োল, হাতুড়ি বড় সাইজের। কিন্তু সংখ্যায় বেশি নয়। আজকাল টাটা কোম্পানির কোদাল আর কুড়ল পাওয়া যায় লোহার দোকানে, তার ভারও বেশি, ধারও বেশি, দামও বেশি। তারও পাশে প্রায় অন্ধকারে কিছু চেয়ার, টেবিল, ছোট আলমারি–জাল দেয়া, এমন-কি একটা আয়না-লাগানো ড্রেসিং টেবিলও–বেশ চকচকে পালিশে মোমের আলো পিছলে যায়। আপাতত মনে হয়, হাটটা বুঝি এইখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তারও পর, অন্ধকার মাঠ থেকে দুর্গন্ধ আসে। একটু নজরে লোকজনের আসা যাওয়াও বোঝা যায়। সারের এফ-সি-আই-এর ইউরিয়া আর মিশ্রসারের চোরাই বাজার। বসেই সন্ধ্যার পর। একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
সারের হাটটার কাছে ত পৌঁছনো যায় না। গন্ধে তার আভাস পাওয়া যায়। মনে হয় হাটটা যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু সেই অন্ধকারের দিকে, সেই গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে তাকিয়ে থাকলে যেন মনে হতে থাকে দূরে-দূরে অন্ধকারে, মাঠে-মাঠে, আরো দূরে-দূরে হাটটা ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার সেই মাঠের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠে আসে চাপা প্রতিধ্বনির মত, কিন্তু ধারাবাহিক। যেন বাশের পঁজার ওপর গাড়ি-গাড়ি বাশ ফেলার আওয়াজ। সেই চাপা আওয়াজ একবার শোনা গেলে কানে আসতেই থাকে। থামে না। হতে পারে, ট্রাকের পর ট্রাক বাঁশ লোড হচ্ছে–টিটাগড়ের কাগজ কারখানার জন্যে। হয়ত ফরেস্টের সাপ্লাই। কিন্তু বেশির ভাগই কনট্রাকটারের। সে ফরেস্ট থেকেও কেনে, চাষির কাছ থেকেও কেনে। নইলে গ্রামের বন্দরের হাটে কখনো বাশহাটি বসত না। আবার হতেও পারে এটা বাশের আওয়াজই নয়। এমন ধারাবাহিক আওয়াজ ত অন্ধকারের ভেতর থেকে নানা কারণেই উঠতে পারে। দিনেও হয়ত ওঠে। কিন্তু অন্ধকারেই হয়ত বেশি শোনা যায়। তিস্তা কোন দিকে? কতদূর? তিস্তার বন্যায় ফরেস্টের কোনো শাল-সেগুন ভেঙে পড়েছে। এখন অন্ধকারে রাতারাতি তা টুকরো-টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসছে। হতে পারে সেই কুড়োল কাটার শব্দ। বা, এখন সন্ধ্যায়, সেই দূরের ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে ট্রাকবাস যাওয়ার আওয়াজ মাটি কাঁপিয়ে আসে। বা পাহাড়ের ওপরের কোনো বন্যা ন্যাওড়া নদী দিয়ে এখুনি বয়ে যাচ্ছে–দুই পাড়ে ধাক্কা দিয়ে আরে বেগে ও আরো বেগে। কোথাও হুড়মুড় করে পাথর পড়ছে? নাকি চা বাগানের জেনারেটারের আওয়াজ ফরেস্টে নদীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে-হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে? কুপি আর মোমবাতি, কারবাইড আর হ্যাজাকের আলোতে হাটভরা মানুষের আকার অনেক বড় হয়ে গেছে। অন্ধকারটাই প্রধান মাঝে-মাঝে আলোর ছোঁয়া, আবার কোনো-কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে দু-একবার দিগন্ত বা কোনে অন্যমনস্কতায় আকাশ চোখে পড়লে ব্যাপ্ত অন্ধকারটাই দেখা যায়। আলোর নানা বৃত্তেও শুধু উজ্জ্বলতা নয়। কোনো মদেশিয়া রমণীর পিঠে কাপড় দিয়ে বাধা বাচ্চার মাথা দোল খায়, ওপরেই জেগে থাকে লাল ও কিছু অস্পষ্ট রঙের বুনো ফুলের ঝাড়, কালো চুলে। কালো মুখ অন্ধকারের সঙ্গে কোন অনির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে গিয়ে মেশে। নাইলনের উজ্জ্বলতা পিছলে যায় কোনো তাগড়া আদিবাসী বুক থেকে ধনুকের একটা মাথা দেখা যায়। রাজবংশী রমণীর ফোতার ওপরে উঠে আসে নগ্ন হাত, গলাকাঁধ অন্ধকারে ঝিলিক দেয় কুচকুচে আদিবাসী রমণীর ঝকঝকে দাঁতের সারি। কোথাও নিষ্ঠুরতা ঘটে যেতে পারে। বটগাছের গুঁড়ির মত ভূয়োদর্শী মোঙ্গলয়েড মুখ চামড়ার অসংখ্য কুঞ্চনে নদীর চরের মত জেগে থাকে। কোথাও জমি চষা হয়ে গেছে। মেদহীন তীব্র পাহাড়ি চিবুকে পার্শমুখের শান। টিলার মাথা থেকে সমতল দেখা যায়। এ হাটের বেচাকেনা শেষে এখন যেন ভিড়েরই মুখ–বহু শত বর্ষের আদিবাসী ঘরানার মুখোশে অলঙ্কৃত সে-মুখময় শুধু বিস্ময় বা বিস্ময়ের অবসান। রেখা, রং আর অঙ্গসংস্থানে কোনো নতুনত্ব নেই, একটি মুখোশ থেকে আর-একটি মুখোশ আলাদা করা যায় না, অথচ প্রতিটি মুখোশই আলাদা হয়ে যায় অনিবার্য। এই দীর্ঘ-দীর্ঘ ছায়াসন্নিপাতে সেই মুখোশের ক্ষণিকতা অথচ তার বড় বেশি নির্দিষ্টতায় বিদ্যুচ্চমকিত অরণ্যের আভাস যেন খেলে-খেলে যায়। বা, কখনো, বিদ্যুচ্চমকের জন্য অরণ্যের অন্ধকার প্রতীক্ষা। সেই প্রতীক্ষাতেই নাচের গানে পাহাড়ের প্রতিধ্বনির ক্ষীণতা আসে। একাকী ঢোলে বোল ওঠে। কোন বিস্মৃত নিঝর বয়ে যায়। আর এই ভিড়, আর সওদা, আর বেচাকেনা, আর ভিড়, আর সওদার ভেতরে মিশে গিয়েও মিশতে পারে না, ভিড়ের হয়েও ভিড় থেকে যেতে পারে না, আরো একবার মেলায় এসেও যেন হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে যাওয়ার মত বিষণ্ণ, আত্মবিস্মৃত, বিচ্ছিন্ন মুখ, মুখ, মুখের সারি।
.
০১০.
হাটের আড়ালে হাট
হাটের পুব দিক থেকে উত্তর ঘিরে যে রাস্তাটা বেঁকে গেছে, সেই সমকোণেই ত এই হাটটা বসেছে। হাটের পাশে সারি সারি দোকান হাটটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করেছে। বেশির ভাগ দোকানের মুখ রাস্তার দিকে। দু-একটা দোকানের পরই একটা করে ফাঁক-হাট থেকে বাইরে বেরবার। এ রকম ফাঁক-ফোকর অনেক।
তেমনি একটা ফাঁকের পাশে দু সারি দোকানের মাঝখানে পাটহাটিরও উত্তরে এক লম্বা-জমিতে হাটের আড়ালে হাট। খুব কাছাকাছি লাইন দিয়ে কুপি জ্বলছে। একদিকে সেই কুপির আলো বাইরে বেরতে পারছে না, নোয়ানো মানুষগুলোর মুখ চোখকেই শুধু আলোকিত রাখে। আর-একদিকের শিখাগুলোতে কোনো আড়াল নেই, যেন দমকা বাতাসে নিবে যেতে পারে। সাট্টা, জুয়া, ডুগডুগি খেলা চলছে। জায়গাটা লম্বাটে। জুয়ার টেবিল মাটির ওপর বা টুলের ওপর বসেছে লাইন দিয়ে–যেন বসার ভেতর একটা পরিকল্পনা আছে। কোনো কথা বা আওয়াজ শোনা যায় না। কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে এ টেবিল থেকে অন্য টেবিলে উঁকিঝুঁকি মারছে। বেশির ভাগই নিচু হয়ে খেলছে। জায়গাটা যেন অন্ধের হাত। কেউ কিছু দেখছে না। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেআইনি হাট বসে গেছে। আসল হাট উঠে যাবে, এই হাট যতক্ষণ ইচ্ছে চলবে। কিন্তু বেআইনি বলেই এক ধরনের দ্রুততা আসে। সবাই যেন একই দ্রুততায় নিজের খেলাটুকু সারতে চাইছে।
আর-এক পাশে সারি সারি অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি আর গ্লাশ নিয়ে মেয়েরা। ডেকচিগুলোর ওপরে গামছার ঢাকনা। প্রত্যেক ডেকচি ঘিরেই ভিড়। হাড়িয়া বা পচাই। কোনো মাতালের স্বলিত চিৎকার নই। খুব চাপা স্বরে, প্রায় ফিসফিসের মত, স্বরের জড়তা, কথাটা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার মত শোনায়।
মাটি থেকে উঠছে কেউ। এতক্ষণ মাটিতে গড়াচ্ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে, উবু হয়ে বসে, দুই হাঁটুতে দুই হাতের ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু আবার সোজা উঠতে থাকে, মাথাটা একটু দোলে, তারপর খাড়া দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখলে, দেখ। দেখ দেখ, ভাইমন অউর হিনমন, দেখো, হাম খাড়া উঠলেক হো—আ-আ-ডা। এই খাড়া হয়ে উঠতে ও খাড়া ভাবটা রাখতে, তাকে কিছুটা মেহনত করতে হয়। তার পা যাতে না টলে তার মাথা যাতে না টলে, সেটা সামলাতে তাকে শুধু কোমরটা টলাতে হয়, কোমর থেকে গলা পর্যন্ত অংশটাও পাক খায়। ফলে সেই অন্ধকারে তার এই একান্ত একাকী প্রয়াস চলতে থাকে–সে শক্ত ও সোজা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, মাথাটা শক্ত ও সোজা, মাফখানের পেট, বুক মাঝে মাঝেই যেন ভেঙে পড়তে চায় কিন্তু কোমরটা দুলিয়ে সেটা সামলাতে হয়। সেই সামলানোর সময় কোনো পা হয়ত হাঁটু দুমড়ে পড়তে চায় কিন্তু তখন পটের দুলুনি উরুতে এনে উরুতেও একটা দোলানি দিয়ে সে ভাঙনটা রোখে। আর এর সঙ্গেই সেই স্থির মাথার স্খলিত উচ্চারণে সে চ্যালেঞ্জ জানায়, কুন কহথে মায় মাতৃগেলাক? কভি নেহি। হাম কভি মাতোয়ালা হনে নাহি শেকথে। এই দেখ। পাক্কা দে। হাম এই দোনো পায় পর খাড়া হয়। এই দেখ। পাক্কা দে। হামারা ই মাথাঠে ভি খাড়া হায়! তব? তব ভি হাম মাতোয়াল? কভি নেহি? এই দেখ, হাম পারিড করেগা। রে-ডি, ওয়ান টু থ্রি, লেফট রাইট, লোকটি তার পা দুটো একবারের বেশি তুলতে পারে না। তাতেই তার সমস্ত শরীরটা হুমড়ি খেয়ে যায়। লোকটা মাটির ওপর শুয়ে পড়ে।
আবার কিছুক্ষণ পর লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে কিন্তু বসে না। হামাগুড়ি দিয়েই ঐ হাড়িয়ার সারির দিকে এগয়। তারপর এক জায়গায় গিয়ে থামে। হামাগুড়ি থেকে উবু হয়ে বসে। আবার দাঁড়াবার জন্য দুই হাঁটুর ওপর দুই হাতের ভর দেয় কিন্তু উঠতে পারে না বা ওঠার চেষ্টাও করে না। সেখান থেকে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে বলে, দেখ, হাম পারেড ভি করলেক, আভি হামকো অউর এক গ্লাশ দে। হাম তো মাতোয়াল নাহি হোলাক, হে ডায়ানা, হাম জরুর অউর এক গ্লাশ পিগা, হে ডায়ানা, হামকো জরুর–
যে-মেয়েটি গ্লাশে-গ্লাশে হাঁড়িয়া দিচ্ছিল তার কাছে গিয়ে লোকটি দাঁড়ায়। যারা খাচ্ছিল তারা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মেয়েটির পাশে গিয়ে বসতে চেষ্টা করে। কিন্তু পা দুটো ভাজ করতেই টলে যায়। তারপর একবার টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়ে যায়। মাটির ওপর সোজা হয়ে বসে সে আবার সেই মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, হে ডায়ানা, হাম জরুর পিয়েগা, পয়সা লে, দারু দে। সেই মেয়েটি তার দিকে মুখ না ফিরিয়ে ডান হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিতেই লোকটি একেবারে গড়িয়ে যায়। আর ওঠে না।
বাতাসের মত ফিসফিস ফিসফিস স্বরে সহসা রটে যেতে থাকে জাপানি টেরিলিন, ষাট টাকা প্যান্ট পিস, সিকো ঘড়ি, বাঁ-হাতের পাতার ওপর মেলে ধরা কোনো ঘড়ির রেডিয়ামের বিদেশী দ্যুতিতে অন্ধকারে আদিবাসী চিবুকের ডৌল। লোকটা মুঠো বন্ধ করে ফেলে। আলো নিভে যায়। চিবুকের ডৌল অন্ধকারে মিশে যায়। বাতাস পাক খায় জাপানি হংকং, মেড ইন ইউ. এস. এ। সাট্টা আর জুয়োর ভিড়টা হুমড়ি খেয়ে খেলছে। আর চাকা থামলে, বা ডুগডুগি ওঠালে, বা, লুডোর গুটির মতো গুটি ফেললে একবার সমবেত হি-ধ্বনি উঠেই আবার চাপা হিংস্র নীরবতা।
জুয়োর বোর্ডের কিছু দেখা যায় না। কুপির শিখা মানুষজনের মুখের ওপর লকলক করছিল, দপদপ করছিল, পিছলে যাচ্ছিল। হাটের দূরদৃশ্যের মত নয়–অতি নিকট দৃশ্য। এত নিকট যে হাত-পাও দেখা যায় না, শুধু মুখ, বা সূর রেখা বা কপালের চ্যাপ্টা বা কালো কুচকুচে নাকের একটি পাশ। সাট্টা বোর্ডের কুপির আলোতে চেনা যায় না বোর্ডের মালিকের মুখটা-নেপালি, রাজবংশী, মেচ; কোচ, রাভা যে কোনো কিছু হতে পারে, পেছন থেকে দেখলে মাথার খুলিতে সঁওতালের লম্বাটে ধাচও যেন দেখা যায়।
১.২ হাটের সামাজিকতা
০১১.
হাটের সামাজিকতা
সদর রাস্তার দু পাশের দোকানে হ্যাজাক বাতি, ডান হাতিতে একটু দূরে একটা ইন্টার-প্রভিন্সিয়াল ট্রাক দাঁড়ানো। বয়ে চায়ের দোকানগুলিতে লোকজনের ঠাসা ভিড়। ডাইনে-বায়ে তাকিয়ে সুহাস যেন হাটের ম্যাপটা আর-একবার ছকে নেয়।
সুহাস মিষ্টি ও চায়ের দোকানগুলোর দিকে যায়।
বাইরের বেঞ্চিগুলোতেই বসার ইচ্ছে ছিল সুহাসের। কিন্তু সেখানে এখন গাদাগাদি ভিড়। খবরের কাগজের টুকরোর ওপর জিলিপি আর নিমকি। বেশির ভাগই চা বাগানের মজুর-মজুরনি। এদিককার ভাষায় মদেশিয়া। অনেকে, নিজেও খাচ্ছে, কোলের বাচ্চাটিকেও খাওয়াচ্ছে-ভেঙে-ভেঙে।
সুহাসকে ভেতরে গিয়েই বসতে হয়। আর, ভেতরেই যখন বসেছে তখন একেবারে শেষে গিয়ে বসাই ভাল। মাইকাটপ হাইবেঞ্চ। সামনে বেঞ্চিও আছে, কোথাও-কোথাও ভাজ করা চেয়ারও। সুহাস একটা ভাজ করা চেয়ারে আলগা হয়ে বসে। তার সামনের, পাশের সব টেবিলেই লোক। সুহাসের শুধু এক কাপ চা-ই খাওয়ার ইচ্ছে। অথচ বুঝতেই পারে চা-টা যথেষ্ট অখাদ্য হবে। কিন্তু এতটা ভেতরে বসে শুধু চা খাওয়া ঠিক কিনা বুঝতে পারে না। ছেলেটি এলে বলে, এক কাপ চা-ই দিন, পরে কিছু নিলে বলব।
কিন্তু ছেলেটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে একটা চায়ের ডিশে গাদাগাদি মিষ্টি নিয়ে। সুহাস বুঝতেই পারত না মিষ্টিটা তারই জন্যে, যদি-না তার একেবারে মুখের সামনে এনে এই ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকত। আর সুহাস কিছু বলতে পারার আগেই ধুতি-গেঞ্জিপরা লোকটি সামনে এসে দাঁড়ায়। সুহাস বুঝে ফেলে, দোকানের মালিক। এতক্ষণ রসে থাকার জন্য ধুতির গিট তলপেটের অনেক নীচে নেমে গেছে, গেঞ্জিটা পেটের ওপর দিয়ে অতটা ঢাকতে পারছে না। খুব ফাইন ধুতি আর ফাইন গেঞ্জির মাঝখানে রোমশ একটা মোটা লাইন।
ছেলেটির হাত থেকে ডিশটা নিয়ে বলে, জল নিয়ে আয়, তারপর দু হাতে সুহাসের সামনে ধরে বলে, স্যার, নিন স্যার, আমার দোকানের মিষ্টি স্যার কলকাতায় যায়, চাবাগানের সাহেবরা বাগডোগরায় প্লেন ধরতে যাওয়ার সময় এখান থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যান স্যার। বিকানীর সুইটস স্যার।
সুহাস তখন পারলে উঠে পালায়। কিন্তু লোকটার কথাতে, তার দোকানের আর মিষ্টির তারিফে, সে একটু স্বস্তি পায়–অন্তত এইটুকু বাচোয়া। কিন্তু তার সামনে লোকটি দুই হাতে এইটুকু ডিশে এমন পাজা করা মিষ্টি ধরে আছে–দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি এপাশে-ওপাশে তাকায়। বুঝতে পারে, সামনের বেঞ্চিতে যারা খাচ্ছে তারা ব্যাপারটা দেখছে। কিন্তু দোকান-ভর্তি মদেশিয়া আর রাজবংশী মজুর কৃষকরা এদিকে তাকাচ্ছেও না।
সুহাস তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা চুকিয়ে দিতে চেয়ে বলল, আমি মিষ্টি খেতে পারি না। আপনি নিজে এনেছেন। একটা মিষ্টি দিন।
আচ্ছা স্যার, আমি জিদ করব না। কিন্তু আপনাকে টেস্ট ত করতেই হবে। রোজ একটা করে টেস্ট করলেই আমার সব মিষ্টি টেস্ট করা হয়ে যাবে। এই ডিশ লাও, লোকটির গলা খাদে আর চড়ায় খেলে গেল।
ডিশ মানেই অন্তত গোটা দুয়েক। সুহাস তাড়াতাড়ি হাত পেতে লোকটিকে বিপন্ন করে–হাতে দিন, একটা।
এ স্যার কি হয়, আপনাকে হাতে দিব?
আমার ত হাতে খেতেই ভাল লাগবে–সুহাস মনে-মনে চটে। হঠাৎ মনে হয় দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
বোধহয় তার মুখ দেখে দোকানদার কিছু আঁচ করে। সে সবচেয়ে তলা থেকে লম্বা, গোল সাইজের সবচেয়ে বড় মিষ্টিটা বের করে। সুহাস বলে, এইটি দিন, ওপরের সন্দেশটি দেখায়।
এ কী স্যার, এটুকু কী হবে স্যার, এ ত গালে দিতেই গলে যাবে।
ঠিক আছে, ঐটিই দিন।
ইতিমধ্যে বাচ্চা ছেলেটি ডিশ নিয়ে এসে বেঞ্চির ওপর রাখে। তাতে সন্দেশটি তুলে দিয়ে আর-একটি মিষ্টিতে চামচ লাগাতেই সুহাস ডিশটি সরিয়ে নিয়ে বলে, উ–।
দোকানদার হে হে করে হেসে উঠল, স্যার, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে চলে যায়।
সামনের বেঞ্চিতে যারা বসে খাচ্ছিল তাদের ভেতর একজন উঠে সুহাসকে নমস্কার করে বেরিয়ে যায়। সুহাস প্রতিনমস্কারের সময় পায় না। আর, তারপরই হাট কমিটির সেই বয়স্ক ভদ্রলোক এসে তার সামনের বেঞ্চিটাতে বসেন, হাটটা দেখলেন?
এখন ত সন্ধ্যা। বোধ হয় বিকেলে জমে বেশি।
না, সে ত এখনো জমাই আছে। এ ত ডুয়ার্সের প্রায় ধরেন কেন বড় হাট। ধূপগুড়ির হাটঠে অনেক ঘট! ধূপগুড়ির হাট ত পাইকারি হাট।
সুহাসের মনে পড়ে যায়, সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, এখানে কি শুকনো লঙ্কা তৈরি হয় নাকি? হাটে শুকনো লঙ্কার পাহাড় দেখলাম।
ছেলেটি এসে চা-টা রাখে।
না, না, এখানে শুকনা লঙ্কা হয় কোটে? এইঠে ত শুকনা লঙ্কা না হয়। ধরেন, এই ক্রান্তির হাটতও বছর খানিক আগতও শুকনা লঙ্কা না আছিল। তখন নারায়ণপ্রসাদের গোডাউন ছিল শিলিগুড়ি।
নারায়ণপ্রসাদ কে?
এই ধরেন কেনে এই তামান এলাকার, আসামের, শুকনা লঙ্কার ডিলার। উমরার শুকনা লঙ্কার মালগাড়ি ত এখন মাল স্টেশনে আসে।
ত সে এখানে কী করে?
নারায়ণপ্রসাদ বছর তিন আগে এইখানে একখান চাবাগান কিনি নিসে। ত বাগান মাস ছয় পর হয়্যা গেইল বন্ধ। নারায়ণপ্রসাদ ওর এই বাগানের গোডাউনটাক বানাইল শুকনা লঙ্কার গোডাউন। ব্যস, সেই থাকি আসাম আর তামান-তামান জায়গায় সব পাইকারি বেচাকেনা হবার ধরিছে এই ক্রান্তি হাটত। স্যালায় ত ক্রান্তি হাটার এ্যানং নামডাক।
আর সেই চা বাগান?
সে ত বছর খানেক আগে খুলি গেইছে। ত ফ্যাকটরি ত আর চলে না। গ্রিনটি বেচা হয়া যায়। গোডাউনটা শুকনা লঙ্কারই আছে।
সুহাসের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, আর আলু?
সে ত এই বছরই একখান ঠাণ্ডা ঘর চালু হবা ধরিছে ওদলাবাড়িত।
ওদলাবাড়িতে ত এখানে কী?
সে ত ঠিক বলিবার পারিম না। এইঠেও বুঝি একটা গুদাম থাকিবার পারে।
সুহাস আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখন আস্তে-আস্তে বেরতে শুরু করল। তখন ভদ্রলোক পেছন-পেছন এসে বললেন, আমাদের কথাটা একটু বিবেচনা করি দেখিবেন। এর মধ্যে ত কুনো দোষ নাই। আমাদের বাড়িঘরেরও ত সাগাইকুটুম আছে।
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আন্তরিকতা ছিল যার জন্যে সুহাসকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হয়। কিন্তু দোকানের মাঝখানটাতে বড় ভিড়। এদিকের বেঞ্চের একটা বড় দল খাওয়ার পর উঠে পয়সা দিতে যাচ্ছিল–প্রায় লাইন দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছিল দলটা আসলে একটাই-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ফলে সুহাসকে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতে হয়।
ভদ্রলোকও পিছু-পিছু এসে পঁড়ান। সুহাস তখন তাকে বলতে পারে, আপনারা এরকম করে বললে আমারই লজ্জা হয়। হবে-খন, আমরা ত এখন থাকবই।
ভদ্রলোক দুই হাত সামনে নিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে মাথা হেলান।
প্রিয়নাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন সুহাসের সঙ্গে আরো দু-চারজন কথা বলছে তখন প্রিয়নাথ এগিয়ে এসে এদের পেছন থেকে বলে, স্যার, আমি ক্যাম্পে এগুলো রেখে আসি?
সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে একবার দেখে নেয়। আর তাদের দেখার সুবিধে করে দেয়ার জন্যেই যেন প্রিয়নাথ তার মুখটা আলোতে মেলে রাখে। এরপর ত তার সঙ্গেই সবাইকে কথা বলতে হবে।
আপনি যান, আমি যাচ্ছি সুহাস প্রিয়নাথকে বলল। তারপর হঠাৎ ভিড়টা সরে গেল। সুহাস ভেবেছে সে এখন চলে যেতে পারে। কিন্তু ফাঁক দিয়ে বেরবার জন্যে পা ফেলতেই খুব ছোটখাট একটা লোক সামনে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল, খুবই মৃদু গলায় বলল, আমার নাম নাউছার আলম।
অ্যাঁ! বলে হকচকিয়ে সুহাস প্রতিনমস্কার করতে ভুলে গেল। নাউছার আলম–এই নামটা ত প্রায় গেজেটিয়ারে উঠে গেছে। সরকার বেশির ভাগ কেসেই হেরেছে সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। বাকি জমিতে ইনজাংশন। নাউছার আলম–এই নাম শুনে যাকে ভেবেছিল ডাকাতের মত পরাক্রান্ত, সে কি না এরকম ছোটখাট ভদ্রলোক। কিন্তু ততক্ষণে অন্য সবার দিকেও ঘুরে-ঘুরে নমস্কার করে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই আচ্ছা চলি বলে ভদ্রলোক ভিড় থেকে বাইরে চলে গেছেন।
.
০১২.
শেষহাটি থেকে হাট শেষ
একটা চরম বিন্দু আছে যখন কোনো কিছুই আর হাটের বাইরে নয়। তখন যে হাটের রাস্তায় আছে, হাটে। এসে পৌঁছয় নি-সে-ও হাটের ভেতরে ঢুকে যায় দূর থেকে। এই একটা সময়, যখন হাটটা যেন তার অব্যবহিত চারপাশের অনির্দিষ্ট সীমাটুকুও উপছে যায়। বেড়ে যাওয়ার ও জমে ওঠার সেই অস্পষ্টতায় হাটটা যেন আর হাটে ধরছে না। এই সময়ই নেমে আসে গোধূলি। মানুষের পায়ের ধুলোয় আবছায়া ঠেকে সব। কোথাও-কোথাও লম্বা কুপি জ্বলে উঠে দীর্ঘ-দীর্ঘতর ছায়ায় ছায়ায় হাটটার ভিড় যেন সহসা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এই অবস্থাটা কিছুক্ষণ চলতে-চলতেই দেখা যায় সীমান্ত থেকে সীমান্তের দিকে চলে যাওয়া মুখগুলো আর এদিকে ফেরানো নয়, মুখগুলো ঘুরে গেছে, আদিগন্ত পথে-মাঠে মানুষের সারির মুখ এখন কেন্দ্রের বিপরীতে, দিগন্তের দিকে হাট শেষ-ভাঙা ভাঙতে শুরু করে। কখন যেন হাটটা চরমে উঠে মিইয়ে গেল। মানুষজনের পায়ের দাগ বদলে গেল।
হাটে যাওয়ার পথে মানুষজন যত কথা বলে, যেন হাট থেকে ফেরার পথে তার চাইতে অনেক বেশি। নাকি, হাট থেকে ফেরা ত সব সময়ই অন্ধকারে, তখন ত আর মানুষজন পরস্পরকে দেখতে পায় না, তাই কথা বলে বলে আন্দাজ নেয়। কথা বলে বলে পথ বানায়। নাকি, হাট-ভাঙা মানে সমবেত ধ্বনির সেই কেন্দ্রটিই ভাঙা, তার টুকরোগুলো তখন চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। রাত্ৰিময় ধ্বনিমগ্ন পথে-পথে গড়াতে-গড়াতে গুড়ো-গুড়ো হয়ে হাটটা শেষে ধুলোবালি ও আকাশে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যায়।
হাটের শুরুও শুরু হয় দূরের মানুষ নিয়ে। হাটের শেষও শুরু হয় দূরের মানুষ দিয়েই। যারা বাস ধরবে, তারা সবচেয়ে আগে হাট ছাড়ে। যাদের বাস হাট থেকেই ছাড়ে, তারা তারও পর। রিক্সা যাদের দাঁড়িয়ে থাকে, এর পরই তারা ওঠে। তাদের শেষে, সাইকেলের যাত্রীরা। এই পুরো সময় জুড়েই চলে পায়ের যাত্রীরা-যদিও তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর দূর-দূর রাস্তার দূরত্ব থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে আসতে-আসতে শেষ পর্যন্ত হাটের আশেপাশের গগঞ্জের মধ্যে মিশে যায়। সবচেয়ে শেষে আসে, শেষে যায়।
মানুষজন যে-ভাবে হাটে আসে সেভাবেই ত ফেরে, জিনিশপত্রের বোঝা নিয়ে, পশুপাখি ঝুলিয়ে, বা টেনে। মাঝখানে হাটে হাত বদল হয়ে যায়। ধীরে-ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকারে পশুপাখির চোখের সামনের অভ্যস্ত আলো বা অন্ধকার বদলে যায়। সব অনভ্যস্ততেই ত পশুপাখির ভয়। কিন্তু সেই নিরুপায় অন্ধকারে অভ্যাসের একমাত্র ধারাবাহিকতা থাকে মানুষের কণ্ঠস্বরে বা মানুষের স্পর্শে। হাটে আসা-যাওয়ার পথ এই পশুপাখির অনিশ্চয়তার ডাকাডাকিতে মুখর হয়ে যায়। বা পায়রা-হাঁস-মুরগির অনিশ্চিত নীরবতায়। হাম্বা ডাক শুনে কি বলা যায় কোন বাছুর বিক্রি না হয়ে অভ্যস্ত হাতের টানে ফিরে চলে, আর কোন বাছুরের দড়িতে নতুন হাতের নতুন টান?
সেই অশ্বারোহী ও তার ঘোড়া এখন শূন্য হাটে পাক খায়। ঘোড়াটার পেছনটা এখন ঝোড়ো বাতাসে দোল খাওয়া চালাঘরের মত, আরো ঘন-ঘন দোল খাচ্ছে। এর পরই যে-কোনে সময় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। ঘোড়র পেছনটাই শুধু দেখা যায়–তার দুটো পায়ের কেমন অনেকগুলো ভাজ বা পেছনের হাড় দুটো উঁচু। লেজটা দুই পায়ের মাঝখানে নেতিয়ে ঝুলে, মাছি তাড়াবার জন্যও আর উঠবে না, এমন। ঘোড়ার সামনেটা আর ঘোড়ার নয়। অশ্বারোহী দুই হাতে ঘোড়ার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে বসে। সেই চাপে ঘোড়ার গলাটা লম্বা হয়ে ঝুলে গেছে। ক্রমেই গলাটা আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটি গলা লম্বা করে ঝুলিয়ে দিয়েও ঘাসে মুখ দেয় না। তার পিঠের ওপর নিজেরই ঘাড়ের ভেতর মাথা গুঁজে দেয় অশ্বারোহী আর লম্বা করে দেয়া গলার তুলনায় ঘোড়াটার নড়বড়ে পেছনটাকে কেমন হালকা লাগে, যেন মাথাঘাড়সমেত ঘোড়াটা কোনো ফাঁদ গলায় নিয়েছে, আর এখন শুধু পেছনের অংশটুকুই তার নিজের।
সেই ঘোড়া আর তার আরোহী এখন এই শূন্য হাটের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়, যেন এখনো সেখানে হাট, যেন এখনো তাদের মানুষজন ঠেলে-ঠেলেই এগতে হচ্ছে। কিন্তু এখন আর অশ্বারোহী তার ভিক্ষার ঝুলি কাঠির ডগায় ঝুলিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে না। এখন আর ঘোড়াটিকে পেছনে ধাক্কা খাওয়ায় চমকে উঠতে হয় না। আর অস্পষ্ট চাঁদনিতে সেই ঘোড়া আর অশ্বারোহী ঘুমুতে-ঘুমুতে প্রায় নির্জন হাটের অলিগলি দিয়ে পাক খেতে-খেতে যেন মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বস্তির দিকেই চলেছে। এতে পারে, এই অশ্বারোহী অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়াটি অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়া আর অশ্বারোহী দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো এক সময় পথ পেয়ে যাবে–তারপর আকাশের পটভূমিতে, নদীর চর ও অরণ্যের দূরত্বকে এই ঘোড়া আর তার আরোহী আদিগন্ত প্রান্তরের আলে-আলে কমিয়ে আনবে। ভাদ্রের আকাশের ধূসরতায়, নীল আর প্রান্তরের সবুজে, অরণ্যের কৃষ্ণাভ হরিতে এই ঘোড়া ও তার আরোহী কখনো মিশে যাবে, কখনো ঘোড়াটির লম্বিত গলাটিই ঝুলে থাকবে, কখনো ঘাড়ের ভেতর গুঁজে যাওয়া মাথা নিয়ে আরোহীর ছায়াটুকু ভেসে থাকবে, কখনো ঘোড়ার পেছনটা একটা ভাঙা মেশিনের মত লাফাতে লাফাতে যাবে–যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো নদীর দুই পাড়ে ছায়া–মাঝখানের জলটুকুতে ওদের ছায়া, কখনো জলহীন নদীখাতটুকু যেন ঘোড়ার চারটি পায়ের ভঙ্গুরতা থেকে উজিয়ে গেছে, কখনো নদীর বাঁধের ওপর ছায়ায়-আলোয়, নদীর ভিতর-চরে বালিয়াড়ি ভেঙে, বা অরণ্যের কোনো গাছতলায়। এখন মধ্যরাত্রিতে এই শূন্য হাটে বোঝা যায় না, এই ঘোড়া ও তার আরোহীর কোথাও একটা অবতরণ আছে।
বিকেল আর সন্ধ্যার সব দৃশ্য এখন রাত্তির গভীরতায় ছায়ামূর্তি হয়ে যাচ্ছে। যেন, নদী বা পাহাড়পর্বত বা বনজঙ্গলের মত এই হাটখোলাও একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। যতক্ষণ এই হাটখোলায় মানুষজন ছিল, আলো ছিল, চঞ্চল ছায়া ছিল, পশু ও মানুষের আহ্বান ছিল–ততক্ষণ তার বিস্তার ছিল না, যেন সমস্ত দৃশ্যটাই ছিল সংহত, একান্ত। এখন, মধ্যরাত্রিরও পরে, এই জনহীনতায়, এই নৈঃশব্দ্যে, এই হাটখোলার প্রান্তর যেন তার প্রাকৃতিক বিস্তারে ফিরে যাচ্ছে–ধীরে-ধীরে, প্রায় কোনো সজীব অস্তিত্বের অনিবার্যতায়। এখন, এই রাত্রি আর অন্ধকারের ভেতর থেকে সারাদিনের সেই ব্যস্ততাকেই কেমন অলীক ঠেকতে পারে।
কিন্তু হাটটা এখন সম্পূর্ণ জনশূন্যও নয়। অত পাহাড়-পাহাড় মাল সবই কি ফেরত গেছে। কিছু হয়ত আছে, কাল সকালে যাবে। সেই যে প্রায় শেষহীন মাটির হাঁড়ি। আর অন্ধকার থেকে গো-হাটার গরুর হাম্বা। সারা হাটে, সেই হাটের পেছনের আপাত গোপন হাটেও, এখানে-ওখানে ঝরে পড়ে আছে দু-একজন মাতোয়ালা মানুষ এখন অন্ধকারে তাদের গায়ের চামড়ার তামা বা কাল মিশে গেছে, নাকের মোঙ্গলীয় খর্বতা আর অস্ট্রিক শান হারিয়ে গেছে, তাদের কুঞ্চিত বা স্বল্প সরল চুলে ঢাকা মাথার খুলির আকার অন্ধকার থেকে আর আলাদা করা যায় না। আজ সারারাত তাদের ওপর শিশিরপাত ঘটবে অবিরত। ভেতরে-ভেতরে তপ্ত সেই শরীর শিশিরে-শিশিরে ঠাণ্ডা হবে। কাল সকালে, বা রাতেই কখনো, এই মানুষজন তাদের নেশামুক্ত পায়ে আবার ফিরে যাবে পাহাড়ে, নদীর চরে, বনের ভেতরে।
আর এখন এই পুরো প্রকৃতি ছায়াময়–যেমন হয়, যখন উঠে আসার আগে চাঁদ দিগন্তের নীচে, বা, চাঁদকে আড়াল দিতে-দিতে সহসা কোনো পাহাড় বা টিলা উঁচু হয়ে উঠতেই থাকে, বা, মাঝখানে মাইল-মাইল ফরেস্টের ওপারের অববাহিকায় চাঁদ।
.
০১৩.
সাহেবের আত্মবিলাপ
সুহাস বলে ফেলেছিল, যা হক, ক্যাম্পেই রান্না করবে–সেই জন্যই ত শেষ পর্যন্ত জ্যোৎস্নাবাবু-বিনোদবাবুও সেটা মেনে নিলেন। এ যেন, মন্ত্রীদের মত দু-কোপ মাটি কেটে হাড়কালি মেহনতের মানুষজনকে অনুপ্রাণিত করার নামে অপমান। জ্যোৎস্নাবাবু ত তার স্টাফ নন। প্রাইভেট আমিন। বিনোদবাবুদের চেনা লোক। সঙ্গে থাকলে কাজ খুব তাড়াতাড়ি এগয়। পাটিরা ওঁকে দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে নেয়। কিন্তু কর্মচারীদের সামনে তাকে যে এরকম একটা উদাহরণ হয়ে উঠতে হল এতেই সুহাসের নিজের ওপর এত বিরক্তি। আর, ব্যাপারটা এত আলোচিত-প্রচারিত হওয়ায় যেন একটা নৈতিক কর্মসূচির, না কী যেন, অ্যান্টিকরাপসন ড্রাইভ-এর চেহারা নিল। যেন সুহাস কোন নৈতিকতা বা সংস্কারের প্রয়োজনে এমন একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিল!
কিন্তু সুহাসের বিরক্তিটা বাড়ে এই কারণে যে বিকল্পটাও সে বুঝতে পারে না। সে কি এখন হাট কমিটির জোতদার আর চা বাগানের ম্যানেজারদের বাড়িতে বা বাংলোয় গেস্ট হয়ে, এখানকার জমিজমার বেআইনি দখল বা আইনি দখল বা জমির আইনসঙ্গত পরিমাণ এই সব নির্ণয় করবে? আবার, এখানেও সুহাস আর-এক প্যাঁচে পড়ে যায়–সে কি সেটলমেন্টের অফিসার হয়ে এসে এই এলাকায় ভূমি-বিপ্লব ঘটাচ্ছে না-কি? তার কাজ ত রেকর্ড করা। রেকর্ড করার সময় দু-এক জায়গায় হয়ত সত্যনির্ধারণে তার বুদ্ধি বা বিবেচনাশক্তি, বা তার চাইতেও বেশি, ইচ্ছাশক্তি দরকার হতে পারে। এবার আছে বর্গাদার রেকর্ডিং। কিন্তু কেউ রেকর্ড করাতে চাইলে সে রেকর্ড করবে। সুহাস খুব ভালই জানে জমিব ওপর আধিয়ারের দখলটা যেখানে নির্ভর করে জোতদারেরই ওপর–নিজের বা নিজের মতই আরো অনেকের দখলবোধের ওপর নয়–সেখানে বর্গাদার রেকর্ডিং করাতে জোতদারও আসে না, বর্গাদারও আসে না। অপারেশন বর্গা ত সরকারের একটা আইন-যা আরো নানা আইনের মত ফাঁকি দিতে হয়।
এত জেনেশুনেবুঝেও সুহাস এই মাল এলাকা নিয়ে এত ম্যাপট্যাপ দেখে, একে, সেনসাস রিপোর্ট-টিপোর্ট ঘেটে, এত-এত তৈরি হল কেন।
এই মধ্যরাত্রিতে সুহাসের নিজের কাছেই নিজের এই দ্বিচারণ যে ধরা পড়ে যায়, সে কারণেই সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার কোনো ক্ষমতা নেই জেনেও, আর এই সব রেকর্ডিং করে কিছু সমাধান সম্ভব ..নয় জেনেও, সে ত নিজেকে তৈরি করেছে যদি কিছু করা যায় তার জন্যেই।
সুহাস কি তা হলে বেঁচে যেত যদি সে নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজে করে নিত আর অফিসের কর্মচারীরা চিরকাল যা হয়ে আসছে তেমন ব্যবস্থাই মেনে নিতেন? কিন্তু জোতদার বা চা বাগান ত আর বিনা স্বার্থে লোকগুলোকে খাওয়াত না। তা হলে ত এই কর্মচারীরাই তার হাত দিয়ে চাবাগান আর জোতদারের কাজগুলো করিয়ে নিত। সব কিছুতে, সরকারেসংগঠনে-আইনে ও তার ব্যক্তিগত ভূমিকাতে, যতই অবিশ্বাস করুক সুহাস-তার হাত দিয়ে জোতদার আর চা বাগান কলকে খাবে এটা সে মেনে নেয় কী করে?
কিন্তু তার সততাপনায় বাধ্য হয়ে এই কম মাইনের কর্মচারীরা তাদের ডেইলি অ্যালাউন্সের টাকা কটা বাঁচাতে পারবেন না; অথচ একসঙ্গে এতগুলো টাকা পাওয়া যাবে বলে হয়ত খরচ-খরচার একটা প্ল্যানও তারা পরিবারে ছকে রেখেছেন। এই আত্মত্যাগ করে যাওয়ার জন্যে আদর্শের যে-ডোজ অবিরত দিয়ে যাওয়া দরকার তা সুহাস পাবে কোথায়? আর দেবেই বা কেন? তাহলে কি উচিত হয়েছে ওদের এতটা ক্ষতি করা? সুহাস ত ওঁদের চাইতে অনেক বেশি মাইনে পায়। তার ডেইলি অ্যালাউন্সও অনেক বেশি। তার বেশি টাকা মাইনের বেশি সুযোগ-সুবিধেয়, কম পারিবারিক খরচার ফাঁকে, একটু বাড়তি টাকা থাকে বলেই কি সুহাস নৈতিকতায় আদর্শস্থল হয়ে ওঠার দম্ভ দেখায় তার অধস্তন কর্মচারীদের সামনে?
এর সঙ্গে-সঙ্গে সুহাসকে আর-একটা সন্দেহে জড়িয়ে পড়তে হয়। অফিসের কর্মচারীরা অ্যান্টি করাপসন ড্রাইভ-এ যেমন তাকে সমর্থন দিতে বাধ্য, তেমনি সেই কারণে যে-আর্থিক ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে তুলতে অন্য কোনো ব্যবস্থা কি নেবে না? শুধু খেলে ত না হয় গৃহকর্তার কাজটুকু করে দেয়ার থাকত। এখন কি ঘুষ আগে ব্যাপক হয়ে উঠবে না? অর্থাৎ সুহাসের হাত দিয়ে অনেক বেশি কলকে খাওয়ার চেষ্টা হবে না? তা হলে, সুহাসকে কতদিকে চোখ রাখতে হবে? কোন দিকে? একটা দিকের দায় মেটাতে সুহাস নিজেকে আরো কত প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলল? আর, সুহাসের যাতে গা ঘুলিয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তিগত নীতিবায়ুতেই কি সে জড়িয়ে পড়ল তার অফিস-টফিস সমেত? কিন্তু এত আবার অফিসার হিশেবেও তার করণীয় বা কর্তব্য–বেঙ্গল সার্ভিস রুল বা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট হ্যান্ডবুকে নির্ধারিত। শেষে, সুহাস কি তার ব্যক্তিগত নীতিবায়ুজনিত আত্মদ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যুরোক্রেসির নীতিতন্ত্রের নৈর্ব্যক্তিকে পরিত্রাণ খোঁজে, এই মধ্যরাতে, তেতো মনে? যেন, অফিসার বলেই তার আচার-আচরণের দ্বারাই সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ নির্ধারিত হবে? সে রান্না করে খাবে বলেই এরাও রান্না করে খাবেন? আমলাগিরির এমন নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থার মধ্যে সুহাস এমন ফিট হয়ে যাচ্ছে কেমন করে? নাকি, সাহেবদের তৈরি ব্যবস্থায় এমনি ভাবেই ফিট হয়ে যেতে হয়? সুহাসের চাকরি জীবনের এই প্রথম ক্যাম্পেই।
.
০১৪.
ফরেস্টারচন্দ্রের আত্মঘোষণা
এখন এই মাঠটা একটু স্পষ্ট। হাটখোলার চালা আর ঘরগুলো মিলে ছায়ার একটা নকশাও তৈরি হচ্ছে। সেই নকশাটা ধীরে-ধীরে বোনা হচ্ছে–আকাশের পটভূমিতে। ধীরে-ধীরে সেই নকশার কারিকুরি বাড়ছে, বিস্তার বাড়ছে। ঝোঁপঝাড়, ফাঁক-ফুকর–সেই নকশার ভেতর এসে যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে এসে যাচ্ছে দূরের, প্রায় দিগন্তরেখার গাছ-গাছালি। আর তারও পরে, বড়বড় গাছের মাথা। এখন, এই সমস্ত পরিবেশটাকেই নানা ধরনের ও দূরত্বের ছায়া দিয়ে-দিয়েই আন্দাজ করা যায়। ছায়াগুলো এত ধীরে-ধীরে বাড়ে আর ছড়ায়, ধীরে এত বেশি দূরত্ব ছায়ায়-ছায়ায় আভাসিত হয়, যেন, যে-কোনো মুহূর্তে এই স্থির ছায়া চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে বা, এই স্থির ছায়াগুলির ভেতর দিয়ে কোনো চলচ্ছায়া চলে গিয়ে ছায়াময় পরিস্থিতিকে জ্যান্ত করে তুলতে পারে।
নানা উচ্চতার আর বেধের ছায়া যত স্পষ্ট হচ্ছিল-নীচটা যেন ততই হয়ে উঠছিল অস্পষ্ট, অন্ধকার। সেই নাচের মাঠ, সদর রাস্তা আর হাটে ঢুকবার নানা গলিখুঁজিতে অন্ধকারটা একটু বেশি জমাট বাধা। উঁচুতে, দিগন্তে এত বেশি নতুন নতুন ছায়ার মাথা যে সেই গোড়ার অন্ধকারটা যেন আরো তলানিতে পড়ে যায়।
মাঠটার ভেতরে সেই তলানিটুকু আলোড়িত হয়ে উঠছিল। অবশ্য আকাশের দিগন্তের, নীরব অথচ দ্রুত ছায়াময় বদলের অনুষঙ্গেই মনে হতে পারে তলার এই অন্ধকারও বদলাচ্ছে। রাত্রি ও অন্ধকার ত সবটুকু ব্যেপেই রয়েছে। তাই তার এক সীমান্তের আলোড়ন হয়ত আরেক সীমায় ঢেউ তোলে, ক্ষীণ।
জলের ভেতরের কোনো আলোড়ন যেমন সেই জায়গার ভেতর থেকে জলটুকুকে আলোড়িত করে–অন্ধকারটাও তেমন হচ্ছিল। একটা গোঙানিও যেন শোনা যায়–তবে রাত্রিতে ত কত রকমই আওয়াজ ওঠে।
আলোড়নটা যে অন্ধকারের নয় ও আওয়াজটাও যে শুধু রাত্রিরই নয়–সেটা বোঝাতেই ঐ অন্ধকারটা ধীরে ধীরে একটা কঠিন আলোড়নের আকার নেয়, গভীর নিভৃতিতে বাঘিনীর একা-একা খেলায় যেমন আলোড়ন ওঠে ঝোঁপঝাড়ে। তারপর সেই অন্ধকারটা ফুড়ে একটা মানুষের দাঁড়ানোর নানা চেষ্টা আর বারবারই পড়ে যাওয়া ঘটতে থাকে-নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া ডুবো মানুষের যেমন হাবুডুবু দেখা যায়। তার দাঁড়িয়ে ওঠাটাই যেন একটা কঠিন কাজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে, যেমন সার্কাস-দেখানো যে-কোনো চারপেয়ে পশুরই হয়। কী অসম্ভব কষ্টে তাকে দু-পায়ের ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করে, আবার ভেঙে যেতে হয় নিজের শয়ান অস্তিত্বে।
এমনি করে এক সময় লোকটি দাঁড়িয়েই ওঠে। দাঁড়িয়েই থাকে তার গায়ে অন্ধকারের এক পুরু পলেস্তারা লাগিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকে আর টলে। তাতে অন্ধকারটা টলে না অবশ্য, কিন্তু অন্ধকারের গাঢ়তার একটা তারতম্য ঘটে। তারতম্যের সেই সামান্য তফাতেই লোকটির ভঙ্গির আভাস মেলে–তা ছাড়া সবটাই ত ছায়া। পটভূমির ছায়ার লাইনটার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে একটু আকাশ, তার মাথার ওপর তোলা দুই হাতের দশটি আঙুল আর মাথার চুলের ছায়াময় রেখাগুলিকে প্রখর করছিল। সেখানেও, ডুবো মানুষের মতই, লোকটি হাতটাই নাড়ায়।
লোকটি দাঁড়িয়ে ওঠার পর আর-কোনো গোঙানি শোনা যায় না। যেন, গোঙানিটা এতক্ষণ ছিল তার দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টারই আনুষঙ্গিক আর, দাঁড়িয়ে ওঠার পর, দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টায় সে কোনো আওয়াজই করছিল না।
অনেকক্ষণ পর, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বললে যেমন আত্মগত আওয়াজ বেরয় গলা দিয়ে, তেমনি স্বরে লোকটি ডাকে, হু-জ-উর। সে এই ডাকটি ডাকার আগেই তার গলায় একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠেছিল। ডাকটি শেষ হয়ে গেলেও আওয়াজটি থাকে। জোরে ঢোক গিলে সেই আওয়াজটাকে বন্ধ করে। জোরে ঢোক গিলতে গিয়ে তাকে গলার ভেতরে যে-অতিরিক্ত জোর চালান করতে হয়, তাতেই তার ঘাড়টা তার বুকের ওপর ঝুলে পড়ে। ওরকম ঝুলেই থাকে, যেন মাথাটা তার মাথা নয়, গলার লকেট।
দুমড়ে-মুচড়ে গলাটাকে শক্ত করে সে তোলে। বেশি নাড়ায় না, পাছে আবার স্কুলে যায়। শক্ত অবস্থাতেই সামনে জোরে হাঁক দেয় হাকিম। দ্বিতীয় হাঁক দিতে পারে না। তা হলেই মাথাটা মুচড়ে ভেঙে যাবে, মাথাটা শক্ত রাখা দরকার। কিন্তু মাথা আর শক্ত রাখা যায় কতক্ষণ। সেটা যখন নিজের ভারেই নুয়ে ঝুলে পড়তে চায় বুকের ওপর, তখন লোকটি মাথাটা জোর করে পেছনে ভেঙে দেয় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকে, সাহেব।
লোকটি যেন তার হুজুর-হাকিম সাহেবের আকাশ থেকে নেমে আসাটা দেখে। বেশ কিছুটা সময় লাগে ত আকাশ থেকে নামতে। কিন্তু তার হকিম মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ত আর সে ঘাড় সোজা করে হাকিমকে দেখতে পারে না। তাকে ঘাড় তুলতে সময় নিতে হয়। তুলে,সে অন্ধকারের মধ্যে হুজুরকে ঘেঁজে–এদিকে-ওদিকে, এ-কোনায় ও-কোনায়, তারপর একদিকে সোজা কয়েক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, হুজুর, মুই আসি গেছু, মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন।
ফরেস্টার তার দুটি হাত জোড়া করতে চায়। কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। দুটো হাতের যেন দুধরনের গতি ও ভার। বাঁ হাতটা ওঠে ত ডান হাতটা ওঠেই না। বা হাতটাকে নমস্কারের ভঙ্গিতে অনেকখানি তুলে ফরেস্টার চোখ কুঁচকে দেখে তার ডান হাতটি নেই, চোখটা আরো পাকিয়ে সে যেন বুঝে উঠতে চায়, ডান হাতটা গেল কোথায়। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেহাতই অকস্মাৎ তার ডান পাশে সেই হাতটাকে খুঁজে পায়। তখন সেই হাতটাকে বা হাতের কাছে আনার জন্যে তুলতে থাকে। তাকিয়ে-তাকিয়ে একটু-একটু করে। এদিকে বা হাত আবার স্কুলে যেতে থাকে। কিছুটা ঝুলে যাওয়ার পর সেটাও ফরেস্টারের নজরে পড়ে। সে তখন দুটো হাতকেই স্থির করে একবার বা, আর একবার ডান হাতের দিকে তাকায়। এরকম বারদুয়েক তাকানোর পর আর দেরি না করে সে হঠাৎ দুটো হাতকেই নমস্কারের জায়গায় টেনে নিয়ে আসে। একটু বাকাচোরা ভাবে দুটো হাতই জোড়া লেগে গেলে ফরেস্টার সেই জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে খুব হাসে, যেন সে দুই হাতের গোলমাল ঠেকিয়ে দুই হাতকে খুব জব্দ করতে পেরেছে। আপন মনে হাসতে-হাসতে জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে ফরেস্টার বল, লায়? বলে, আবার হাসে।
এবার আর জোড়াহাতটাকে মাথায় না তুলে, সে মাথাটাকেই জোড়াহাতের ওপর নামিয়ে আনে। নামাতে তার সময় লাগে। মাথা ঠিক সমান ভাবে নামতে চায় না–ভেঙে দুমড়ে ঝুলে যেতে চায়। কিন্তু ফরেস্টার এখন ঝুলে যেতে দেয় না। সে ধীরে ধীরে মাথাটাকে জোড়াহাতের কাছাকাছি নোয়াতে চায়। হাত দুটো একটু এলোমেলো ভাবে জোড়া লেগেছিল, আঙুলগুলো ঝুলছে, কব্জিটা ওপরের দিকে। কব্জির ওপরে কপাল ঠেকায় ফরেস্টার। তারপর হাতদুটো জোড়া রেখেই সে মাথাটা সোজা করে। ধীরে ধীরে সোজা করতে করতে হঠাৎ সোজা হয়–যেন খট করে শব্দও হল ঘাড়টা ফিট হয়ে যাওয়ার। তারপর ফরেস্টার কথা শুরু করে, হুজু-উর, মুই ফরেস্টারচন্দ্র আসি গেইছু। এটুকু বলতেই জোড়াহাতের দিকে নজর পড়ে। তখন, যেন ছিঁড়ে আলাদা করতে হচ্ছে এমন ভাবে, ফরেস্টার হাতদুটোকে পরস্পর থেকে আলাদা করে, সোজা দাঁড়ায়। এবার হেসে বলে, হুজুর, আসি গেইছি। মুই ফরেস্টারচন্দ্র। ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবন। দেখি নেন। মোর মুখোন, দেহখান, দেখি নেন। টর্চ ফিকেন, কি ম্যাচিসের কাঠি জ্বালান। দেখি নেন। ওয়ান-টু-থিরি
যেন একটা টর্চ সত্যি জ্বলল, ফরেস্টার এমন ভাবে দাঁড়ায়। তার দুই চোখ হাসিতে বুজে গেছে। তার মোটা-মোটা সঁহ্যাঁতগুলি বেরিয়ে আছে। সে সেই হাসিমুখ আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। যেন, তার ফোটো তোলা হচ্ছে। বায়ে একবার, ডাইনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে ফরেস্টার জিজ্ঞাসা করে, হুজুর। দেখি নিছেন তো মোক? ভাল করি দেখি নিছেন ত? মোর নামখান ফোমে রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। বাপাখানের নাম হইল। কিন্তু বাপাখানের কথা ছাড়ি দাও। বাপার বাদে অনেক কাথা। মোর নিজের কাথাটা আগত শুনাবু তোমাক।
সেই কথাটা শুরু করতে গিয়েও ফরেস্টার থেমে যায়। হঠাৎ দুই হাতের পাতা দিয়ে চোখ ঢাকে, তোমার টর্চের আলোখান মোর চোখদুইটা ঝলঝলাই দিছে হে হুজুর। চক্ষুর পাতাখানের উপর আলোর তারা চকমকাছে, চকমকাছেয্যানং তিস্তার চরত বালি চমকায়। খাড়াও হে হুজুর, এই চকমকিখান একটু কমিবার ধরুক।
দুই হাতের পাতায় চোখ ঢেকে, ফরেস্টার অন্ধকারকে আরো অন্ধকার করছিল। নীরবতা তৈরি হচ্ছিল। সে নীরবতায় এতক্ষণের কথাবার্তাগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সেই নীরবতার ভেতর থেকে ফরেস্টার শুরু করে, শুন হে হুজুর, কাথা মোর একখান। না হে, একখান না হয়, দুইখান। কাথা মোর দুইখান। কী দুইখান কাথা? একখান কাথা হই যে তোমরা ত জমির হাকিম। ত মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর জমিঠে মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর একখান ত জমি আছিল। আপলাদ ফরেস্টের গা-লোগো। মোক ঐঠে পাঠায় গয়ানাথ জোতদার। হালবদল-বিছন গায় ওর। মুই হালুয়া আছি কয়েক বছর। অ্যালায় আর নাই। মোর নামখান কাটি দাও। ঐ জমিখান লিখি দাও গয়ানাথ জোতদারের নামত। বলদ যার, বিছন যার, হালুয়া যার, ধান যার-জমি ত তারই হবা নাগে হুজুর। ত ঐ জমিখান মুই, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন, ছাড়ি দিছু। লিখি দাও, শ্রীফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মনক এই জমিঠে উচ্ছেদ দেয়া গে-এ-এ-ই-ল।
হাঁকটা শেষ করে ফরেস্টার হেসে ওঠে। হাসির ঝোঁকে শরীরের সামাল ঢিলে হয়ে যায় বলে একটু টাল সামলায় হাসতে-হাসতেই। হাসিটা শেষ হলে ফরেস্টার একটা তৃপ্তির আওয়াজ তুলে বলে, ব্যাস, হুজুর। মনত রাখিবেন। আপলচাঁদের ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন উমরার দেউনিয়া-জোতদার গয়ানাথ রায়বর্মনক উচ্ছেদ দিয়া দিল। গয়ানাথ সব শিখিবার চাছে। কহে, হে ফরেস্টার, মোক হালুয়াগিরিখান শিখি দে। বাপপিতামহর কামটা মুই ভলি গেছু, মোক শিখি দে। ত মুই নিচয় শিখি দিম। হুজুর, কালি আমি গয়ানাথক সৰ শিখাই দিম, ক্যানং করি হাল দিবার নাগে, মই দিবার নাগে, পাতা গুছিবার নাগে, ছাই ছড়ি দিবার নাগে, কোদা করিবার নাগে, রোয়া গাড়িবার নাগে–সব শিখাই দিমকালি সকালে। ব্যাস, কালি সকালঠে গয়ানাথই জোতদার, গয়ানাথই হালুয়া। মুই এ্যালায় যাছ, গয়ানাথের বাড়িত, উমরাক হালুয়াগিরি শিখাবার তানে।
ফরেস্টার যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কিন্তু মোর ত দুইখান কাথা আছে। একখান কাথা মুই ফরেস্টারচন্দ্র এ্যালায় গয়ানাথ জোতদারক খালাশ দিছু। মনত রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। এইঠে ত অনেক ফরেস্টার। অনেক বর্মন। কায় সাচা আর কায় মিছা? হুজুর! দেখি নেন। যেইলা ফরেস্টারচন্দ্রের বা পাছা, আর ডাহিন পিঠত বাঘের দুইখান থাবার দাগ আছে ঐলা ফরেস্টারচন্দ্র আসল। ত দেখাও। সগায় পাছার কাপড় তুলি দেখাও। তুলো হে তুলল। পাছার কাপড় তুলে আর পাছাখান ঘুরাও। ফরেস্টার নাচের ভঙ্গিতে ঘুরপাক খায় আর খিলখিল হাসিতে যেন তার চারপাশের অনুপস্থিত ভিড়ের এক-একজনকে আঙুল দেখিয়ে বলে, তুলল, তুলো, পাছার কাপড় তুলল, ফরেস্টার পাক খায় আর আঙুল দেখায়, তুলল, তুলল। এক পাক ঘোরা হয়ে গেলে ফরেস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, কায়ও দেখাবার পারিবে না, হুজুর। সগার পাছা ঢাকা থাকিবে। সগার পাছত, হাগা আছে, বাঘা নাই। কিন্তু মুই সাচা ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন–আদি। মুই মোর পাছাখান নং উদলা করি দিম। খাড়াও হে হুজুর। তোমার টর্চখান আর চোখত না ফেলল। হ্যাঁ, রেডি। ওয়ান-টু-থিরি।
ফরেস্টার তার পরনের কানিটুকু সরিয়ে পেছনটা উদোম করে দেয় আর যেন টর্চের আলো সত্যিই পড়েছে এমন ভাবে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখায়, এক পাক, তার চার পাশে যেন সত্যিই দেখবার লোকের জটলা।
পাক শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফরেস্টার বলে, ব্যাস, হুজুর। এ্যালায় ত জানি গিছেন, যায় বাঘা সে-ই সাচা ফরেস্টারচন্দ্ৰ। এইঠে ফরেষ্টার ত অনেক হুজুর বর্মনও হুজুর অনেক। রায়বর্মনও কনেক-আধেক আছে। কিন্তুক বাঘাবর্মন এই একোটাই। ত মুই যাছ হুজুর। গয়ানাথক হালুয়াকাম শিখাবার যাছি। তোমরালা কাল রায় দিয়া দিবেন–বাঘারু তার জমি গয়ানাথ জোতদারক দিয়া দিছে, এ্যালায় গয়ানাথ হালুয়া হবা ধরিবে-এ।
ত মুই যাছ হুজুর, বাঘারু কয়েক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, হুজুর, একখান সিগারেট খায়্যা যাছু। বা কান থেকে একটা সিগারেট বের করে বাঘারু ঠোঁটে লাগায়। পোড়া সিগারেটের শেষাংশ। ডান কানের পেছন থেকে দেশলাইয়ের কাঠি আর কানের ভেতর থেকে দেশলাইয়ের বারুদ-লাগানো একটা টুকরো বের করে আনে। তারপর সিগারেট ঠোঁটে চাপাস্বরে বলে, সাহেব ভাবিছেন মুই মাতাল খাছি। দেখো কেমে, কেনং ফস করি জ্বালাম কাঠিখান। ওয়ান-টু-থিরি। প্রথমবার জ্বলল না। দ্বিতীয়বার জ্বলল। শিখাঁটিকে বাঁচাতে তার দুই পাঞ্জার ঘের দেয়। ওটুকু বেঁকাতেই তার শক্ত পাঞ্জায় টান ধরে, যেন ভেঙে যাবে। পাঞ্জার ওপর আনত মুখে ঐ অন্ধকারে খোদাই হয়ে যায় অনড় দৃঢ় মোঙ্গোলীয় স্থাপত্য। সিগারেটটা ধরিয়ে, কাঠিটা ফেলে দিয়ে, নাক-মুখ দিয়ে বাঘারু যত ধোয়া ছাড়ে তাতে মনে হয় সিগারেটটা একটানেই শেষ হয়ে গেছে। সিগারেটটা নামিয়ে বাঘারু তাকিয়ে-তাকিয়ে আগুন দেখে।
.
০১৫.
সার্ভে পার্টির যাত্রা
সুহাস টের পেয়েছিল যে ওঁরা জেগেছেন ও তৈরি হচ্ছেন। কিন্তু সারা রাতের ঘুম তখনই যেন চোখ ঝাঁপিয়ে আসে। সে পাশ ফিরে শোয়। কিন্তু পাশের ঘরের আওয়াজ আরো বাড়ছে। সকাল ছটা থেকে কাজ শুরু হবে সেই তিস্তা পারে– তারপর আপলাদের দক্ষিণ কিনারা দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে এগবে। এখান থেকে হাঁটতে হবে দু-তিন মাইল। এখনই না-উঠলে দেরি হয়ে যাবে।
একথা ভাবতে-ভাবতেই দরজায় টোকা পড়ে স্যার। বিনোদবাবুর গলা।
হু, সাড়া দিয়ে সুহাসকে উঠতে হয়। চোখ খুলতে পারে না, এত জ্বালা করে। ফলে, পা-টা কিছুতেই স্যাণ্ডেলে গলাতে পারে না! দরজা খুলে সুহাস বেরিয়ে দেখে তার ঘরের সামনে বারান্দায় একটা বড় বালতিতে জল, পাশে মগ।
মুখ ধোয়া শেষ হতে-হতেই প্রিয়নাথ একটা কাপে চা নিয়ে সুহাসের টেবিলে রেখে আসে। এইবার সুহাস বুঝতে পারে, তার পার্টির আর-সবাইই একেবারে তৈরি হয়ে আছে, শুধু তার জন্যই দেরি। সে অবিশ্যি এখুনি তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু প্রথম দিন সে সবার শেষে তৈরি হচ্ছে এতে সুহাস একটু লজ্জা পেল। তবে তাকে কেউ যেমন তাগাদা দিল না, তেমনি বিনোদবাবু বা অনাথ-প্রিয়নাথ কেউই খুব তাড়াহুড়োও করছে না। ওরা যেন জানেই সুহাসের দেরি হবে। বা, সুহাস যখন বেরবে তখনই কাজ হবে–তাই ওদের কোনো উত্তেজনা নেই।
চা খেতে-খেতেই সুহাস দ্রুত জল নিয়ে এল ও দাড়িতে সাবান ঘষতে শুরু করল। সুহাস ভেবেছিল। দু-চুমুক চা খেতে-খেতেই দুই টানে দাড়ি নামিয়ে দেবে। নামালও তাই, কিন্তু ঠেকে গেল গোফে। গোফে তাড়াহুড়ো করলে সময় আরো বেশি লাগবে। তাই সুহাস ব্লেডটা আস্তেই চালাতে চায়। কিন্তু আঙুলটা যেন ঠিক থাকে না। সুহাস তাড়াতাড়ি ব্লেডটা তুলে নিল। আর আয়নায় নিজের গোফটার দিকে তাকিয়ে ভাবলু, প্রতিটি দিন ত এই গোফ তাকে জ্বালায় ও জ্বালাবে। এখুনি সে ত এটাকে নামিয়ে দিতে পারে। বড়জোর বিনোদবাবু, প্রিয়নাথবাবু আর অনাথবাবু সেটা টের পাবে। আর ত কেউ তাকে আগে দেখেও নি। অফিসে ফিরে গেলে, তখন…। এই সুযোগ ত তার দ্বিতীয়বার না-ও আসতে পারে। আজই ত সবাই গোফঅলা হাকিমকে দেখে ফেলবে। তখন ত আর সে গোফ উড়িয়ে দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সুহাস ব্লেডটা নিয়ে নীচের লাইনটা একটু সোজা করে দেয়, আর ওপরে ব্লেডটা-একটু বোলায় মাত্র। তবু যেন অভ্যাসবশেই আয়নায় দেখে নিতে হয়। আর দেখলে তখন সেই ছোট কাচিটাও তুলতে হয়। একটু লাইটা ঠিক করে আয়না থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়।
বিনোদবাবু জানলায় এসে বলেন আপনি তৈরি হোন, আমি বরং ওদের নিয়ে এগিয়ে যাই। জ্যোৎস্নাবাবু আপনাকে নিয়ে যাবেন।
আমার ত হয়েই গেছে, বলে চায়ের কাপটাতে শেষ চুমুক দিয়ে সুহাস, বাথরুমটা যেন কোনদিকে? বলেই বোঝে বিপদে পড়ল। কাল সন্ধ্যাতেও দু-একবার মনে হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারে নি। বিনোদবাবু জানলা থেকে সরে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই বললেন, পায়খানা কি আছে? দেখি।
তার মানে, এরা সেই অন্ধকার থাকতে উঠে মাঠে বা ঝোঁপঝাড়ে কোথাও গিয়ে কাজ সেরে এসেছেন। এখন বেলা হয়ে গেছে। মাঠে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়াও, সুহাস মাঠে যেতে পারবে কি? এই ব্যাপারটাতে সুহাস প্রথম থেকেই একটু অনিশ্চিত। এখনো সে অনিশ্চয়তা কাটে নি, ভাবছে, এদের মত শেষ রাতে উঠলে হয়ত তার পক্ষেও মাঠে যাওয়া সম্ভব হত। কিন্তু এখন বেরিয়ে দুপুর বারটা-একটা পর্যন্ত কাজ। তৈরি না-হয়ে বেরয়ই বা কী করে? দুপুরে ফিরে এলেও ত আর এখানে বাথরুম গজাবে না। একটু অপ্রস্তুত ভাবেই সুহাস ঘর থেকে বেরয়। তার বাথরুমের জন্যে সমস্ত পার্টির কাজে রওনা হতে দেরি হয়ে যাবে- এটাও তার ভাল লাগে না। তার চাইতে বরং বিনোদবাবু যা বললেন, সেটাই ভাল, প্রিয়নাথবাবু আর অনাথবাবুকে নিয়ে বিনোদবাবু গিয়ে পৌঁছন, জ্যোৎস্নাবাবুর সঙ্গে সে না-হয় একটু দেরিতেই পৌঁছবে। বারান্দায় কাউকে না-পেয়ে সুহাস সিঁড়ির মাথায় এসে দেখে, কুয়োপাড়ের কাছে বিনোদবাবু আর প্রিয়নাথবাবু দাঁড়িয়ে, আর জ্যোৎস্নাবাবু একটা লোককে কিছু বলছেন। সুহাস কিছু বলার আগেই বিনোদবাবু বললেন, স্যার, পায়খানাটা ত নোংরা হয়ে আছে, ভেতরে জঙ্গলও হয়েছে, এখন বলা হল, পরিষ্কার করে রাখবে। আপনি — বিনোদবাবু কথাটা শেষ করতে পারলেন না। ততক্ষণে জ্যোৎস্নাবাবু লোকটির সঙ্গে কথা সেরে ফিরে বিনোদবাবুর কথার পিঠেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, গিরিজাবাবুর কাছে খবর পাঠালাম, আমরা ফেরার আগেই সব ঠিকঠাক করে রাখবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, আমরা রওনা হয়ে যাই, পরে দেখা যাবে, বলেই সুহাস জামা-প্যান্ট পরতে ঘরে যায়। আর যেতে-যেতে ভাবে, নেহাত মাঠে যাওয়ার দরকার হলে বরং যেখানে যাচ্ছে সেখানেই সুবিধে। অবশ্য গা-সুদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে থাকবে আর সাহেব মাঠে যাবে–সেটা দেখাবে কেমন। সার্ভে ত বেলা বারটা-একটা পর্যন্ত। দেখাই যাক। সুহাস বাইরে বেরিয়ে এসে বলে, চলুন, দেরি হল না ত? গিরিজাবাবু কে?
এখানকার হাট কমিটির, ঐ যে কাল আপনার সঙ্গে দেখা করলেন। না, দেরি আর কী, দেখতে-দেখতে পৌঁছে যাব।
কাল সন্ধ্যায়ই যার নিমন্ত্রণ অত করে প্রত্যাখ্যান করল সুহাস, আজ সকালেই তাঁর সাহায্য দরকার–এতে যেন লজ্জাই পায়। এখন আবার ভদ্রলোক বিকেলে এসে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে না চান, যেখানে অ্যাটাচড…। সামনেই ত চা বাগান আর তাদের ইস্পেকশন বাংলো৷ সুহাস যে মাঠে যেতে পারে নি এতেই যেন তার দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল।
ওঁরা পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। প্রিয়নাথ পেছন থেকে এসে বিনোদবাবুর হাতে চাবি দুটো দিল-তালা আটকাচ্ছিল। তারপর ওরা দক্ষিণ দিকে চলে। সুহাস কেবির (খানাপুরী কাম বুঝারত) কাজ শুরু করছে একেবারে তিস্তার পাড় থেকে–ঠিক যেখানে আপলাদ ফরেস্টের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমা, গাজোলডোবা চা বাগান। পশ্চিমে তিস্তা। গাজোলডোবার একটু দক্ষিণ থেকে একটা ছোট নদী, খানা, বেরিয়ে আরো দক্ষিণে গিয়ে তিস্তাতে মিশেছে। এখান দিয়েই ৬৮ সালের বন্যায় তিস্তার বান ঢাকে। গাজোলডোবা চা বাগানের আর ঐখানে আপলাদ ফরেস্টের বেশ বড় অংশ একেবারে ভেসে যায়। ফলে; ওখানে ম্যাপিং-এর একটা বেশ ঝামেলা আছে। অর্থাৎ এখন তিস্তা কোথা দিয়ে বইছে, চর উঠছে কি না, গাজোলডোবার কতটা নদীতে আর কতটা এখনো কায়েমে, ৬৮র বন্যার পর গত দশ-পনের বছরে আবার আগের ম্যাপের অবস্থায় ফিরে এসেছে কি না, আপলাদের সাদার্ন আর সাউথ ইস্টার্ন বর্ডার কোথায় ধরা হবে–এই সবের একটা মীমাংসা করতে হবে। তারপর আপলাদ ফরেস্টকে বয়ে, উত্তরে রেখে ওরা ধীরে ধীরে সোজা উত্তর-পশ্চিমমুখো আনন্দপুর চা বাগানের জোল্যাস্ত পর্যন্ত পৌঁছবে। এখানে ম্যাপিং-এর ঝামেলা কম, আর ফরেস্ট ল্যাণ্ডের ত মৌজা ম্যাপ ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট থেকেই তৈরি করে দেয়, চা-বাগানেরও তাই। সুতরাং ফরেস্টকে বঁ হাতিতে রেখে ঐ ফালিটার সার্ভে শেষ করে, পরের দফায় আবার রাজাডাঙ্গা দিয়ে ঘুরে, এর নীচের ফালিটা দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সেই একেবারে খালপাড় পর্যন্ত যাবে। এই প্ল্যান অনুযায়ীই নোটিশ ও মৌজা-ইস্তাহার দেয়া হয়েছে।
পাকা রাস্তা ছেড়ে ওরা মাঠে নামে, আল ধরে যেতে হচ্ছে বলে একটা লাইনও হয়ে গেল। সবচেয়ে আগে অনাথ-কাঁধে ফোভিংসার্ভে-টেবিল। তার বেশ পিছনে প্রিয়নাথ শিকলভরা থলিটা তার ডান কাঁধে, কিন্তু বা আর ডান দুই হাত দিয়েই সেটা চেপে ধরা। ভারের চোটে প্রিয়নাথের মাথা ব্যায়ে হেলে গেছে। তার পেছনে জ্যোৎস্নাবাবু–তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতেও একটা বোঁচকা। তার নিজের জিনিশপত্র ব্যাগে, আর হাতে লাল সালুতে মোড়া মৌজার একটা অংশ। তার পেছনে সুহাস। দুই হাতই খালি। পেছনে বিনোদবাবু-তার হাতেও ত মৌজাই। সুহাসকে এরা কেউই কিছু নিতে বলে নি, সুহাসও কিছু চায় নি। কারণ সুহাস বুঝে উঠতে পারে না এর মধ্যে কোনটা সে চাইতে পারে। একমাত্র মৌজার দু-একটা খাতা সে নিতে পারত। কিন্তু এরা বস্তাগুলো বেঁধেইছেন এমন করে যে তার কিছু চাওয়ার উপায় থাকে না। কিন্তু সুহাসের নিজের পক্ষে এটা বড় খারাপ লাগে যে বাকি চারজন, বা বলা যায় তিনজন, কারণ জ্যোৎস্নাবাবু ত আর তার পার্টির লোক নন, যখন বেশ ভারী-ভারী মাল বইছে তখন সে একা একেবারে শূন্য হাতে। জ্যোৎস্নাবাবুরও ত কোনো কিছু বইবার কথা নয়। কিন্তু তিনি এই পার্টিতে থাকেন আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন বলে তাকে ওটুকু বইতেই হয়। এতে হয়ত তার প্র্যাকটিসেরও সুবিধে।
জ্যোৎস্নাবাবু, আমাকে আপনার কাঁধের ব্যাগটা দিন না-পেছন থেকে সুহাস বলে।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই যেন জ্যোৎস্নাবাবু বলে ফেলেন, না স্যার, না স্যার, ও ত আমার ব্যাগ।
অগত্যা সুহাসকে চুপ করতে হয়–একবার শুধু পেছনে বিনোদবাবুর দিকে তাকায় দুই হাতে মোটা-মোটা মৌজা নিয়ে হাঁটছেন। সুহাস সেই মৌজার সাইজ দেখেই বোঝে, তার পক্ষে এ ভাবে ঝুলিয়ে নেয়া সম্ভব হত না, কাঁধে দিতে হত। এবং নিজের মৌজা নিজে কাঁধে নিয়ে সার্ভে অফিসার উপস্থিত হলে তাকে আর সার্ভে করতে হবে না!
.
০১৬.
গয়ানাথের হালুয়াগিরি প্র্যাকটিস
হালে বলদ জুতে, মাঠে নামিয়ে বাঘারুর বাইরে থেকে গয়ানাথকে ডেকেছে–হে দেউনিয়া, উঠ কেনে, শাদা হবা ধরিছে হে।
গয়ানাথ উঠে বিছানায় বসে কাশি শুরু করেছে। এই কাশি তুলবে, তারপর খানিকটা হাফাবে, তারপর গয়ানাথ নামবে।
বাঘারু দারিঘরে ঢুকে মাচার পোয়ালের ফাঁকে বিড়ি খোঁজে। পায় না। বেরিয়ে এসে দেখে ভটভটিয়াখান বাইরে এনে রেখে এখন আসিন্দির-জোয়াই (জামাই) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। হে জোয়াই, সিগারেট খিলাও একখান। নিজের সিগারেটটায় একটা লম্বা টান দিয়ে আসিন্দির হাত বাড়িয়ে রাঘারুকে দেয়। বাঘারুর সিগারেটটা হাতে ধরে রেখে টেনে-টেনে নিশ্বাস নেয়। সিগারেটের না, আসিন্দিরের গন্ধ। জোয়াইটার গা দিয়া ক্যানং প্যাটরোলের নাখান গন্ধ, আর ঐ বুড়াটার গাঅত কাদাখোচার গন্ধ।
অ্যাই, কহিছিস কী?
কুছু না, কুছু না, গন্ধে কাথা, বাঘারু মাঠের দিকে তাকিয়ে আধখানা সিগারেট টানে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ধরে। কিন্তু তার আঙুলগুলি এতই থ্যাবড়া যে প্রায় অর্ধেক সিগারেট ঢাকা পড়ে যায়। ঠোঁট ছুঁচলো করে বাঘারু-ঠোঁট তার মোটা নয়। মাঠের মাঝখানে শাদা আর ছাই-ডাই বলদজোড়া নানা দিকে তাকিয়ে দেখছে, এক-একদিকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে।
গয়ানাথ হাল দেবে বলেই দু-দুটো বলদ জোড়া হয়েছে। বলদেই টানুক। বুড়া শুধু ধরে থাকবে। এই সার্ভের সাহেব নাকি নাকশালিয়ার ঘর। যে-জোতদার নিজ চাষ দেখাবে, উমরাক নাকি কহিবে, চালাও, হাল চালাও, তারপর নাকি দুই হাত দেখিবার চাহিবে-নরম কি শক্ত, বেঁকে কি না-বেঁকে, গাও হাত দিলে বাবলা গাছের নাখান খড়খড় করে কি না করে, আর যায় হাল দিবার না পারিবে উমরাক ক্যানসেল করি দিবে, আধিয়ারের নামে জমি রেকর্ড করি দিবে।
গয়ানাথ তাই এখন হালুয়াগিরি শিখছে। আপলাদ ফরেস্টের পাশে, ফরেস্টের জমির সঙ্গে তার টানা জমি। নিজ চাষেই। সেখানে বাঘারু মাঝে-মাঝে চাষ করে, আরো কায়কায় করে। সেই জমিটা নিজচাষ রেকর্ড করার সময় সাহেব যদি গয়ানাথকে হাল চালিয়ে দৈখাতে বলে সে সত্যি হালয়া কি না! হাত গয়ানাথের এমন কিছু নরমও না, ফর্শাও না। কিন্তু হাল ত টানবে বলদ। বলদ ত চেনে বাঘারুকে। বলদ ত আর জানে না কে গিরি আর কে হালুয়া, আর কে সাহেব। শেষে, সাহেব যদি তাকে জমিতে নামায়, আর তখন যদি বলদ তার কথা না শোনে? তাই গয়ানাথ বাঘারুকে বলেছে, বলদটাকে একটু মোক চিনি দে কেনে বাঘারু, মোর আওয়াজ-টাওয়াজখান একটু চিনি দে।
আসিন্দির বলে, হে বাঘারু, তোর বুড়ার কি মাথাটা খারাপ হয়া গেইল রে? এ্যালায় হাল ড্রাইভ করিবার চাহে? বাঘারু এ কথার উত্তরে ঘুরে তাকায় না। মাঠের দিকে, বলদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, যেমন ঐ বলদ দুটিও আছে, সামনে, একটু নীচে, জমিতে হাল কাঁধে। তারপর বলে, কায় জানে? কালি হাটত শুনিবার পাছ সাহেব নাকি হাত টিপিবে, গাও টিপিবে, মাথা টিপিবে—
কথা শেষ হওয়ার আগে আসিন্দির জোরে হেসে ওঠে, এই প্রায়ান্ধকার উষার পক্ষে একটু বেশি জোরে, তোর আর বলদের ত একই বুদ্ধি। তোর সেটেলমেন্টের সাহেবের তানে কি বিয়া বসিবার ধইচছে হে কন্যার গাও টিপিবে, গাল টিপিবে? তারপর, আসিন্দিরের আরো কিছু মনে পড়ে, সে হো
হো হেসে গয়ানাথকে ইঙ্গিত করে বলে এই বুড়াখানের গাও টিপিলে ত জিভাখান বাহির হয়্যা যাবে, আর গাল টিপিলে ত সিনজাকাঠির [পাটকাঠি] নাখান হাড়গিলা মড় মড় করি ভাঙি যাবার ধরিবে।
গয়ানাথ দরজা খুলে বেরিয়ে খড়ম খটখটিয়ে কুয়োপাড়ের দিকে যায়, তার গায়ে ধুতির খুঁট। মুখে-চোখে জল দিয়ে আবার দ্রুত খটখটিয়ে ফিরে আসে। ঘরের ভেতর থেকে,-গেঞ্জি গায়ে দিয়ে, ধুতিটা হাঁটুর ওপর তুলে খড়মটা পায়েই, যেন তৈরি হয়ে, বেরিয়ে আসে। আসিন্দির তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। বুড়ো যখন দরজার পাশে খড়মটা খুলে উঠোনে নামে, আসিন্দির বলে-তোমরালার কাম কি ঐ মাঠে যাওয়ার? ছাড়ি দেন। উকিলবাবুকে পাঠি দেন। ঐঠে আমিন আছে, যা করিবার উমরায় করিবেন, তোমরালা এ্যালায় হাল ঠেলিবার ধরিছেন?
গয়ানাথ হেসে জবাব দেয়, কেনে রে বাউ, হালুয়ার জোয়াই হবার তানে লাজ লাগিছে? তারপর মাঠের দিকে তাড়াতাড়ি নামতে নামতে বলে, হে বাঘারু, চল কেনে।
আসিন্দিরও পেছন পেছন আসে মাঠের আলে নামে না। ওপর থেকে বলে,তোমাক এইখান বুদ্ধি কায় দিল, হাকিম কি ড্রাইভিং লাইসেন্স দিবেন নাকি?
আরে, কাল হাটত শুনিছু এ শালোর ঘর হাকিম নাকশালিয়া। হাত টিপিবে, গাও টিপিবে।
আরে, তোমার কি মাথা খারাপ করিবার ধরিছেন। সেটেলমেন্টের হাকিম আসি তোমার হাত দেখিয়া জমি রেকর্ড করিবেন? তোমরালার এই সব কাম কী? ছাড়ি দাও, মুই যায় ক্যাম্পত, দেখিম।
আরে বাপা, তুই ত তোর জীবনখানে একখানসেটেলমেনটোও দেখিস নাইরে বাপা। যেইঠে যা নিয়ম, করিবার নাগে। খতিয়ানও থাকিলে, আবার ধর কেনে এই পেরাকটিসও থাকিলো।
কিসের পেরাকটিস?
এই হালুয়াগিরির। যদি মোক আজি চাষ দিবার কহে?
তোমাক কোট হাল দিবার কহিবে?
ঐ ফরেস্টের জমিঠে
ত তুমি চলি আইস কেনে, মুই পেরাকটিস দিছু। হাকিম কহিলে কহিবেন, মুই বুড়া হছি, এ্যালায় মোর জোয়াইখান হাল দিছে, আসিন্দির পাড়ায়।
আরে, খাড়ো না কেনে বাউ, বলে গয়ানাথ তাড়াতাড়ি গিয়ে বলদের পেছনে হাল ধরে।
আসিন্দির চিৎকার করে ওঠে, হে বাপ, মোক ছাড়ি দাও, মুই চাষ দিছু। গয়ানাথ একবার হেট আওয়াজ করে। বদলদুটো লেজ নাড়ায়, মুখটাও একটু ঘোরায়, কিন্তু নড়ে না। হেট বলে আর-একবার আওয়াজ তোলে গয়ানাথ কিন্তু বলদ নড়ে না। বাঘারু পাশ থেকে জিভ দিয়ে ঈকরায় দুটো আওয়াজ তুলতেই বলদ দুটো পা ফেলে এগিয়ে যায়।
আসিন্দির চিৎকার করে ওঠে, হেই বাপ, তোমাকতয় মুই ফেলি দিম, ছাড়ি দাও। মুই যাছু, মোক দেও।
গয়ানাথ এবার ধমকে ওঠে, হে-ই, চুপ যা কেনে ছাগির বেটা, তোর কথা শুনি মোর জমিখান আজি খরচা করিবার ধরিম নাকি হে?
.
০১৭.
হাল, বলদ ও মোটরসাইকেল
আপলাদ ফরেস্টের সঙ্গে লাগোয়া জমিটার জন্যই এত ঝামেলা। ফরেস্টের সঙ্গে জমিটা এতই লাগানো যে, দেখলেই মনে হয় জমিটা ফরেস্টেরই, কেউ হয়ত চাষ আবাদ করছে। ঐ ফরেস্টের একটা অংশ ছিল এদেরই–গয়ানাথের বাবা পদ্মনাথ, পদ্মনাথের বাবা ভদ্রনাথের আমলে। ভদ্রনাথের আসল নাম ভাদই রায় তার আমল থেকেই এরা ভদ্র ও নাথ হয়েছে। পরে,বছর পঞ্চাশ আগে সেটেলমেন্টের সময় একটা দাগ নম্বরেই ফরেস্টের খাস জমিও ঢুকে যায়। এমন অবশ্য হওয়ার কথা নয়। হয়ও না। কিন্তু হয়ে যাওয়ার পর তার নিজ জমিটা যাতে ফরেস্টের জমির ভেতর ঢুকেই থাকে ও এক খতিয়ানেই থাকে সেটা ভদ্রনাথ রায়, পদ্মনাথ রায় ও গয়ানাথ রাগ তিনপুরুষ ধরে দেখে আসছে। তখনকার দিনে ত আর জমিজমার খবর হালুয়া-আধিয়াররা রাখত না। ফলে সবাই জানত ভাদই রায়ের জমিটাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সেখানে ভাদই রায়ের জমির টানা অংশটা ভাদই রায়েরই আছে। আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকও কোনো সময় একটা চাষের জমিতে শালগাছ পুঁততে যায় নি। বা যাতে না পেতে সেটা ভদ্রনাথ, পদ্মনাথ, গয়ানাথ তিনপুরুষ ধরে দেখে আসছে। ফলে, ফরেস্টের অনেক-অনেকখানি জমিও গয়ানাথ নিজের জমি বলেই চাষ করে।
কিন্তু এবার বিপদ হতে পারে। এখন সব হালুয়া-আধিয়াররা জমি বোঝে, মাপামাপিও বোঝে। তদুপরি এই জমির লাগাও আনন্দপুরের ভেস্ট জমিতে রাধাবল্লভের দলের জবরদখল। তারা উকিল-মোক্তার ডাকে, শিট ম্যাপ দেখতে পারে, কোন দাগ কোথা দিয়ে গেছে তাও বলে দিতে পারে। তারা যদি এখন জরিপের সুযোগে হঠাৎ ইনকিলাব বলে ঝাণ্ডা গাড়ে? সুতরাং গয়ানাথ কোনো ঝামেলাই নেই। তাকে যদি নিজে হাল চালিয়ে দেখাতে হয় জমি তার, তা হলে তাই দেখাবে।
গয়ানাথ জমিটার দক্ষিণ থেকে সোজা তার বাড়ির দিকে আসছিল–মাটিতে হাল লাগিয়ে কাঠি দিয়ে। যাচানোর মত একটা-সরু লাইন বানাতে রানাতে। আসিন্দির তার মোটরসাইকেলের স্টার্টারে কিক মারতেই বদল দুটো কান খাড়া করে যেন দাঁড়িয়ে পড়ে। গয়ানাথ চিৎকার করে ধমকে ওঠে, হে-ই শালা জোয়াই, ভটভটি বন্ধ কর। চেঁচালে গয়ানাথের গলা দিয়ে বনমোরগের মত আওয়াজ বেরয়। আসিন্দির পা নামিয়ে হে-হে করে হাসে, উঠি আইস কেনে, উঠি আইস, না-হয় ত তোমরাক ফেলি দিব হে বাপা। গয়ানাথ তার বাড়িটাকে পেছনে রেখে বয়ে ঘোরে। পেছন থেকে তার মেয়ে চিৎকার করে, বাবা, চা দিছি।
গয়ানাথ যখন জমিটার এই সীমায় চলে এসেছে, তখন আসিন্দির হঠাৎ মোটরসাইকেলটাতে স্টার্ট দিয়ে অ্যাকসেলিরেটারটাকে একবার পুরো ঘুরিয়ে দেয়। সেই গা আ-আ-আশব্দে মুহূর্তের মধ্যে কান ও লেজ খাড়া করে দুই বদল দুই দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েই দু-দিকে দৌড় দিল। গয়ানাথ হালের মাথা ছেড়ে দেয়ার সময়টুকুও পেল না, জমির ওপর উপুড় হয়ে পড়ল।
কাঁধে জোয়াল আর পেছনে হাল নিয়ে বলদ দুটো দুদিকে দৌড়তে গেলেই ঠেকে যায়। বা দিকের ছাইরঙা বলদটার পা বেকায়দায় ছিল। ডান দিকের শাদা বলদটা একটা হেঁচকা টানে পাশের ডাঙা জমির দিকে দৌড়লে হালটা এক ঝটকায় গিয়ে তার গায়ে পড়ে। আর ছাইরঙা বলদটা ঘুরে দৌড়তে গেলে প্রথমে দড়িতে পেঁচিয়ে যায়, আর তারপরে শাদা বলদটার বিপরীত টানে, জোয়াল দড়ি-টড়ি সব নিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে। জোয়ালের সঙ্গে ধাঁধা তার গলাটা মুচড়ে যায়। ছাই বলদটা পড়ে যাওয়ার হ্যাঁচকা টানে শাদা বলদের পেছনের পা দুটো সামনের উঁচু আল থেকে হড়কে যায়। বলদটা তখন সামনের পা দুটো দিয়ে মাটি খুবলে-খুবলে দাঁড়াতে চায়।
গয়ানাথকে পড়ে যেতে দেখে বাঘারু গয়ানাথের দিকে এক পা ফেলেই ঘুরে, হে-ই হে-ই বলে বলদ দুটোকে ধরতে দৌড়য়। বলদ দুটো পড়ে না গেলে ধরতে পারত কি না সন্দেহ! বাঘারু গিয়ে আগে জোয়ালটার দড়ি টেনে বের করে এনে ছাই-বলদটাকে ঢিলে করে। আর বলদটা দাঁড়িয়ে উঠে কান ঝটপট করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন খুঁজতে থাকে সেই আওয়াজটা কোথায়।
ছাই বলদটা খালাশ হতেই শাদা বলদটা জোয়ালটাকে টানতে-টানতে ওপরের আলটাতে সামনের দু পা তুলে দাঁড়ায়। পেছনে জোয়ালের আর লাঙলের ভার নিয়ে সে চট করে উঠতে পারে না। বাঘারু দৌড়ে গিয়ে তার দড়ি ধরে ফেলে। তারপর দুই লম্বা দড়ি জোয়াল থেকে ছাড়ানো শুরু করে।
ততক্ষণে গয়ানাথ মাটি থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার কপালে-নাকে-মুখে, গেঞ্জিতে হাঁটুতে কাপড়ে, কাদা। গয়ানাথ দাঁড়িয়ে উঠে নিজেকেও দেখে না, বলদগুলোকেও দেখে না। সে যে-টুকু হাল দিয়েছিল, তারই এক-খাবলা মাটি তুলে ঢিলের মত করে তার বাড়ির দিকে ছোড়ে। সেটা তার সামনেই ঝুরঝুর করে ঝরে যায়। তখন গয়ানাথ, শালো জোয়াই, তোর পাছত বাংকুয়া (ধাক)। সিন্ধাম-বলে তার বাড়ির দিকে দৌড়তে শুরু করে। আসিন্দির একসেলিরেটারটা একবার ঘুরিয়েই বন্ধ করে দিয়েছিল। আর তার হাসির শব্দে গয়ানাথের বৌ আর মেয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ায়। তখনো, গয়ানাথ মাটিতেই পড়ে। তিনজন মিলে যে-হাসি হাসে সেটা গয়ানাথ উঠে দাঁড়ানোর পরও থামে না। গয়ানাথ ঢিল মারার পর বেড়ে যায়। আর, গয়ানাথ তাদের দিকে ছুটতে শুরু করলে তিনজনই ঢিল-খাওয়া মুরগির মত নানা দিকে ছুটে যায়। এতটা দৌড়ে আর বাড়িতে ওঠার ঢাল বেয়ে উঠে গয়ানাথ হাঁপিয়ে গিয়েছিল। সে উঠেই মোটর-সাইকেলটাতে একটা লাথি মারে। মোটর-সাইকেলটা সামান্য নড়েও না। তার পায়ের কাছে একটা কাঠের টুকরো পড়ে ছিল, সেটা তুলে মোটরসাইকেলটার ওপর মারে। হেই, কী করিবার ধরিছেন? গয়ানাথের বৌ এসে দাঁড়ায়, চা ঠাণ্ডি হবা ধরিছে,. খায়্যা নেন। শুনে গয়ানাথের মেয়েও ঘর থেকে বাইরে আসে, বাবা, তোমাক কায় কহিসে হাল চালাবার!
তোর বাপ কইসে। কোটত স্যায় শেয়ালখাগের বেটা, শালো, ছাগির ছোয়া।
শুনে গয়ানাথের বৌ মুখে আঁচলচাপা দেয়। আর ঠিক পেছনে বাড়ির নীচে, মাঠের পাশ থেকে আসিন্দির জোড়হাতে চিৎকার করে, হে বাপা, মোক ক্ষেমা দাও কেনে, মোক ক্ষেমা দাও কেনে, বাপা, কিন্তু বলেই হেসে ফেলে। আসিন্দিরের গলা শুনে গয়ানাথ পেছন ফিরে বনমোরগের চিৎকার করে ওঠে, শালোলা, মুই হাল দিছু, আর তুই বেটার-ঘর ভটভটাছিস, শালো।
ক্ষেমা দাও কেনে বাপ, মোর কাথাটা কেনে শুনিলু না! মুই ত ওর্নিং দিছু তোমাক, নিরাপদ দূরত্ব থেকে আসিন্দির হাত জোড় করে।
শালো তোর ওর্নিং-এর পাছত মাররা। চায়ের কাপটা নিয়ে মেয়ে এসে গয়ানাথের সামনে দাঁড়ায়–ঠোঁটে আঁচলচাপা দিয়ে ও আসিন্দিরের উল্টোদিকে চেয়ে। চায়ের কাপটা গয়ানাথ হাতে নিতেই মেয়ে বারান্দায় পিড়ি পেতে বলে, বসিসি খাও বাপা। গয়ানাথ ততক্ষণে এক চুমুক দিয়ে ফেলেছে।
পিড়িতে বসে সে রাগের শেষটুকু দিয়ে চিৎকার করে, শালো, ছাগির বেটা, যা কেনে, তুই হাল ধর, মুই না যাও জরিপের পাখে, তোকই হাল দিবার নাগিবে।
.
০১৮.
আসিন্দিরের হাল দেয়া
এতে আসিন্দির যেন বেঁচে যায়। সে যাছি হে বাপ, যাছি, মুই ত যাবারই চাছি। বলে মাঠ বরাবর দৌড়য়, বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে হালবদল নিয়ে। তার সেই দৌড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে গয়ানাথ ধুতির খুঁট খুলে মুখের কাদা মোছে। তারপর চায়ে চুমুক দেয়। গয়ানাথের বৌ ও মেয়ে এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে, আসিন্দির বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া নিয়ে নিলে, বাঘারু জোয়ালটা দুই বলদের কাঁধে জোতে। ছাই বলদটা সরতে চাইছিল না। বাঘারু তার গলায় ঘাড়ে হাত দিয়ে নির্ভয় দিলে সেই শাদা বলদটার পাশে এসে দাঁড়ায়। যেন এখনো কোথাও মোটর সাইকেলের আওয়াজ উঠতে পারে–এমন ভাবে ডাইনের বলদটা ব্যায়ে অনেকখানি মাথা ঘুরিয়ে গয়ানাথের বাড়ির দিকেই তাকিয়ে থাকে। জোয়াল জোতা হয়ে গেলে আসিন্দির বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া টেনে নিয়ে হালের গোছাটা চেপে ধরে। তারপর বলে, অ্যালায় স্টার্ট দিছু রে বাঘারু।
হে জোয়াই, আলাং-পালাং না করেন, গরু ডর খাছে,বলে বাঘারু আর অপেক্ষা না করে জিভ দিয়ে টাকায় একটা খুব নরম শব্দ তোলে।
বলদ দুটো নড়ে না। কিন্তু শব্দটা শুনতে ডাইনের বলদটা যেন মুখটা আর-একটু ঘোরায়। বাঘারু তখন নরম করে পর পর দুবার টট্টর টট্টর শব্দ তুলে সামনে গিয়ে দুই বলদেরই শিঙের মাঝখানে হাত রেখে একটু চুলকে দেয়। বলদ দুটো ঘাড় তোলে। গলকম্বলে একটু সুড়সুড়ি দিয়ে, বাঘারু বলে, দেন কেনে জোয়াই, স্টার্ট দেন।
আসিন্দির নির্ভুল নির্দেশ দেয়। আর বলদদুটো চলতে শুরু করে। হালের গোছা তার হাতে শক্ত করে ধরা আর ফাল পুঁতে যাচ্ছে মাটিতে। বেশ বড় বড় মাটির চাঙড় উঠে দু-পাশে পড়ে যাচ্ছে। সামান্য একটু পরেই বলদদুটি বোঝে অরা বেশ শক্ত সমর্থ দুই হাতে। জোয়ালের ওপর সমান টান পড়ছে। বলদ দুটোর ঘাড় ধীরে-ধীরে সোজা হয় আর আসিন্দির তার টাকরার আওয়াজে বলদ দুটোর গতি বাড়ায়। কোনোদিনই যাকে হাল ধরতে হয় না পেশিবহুল শক্তসমর্থ শরীরে এই আচমকা হালচালানোয় তার যেন একটা শারীরিক আরামই জোটে, স্বেদমোচনের আরাম। অভ্যেস নেই বলে আসিন্দিরের হাতের চাপটা সমান থাকে না, একটু কম-বেশি হয়ে যায়। তখন হালও লাফায়, জোয়ালও লাফায়, বলদও একটু হোঁচট খায়। কিন্তু সে ত মাত্র দু-একবার। তার ধুতি আর গেঞ্জিতে আসিন্দিরকেও জমির ভেতর প্রোথিত মনে হয় না, তাকেও মনে হয় শখের হাল চালাচ্ছে। কিন্তু দেখতে-দেখতে যে-গভীর নালী তৈরি হয়ে যায় তার হলচালনার ফলে, যেকালোকালো নরম মাটি ঝুরঝুর উপড়ে যাচ্ছিল ফালের দু পাশে–তাতে তার গায়ের জোর ও তার মোগ্যতার প্রমাণে হল।চালনার বিষয়টিই বদলে যাচ্ছিল।
দূরের দিকে তাকালে কুয়াশা এখনো গভীর। চোখের সামনের কুয়াশা কাটছে। সামনের বাশগাছের মাথায় মাকড়সার জালের মত কুয়াশার জাল। চার-পাঁচজন লোক ফরেস্টের পাশ দিয়ে বন পেরছে। দু-একজনের মাথায় এক-একটা পঁজা। দিগন্ত পর্যন্ত ত চেনাই এখানে–এমন-কি আকাশের রেখাঁটিও! বাঘারুকে একটু নজর করে এই দৃশ্যটা ঠাওরাতে হয়। হে জোয়াই, দেখ কেনে–আসিন্দিরকে বাঘারু ডাকে। আসিন্দির হাল ছেড়ে এলে দেখায় দেখ কেনে। একটু নজর করে দেখে আসিন্দির ছুটে গিয়ে মাঠ থেকেই গয়ানাথকে বলে, হে বাপা, তোমার সার্ভে পার্টি ত যাছে হে সার্ভের জায়গা। বাঘারু গিয়ে হালের দড়ি ধরে। অ্যাঁ? বলে গয়ানাথ লাফিয়ে ওঠে, বাঘারু-উ। বাঘারু মাঠের ভেতর থেকেই তাকায়। ঐ চিয়ারখান নিয়া ছুটি যা সার্ভের জায়গাত, ছুটি যা। বলে গয়ানাথ দৌড়ে কুয়োপাড়ে যায়। আসিন্দির তাড়াতাড়ি গিয়ে বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া ধরে বলে, কাউক পাঠাই দে জলদি, আর চলি যা চেয়ারখান নিয়া।
বাঘারু দৌড়তে-দৌড়তে সদরবাড়ির ভেতর দিয়ে পেছনে গোয়ালবাড়িতে গিয়ে চিৎকার করে, হে-ই ভোচকু, যা কেনে বলদদুইটাক নিগি আন। তারপর আবার দৌড়ে ফিরে এসে দেখে গয়ানাথের মেয়ে চেয়ারটায় বসে। উঠো কেনে, উঠো। গয়ানাথের মেয়ে লাফিয়ে ওঠে। চেয়ারটা উল্টিয়ে মাথায় নিয়ে বাঘারু সোজা পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে যায়। এই দিক দিয়ে একটা ছোট রাস্তা আছে। এখন তার পরনে নেংটি, সারা গায়ে আর-এক চিলতে কাপড় নেই, মাথার ওপর উল্টনো চেয়ার, পা ওপর দিকে তোলা। বাঘারু খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে, এ-আল, ও-আল দিয়ে। তাকে সার্ভে পাটির আগে পৌঁছতেই হবে। চেয়ারটা কোনো গাছের তলায় ঠিকঠাক করে রাখলে হাকিম বসবে। আর হাকিম যদি আগে যায় তবে বসবে কোথায়। হাকিম আছে, চেয়ার নেই–এই অসম্ভব অবস্থা দূর করার ভার নিয়ে বাঘারু তার বড় বেশি চেনাজানা এই মাঠ-ঘাট বনবাদাড় দিয়ে, ছোট থেকে আরো হোট পথে, ছুটছে।
গয়ানাথ জামাকাপড় পরে এসে উঠোন থেকে চেষ্টায়, হে জোয়াই, ভটভটিখান বাহির কর, লেট হয়্যা যাছে, মোক ছাড়ি দিয়া আয়। আসিন্দির ভোচকুকে দৌড়ে আসতে দেখে বলদদুটোকে ছেড়ে দৌড়ে এসে লুঙি-গেঞ্জিতেই মোটর-সাইকেলটাকে ঠেলে-ঠেলে উঠোন দিয়ে বাইরে নিয়ে যায়, বড় আলের মুখে। গয়ানাথ ঘরের ভেতর থেকে মার্কিন কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা পুটুলি চটের ব্যাগে ভরতে-ভরতে বেরিয়ে আসে। সেটা হাত বাড়িয়ে সামনে নিয়ে, আসিন্দির ট্যাঙ্কের ওপর রাখে। গয়ানাথ পেছনে বসে। গয়ানাথের বৌ আর মেয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আসে কিন্তু তার আগেই মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেয়ার আওয়াজ ওঠে। ওরা বড় আল দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়।
.
০১৯.
বনপথে আকাশ-বাতাস
সুহাসকে সামনে জ্যোৎস্নাবাবুর প্রাইভেট আর পাবলিক বোঝার ভার দেখতে হয় আর পেছনে বিনোদবাবুর ক্রমঘন নিশ্বাস শুনতে হয়। প্রিয়নাথ আর অনাথ তাদের কাঁধের আরো ভারি বোঝা নিয়ে অনেকটা আগে চলে গেছে তাদের টেবিল আর শিকলের ব্যাগটা দুলতে-দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন ঐ ভারের বোঝাতেই তাদের পায়ের গতিও বেড়েছে।
মাসটা ভাদ্রের শেষ। বর্ষার একেবারে মধ্যপর্ব। এই সকালে অবশ্য বৃষ্টি নেই, মেঘও নেই। ফলে রোদের তাপ বাড়ছে। এই সকালেও। সেটা এত জোরে-জোরে হাঁটার জন্য, নাকি, এত সকালের এই চাপা রোদের তীব্রতার জন্যও, তা বোঝার উপায় নেই।
এখন এই বৃষ্টিহীন, মেঘহীন সাতসকালে যেন কারো মনে হয়ে যেতে পরে বৃষ্টি এবারের মত শেষ। মাঠের ঘাস, খেতখামার, ফরেষ্ট আর চা বাগানের সব গাছগাছড়ার, ঝোঁপঝাড়ের, গাছপালার রং একেবারে মোটা কাঁঠাল পাতার মত কালচে সবুজ। ঝোঁপঝাড় আর খাটো-খাটো সব বুনো গাছগাছড়া বর্ষার জলে ফুলেফেঁপে এতটাই, যে আর খাড়া থাকতে পারে না, নিজের ভারে নিজেই নুয়ে পড়ে মাটির ওপর পাকার–যেন এগুলো সবই মাটির ভেতরের জল থেকে ফেনিয়ে ওঠা। কিন্তু এখন, এই সকালের রোদে সেই সব ঝোঁপঝাড়ের ওপর থেকেও যেন বাড়তি জল উপচে যাচ্ছে। সামনে একটা ফরেস্ট শুরু হয়েছে। একটু উঁচুতে। এই তলা থেকে ফরেস্টের, ওপরে জলকণার এই বাষ্পীভবনের ধোয়া দেখা যাচ্ছে ফরেস্টের ভেতর থেকে, মাথা থেকে ধিকিধিকি আগুনের ধোয়ার মত, যেন পাতলা মেঘ ভেসে যাচ্ছে কোনাকুনি ওদলাবাড়ির দিকে তার মানে বাতাস এখনো পূর্ব থেকেই বইছে। কী ফরেস্ট যেন…। একই নামে একটা চাবাগানও আছে। সার্কল ম্যাপটা অত সুহাস সঙ্গে রাখতে পারত। কী যেন ফরেস্টটা, এটা?
মালহাটি, জ্যোৎস্নাবাবু না তাকিয়ে উত্তর দেন।
মালহাটি, মালহাটি। মালহাটি ফরেস্ট আর মালহাটি টি এস্টেট।
ওরা একটা টিলার মত উঁচু ডাঙা, বরমতল, থেকে নীচে নামছিল। সামনে আবার চড়াই-এ উঠে বোধহয় কিছুটা সমতল জমি–তারপর ফরেস্ট। সেই নিচু জমিটাতে একজন একটা বলদের ঘাড়ে লাঙল লাগিয়ে হাল দিচ্ছে। লোকটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে হয়, সেই ডাঙার মাথা থেকে। উল্টোদিকের চড়াইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সামনের চড়াই মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠলেই ফরেস্টে নজর আটকে যায়। তখন প্রিয়নাথ আর অনাথ প্রায় ফরেস্ট ছোয়-ঘেঁয়। এখন এই একটু তলা থেকে দেখা যাচ্ছে ফরেস্টের গাছগুলোর মাথাতে রোদ ঝলমল করছে। গাছের পাতায় বা বাতাসে কোথাও ধূলিকণা নেই, এমনু-কি আকাশেও মেঘ নেই, ফলে রোদ যেন শান দিয়ে উঠছে। আর ফরেস্টের মাথাটা তাতে ঝিকিয়ে উঠছে। অনাথ আর প্রিয়নাথ ফরেস্টের ভেতর কিন্তু ঢুকল না, ফরেস্টটাকে বাঁ হাতে রেখে ডাইনে ঘোরে। ফরেস্টের যত কাছে যাওয়া যায়–গাছের মাথাগুলো তত অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃষ্টি যেন ধীরে-ধীরে ফরেস্টের মাথা থেকে কাণ্ড বেয়ে নেমে আসতে থাকে। তারপরই ফরেস্টের লম্বা ছায়াটায় ঢুকে যেতে হয়।
সেই ছায়া দিয়ে এগিয়ে, ফরেস্টটাকে বা হাতিতে রেখে ডাইনে ঘুরে, ফরেস্টটার গা ঘেঁষে যেতে হয়। তখন ত আর রোদ নেই। কিন্তু বর্ষার জলে ফরেস্টের রোদহীন এই অংশে মোটা ঘাস প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। পায়ে জল লাগে আর এরকম একটু চলতে-চলতেই ধীরে-ধীরে ঘামটা শুকিয়ে যায়। আরাম লাগে। নিশ্বাসটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু তারপরই একটু আগের রোদ ঝলমল যেন-শরতের আকাশকে মনেও পড়ে না। মনে হয় যেন চার পাশেই বৃষ্টি পড়ছে–তারা ফরেস্টের গাছের পাশ দিয়ে-দিয়ে যাচ্ছে বলে গায়ে জলকণা লাগছে না। ডাইনে তাকালে, কালচে সবুজ ঘন ঘাসের প্রান্তর, আর বায়ে তাকালে, নিচ্ছিদ্র প্রায়ান্ধকার জঙ্গল–গাছের কাণ্ডগুলোও জঙ্গলের সবুজে ঢাকা, শ্যাওলায় বা লতায়।
ততক্ষণে শীত লাগতে শুরু করেছে, আর সেই শীতের মধ্যেও চামড়াটা কেমন তৈলাক্ত হয়ে ওঠে। ফরেস্টের ভেতর থেকে গরম বাষ্পের ভাপ বইছে। একদিকে শীত, আর-একদিকে সেই ভাপের গরমের ঘাম। বুকটা পিঠটা ভারী হয়ে ওঠে। নিশ্বাসও ভারী হতে থাকে।
মাটির ওপর ফুলে ফেঁপে ওঠা এই জলীয় জঙ্গল যেন মাটিরই গেজিয়ে ওঠা। জলে-জলে লতাপাতার মাটির তলার শেকড় এত বেশি ফাপা, সেগুলো যেন আর মাটি আঁকড়াতে পারে না। শাল-সেগুন-খয়ের-লাম্পাতি নিজেদের শরীরের ভারেই সেঁদিয়ে যাচ্ছে মাটির ভেতরে। এত বর্ষার এত জলে এই গাছগুলোর পাতাও মোটা ও ঘন হয়ে ছড়িয়ে গেছে–ডালপালার সেই ভারে শালগাছের দৈর্ঘ্যকেও আর দীর্ঘ মনে হয় না।
কয়েক মাসের বর্ষার অবিরল জলে সব কেমন ছোট হয়ে গুটিয়ে গেছে। দুই ধারের মোটা মুথা ঘাসের নীচে পায়ে চলার পথ চাপা পড়ে গেছে। ডাইনের পড়ো নিচু জমির ভেতর থেকে ঘাস আর জঙ্গল বেড়ে বেড়ে যেন ডাঙা হয়ে উঠেছে। ছোট টিলার ওপর ছোটখাট বুনো গাছের মাথা আকাশে ঋকিয়ে উঠেছে। সেই সব গাছের মাথায় এখন আকাশের পটভূমি। ফলে, আকাশও যেন নেমে এসেছে কেশ নীচে। অথচ এই একটু আগে আকাশকে কেমন নীল ও গোল দেখাচ্ছিল। একদিকে ঘাস-লতাপাতা-ঝোঁপঝাড়-গাছপালা আর বিরাট-বিরাট গাছের ঝাকড়া ঝাকড়া মাথা নিয়ে মাটির সংকীর্ণ হয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা, আর, তার সঙ্গে ওপর থেকে আকাশের এমন নিচু হয়ে এই সবের পরিপ্রেক্ষিত, হওয়া–পৃথিবীটাকে যেন গুটিয়ে দেয়, যেন সব কিছুই পাকিয়ে ওঠা, আড়াল হয়ে যাওয়া। টিলার। ওপরে, দৃষ্টি আড়াল করা কোনো ঝাকড়া গাছের মাথায় আকাশের নীল। গাছটা এখন মাটির তলায় জল শুষে চছে, বাড়ছে। কিন্তু এর ভেতরেই কি বর্ষার পরের এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে? এর পর শরতের রোদে মাটি শুকিয়ে গেলে, মাটির তলার জল আরো-আরো নেমে গেলে, জলকণা সরিয়ে বাতাস খড়খড়ে হয়ে উঠলে, এই সব ঝোঁপঝাড় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে শুরু করবে। পায়ের তলার মাটি এখন আচমকা দেবে যায়। দিনে দিনে এই জল মাটির আরো নীচে চলে যাবে–তখন ধীরে ধীরে মাটি শক্ত হবে, শক্ত হতে-হতে কোথাও-কোথাও পাথরের মত হয়ে উঠবে। কোথাও-কোথাও। কারণ, ফরেস্টের ভেতরের মাটি পচা পাতায় সারা বছরই ত নরম। এখনো ফরেস্টের, যাকে বলে ঝোঁপঝাড়, প্রায় যেন স্থির, কিন্তু উচ্ছ্বসিত জলাশয়ের মত ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে, দূরে-দূরে মিশে গেছে বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে। ওগুলোতে মানুষ ডুবে যাবে। ডুবে গেলে আর মুখ তুলতে পারবে না–আরো নীচে লতাপাতা এত জটিল আর মাথার আচ্ছাদন এত কঠিন।
এই সব মিলিয়ে এখন যেন চারপাশ থেকে একটা ঢাকনা তোলার মত ভাব। আকাশটা নীল আর রোদটা এত প্রচণ্ড হওয়াতেই এই খোলামেলা ভাবটা ছড়ায় বটে কিন্তু সেই ঢাকনাটা এখনো সরে নি। আকাশ-ভাঙা জল আর মাটির তলার জল–এই দুদিকেই এখন ত জমা জলের পচন। আকাশের জল শেষ হলে মাটির তলার জল টেনে নেবে গাছপালা। এই ভরা বর্ষাতে কি সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে? বাতাসও কেমন অনিশ্চিত–পূর্ব থেকে কখনো, কখনো বা উত্তর ঘেঁষাও মনে হয়। রোদও তেমনি অনিশ্চিতকখনো মনে হয় আরামের আর কখনো মনে হয় শরীরের সব রস শুকিয়ে যাবে। ছায়াও তেমনি, কখনো মনে হয় ঠাণ্ডা, কখনো মনে হয় হিম।
আকাশ বাতাসের এই দুরকমের ভাবটা সবচেয়ে বোঝা যায় ধানখেতে। নতুন চারার কাঁচা সবুজ যেন উঠে যাচ্ছে–সমস্ত ধানখেতের চেহারাই এখন রঙচটা ফ্যাকাশে সবজে। বাতাসে ত ধানখেত দোলেই–এত পাতলা পাতায় ও গোছায় ধানখেত ত প্রায় জলের মতই। কিন্তু সেই দোলায় একটা রঙেরই রৌদ্র ছায়াপাতের প্রবাহ খেলে না, যেন মনে হয় বিবর্ণ মড়া একটা খেত ছড়িয়ে পড়ে আছে। এখন ধীরে-ধীরে খেতের জল শুকোবে। তারপর মাটি শুকোবে। তারপর মাটি খটখটে হবে। আর, সামনের তিনমাসের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ধানগাছের গা থেকে এই সবুজের শেষ আভাটাও চলে যাবে। বাতাসে ধানগাছের হিল্লোলিত রং দেখেই বোঝা যায় মাটিতে ও বাতাসে তখনো কতটা রস লেগে আছে। এই রস যত শুকোবে ধানগাছের সবুজ তত ঝরবে। ঝরতেঝরতে শেষে আর-এক রঙের দিকে বদলে যাবে। তখন ধানগাছের শরীরের সব রস শুকিয়ে ধানের দুধ ঘন হবে। যত শুকোবে-ধানের দুধ তত জমবে। যত জমবে–ধানগাছ তত হলুদ হবে। যত হলুদ হবে-ধানের ভেতর চাল তত তৈরি হবে। তারপর বাতাস, মাটি ও শরীরের সব জল ঝরিয়ে সমস্ত ধানখেতটা, সোনারং হয়ে যাবে। সোনালি হলুদ। ধানখেতের মরণের রোগ। যত শুকোবে তত সোনালি। আর, ধান তত পাকবে। তারপর একসময় সেই রসহীন শুকনো পাতার তুলনায় চালভরা শিষ অনেক ভারী হয়ে উঠবে, ধানখেত নুয়ে যাবে, নেতিয়ে পড়বে, ধানগাছের মাথায় ধানের শিষ মাটিতে ফিরে যেতে চাইবে আর মাটিতে নোয়াতে পাতাগুলো খড়খড়িয়ে সোজা হয়ে উঠে বাতাসে দুলবে। তখন ধানখেত বাতাসে জলাশয়ের মত, হিল্লোলিত হয় না, মাঠময় ছড়িয়ে থাকে–দেখলে মনে হয় ধানখেত, নয়-পোয়ালের খেত।
সামনে ফরেস্টটা শেষ হয়ে যায়। ফরেস্টের ছায়ার ভেতর থেকে ওরা সামনে দেখে, ঘাস আর গাছ-গাছালির ওপর সেই পুরনো পরিষ্কার রোদ। যেন সেই রোদের আভাসেই এখানে ফরেস্টের ছায়াচ্ছন্নতাও কেটে যাচ্ছে। ফরেস্টটা পেরিয়ে ওরা বা দিকে ঘোরে-ধানখেত।
ধানখেতের ভেতর দিয়ে সেই রোদে যেতে-যেতে আবার বর্ষাটাকে অতীত মনে হয়, যেন শরৎ শুরু হয়ে গেছে। ডাইনে একটা গা। বাঁশের বেড়ারলাইন আর গায়ে গা লাগানো বাড়িগুলোর পেছন দিক দিয়ে বানানো প্রাকারেই বোঝা যায় মুসলমান পাড়া। গোচিমারি। পাশ দিয়ে ওরা আরো কোনাকুনি এগয়। একটু পরেই তিস্তার ঠাণ্ডা বাতাস। বাতাসটা তিস্তার ওপর দিয়ে আসছে বাতাসের ঠাণ্ডাটা এমনই তাজা আর টাটকা, যদিও ভেজা। ফরেস্টের ভেতরের বাতাস যে বাইরে আসছিল, সেটাও ভেজা ছিল কিন্তু ফরেস্টের পাশ দিয়ে আসার সময় তার জলীয় তৈলাক্ত ভেজা ছায়াতেও ঘামিয়ে দিয়েছিল, ধানখেতের রোদেও সেটা যেন পুরো শুকোয় নি, অদৃশ্য তিস্তার এক ঝলকেই সেটা মুছে যায়। ওরা আর-একটা সরু পাকা রাস্তায় ওঠে। দলটা ডান দিকে ঘোরে। বিনোদবাবু পেছন থেকে বলেন, এইটা চ্যাংমারি হাটের রাস্তা, পেছনে।
চ্যাংমারিটাও সুহাসের হলকায় পড়বে। সুহাস যা কাজের পরিকল্পনা করেছে তাতে একেবারে শেষে ঐ অঞ্চল ধরতে হবে। এখন যে-লাইনটা শুরু করবে, এর পরে তার তলায় পুব-পশ্চিমে আর-একটা লাইন হবে চ্যাংমারিতে। তখন চ্যাংমারি থেকে আদাবাড়ি, চক মৌলানি, দক্ষিণ চক মৌলানি, দক্ষিণ মাটিয়ালি, ঝাড় মাটিয়ালি, লাটাগুড়ি আর উত্তর মাটিয়ালী–এই মৌজা দিয়ে কাজ শেষ হবে। এগুলো গত সেটেলমেন্টের পর মাল সার্কেলে এসেছে, তার আগে ছিল মাটিয়ালি সার্কেলে। সুহাস একটু দাঁড়ায়। বিনোদবাবু তার পাশ দিয়ে এগিয়ে যান। দলের দিকে পেছন ফিরে সুহাস এই রাস্তাটি দিয়ে চ্যাংমারি হাটের দিকে তাকায়। তারপর আবার ঘুরে দলের পেছন-পেছন চলে। একটু যেতেই সামনে দেখা যায় ফরেস্ট আর তিস্তা–ফরেস্টটা হঠাৎ এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকে একটা ঘসহীন কাদাহীন ভেজা বালির প্রান্তরের মত নদী। বাতাসে জলের গর্জন। আর একটু এগলে তিস্তার, স্রোত আর ফেনা দেখা যায়। তখন মনে হয়, তিস্তা ফরেস্টটাকে খাচ্ছে-ফরেস্টের পাড়ে এত ভাঙা জমি আর উপড়নো গাছ।
.
০২০.
তিস্তার পাড়ে জমি জরিপের আয়োজন
সুহাসদের আসতে দেখেই পুরো ভিড়টা দাঁড়িয়ে ওঠে।
এর ভেতর প্রিয়নাথ আর অনাথ পৌঁছে গিয়েছিল। তারা সার্ভে টেবিলটা একটা শালগাছের তলায় পেতে ফেলেছে। তার থেকে একটু তফাতে একটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে, খালি, সে-ও গাছতলায়। সেই চেয়ার আর টেবিলের চার পাশেই নানা রকম মানুষের জটলা। একটু দূরে আর-একটা গাছতলায় গাছে-গাছে এক পলিথিনের চাদর বেঁধে চায়ের দোকান, এদিককার সব হাটেই যে-ছেলেটি চায়ের দোকান দেয়, তার।
জায়গাটিতে এই পার্টি একটা ধাপ ভেঙে উঠল। তার আগে বিনোদবাবু আর জ্যোৎস্নাবাবু ওদের বোঝাটা মাটির ওপর নামিয়ে দিয়েছেন, সার্ভে টেবিলটার কাছে। ওপরে উঠে, জ্যোৎস্নাবাবু আর বোঝায় হাত দিলেন না, নিজের ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে ভিড়ের ঐ দিকেই চলে গেলেন, চায়ের দোকানটা যে-দিকে। হাফশার্ট গায়ে, ধুতি পরা, ক্যাষিশের পাম্পসু পায়ে গয়ানাথ এগিয়ে এসে নমস্কার করল, আসেন স্যার, আসেন। তারপর সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসেন স্যার। বসতে একটু ইচ্ছে করছিল সুহাসের। উনি বলা মাত্র ঐ খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসলে মনে হবে, সুহাস এখানে অতিথি, বেশিক্ষণ থাকবে না, এই ভদ্রলোকই গৃহকর্তা। কিন্তু সার্ভে পার্টিটা ত সুহাসেরই। তার ওপর দ্বিতীয় আর-একটি চেয়ার নেই। বসার প্রয়োজন হলেও, একটু সময় নেয়া ভাল।
বিনোদবাবুর হাত প্রায় যন্ত্রের মত নিশ্চিত ও ব্যস্ততাহীন। তিনি সুহাসের কাছে কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না। লাল সালুর বস্তা খুলে মৌজা ম্যাপটা সুহাসকে দিলেন। তারপর এখানকার খানাপুরী টেকনিক্যাল ম্যানুয়াল খুলে, তার ভেতর এই সেটেলমেন্টের খশড়া ফর্মটা ঢুকিয়ে নিলেন। মৌজার এক নম্বর দাগ থেকে টুকে যাবেন। আর এই জায়গাটাতে ম্যাপিং-এর একটা ঝামেলা আছে। সেই জন্যই কেজি ওয়ান এখান থেকেই কাজ শুরু করছেন। খাতা আর কম্পাস হাতে বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে অনাথ আর প্রিয়নাথকে খুঁজলেন। অনাথকে দেখেই বললেন, প্রিয়নাথকে ডাকো, তাড়াতাড়ি শিকল ধরো, এখন রোদ আছে, যতটা পার সেরে রাখো, ঐ, নদীর পাড় বরাবর চেন ফেলল। বিনোদবাবু সুহাসের কাছে এসে বললেন, আপনি ত ম্যাপটা দেখেছেন। এখানেই ফ্লাডের জন্য একটা নতুন ম্যাপিং করতে হবে। আমি চেইন ফেলছি।
বিনোদবাবু নদীর দিকে পা ফেললে অনাথ এসে বলল, প্রিয়নাথকে ত দেখছি না। বিনোদবাবু তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, তাকে কি এর মধ্যেই বাঘে খেল? তাড়াতাড়ি চেইন ধরতে বলল। বৃষ্টি হলে ত তোমাকে-আমাকে আবার একদিন এখানকার কাজের জন্যেই আসতে হবে। দিন বেশি লাগালে তোমার-আমার কোনো লাভ নেই, অফিসার না হয় অ্যালাউন্স পাবে।
বিনোদবাবু জানেন প্রিয়নাথ ঐ ভিড়ের মধ্যে মলে ধরতে গেছে। বস্তি বা বড় জোতের কাজে বেশ সময় লাগে, অংশের মামলা থাকে, মক্কেলই প্রিয়নাথকে খুঁজে বের করবে। এখানে তিস্তা নদীর ভাঙন আর শাল গাছের ফরেস্টের মাপামাপি দেখতে ত এসেছে দুনিয়ার বনুয়ার দল–সে রাজবংশীই হোক, আর মদেশিয়াই হোক, আর নেপালিই হোক। সারা তল্লাটে যাদের এক চিলতে জমির কাজ জোটে নি, আর, এমন-কি ফরেস্টের জমি বেআইনি চাষ করতেও যাদের আসতে হয়েছে এই গাজোলডোবা-সিদাবাড়ির তিস্তার গড় পর্যন্ত, তাদের ভেতর আর মক্কেল পাবে কোথায়? এক গয়ানাথ জোতদার। কিন্তু সে তআর ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা খুচরো মক্কেল নয়। মৌজ-মৌজা জমিতে তার কারবার। কাজকর্ম ঠিকমত শেষ হলে সবাইকে থোক কিছু দেবে হয়ত। এখানকার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে পারলেই লাভ। প্রিয়নাথ এর ভেতর কোনো দেউনিয়ার কোনো মামলা আছে কি না, সেটাই ঠাহর করতে গেছে। নদীর কাছাকাছি থেকে পেছন ফিরে বিনোদবাবু কেন, প্রিয়-না-থ। তার আওয়াজটা তিস্তার হওয়ার আওয়াজে ঢাকা পড়ে যায় বটে, কিন্তু তাতেও সুহাস পর্যন্ত একটু চমকে যায়, বিনোদবাবুর গলার এতটা জোর দেখে। মৌজা ম্যাপটা খুলে সুহাস চেয়ারটার দিকে এগয়।
স্যার, একটা কথা ছিল স্যার, কথা না হয়, অনুরোধ, অনুরোধ ছিল স্যার–সেই ভদ্রলোক
এই স্যার, জরিপ মানে সার্ভে ত আপনার স্যার রোজই হওয়া লাগিবে। অনেক টাইম ত লাগিবেই স্যার কিন্তু এই রোজ-বোজ কি এই টেবিল আর খাতাপত্র স্যার আপনাদের পক্ষে, আপনার না স্যার, কিন্তু উনাদের পক্ষেও টানাটুনি করা উচিত স্যার?
সে আর কী করা যাবে, সার্ভে করতে হলে ত এ-সব লাগেই, ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সুহাস চেয়ারটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সেটা বিষয়েই আমার স্যার একটা অনুরোধ রাখার ছিল। সেটা আমাদের ত এইটা কাজ এটা ত আপনাকে মানিতেই লাগে স্যার, সুহাস যখন চেয়ারটায় বসতে যাচ্ছে গয়ানাথ বাধা দিয়ে বলল, বসিবেন না স্যার, কনে থামেন।
সুহাস ম্যাপটা বেশ মন দিয়ে যাচাই করছিল। এর পর এই ম্যাপের ওপরই নতুন ম্যাপের লাইন কোথা দিয়ে টানা হবে সেটা বের করার আগে আউটলাইনটা দেখে নিচ্ছিল। খুব সুবিধে হত, যদি ঠিক এই সেকশনটার একটা এনলার্জড আউটলাইন আঁকা থাকত। লোকটার কথায় সে একটু চমকে চোখ তুলতেই চিৎকার উঠল, হে-ই বাঘারু। যে-ভিড়টা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তার ভতর থেকে একজন এসে দাঁড়ায়। সুহাসের দুই হাতে ম্যাপ মেলাহীল কাগজের ওপর শাদা রেখার। আর এই লোকটিই যেন আর-একটা ম্যাপ রিলিফে আঁকা, এমন নিষ্প্রাণ বস্তুর মত সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মাথা থেকে পা শাল-সেগুনের দীর্ঘ কাণ্ডের মত অনিয়মিত, বর্ণশূন্য ও রুক্ষ। চোখদুটো কোন গভীরে-মণি দেখা যায় না। নাকটা থ্যাবড়া। পরনে একটি নেংটি–তার রংও গায়ের রংয়ের সঙ্গে মিশে আছে। গয়ানাথ এত জোরে চিৎকার করে উঠেছিল, যেন ফরেস্টের ভেতর থেকে বনমোরগের ডাক। আর এই লোকটি এল দাঁড়িয়ে পড়ার পর, দাঁড়িয়ে থাকার পর, বোঝা যায় তাকেই ডাকা হয়েছে।
চেয়ারখান মুছি দে।
সুহাসকে আবার সেই হাফশার্ট-পরা লোকটার দিকে তাকাতে হয়।
ঠিক আছে, বলে সুহাস চেয়ারটায় বসে পড়ে-চেয়ারটা তা হলে এই লোকটিই আনিয়ে রেখেছে–আর দুই হাঁটুর ওপর ম্যাপটা মেলে ধরে। তখন সুহাস টের পায়, সে বসে পড়া সত্ত্বেও ঐ রিলিফ মত লোকটি চেয়ারের মাথা, পেছন দিকটা, পায়াগুলো হাত দিয়ে দিয়ে মুছে যাচ্ছে। শুকনো কাঠের সঙ্গে তার শুকনো হাতের ঘর্ষণে খসখস আওয়াজ উঠছে।
তাই স্যার এই টেবিল শিকল এসকল স্যার আমার লোকজন নিয়ে ঠিক জায়গায় গোছ করি রাখি। দিবে। আর রোজ-রোজ আনি দিবে। আর এই খাতাগুলা আনার জন্য একটা মানষিক সকালে আপনার ক্যাম্পত পাঠাম।
সুহাস আর মুখ তুলে তাকায় না। সে একটা পেন্সিল দিয়ে তিস্তার পাড়টার যে-অংশটুকু আজকের ব্যাপার, তাকে চিহ্নিত করে।
স্যার, এই স্থানে আমাদের একোটা সুনাম-খ্যাতি আছে, কিম-অফিসার-নেতাগণকে আমরা সেবা করিয়া থাকি। স্যালায় আপোনাকে এই নিবেদন।
গয়ানাথ থামার পরে সুহাস বোঝে সে থেমেছে, সুহাস চোখ তোলে না।কিন্তু চোখ না তুলে বুঝতে পারে না লোকটি আছে না চলে গেছে।
একটু পরেই সুহাস বুঝতে পারে যে লোকটি যায় নি। সে একবার সোজা: তাকিয়ে দেখে নেয়–দূরের লোজন আর তার মধ্যে এই লোকটিই একমাত্র দাঁড়িয়ে। সুহাসের একবার ইচ্ছে হয়, লোকটিকে চলে যেতে বলে। কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সুহাস যেন একটু রেগে থাকতে চাইছে–এটা বুঝে সুহাসের নিজেরই ভাল লাগে না। লোকটি ত এখন পর্যন্ত আপত্তিকর কিছু বলে নি, সে মিছিমিছি বিরক্ত হচ্ছে কেন? সুহাস আবার ম্যাপের ওপর ঝোঁকে।
স্যার–লোকটির গলা। কিছুক্ষণ কেটে যায়। লোকটি আবার ডাকে, স্যার।
সুহাস ঘাড় না তুলে বলে, বলুন না, বলে যান, শুনতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ স্যার, আমাদের উচিত নয় আপনাকে বাধা দেয়া।
সুহাস ঝোলানো ঘাড়টাই দোলায়। কিন্তু থামে না, দুলিয়েই যায়। লোকটি আর-কোনো কথা বলছে না দেখে সুহাস মাথাটা দুলিয়েই যায়। আর ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সে ম্যাপটাকে এতটাই আত্মসাৎ করতে চায় যেন এর পর সে ম্যাপ না দেখে জমি চিনে নিতে পারে।
আপনার সুবিধার জন্যে স্যার, এইটুকু সুযোগ আমাদের দিবা নাগিবেই
একটু নীরবতার পর লোকটির গলা যেন অভিমানী হয়ে ওঠে, ই ত স্যার, আমাদের অঞ্চলের অপমান।
সুহাস মনে-মনে কৌতুক বোধ করে–হাকিম এমনই জিনিশ যার সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা পর্যন্ত বলা চলে না। সুহাস চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, নদীর পাড়ে অনাথবাবু শেকলের একদিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আর-একদিক নিশ্চয়ই তিস্তার পাড় ধরে বনের মধ্যে গেছে। বিনোদবাবু বোধহয় ঐ দিকেই।
সে চেয়ার থেকে ওঠে। ঐ লোকটি এখনো বসে বসে চেয়ারের পায়া মুছে যাচ্ছে। সুহাস নদীর পাড়ের দিকে যায়।
১.৩ গাছের ডগায় মৌজা ম্যাপ
অনাথকে ছাড়িয়ে নদীর আরো কাছে সুহাস তিস্তার পাড় ধরে সোজা উত্তরে তাকায়। এখন এই পাড়টা রাইট এ্যাঙ্গেলে উত্তরে গেছে। সুহাস যেখানে দাঁড়িয়ে সেই ফরেস্টটা মৌজা ম্যাপে জে-এল নাম্বার ৮৭ আর ৮৮র সিদাবাড়ি-গোচাবাড়ি বর্ডার লাইন থেকে উত্তরে, একটু পুবে সরে আসা। এখানেই এখন নদী। এর সরাসরি পশ্চিমে ছিল–এই সিদাবাড়ি-গোচাবাড়িরই একটা অংশ আর আপলাদের একটা ছোট ছিট। আর তার উত্তরে এই সার্কেলের সবচেয়ে বড় জে-এল ৮৪ নম্বর আপলাদ ফরেস্ট।
তার পশ্চিমে ৮৫ নম্বর গাজোলডোবা, ও তারও উত্তরে মৌজা হাঁসখালিরই ২১ নম্বর জে-এল। এই ২১ নম্বর জে-এল থেকে ৮৪-নম্বরের পশ্চিম সীমা, ৮৫ নম্বর গাজোলডোবা ও সে যেখানে দাঁড়িয়ে তারও বায়ের, পশ্চিমের, সিদাবাড়ি গোচাবাড়ি–সবটাই এখন তিস্তার ভেতরে। এর তলায় ৮৬ নম্বরে আপলাদের একটা ছিট ছিল, সেটুকুও ম্যাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে–যদিও সেটা অন্য মৌজার। কিন্তু তারও নীচে এই ৮৪রই আরো একটা একটুখানি ছিট ছিল। তা হলে এখন যেটা ৮২ নম্বর উত্তর আর ৮৩ নম্বর দক্ষিণ হাঁসখালি তারও উত্তরে, আপলাদেরও উত্তরে ছিল আসল হাঁসখালি। আবার এখনকার এই সব জোতের নীচ পর্যন্ত ছিল আপলাদ। নইলে একই জেএল নম্বরের মাঝখানে এত জোত এসে যায় কেমন করে? মৌজা ম্যাপটা মাটির ওপরই মেলে ধরে তার ওপর উবু হয়ে বসে সুহাস বড় হাঁসখালির ২১ নম্বরে, ৮৫ নম্বরে, ৮৬ নম্বরে ৮৭ ও ৮৮ নম্বরের পশ্চিম অংশে একটা করে ঢেরা, মারে। ৮৭ ও ৮৮ নম্বরের পুবে একটা লম্বা দাগ দেয়। এর পর একটা রাস্তা আছে–সোজা আপলাদের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। এই গ্রামগুলো যদি বাতিল হয় তা হলেই একটা নতুন আউটলাইন বেরিয়ে আসে। কিন্তু নদী ত আর জেএল নম্বর ধরেধরে ভাঙে নি। তাই ৮০ নম্বরের পশ্চিম সীমাটা তাকে সাব্যস্ত করতে হবে।
এক-একটা ঢেরায় এক-একটা গ্রামের হিশেব চুকিয়ে, সুহাস ম্যাপটা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তিস্তার ভেতর থেকে এক হাওয়াপ্রপাত ঘটে যায় যেন, আর তার হাত থেকে অত বড় ও ভারী মৌজা ম্যাপটা একটা ছেঁড়া কাগজের মত উড়ে যায়। হে-এ-এ বলে একটা চিৎকার করে উঠে ম্যাপটার পেছনে সুহাস ছোটে। মাপটা তখন লাট খেয়ে মাটিতে পড়েছে। অনাথ শিকল ফেলে দিয়ে ম্যাপটা ধরতে ছোটে। কিন্তু সে ম্যাপটার ওপর পড়ার আগেই আবার ম্যাপটা উড়াল দেয়, এবার আর সোজা নয়, কোনাকুনি ভাবে ওপরে গাছের মাথার দিকে, প্লেনের আকাশে ওড়ার মত। তখন সুহাস দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু অনাথ হাত তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। ম্যাপটা যেন কোনো ওস্তাদের লাটাইয়ের সুতোয় বাধা ঘুড়ি, এমন নিশ্চয়তায় আরো ওপরে উঠল ও একটা মাঝারি সাইজের ডালের খাজে সেঁদিয়ে ঝুলতে লাগল। এতক্ষণের অলস ভিড়টা যেন মুহূর্তে প্রাণ পেয়ে সবাই মিলে ঐ ম্যাপের পেছনে ছুটছে। সুহাসও ভেবেছিল, বাতাসের দমকাটা চলে গেলেই ম্যাপটা ঝুপ করে পড়বে। কিন্তু পড়ল না। সুতরাং আর-একটা দমকায় গাছ থেকে ওটাকে ফেলে দেবে এই আশাই অগত্যা করতে হয়।
এখন নদীর পাড়ে, নদীর দিকে পেছন ফিরে সুহাস। তার সামনে একটু দূরে সার্ভে টেবিল। তার থেকে একটু দূরে গাছতলায় সেই চেয়ার। তার থেকেও একটু দুরে, বায়ে এই সমস্ত ভিড়টা গিয়ে জমা হয়েছে এক গাছের নীচে। সুহাস আঙুলে ধরা পেন্সিলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তারপর নিজের বোকামিটাই আরেকবার দেখতে একটু আনমনায় দিগন্তের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ধূসর জলভূমির দিকে তাকায়। তার ওপর দিয়ে যেন শুধু বাতাসই বয়ে আসছে-ধারাবাহিক কিন্তু প্রবলতর। হে এ বাঘারু–চিৎকারে যেন আবার মোরগ ডেকে উঠল। সুহাস আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, গাছতলায় সেই ভিড়টার পেছনে সেই খাটো, রোগা, শুকনো লোকটা চিৎকার করছে। তার চিৎকারে ভিড়ের ভেতর কী আন্দোলন হয় সুহাস দেখতে পায় না। কিন্তু কিছু একটা হচ্ছে, অনুমান করে। একটু এগিয়ে যেতেই লোকটি তার পাশে এসে বলে, স্যার, বাতাসটা বেশি ত, পাড়ি দিছি। সুহাস দেখে, একটা লোক তরতর করে গাছটাতে উঠে যাচ্ছে। সে কি সেই লোকটিই, যে চেয়ার মুছছিল? এ-লোকটি যেন সেরকম ভাবেই ডাকল।
যে গাছে উঠছিল সে ত এমন ভাবে গাছে ওঠে যেন হাঁটার চাইতেও গাছে ওঠার অভ্যাসই তার বেশি। কিন্তু সে ডালের খাজ থেকে ম্যাপটা বের করেও বুঝে উঠতে পারে না, ম্যাপটা নিয়ে কী করবে। সে যদি ওপর থেকে ছেড়ে দেয় তা হলে ত বাতাসে আবার উড়ে যাবে। সে যদি হাতে ধরে নামতে যায় তা হলে গাছের ঘসায় ম্যাপ ছিঁড়ে যেতে পারে। কিন্তু সুহাস, তার পাশের সেই হাফশার্ট-পরা লোকটি, আর গাছতলার ঐ ভিড়টা সমস্যা বুঝতে পারলেও লোকটি তা মেটাবার জন্য কিছুই করে না। সে একহাতের ঘেরে নিজেকে গাছটার সঙ্গে সেঁটে রাখে, আর-একহাতে ম্যাপটা ধরে থাকে। বাতাসের ধাক্কায় সেখানেই ম্যাপটা ফরফর করে।
হে-এ বাঘারু মুখত ধরি নামা কেনে, মুখত ধরি নামা।
লোকটি যেন জানতই এরকম কোনো নির্দেশ আসবে। মুহূর্তের ভেতর সে অতবড় ম্যাপটা দাতে চেপে ঝুলিয়ে সড় সড় করে নেমে আসতে শুরু করে–যেন বাতাসের বেগে গাছটাই কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে–ডালেপাতায় পাখির বাসা, পিঁপড়ের ডিম, এমন-কি সাপখোপ সবই। মাটিতে পৌঁছনের আগেই ম্যাপের একটা কোনা মাটি হোয়। লোকজন সেটা ধরে নেয়। লোকটা দাঁতের কামড় ছেড়ে দেয়। আর অন্যরা ম্যাপটা ধরে সুহাসের দিকে যায়। কিন্তু সুহাসের কাছে পৌঁছনোর আগেই সেই শাটপরা লোকটা নিয়ে নেয়। তারপর সে সুহাসের দিকে হেঁটে এসে, ম্যাপটা দিয়ে বলে–চাপি ধরি রাখিবেন, বড় বাতাস, যেন ম্যাপটা তার প্রীতি-উপহার। নদীর কাছে সার্ভে টেবিলের পাশে সুহাস, আর, ঐ দিকে ভিড়, তারও পেছনে লোকটা কোথায় দেখা যায় না–যে গাছে উঠেছিল। ঐ ভিড় আর সুহাসের মধ্যে এই হাফশার্ট-পরা লোকটা সংযোগ স্থাপন করে যায় যেন। কিন্তু এই লোকটা কে? কোনো-এক জোতদার ত বোঝাই যাচ্ছে। তালটা কী?
.
০২২.
জঙ্গলের ভেতরে
ফরেস্টের ভেতর থেকে প্রিয়নাথ বেরিয়ে আসে, স্যার, একটু ওদিকে চলেন, বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
হ্যাঁ, চলুন, প্রিয়নাথের সঙ্গে শালবনে ঢুকতে ঢুকতে সুহাস হেসে বলে, ম্যাপটা হাত থেকে উড়ে গিয়েছিল।
যে বাতাস! আমাকে দেন স্যার, প্রিয়নাথ হাত বাড়িয়ে ম্যাপটা নেয়। সুহাস দেখে সেই শার্টপরা লোকটিও তার সঙ্গে চলেছে। একবার ভাবে বলে দেয়, আপনি কেন আসছেন। কিন্তু বলে না। দরকার কী। ওর সঙ্গে যখন কোনো মাপামাপির ব্যাপারে লাগবে তখন দেখা যাবে। কিন্তু তখনই-বা দেখা যাবে কেন? সুহাস ভেবেই নিচ্ছে কেন, লোকটি কিছু একটা বদ মতলবে ঘুরছে। সন্দেহটা সুহাস মন থেকে সরাতে চায়। কিন্তু মনে লেগে থাকে। আর সে কারণেই যেন সে থেমে, ঘুরে লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসে, আপনারা ত এখানকার অনেক দিনের?
প্রশ্নটি শুনে প্রিয়নাথও থেমে যায়, লোকটিও থেমে যায়। প্রিয়নাথ একটু অবাক হয়ে সুহাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাত্র ত এই কয়েক পা এসেছে–কিন্তু এতেই সুহাসের মনে হয় যেন ফরেস্টের কত ভেতরে। তিস্তাও দেখা যাচ্ছে না। তাদের সেই মাপামাপির জায়গাও না।
আর চারপাশে বর্ষার ফরেস্টের ঘন সবুজ জঙ্গলের ঘের। শালগাছের কাণ্ডময় গভীর শ্যাওলা। এই সবের ভেতর ওরা, দুজন থেমে যাওয়ায় সুহাসকেও থামতে হয়।
প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসা করে, কে স্যার?
সুহাস বলে, না, আপনাকে নয়, ওঁকে জিজ্ঞাসা করছি, আপনারা ত এখানে অনেক দিনের?
প্রিয়নাথ না নড়ে বলে, উনি ত স্যার গয়ানাথ জোতদার। কথাটা শোনাল যেন স্যারটা গয়ানাথের উপাধি। শুনে গয়ানাথ তার দুই হাত বুকের কাছে তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে ঘাড় নুইয়ে থাকে, যেন এখানে সুহাস আর প্রিয়নাথই শুধু নয়, বেশ অনেক লোক আছে, যেন এই গাছগাছড়ার কাছেও তার এই পরিচয়ের একটা অর্থ আছে। ভঙ্গিটা প্রায় অপরিবর্তিত রেখে গয়ানাথ বলে, হয়। মুই গয়ানাথ। লোকটি বোধহয় এই প্রথম তার নিজের ভাষাতেই সম্পূর্ণ কথাটি বলল। সুহাসের চোখেমুখে এই কথার কোনো অর্থ ধরা না পড়লেও সে বলে, ও! আচ্ছা। তারপর পা ফেলে।
গয়ানাথ কিন্তু সুহাস আর প্রিয়নাথের পেছনেই থাকে, পাশে আসে না। সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করে, আপনি, স্যার কী বলিছিলেন?
আপনারা ত এখানে অনেক দিন আছেন?
হ্যাঁ স্যার। আমরা ত এইখানেই থাকি।
না। তা ত বটেই। কিন্তু ছোটবেলাতেও কি এখানে ছিলেন? মানে তিস্তা কি বরাবরই এরকম কাছাকাছিই ছিল?
তিস্তা ত স্যার, আটষট্টি সনটাক যদি বাদ করি ধরেন, তা হলে ধরেন একখান বলা যায় গয়ানাথ সুহাসের প্রথম প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না।
মানে, আটষট্টির, ফ্লাডেই সবটা বদলাল?
না, সে ত বদল হয়ই, নদী ত আর মানষির দালানবাড়ি না-হয়, যে, একেবারে পাকা থাকিবে, নড়চড় না হবে। বদল ত হয়ই হওয়া নাগে।
সুহাস ওঁর কাছে আসলে জানতে চাইছিল সে ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে যেবদলটা দেখছে তার কতটা এদের চোখে দেখা। কিন্তু গয়ানাথ অত দার্শনিকতায় পৌঁছে গেছে দেখে সে আর কথা বাড়ায় না। গয়ানাথের যেন খানিকটা প্রতীক্ষা ছিল, সুহাস কিছু বলবে, সেটুকু জুড়ে তীক্ষ্ণতর ঝিঁঝির ডাক আর প্রতিধ্বনিত তিস্তার গর্জনে এই ফরেস্টটা আরো ঘন ও নীরবতা আরো প্রসারিত হয়।
গয়ানাথ যেন আত্মচিন্তার মতই আবার যোগ করে, কিন্তু আবার নদীর ত একটা পাকাপাকি ভাবও আছে। অ, যতই ভাঙুক আর সক স্যার শ্যাষম্যাস একটা ঠিকই হয়। ধরেন–
গয়ানাথ একটু থামে। কী উদাহরণ দেবে সেটি তাকে একটু ভাবতে হয় যেন। আর সুহাসও একটা অনুমানের চেষ্টা করে–গয়ানাথ তার নিজের কয়েক বছরের কোনো দেখাকে যেন একটা পাকা সিদ্ধান্তের মত করে বলছে। নদীর পাড় একেবারেই বদলে যায়, নদী পুরনো খাতে আর ফিরে যায় না, এমন ঘটনা গয়ানাথ দেখে নি, কিন্তু তাই বলে ত সেটা মিথ্যা নয়। সুহাস যেন বুঝে যায়, গয়ানাথের কাছে তার ম্যাপের সাক্ষ্যের যে-সমর্থন চাইছিল তা পাওয়া যাবে না।
এই নীরবতায় তারা ভেজাপচা পাতার ওপর দিয়ে চলে যায়। সুহাস প্রিয়নাথকে জিজ্ঞাসা করে, কোথায়? প্রিয়নাথ কোনাকুনি হাতটা তুলে একটা আন্দাজ দেয়। সেই সময় গয়ানাথ বলে, ধরেন, এই আটষট্টির বানাটাই ধরেন। তিস্তা ত, ধরেন, এইখান থিকা সোজা বায়ে ঢুকে, ধরেন, তিস্তা আর ধরলার মাঝখানে যে বিশাল তেকেনিয়া জায়গাখান, ঐটাকে ভাজি-ভাসি চলি গেল। আমরা ভাবিলাম, এই হইল, এখন থিকা ধরলার খাতখান তিস্তার খাত হয়্যা যাবে। কিন্তু তিস্তা ত আবার তার পুরানা খাতেই ফিরি গেল। এখনো যাছে।
এই একটু আগে যে-জায়গাগুলিকে ম্যাপ থেকে বাদ দেবে বলে ঢ্যারা কেটে এসেছে সেগুলোর কথা মনে রেখে সুহাস বলে-কিন্তু আপনাদের ত কত গ্রাম ভেসে গেছে। নামগুলো তার মনে পড়ে না। যেটা মনে পড়ে, সেটাই বলে, এই ফরেস্টেরই ত অনেকখানি ভেসে গেছে। এর উত্তরে হাঁসখালি।
কিন্তু স্যার, নদী মানেই ত ভাঙাভাঙি। যার পার ভাঙে আর নতুন পাড় হয়, সেইটা হয় নদী। আর যার পাড় ভাঙেও না নতুনও হয় না, ঐটা হয় ডোবা।
নদীর এই সংজ্ঞায় সুহাস বেশ চমৎকৃত হয়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গয়ানাথ আবার শুরু করে দিয়েছে কিন্তু আপলাদের যত ভাঙিছে, ততখানই আবার গড়িবার ধরিছে।
কোথায়?
যেইঠে ভাঙিছে সেইঠেই, নতুন চর, নতুন জঙ্গল।
স্যার এই দিকে, প্রিয়নাথ বায়ে ঘোরে। আর সঙ্গে সঙ্গে তিস্তার গর্জন যেন বেড়ে যায়। একটা ঝোঁপ পার হতেই সামনে কয়েকটা গাছের ফাঁকে দেখা যায় তিস্তা। বিনোদবাবু এক জায়গায় ভাঙা গাছের ওপর বসে খাতায় নোট করছেন। সুহাসরা এল দেখে উঠে দাঁড়ান।
.
০২৩.
নদীর ম্যাপ আঁকা
স্যার, আপনি কি ম্যাপ কমপেয়ার করলেন?
হ্যাঁ, এই দেখুন। যেগুলোতে ক্ৰশ, তা বাদ যাবেই, তা হলে একটা আউট লাইন পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ফরেস্টের, মানে এই ভিলেজটার টোটাল একারেজটা দরকার। তা হলে আগের একারেজের সঙ্গে এটার একটা কমপ্যারিজন করা যেত। দেখুন, আমার ডিমার্কেশন। সুহাস প্রিয়নাথের দিকে হাত বাড়ায়। প্রিয়নাথ ম্যাপটা খুলতে শুরু করে। সুহাস বলে, সাবধানে খুলবেন তারপর বিনোদবাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আমার হাত থেকে ম্যাপটা উড়ে গিয়েছিল, ওখানে। বিনোদবাবু সামান্য হাসির ভঙ্গি আনেন। সুহাস তখন নিজে হেসে বলে, একেবারে গাছের মাথায়।
মাটিতে ম্যাপটা পাতা হয়েছিল। সেই পড়েযাওয়া গাছটার ওপর এখন সুহাস বসে। বিনোদবাবু মাটির ওপর উবু হয়ে ম্যাপটার ঢেরা দেয়া জায়গাগুলোর ওপর দিয়ে আঙুলটা টেনে-টেনে বুঝে নেন। প্রিয়নাথ ম্যাপটা একদিকে চেপে থাকে। আর গয়ানাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে ম্যাপটার দিকেই তাকিয়ে থাকে, কিন্তু বোঝাই যায় সেখানে কিছু দেখছে না।
ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বিনোদবাবু উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথকে বলেন, প্রিয়নাথ, চেইনটা একটু বায়ে সরাতে বলোত অনাথকে। আর-একটু ডাইনে সরো। মানে কোনাকুনি হবে। ঐটাকেই তা হলে পয়েন্ট ধরি স্যার, আপনি যেখান থেকে দেখলেন?
ধরুন, ওটা ত ভাল পয়েন্টই হবে।
প্রিয়নাথ শেকলটা একটু নাড়া দিয়ে চিৎকার করে কিছু বলে। তিস্তার বাতাসে সে-চিৎকার ভেসে। যায়। কিন্তু ওরকম ভাবেই ভেসে আসে অনাথেরও চিৎকার। বিনোদবাবু মেপে বলেন, হ্যাঁ ঠিক। আছে। নাকি, আর-একটু ছেড়ে দেব স্যার?
কথাটার জবাব খুঁজতে সুহাস একেবারে পাড়ে গিয়ে তিস্তার গতিটা আন্দাজের চেষ্টা পায়। নদীর দিকে তাকানো, মানেই ত ওপারের দিকে তাকানো, নীলাভ দিগন্তসীমায়। কিন্তু সুহাস তাকিয়ে আছে এই পারের তটরেখার দিকে, তার পায়ের তলায়।
এখানে পাড়টা অনেক বেশি খাড়া। আর, একেবারে পাড় থেকে ঝাকড়া মাথার বিরাট গাছ, লাম্পাতি, হালকা গাছ বলেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। শাল হলে নিজের ওজনেই ভেঙে পড়ত। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার কয়েক হাতের মধ্যে একটা বিশাল খয়ের গাছ ডালপালা সমেত উপুড় হয়ে জলের মধ্যে পড়ে। জলের মধ্যে পড়া সত্ত্বেও তার ডালপালা-পাতা সব জলের ওপরেই আছে–তলার দিকের খানিকটা জলে ডুবে গেছে। সুহাস একটু ঝুঁকে দেখে, তলার মাটিটাও খেয়ে নিচ্ছে। সে বলে, এদিকে ত পাড়টা আরো ভাঙবে বলে মনে হয়, আর-একটু ছাড়বেন নাকি? …–
স্যার, আমরা এখন ওটাকেই পয়েন্ট ধরে করে রাখি। তারপর একারেজ দেখে আর নর্থের হলকার ম্যাপ দেখে অ্যালাইনমেন্টটা ঠিক করা যাবে।
আচ্ছা, তাই করুন। মৌজা মাপের ওপর বিনোদবাবু পেন্সিলের নতুন লাইন টানতে থাকেন আর প্রিয়নাথের পাশ থেকে পুরো শিকলটার লাইনটা দেখে দেখে নেন।
গয়ানাথবাবু, এর বাদে ত ওদলাবাড়ি চাবাগান? গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করেন বিনোদবাবু।
হ্যাঁ। কিন্তু নদী আর বন, কতটা খাবে, কতটা থাকিবে, তার হিশাব ম্যাপে করিবেন কেমনে? গয়ানাথ তার প্রত্যক্ষতাকে এদের আনুমানিকতার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, যে-আনুমানিকতা আবার মাপজোখে অনড়, প্রায় আদালতের রায়ের মতই। বিনোদবাবু কোনো উত্তর দেন না।
সেই ফাঁকে সুহাস দৃশ্য হিশেবেই দেখে–তিস্তার দিগন্ত থেকে দিগন্ত, যেন জলস্রোত নয়, একটা কঠিন জলভূমির বিস্তার। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, তিস্তা চলছে না, এই পারভূমিটাই চলছে। তখন আবার চোখ বুজে ভাসার বিভ্রমটা কাটাতে হয়। তিস্তার স্রোত এতই খর যে প্রায় কোনো আলোড়নও হয় না, স্টিলের পাতের মত একই তলে নদীটা বিস্তৃত হয়ে আছে। হঠাৎ মাঝে-মাঝে, এক-একটা কাঠের গুঁড়ির ভাসমান মাথাটুকু কুটোর মত ভেসে গেলে বোঝা যায় নদীস্রোতের বেগ কতটা। কিন্তু নদীর গর্জনকে তার চার পাশ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে শোনা যায় না, বিশেষ করে ফরেস্টে দাঁড়িয়ে, চারদিকের সমস্ত শব্দের সঙ্গে নদীর শব্দ এতটাই মিশে থাকে। কিন্তু নদীর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে, স্রোত দেখতে-দেখতে, নদীর আওয়াজটাকে চার পাশের আওয়াজ থেকে আলাদা করে নিলে, সিনেমায় যেমন স্মৃতিভ্রংশের নষ্টস্মৃতির পুনরাগমন বোঝাতে সাইরেনের আওয়াজ ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে, অবিকল যেন তেমনি, তিস্তার গর্জনটাই বাড়তে বাড়তে প্রধান হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, এই প্রচণ্ড পরিব্যাপ্ত আওয়াজটাকে না-শুনে কী করে থাকা যায়। তবু আওয়াজটার মধ্যে বিরতিহীন মেঘগর্জনের মত একটা দূরত্বের ইঙ্গিত আছে–যেন ভেসে আসতে হচ্ছে। কিন্তু অবরুদ্ধ গুম-গুম ধ্বনি জলের তলা থেকে আরো তলায় নেমে যাচ্ছে। পাহাড় থেকে বিরাট-বিরাট বোন্ডার জলস্রোতে ভেসে-ভেসে জলের তলা দিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে যাচ্ছে। টানা গড়গড় আওয়াজে যেন পাহাড়ে ধস নেমেই চলেছে। জলের তলায় বোরে-বোল্ডারে যখন ধাক্কা লাগে তখন জলের তলা থেকে যেন কামান গোলার আওয়াজ হয়। লোকমুখে এই আওয়াজটার নামও তাই তিস্তার কামান। সুহাস যখন জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে-কিয়ে দৃশ্য-শব্দ শব্দের-ভেতরে-শব্দ শুনতে পাচ্ছিল তখন সে আর-কিছু শুনতে পায় না, দেখতেও পায় না। আর এই দৃশ্য ও শব্দ তার সমগ্রতা নিয়ে তাকে যেন সম্পূর্ণ অবশ করে দিচ্ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল, তিস্তা যে এখান থেকে উত্তরে, পশ্চিমে বেঁকে গেছে সেখানে ঐ ঘোলা জলের স্রোত প্রায় একটা তৈরি করা স্রোতের মত নিটোলতায় উজানে বাক নিচ্ছে। সেই বাক থেকে জলটা বয়ে আসছে সুহাসের দিকে। আর সুহাস চোখে-চোখে স্রোতটা উজিয়ে-উজিয়ে সেই বাক পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে। তার দৃষ্টিতে ঘোর লাগে–এই স্রোতের প্রবলতা দৃষ্টি দিয়েও উজনো যায় না। সুহাস এই ঘোর সামলাতে প্রথমে চোখ বোজে। তারপর বসে পড়ে।
.
০২৪.
নদী আছে কি নাই : গয়ানাথী তর্ক
চোখ বন্ধ করতেই নদী আর নদীর আওয়াজ দুটোই মিশে যায় পরিবেশের সঙ্গে। এই ভাবে নদীর সামনে বসেই নদী থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে বা নদীকে আবার তার পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে অস্পষ্ট করে নিতে স্বস্তি বোধ করে সুহাস। সে নদীর দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বিনোদবাবু নোট নিচ্ছেন, গয়ানাথ তার দিকে তাকিয়ে, প্রিয়নাথবাবু নেই।
প্রিয়নাথবাবু কোথায়?
চেইন গোটাচ্ছে।
এবার গয়ানাথ সুহাসের দিকে এগিয়ে আসে, স্যার, এইখানে আপনাদের মাপামাপিতে কী পাইলেন? নদীখান কি ভাঙিছে? মাপামাপিতে!
সুহাস বসে বসেই বলে, আপনি যা দেখছেন আমরাও তাই দেখছি। আমরা শুধু এইসব মেপেটেপে একে রাখছি।
সেইটাই ত কহিতে চাই স্যার। আটষট্টির ফ্লাডে নদীখান এইঠে আসি গেইছিল, ঢুকি গেইছিল, ঠিকই। কিন্তু তারপর আর ভাঙে নাই। এ্যালায় ফরেস্টখানই ঐদিকে, নদীর দিকে, এর বাদে বাড়ি যাবে।
সে যখন যাবে, তখন যাবে, এখন ত আর যাচ্ছে না, বিনোদবাবু তার খাতা থেকে চোখ নাসরিয়ে বলেন।
কিন্তুক, স্যার, এই ভরা বর্ষায় ত নদী সবঠেই ঢুকি যাবে। যেখানে যাবে সেইটাই কি বাতিল? স্যালায় ত তামান মৌজা বাতিল হবা ধরিবে–গয়ানাথ উত্তেজনা প্রকাশ করে ফেলে, আর সাধুভাষা বলতে পারে না। আর এতক্ষণে গয়ানাথের কথাতে সুহাসের মনে হয়, এইটুকু গ্রামে সারাজীবন ধরে থেকে এইখানকার নদীটা দেখে-দেখেই গয়ানাথ কোনো সর্বজনীন দার্শনিকতার বুলি আওড়াচ্ছে না, তার যেন আরো নির্দিষ্ট কিছু বলার আছে। সে তাই গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করে, তা হলে আপনার বক্তব্যটা কী, মানে, আপনি কিছু বলছেন?
না স্যার, আমি কহিছি আপনার মৌজার ম্যাপখান বদলিবার ত কিছু নাই। য্যানং ম্যাপ আছে, থাউক– কথাটা গয়ানাথ শেষ করতে পারে না। কিন্তু বোঝা যায় সে শেষ করতে চায়।
সুহাস জিজ্ঞাসা করে, মানে, আমরা দেখছি গাজোলডোবা নেই, হাঁসখালি নেই, চুরাশি নম্বর নেই, এতগুলো দাগ নেই আর আমরা মৌজা ম্যাপে লিখে দেব সব ঠিক আছে!
না, না, তা লিখিবার কাম কী আছে স্যার, কিছুই লিখিবেন না, য্যানং আছে, থাকুক কেনে।
তা হলে ত সেটা রেকর্ড করতে হবে। আমি দাগ নম্বরই বা দেব কোথায়, আর দাগ নম্বর শুরুই বা করব কোথায়?
সে ধরেন, ফরেস্টের জমি হাসিল হছে যেইঠে।
ফরেস্টের জমি হাসিল হয়েছে, মানে?
মানে, আগে ফরেস্ট ছিল, এ্যালায় চাষ হওয়া ধরিছে, সেটা ত আপনারা চাষজমি ধরিবেন?
কে চাষ করছে? ফরেস্টের জমি ত ফরেস্টের। কারা চাষ করতে দিয়েছে? বরং উল্টোটা হতে পারে, আগে আবাদ ছিল, এখন ফরেস্ট হয়েছে।
হ্যাঁ। তাও হবা পারে। কিন্তু এইঠে ত সব জমিই ফরেস্টের ছিল, তার থিকা চাষ হওয়া ধরিছে।
বিনোদবাবু এতক্ষণে মুখ তুলে বলেন, সাত পুরনো কথা তুলে কী লাভ? সে যখন ফরেস্ট হাসিল হত, তখন হত। এখন আমরা দেখছি নদীটা এতদূর এসেছে, সেটা লিখব না? বিনোদবাবু উঠে দাঁড়ান, তারপর সুহাসকে বলেন, আপনি বুঝলেন না স্যার, ফরেস্টের জমি যখন গয়ানাথবাবুরা চাষ করবেন তখন সেটা চাষে দেখাতে হবে আর গয়ানাথবাবুর জমি যখন নদীর ভেতরে যাবে তখনো গয়ানাথবাবুরই থাকবে। কী বলেন গয়ানাথবাবু?
কথাটা আপনি সিধা বলিলেন আমিনবাবু, কিন্তু ঠিকই। জমিনের ত আর পাখনা নাই যে উড়ি যাবে, যেখানকার জমি সেইঠেই থাকে, সে জমির উপর জঙ্গলই হোক আর জলই হোক।
সুহাস বুঝতে পারে পাশাপাশি থেকে, পিছু-পিছু এসে, প্রথমে আনমনা ভাবে, এখন বেশ জোর দিয়ে গয়ানাথবাবু একটা কোনো কথা প্রমাণ করতে চাইছেন। সে কথার সমর্থনে আইনের প্রকাশ্য কোনো বিধান নেই বলেই তার কথাটা হয়ত এতটা ঘোরানো-প্যাচানো মনে হচ্ছে। কিন্তু হয়ত আইনের সমর্থন নিহিত আছে বা থাকতে পারে। সুহাসের সামনে কথা বলছে বলেই এ-রকম ভাবে বলছে। কিন্তু তাতে লাভটা কী আপনার? মানে আপনাদের? আমরা যদি নদীটা এঁকে নাও নেই, তা হলেও ত নদীটা এখানেই থাকবে।
কিন্তু নদী ত এইঠে সরি যাবে স্যার, আর মাস দুই বাদেই নদী সরি যাবে।
না, সে ত যাবেই, বর্ষায় নদী যতটা আসে, শীতে ত আর ততটা থাকে না, কিন্তু আপনি শুধু শীতের নদীটাকেই নদী বলবেন নাকি, বর্ষার নদীটাও ত নদী, বর্ষার জল যাবে কোথায়?
সে ত স্যার, যদি আপনি এইটাক নদী বলি ডিক্লার করি দেন, নুটিশ দেন, তার বাদেও ত নদী আরো ছড়ি পড়িবার পারে, বৃষ্টি বেশি হইলেও বাড়িটাড়িত ঢুকিবার পারে, তখন কি কহিবেন, যে-যে-টাড়িত নদীর জল সিন্ধাইছে স্যালায় সর্ব টাড়ি নদীবাড়ি হয়্যা গেইল? গয়ানাথের এই কথা শুনে সুহাস বুঝতে পারে–উত্তর দেয়া মুশকিল এমন কথা না-শোনা, আর নিজের পক্ষে জোরদার কথা বার বার বলা–তর্কের এই বেশ অভিজ্ঞ প্যাঁচ গয়ানাথের ভাল আয়ত্তে আছে। সুহাসের ঐ সন্দেহ কেটে যায় যে গয়ানাথ তার কথাটা হয়ত বলতে পারছে না। বিনোদবাবু বলে ওঠেন, আমরা এখন যা দেখছি তাই লিখছি। এর পর অ্যাটেশটেশনের সময় বলবেন, তখন ত আর বর্ষা থাকবে না, যাচের সময় বলবেন, ভুল হলে ভুলের লিস্ট বের হবে। চলেন স্যার, আমাদের দেরি হয়ে যাবে। এক জায়গাতেই ত সময় গেলে চলবে না।
সে ত করা যাইবেই আমিনবাবু। কিন্তু, এইঠেও ত স্যারের কাছে মোর কাথাটা কহা যায়। যায় কি না-যায়?
সুহাস তাড়াতাড়ি বলে, নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপনি বলুন না, আমি ত শুনছি আপনার কথা।
সুহাস টের পায় গয়ানাথ তার মত করে আইনের বিধান শুনিয়ে দিল। বিনোদবাবুও চুপ করে যান। গয়ানাথ তখন বলে, মোর কাথাটা ত সিধা স্যার, আপনারা যেইঠে নদী আঁকিলেন, ঐঠে নদী নাই, ঐটা বর্ষার জল।
যেন গয়ানাথের কথাটা যাচাই করে দেখার জন্যই সুহাস নদীর দিকে ফেরে। নদীর আরো একটু কাছে যায়। তারপর নিচু হয়ে সে পাড়ের মাটি ভাঙার লাইনটা দেখে। সে এবার ঐ লাইন বরাবর উত্তরে হাঁটে, নিচু হয়েই পাড় ভাঙার লাইন দেখতে-দেখতে, পরীক্ষা করতে করতে। মাঝখানে সেই উপড়নো গাছটার বাধা। ফলে সেই গাছটাকে ঘুরে পার হতে হয়। গয়ানাথ আর বিনোদবাবু পেছনেই থাকেন। সুহাস বুঝে গেছে গয়ানাথ আইনের জোরেই কথা বলতে চায়, সুতরাং সুহাসও তার যুক্তিটা আর-একটু যাচাই করতে চায়। সে একটা বাক পর্যন্ত দেখতে চায়–যে বাকটা এর চাইতেও ডাইনে নিয়ে গেছে নদীকে। এই পাড়ের লাইন নিশ্চিতভাবেই নদীর পাড়ভাঙার লাইন। বর্ষার জলে নদী যদি এতটা উঠে এসে থাকে তা হলে কি এ ভাবে পাড় ভাঙত? সুহাস নদীর পাড়ভাঙা খুব একটা দেখে নি। সামান্য দেখে থাকলেও, মাত্র সেটুকুর ভিত্তিতে তার পক্ষে এমন বর্ষা তার ধারণারও বাইরে। সুহাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিস্তার দিকে একবার তাকায়। তার সামনে একটু-আধটু পাতলা ঝোঁপঝাড়। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তিস্তা। দূর ঘোলাটে বিস্তারের ওপর আকাশের আর আলোর বিচিত্র সমিপাতে ছায়া আর রোদেরও কত অজস্র বিন্যাস। সেই বিন্যাসের মধ্যে কোথাও স্রোত নেই, ভাঙন নেই, আক্রমণ নেই, আওয়াজ নেই। সুহাসের ইচ্ছে হল, সে তিস্তার আওয়াজ শোনে। চোখ বুজে সে তিস্তার দিকে মন দেয়। প্রথমে ফরেস্টের ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে মিশিয়ে শুনতে পায়। তারপর ধীরে ধীরে সে শব্দ আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হতে-হতে যেন জলতলের নির্ঘোষটা স্রোতের ওপরে উঠে আসে। তিস্তা যেন আবার, জলস্রোত থেকে ধ্বনিস্রোত হয়ে যায়। অবিরত ধ্বনি। বোল্ডারের সঙ্গে বোল্ডারের ঘর্ষণের কামানগর্জন মাটি ভেদ করে উঠে আসছে। অদৃশ্য জলগর্ভ জীবন্ত হতে থাকে। সুহাস চোখ খোলে। আওয়াজটা অনেকখানি মিলিয়ে যায়।
সুহাস ফেরে। সে তার যুক্তি ঠিক করে ফেলেছে। যদি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারে, গয়ানাথ করুক। নইলে সে যা লিখল, তাই পাকা।
গয়ানাথ, বিনোদবাবু তার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সুহাস তাঁদের কাছে গিয়ে ড়ায়। দুজনের কেউই কথা বলেন না। সুহাস বলে, না গয়ানাথবাবু, নদী এই পর্যন্তই এসেছে।
গয়ানাথ যেমন দার্শনিক ভাবে শুনছিল, তেমনি শোনে। কথা বলে না। কিন্তু গয়ানাথ বা বিনোদ কেউ নড়েও না। সুহাস যখন বলতে যাবে, তা হলে চলুন বিনোদবাবু, তখনই বিনোদবাবু বললেন, স্যার, বলছিলাম গয়ানাথবাবু যখন এতই আপত্তি তুলছেন তখন আর-একবার দেখে নিতে ক্ষতি কী?
আমি ত সেজন্যেই দেখে এলাম। এটা নদীরই আউটলাইন। স্পিল এরিয়া নয়। গয়ানাথবাবুর যদি কোনো প্রমাণ দাখিলা থাকে তবে হাজির করুন, বিনোদবাবুর এই কথায় সুহাস একবার গয়ানাথের আর-একবার বিনোদবাবুর মুখের দিকে তাকায়। সুহাসও এই কথাটিই ভেবে রেখেছিল বলবে বলে, কিন্তু গয়ানাথ কোনো কথা বললে তার উত্তরে বলবে, নিজে থেকে বলবে না। বিনোদবাবু আগেই বলে দিলেন? প্রমাণের কথা একবার উঠলে আর পেছুনো যায় না। তবু বিনোদবাবু বললেন কেন? গয়ানাথবাবু সুহাসের কথা শুনতেই দাঁড়িয়ে থাকে। সুহাস বলে, আপনার কোনো প্রমাণ থাকলে, বলুন।
আমাকে একটু টাইম দেন স্যার। মোক ঐঠে যাবা নাগিবে। তারপর প্রমাণ দিম।
নিশ্চয় দিম। হ্যাঁ, আপনি যান। তাড়াতাড়ি আসবেন।
হ্যাঁ স্যার। যাম আর আসিম। যাম আর আসিম।
গয়ানাথ মুহূর্তে সরসর শব্দ তুলে পাতা কাদার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
০২৫.
দশ বছর আগে-পরে ‘গয়ানাথের জোত’
সুহাস গয়ানাথের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে। গয়ানাথ অবিশ্যি নেহাতই ছোটখাট, পাতলা। তার যাতায়াতে কোনো শব্দ না-হওয়ারই কথা। কিন্তু গয়ানাথ যেন তার চাইতেও নিঃশব্দে ফরেস্টের মধ্যে মিলিয়ে গেল খুব দ্রুতগামী জন্তুর মত। এতক্ষণ সুহাস, গয়ানাথের এমন তৎপরতা আছে, ভাবতেও পারে নি। সে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করে, কে ভদ্রলোক?
গয়ানাথ জোতদার। রায়বর্মন। তিনপুরুষের। দেখেন নি? এই মৌজার সবটাই ত ওর। এর নীচের মৌজাও আগে ত ওদেরই পুরোটা ছিল।
গয়ানাথ রায়বর্মন। সুহাস যেন কোন স্মৃতি থেকে নামটা মনে আনার চেষ্টা করছে। দলিলদস্তাবেজে নয়, রেকর্ডে নয়, দাখিলাপচায় নয়, গয়ানাথ নামটা তার কারো মুখে শোনা হয়ে আছে, এর কি ফরেস্টেরও দখল আছে না কি?
কোথায় নেই স্যার,? এটা ত গয়ানাথের জোত বলেই সবাই জানে। আপনি মৌজার নাম বদলেও দিতে পারেন, মৌজা গয়ানাথের জোত-ও লিখতে পারেন। কেন? তা লিখব কেন? সুহাস একটু আনমনা ভঙ্গিতে বিনোদবাবুকে বলে বটে কিন্তু কথাটার মধ্যে একটা কোনো জোর ছিল। বিনোদবাবু তাড়াতাড়ি বলেন না, স্যার, এমনি বলছিলাম।
এখন সুহাসের কাছে যেন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়। একটু হেসে নদীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ওঁর জমি সব? বিনোদবাবু একটু হেসে মাথা হেলান। তা হলে নদীরও দোষ, আমাদেরও দোষ।
গত বারের সেটলমেন্টের পঁচিশ বছর পর এই সেটলমেন্ট হচ্ছে। মাঝখানে আটষট্টির বন্যার মত ঘটনা ঘটে গেছে। তিস্তা ব্যারাজের কাজ শুরু হবে। এই সার্ভে তিস্তা ব্যারাজের জন্যেও হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজ বাধা হলে নদীর অনেক কিছু বদলে যাবে। এখন, এই সার্ভেতে এই মৌজার ম্যাপ থেকে ঐ পুরনো দাগনম্বরগুলো চিরতরে বাদ চলে যাচ্ছে। হালের দাগ নম্বর নতুন করে শুরু হবে। তার মানে নদী যা খেয়েছে তা নদীরই সম্পত্তি হয়ে গেল। এখন যদি দু-চার আট-দশ বার-চোদ্দ বছর পর এখানে চর জাগে, বা ব্যারাজের ফলে পাড়টা আরো এগিয়ে যায় তা হলে তাতে গয়ানাথের কোনো অধিকার থাকবে না, পুরোটা পোয়াস্তি হয়ে যাবে। যার ইচ্ছা সেই তখন দখল নিতে পারবে ও সরকারও সেই পোয়াস্তির বন্দবস্ত যার সঙ্গে ইচ্ছা তার সঙ্গে করতে পারবে। কিন্তু যদি নদীর সীমা এতদূর পর্যন্ত মানা না যায়, পুরনো মৌজা ম্যাপটাই যদি চালু থাকে, তা হলে পঁচ-সাত, আট-দশ, বার-চোদ্দ বছর পরও চর পড়লে গয়ানাথ আইনত বলবে এটা চর নয়, তার নিজ খতিয়ানের অন্তর্গত কায়েম। আর, এবারের সেটলমেন্টে একজনের নামে একটা খতিয়ানই দেয়া হবে। মানে, ঐ নদীর তলের মাটির জন্যেও হালখতিয়ান পেতে চাইছে গয়ানাথ। সুহাস কয়েক পা এগিয়ে ঝুঁকে, নদীর পাড়টা আরো মন দিয়ে দেখে। এইবার নদীর এই ভগ্ন লাইনের একটা অন্য ব্যক্তিগত তাৎপর্য ধরা পড়ছে। এখানে যে-জমি ভাঙছে সেটা ফরেস্টের। কিন্তু আরো দক্ষিণে-দক্ষিণে যে-জমি ভাঙছে বা ভেঙেছে সে সব গয়ানাথের জমি। তিস্তার জলের তলের মাটিটা আর প্রাকৃতিক থাকে না, জলের তলার রহস্য থাকে না, অন্তস্রোতে আর খরস্রোতে যেন অমানবিক কোনো শক্তি থাকে না। তিস্তার জল, বিশেষত এই তীরবর্তী জল, তিস্তার মাটি, বিশেষত এই তীরবর্তী মাটি একটা খুব প্রাকৃত মানবিক শক্তি হয়ে ওঠে। ঝুপ ঝুপ করে যে-মাটি পড়ে, বা স্রোতের আঘাতে-আঘাতে যে-তীরের তলা ফাঁক হয়ে যায়, সেই সব মাটি আর তীরভূমি গয়ানাথের।
সুহাস তিস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু দূরের বিস্তারের অতিঅনির্দিষ্টতা থেকে চোখ গুটিয়ে আনে প্রায় চোখের তলার নিকট নির্দিষ্টতায় তিস্তার জল যেখানে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সুহাস খুব কাছে তাকায় কাদাগোলা জলে ফেনার একটা সূক্ষ্ম শাদা রেখা, দুলছে, কয়েক হাত দূরে তিস্তার পাহাড় ধসানো স্রোতের টান এখানে পৌঁছয় না। মাটি থেকে একটা কুটো তুলে নিয়ে সুহাস ঐ জলে ছুঁড়ে দেয়, যেন পরিচিত আত্মীয়তায়। তারপর বিনোদবাবু বলে, তা, ওর যা প্রমাণ তা ওখানেই দিতে পারেন, এখানে আসার দরকার কী?
বিনোদবাবুও খানিকটা চুপ করে থেকে বিহুলের মত বলেন, হ্যাঁ, তাই ত স্যার। আপনি বললেন, আমিও আর ভাবলাম না, থেমে যোগ করেন, এখনো আমরা চলে যেতে পারি, ওরা ওখানে যাবে।
আচ্ছা এখানেই আসুন, যখন গেছেন বলে সুহাস সেই গাছটার ওপর বসে, হেসে বিনোদবাবুকে বলে, কি, মৌজার নাম বদলে দেবেন নাকি কী বললেন, গয়ানাথের জোত?
না স্যার, এমনি বলছিলাম, বিনোদবাবু যেন কৈফিয়ৎ দেন। কিন্তু সুহাস আবার বলে, মন্দ হত না নামটা–গয়ানাথের-জোত, এদিকে ত এরকম নাম থাকে।
হ্যাঁ স্যার, থাকে–
তাই কি সুহাসের মনে হচ্ছিল নামটা যেন তার শোনা, অনেকদিন আগে কেউ শুনিয়েছিল, স্মৃতিতে কোথাও আছেনকশালবাড়ি, বুড়ার জোত, মঙ্গলবাড়ি জোত, কালীর জোত? সেদিন এমন কোথাও চলে যাওয়ার বদলে, দশ বার বছর পরে, এখন, সুহাস বসে আছে এমন একটা জায়গায় যার নাম হতে পারে–গয়ানাথের জোত। সে ইচ্ছে করলেই এই নাম দিয়ে দিতে পারবে। দিয়ে দিতে পারে। আর গয়ানাথ জোতদার গেছে তার সামনে হাজির করার প্রমাণ-দলিল আনতে। সুহাস এখন জোতদারের বিচারক। এ ত সুহাসের একটা জিতই, বেশ বড় জিত। কিন্তু জয় বোধ করতে পারে না সুহাস, গয়ানাথের জোত এই একটা নামের অনুষঙ্গেই জয়বোধ উধাও হয়ে যায় তার মন থেকে। সে অপেক্ষা করে থাকে, গয়ানাথের। গয়ানাথ তাকে বসিয়ে রেখে গেছে, আবার ফিরে আসছে, দশ বছর আগে তাকে দেখে গয়ানাথ পালাতে-পালাতে এখন তাকে হাকিম বলে মেনে নিয়েছে। এখন গয়ানাথ আসছে–তার হাত দিয়ে এই নদী আর নদীর জল আর নদীর ভেতরের মাটি আর এই জঙ্গল সব গয়ানাথের বলে মানিয়ে নিতে। মেনে না নিলে আপিল হবে। আপিলের আপিল হবে। আপিলের আপিলের আপিল হবে। সেখানে সুহাস ত একটা ধাপ মাত্র। আত্মকরুণা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সুহাস আবারও নদীর দিকে তাকায়। তাও ভাগ্যি তিস্তা গয়ানাথের এতটা জমি পেয়েছে–তাই সুহাস অন্তত জোতদারের হাকিম হয়ে বসতে পেরেছে। সুহাস আবার একটা কুটো ছেড়ে নদীর জলে। জোতদারবিরোধী মিত্রশক্তি, না, শ্রেণীসংগ্রামের মিত্রশক্তি, আবার বামফ্রন্ট সরকার কৃষকের মিত্র সরকার, আবার, সুহাস কৃষকের মিত্র হাকিম। চার পাশেই মিত্র। কিন্তু যার মিত্র, তাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
.
০২৬.
ভিড় ও গয়ানাথ
অনেক মানুষের পায়ের চাপে পচা ভেজা পাতা দলে পিষে যাচ্ছিল। তার একটা হিস হিস শব্দ পাওয়া যায়। সুহাস তাকিয়ে দেখে বহু লোক আসছে। বিনোদবাবু বলেন, কী ব্যাপার, ওখানকার সবাইকেই নিয়ে এল নাকি?
তাই ত মনে হচ্ছে, বলে সুহাস ভাবে, আগে থাকতেই তৈরি ছিল নাকি। তা হলে সকাল থেকে সার্ভের ওখানে যে এত লোক জমা ছিল, সে সবই গয়ানাথের লোক? যেন গয়ানাথের কোনো বিপরীত পক্ষ আছে, এমন করে সুহাস ভাবে, কেউ নদীর লোক নয়?
সুহাস ভাঙা গাছের ওপর বসেই ছিল। সমস্ত দলটা এসে সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সুহাস বসে সই তাকিয়ে থাকে। গয়ানাথকে দেখতে পায় না। তাতে যেন একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব আসে। এখানেই বনের মধ্যে ত ছড়িয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। ছড়িয়ে যাওয়ার জন্যে সবাই এখানে আসেও নি। বসার জায়গা নেই–বর্ষার জঙ্গলে। সমস্ত দলটাই ভিড় করে সামনে, দাঁড়িয়ে। তাতে, বাধ্য হয়েই ভিড়টাকে কয়েকটা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। আর ভিড়টার মুখোমুখি একা-একা সুহাস, নদীকে পেছনে নিয়ে, বসে। বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে, সুহাসের থেকে একটু দূরে, কিন্তু ভিড়ের সামনেই। এখানে, এরকম করে দাঁড়াতে হয়েছে বলেই সবগুলো মুখই মিশে গেছে। সাজানো-গোছানো ঠেকে, প্রায় ক্যালেণ্ডারের জাতীয় সংহতির ছবির মত সাজানো-গোছানোতামাটে মোঙ্গলীয় মুখের পাশেই খাটো নেপালি মুখের তীক্ষ্ণতা, পেছনে লম্বা সঁওতালি মুখ। সুহাস এখানে নতুন বলেই, ও এ-অঞ্চলের সঙ্গে তথ্যে আর ম্যাপে আর রিপোর্টেই তার পরিচয় বলে, এই মুখগুলোর পার্থক্য তার কাছে এত সহজে ধরা পড়ে। নইলে পোশাকে-আশাকে এ-ভিড়ের ভেতর বৈচিত্র্য এত কম যে লোকগুলিকে একটা ভিড় বলেই মনে হয়, আলাদা-আলাদা আদিবাসী-উপজাতির বলে মনে হয় না।
কিন্তু এতগুলো মানুষ এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে সুহাসের সামনে দাঁড়িয়ে, যেন, গয়ানাথ তাকে লোক জুটিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। সুহাস উঠে দাঁড়ায়, তারপর একটু কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করে, গয়ানাথবাবু কোথায়? হঠাৎ যেন সুহাস সতর্ক হওয়ার দরকার বোধ করে–এই জঙ্গলের ভেতর তাকে আর বিনোদবাবুকে এতটা আলাদা করে এনে কি গয়ানাথ কোনো ফাঁদে ফেলছে। বিনোদবাবুর দিকে তাকায় না সুহাস, কিন্তু বুঝতে পারে, তার ভঙ্গিতেও অনিশ্চয়তা আছে। সুহাস ভুলতে পারে না, তার ঠিক পেছনেই তিস্তা, বর্ষার। আর সামনে এত, মানুষ, আদিবাসী।
কিন্তু এত অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা নিয়েও সুহাস সামনের এই মুখগুলোর দিকে তাকায়, এই যেরকম মুখের সমাবেশের স্বপ্ন বছর দশ বার আগে তারা দেখত নানা ঘটনার, ইতিহাসের, এখন মনে হয় রূপকথার, অনুষঙ্গে। ব্যক্তিত্ব নয়, সমষ্টিই যে-মুখের আয়তনে আর রেখায়, নাক-মুখ-চোখ-কানের মত ব্যক্তিগুলোর সব শারীরিকেও, খোদাই করা, তেমনি এত মুখের সারি সুহাসকে কোনো এক লুপ্ত সমাবেশের সামনে হাজির করে। কে জানত, এমন প্রতিপক্ষতায় তার এই আবিষ্কার ঘটে যাবে?
এই সরি যা, সরি যা-বনমোরগের গলায় গয়ানাথবাবুর এই চিৎকারটা দঙ্গলের ভেতর থেকে আগে শোনা যায়। তারপর সামনের সারির লোকজন একটু ফাঁক হয়ে যায় আর সেই ফাঁক গলে পেছন থেকে গয়ানাথ এদিকে আসতে গিয়েও আটকা পড়ে যায়। তাকে দেখতে না পেয়ে সামনের একজন বায়ে সরে ফাঁকটা বন্ধ করে দেয়। গয়ানাথকে কাত হয়ে, আগে মাথাটা বের করে, তারপর পিছলে, বেরিয়ে আসতে হয়। তার কাপড়ের একটা দিক ভিড়ের ভেতর কোথাও আটকে যায় বলে তার উরু পর্যন্ত খুলে যায়। পাছে কাপড়টাও খুলে যায় তাই গয়ানাথ কাপড়টা ধরে থাকে। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ খুঁজে পায় না কাপড়টা কোথায় আটকেছে। আর ঐ অবস্থায় গয়ানাথ বনমোরগের গলায় চিৎকার করে ওঠে, শালো চুতিয়ার ছোঁয়াগিলান, শালো জঙ্গলত আসি জঙ্গলিয়া হবা ধইচছিস, পাছত না দেখিস কায় আছে আর কায় না-আছে? এইঠে কি সার্কাস আসিবার ধইচছে, না, নাটঙ্গি হবা ধইচছে?
ততক্ষণে ধুতি গয়ানাথের কাছেই ফিরে এসেছে। গয়ানাথ সুহাসের সামনে দাঁড়িয়ে দঙ্গলটাকে আবার গালাগাল করে। তার খর্বতার জন্যেই ভিড়টার মুখোমুখি তাকাতে তার ঘাড়টা অনেক হেলাতে হত। অতটা হেলিয়ে এতটা রাগা যায় না। বা, ঘাড় হেলিয়ে গলার এই স্বরটা বের করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভিড়টার সামনে দাঁড়িয়ে, ঘাড় নুইয়ে, মাটির দিকে তাকিয়ে, গলার সবচেয়ে বেশি যে-জোর দেওয়া সম্ভব সেই জোর জোগাড় করে, গয়ানাথ গালাগালি চালাতে থাকে–কায় আসিবার কইছে সগাক? সগায় আসি গেইছে শালো ভূতের দল। শালো পিপিড়ার নাখান নাইল বানাও, নাইল করি চলো, শালো গরুর দল।
গয়ানাথের প্রথম চিৎকারে সবাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাপড়টা আটকে যাওয়ায় সবারই একটা কাজ জুটে গেল। আর, কোথায় আটকেছে সেটা খুঁজে না পেয়ে কাজটা বেড়ে গেল। এর ভেতর কাপড়টা পুরোই খুলে যেতে পারে গয়ানাথের এই ভয় দেখে সবাই মজাও পেয়ে যায়। এখন, গয়ানাথের মাথানোয়ানো চিঙ্কারের ওপরে ভিড়ের লোকজন এ ওর পায়ে ধাক্কা দিয়ে হাসে। কিন্তু হেসে ফেলে এ ওর আড়ালে মুখ লুকোতে চেষ্টা করে। ভিড়ের ভেতরে কেউই যে গয়ানাথকে দেখতে পায় নি, আর গয়ানাথই যে ভিড়ের আড়াল থেকে সামনে বেরতে পারছিল না–এর চাইতে বড় মজা ভিড়ের পক্ষে আর কী হতে পারে?
গয়ানাথ ওয়াক থু করে সশব্দে থুতু ফেলে। কোঁচা দিয়ে মুখটা ও ঠোঁটটা মুছে নিয়ে খুব দ্রুত কোঁচার তলাটা আবার উল্টো করে তুলে শার্টের নীচে গুঁজে দেয়। তারপর, আবার মুখটা নামিয়ে কোঁচাটা একটু তুলে মোছে। এ সবটাই সে করে সুহাসের দিকে পেছন ফিরে, ভিড়টার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন ভিড়টা তার অন্দর। শেষে ভিড়টার দিকে পেছন ফিরে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়াবার আগে সে সামনের সারির লোকগুলোর চোখে চোখ রেখে নিজের মূল কণ্ঠস্বরে হিসিয়ে ওঠে, মহিষের বাথান।
সুহাস বসে পড়েছিল। বসেই থাকে। সে গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করে না। তার জিজ্ঞাসা করার কিছু নেইও। তা ছাড়া, সুহাস বোঝে, গয়ানাথ একটু আগে একা-একা, ধীরে-ধীরে কথা বলে, সুহাসদের সামনে নিজেকে বেশ ভাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, ফলে কিছুটা জোরও পেয়েছিল। এখন, যে-ভিড়টা তার সাক্ষ্য-প্রমাণ তাতেই সে চাপা পড়ায় তার এত চেষ্টা নষ্ট হল। এখন, সুহাসও তাকে আর জোর ফিরে পাওয়ার সময় দেবে না। তাকে তার প্রমাণ সোজাসুজি হাজির করতে হবে। যে-প্রমাণই হোক, সুহাস কী বলবে ঠিক করেছে–আপনার কথা শুনলাম, আমাদের যা সিদ্ধান্ত তা ড্রাফটে, খশড়ায় থাকবে। তখনো দেখে যদি আপনার আপত্তি থাকে দরখাস্ত করবেন।
গয়ানাথ বলে, স্যার।
হ্যাঁ, কই কী এনেছেন? সুহাস হাত বাড়ায়।
প্রমাণ দেখাম, স্যার? গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে।
প্রমাণ দেখাবেন বলেছেন আপনি, দেখাবেন কিনা সেটা ত আপনার ব্যাপার, সুহাস আইনি ভাষায় কথা বলে।
স্যার, মুই ডাকিছু দুই জনাক, ইমরা সগায় আসি গেইসে।
সে আসুক না। কী দেখাবেন দিন না।
আপনি কিছু মনে করিবেন না স্যার।
কেন?
এই জংলিগিলান এই জঙ্গলের ভিতর চলি আসিছে।
তাতে আমার কাজের ত কোনো অসুবিধে হচ্ছে না–আপনি কী দেখাবেন, দেখান না।
দেখাছি স্যার, কিন্তুক মোর কুনো দোষ নিবেন না।
দোষগুণের ব্যাপারই নেই কিছু। এ ত আইনের ব্যাপার।
না, এই জংলিগিলান আসি গেইসে।
ঠিক আছে, দিন না কী দেখাবেন।
হে-এ-এ বাঘারু, আবার বনমোরগের গলায় চিৎকার করে গয়ানাথ।
গয়ানাথের ডাক শুনে ভিড়টাকে ঠেলেঠুলে একজন সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিড়টাকে পেছনে ফেলে সে বেশি দূর এগিয়ে আসে না বলে বোঝা যায় না, গয়ানাথের ডাক শুনে সেই সামনে এল কি না। গয়ানাথ বলে, যা কেনে, ঝট করি যা, মৌজার লাইনখান ধরি যাবি, বুঝিলু? নীরবেই সেই লোকটি উত্তর দিকে চলে যায়, নদীর পাড় ঘেঁষে, নদীভাঙার লাইন পরীক্ষা করতে একটু আগে যেদিকে সুহাস গিয়েছিল। সেই লোকটি এ রকম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুহাসের মনে হয়–আগে কি এই লোকটিই চেয়ার মুছছিল আর গাছে উঠেছিল? কিন্তু সেই লোকটিই কি? ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সুহাস বুঝতে পারে না। এতবার গয়ানাথবাবুর মুখে এই নামটা উচ্চারিত হতে শুনেও সে যেমন লোকটির নাম বুঝতে পারছে না, তেমনি এই এত লোক সামনা-সামনি দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে চিনতে পারছে না–একটি মুখও। বা, একটি মুখ থেকে অপর মুখকে আলাদা করতে পারবে না।
লোকটি চলে যাওয়ার পর ভিড়া একটু আলগা হয়। অনেকে ওর সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর দিকে চলে যায় ঝোঁপের আড়ালে-আড়ালে। আবার অনেকে ঐ জায়গাতেই বসে পড়ে, হাঁটু জড়িয়ে হেলে, আর কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিনোদবাবু, সুহাস আর গয়ানাথকে লক্ষ্য করে।
স্যার, আপনি ত এই জিলার ম্যাপট্যাপ সব দেখি নিছেন?
জেলার? হ্যাঁ। কেন?
না, এমনিই, ধরেন, হামরালা ত তিস্তার খুব পাখে খাড়ি আছি, আমাদের পাছত, মানে ধরেন কি না আরো উত্তরে আর পুবে চালসা, হায়হায়পাথার।
হ্যাঁ, সে ত জানিই।
সে ত জানিবেনই স্যার। আপনারা না জানিলে কায় জানিবে? আর এই যে তিস্তাখান, এর সরাসরি ঐ পারে, পচ্চিমে, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট। এই তামানটাই ত ফরেস্ট আছিল–সেই চালসাঠে হেই বোদাগঞ্জ।
তখন নদী ছিল না?
সেইটাই ত বলি স্যার, নদী থাকে, ফরেস্টও থাকে, মৌজাও থাকে, কিছুই যায় না–
.
০২৭.
জমি জরিপ : গয়ানাথী পদ্ধতি
গয়ানাথ নদীর দিকে আঙুল দেখায়। আর সুহাস দেখে, দূরে নদীতে দুজন মানুষ ঘাসকুটোর মত ভেসে যাচ্ছে। সুহাস একটু অপ্রস্তুত চিৎকারই করে ওঠে, আরে আরে।
ছাড়ি দেন স্যার, অ ত বাঘারু।
মানে? জিজ্ঞেস করেই সুহাস যেন বুঝে ফেলে, কী ব্যাপার, এরা কি নদীতে নামল নাকি?
হ্যাঁ স্যার। যেইঠে এ্যালায় ভাসি যাছে ঐঠে ত মোর এই মৌজাখান শুরু।
তাই বলে আপনি এই বর্ষার তিস্তায় ওদের নদীতে নামালেন?
ও ত বাঘারু স্যার, এ্যালায় উঠি আসিবে। আর মুই ত এক বাঘারুক নামিবার কইছি; আর-একটা কায় নামিছে রে? গয়ানাথ গলা তুলে জিজ্ঞেস করে।
মইনুদ্দিন। ডোয়া-ডাবরির।
অ? মইনুদ্দিন। অয় ত চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু স্যার। এ্যালায় মোর কাথাটা শুনেন স্যার। ঐ যেইঠে বাঘারু আর মইনুদ্দিন এ্যালায় পাক খাছে–ঐঠে বৈকুণ্ঠপুরের বোদাগঞ্জ আর এই আপলাদ এক হয়্যা আছি, মোর বুড়া ব্যাপার, মানে মোর ঠাকুরবাবার, মানে ঠাকুরদাদার মৌজাখান ঐঠে আছিল। কিন্তুক মুই এ্যালায় কি কছি যে ঐ যে মৌজাখানঐঠে মোর নামে লিখি দেন? মোরঠে ওর দলিল আছে, ঠিকঅ। কিন্তু ঐঠে ত নদী। তিস্তা নদী। ঐ নদীখান ত আমি মানি নিছি। কিন্তু তাই বলি কি এইঠেও নদী মানিব্বর নাগিবে? বলে সে পাড়ের তলায় জল দেখায়–এইঠে নদী না হয়, বর্ষার জল। বাঘারু এইঠে আসি গেলে দেখিবেন এইঠে জল নাই, সোতা নাই। যার জল নাই, সোতাও নাই–সেইটা কি নদী হবা পারে? এইটা নদী না হয়। এইটে আপনার দাগ নম্বর দিবা নাগিবে।
এতক্ষণে সেই পুরো ভিড়টাই নদীর পাড়ে ঘেষাঘেষি করে ওদের সাঁতার দেখছে। সুহাসের কেমন অপ্রস্তুত লাগে।
গয়ানাথ তাকে সঁতারে ফাঁসাবে সে ভাবতেও পারে নি। বিনোদবাবুও কি পারেন নি? নাকি তাঁর সঙ্গে গয়ানাথের বোঝাপড়া হয়ে গেছে কোনো! এই দুজনকে তার সামনে নদীতে নামানোর পেছনে গয়ানাথের কোনো মতলবও থাকতে পারে। যদি ঐ দুইজনের কিছু হয়? গয়ানাথের মতলবটা কী? সরকারি অফিসার হিশাবে তাকে কি কোনো কিছুর সাক্ষী রাখতে চাইছে? কিন্তু এখন কি সুহাস এখান থেকে সরে যাবে? সেটা যাওয়া যায়? ঐ লোকদুটো ওঠার আগে?
সুহাসের বাঁ পাশে গয়ানাথ। সুহাস তাকে বলে, আপনি এভাবে সময় নষ্ট করছেন কেন? আমাদের আজ সার্ভের প্রথম দিন। আমাদের ড্রাফট বেরলে আপনি যা প্রমাণ-সাক্ষ্য দেয়ার তা দিতে পারতেন। ওদের উঠতে বলুন।
ও ত এলায় উঠি আসিবে। কিন্তু তার টাইম ত দিবা নাগিবে। ওরা কী আর স্রোত কাটাইয়া আসিবার পারিবে? স্রোত ধরি-ধরি আসিবার নাগিবে।
এই তিস্তাটাকে আজ সকাল থেকে কতবারই না দেখতে হচ্ছে সুহাসকে। মাঝে-মধ্যে ত সে এমনিও তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখল। কিন্তু তিস্তার পেটে গয়ানাথের জমিতে গয়ানাথ তার দখলের প্রমাণের কথা তুলেছে যখন থেকে, যেন এই নদী আসলে নদী নয়–গয়ানাথের জোত, তখন থেকেই তিস্তা যেন আর দৃশ্য থাকছিল না, হয়ে উঠছিল তার এই সার্ভেরই ঘটনাস্থল। আর, এখন তিস্তা নদীর এই দিগন্ত-ছাপানো বিস্তারে, ঐ দুটো প্রায় অদৃশ্য মানুষ জলের ফেনার মত ভেসে যেতে-যেতে তিস্তাকে যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সার্ভে ম্যাপের লাইনের মধ্যে। সুহাস আবার বলে, ওদের পাড়ে উঠতে বলুন।
উঠিবার বলিলেই কি আর উঠিবার পারিবে স্যার? এ ত স্রোতে ভাসি-ভাসি ঘুরি-ঘুরি উঠিবার লাগিবে। উজানে গিয়া নদীতে নামিয়া শরীরখান ছাড়ি দিছে। এলায় ভাটিত গিয়া, ধরেন কেনে মাইলটাক ভাটিত গিয়া, বায়ত মোড় নিবার পারিবে, ঐঠে একটা চরা আছে। সেইঠে সাঁতার কাটি এইঠে আসিবে।
সুহাস দেখে তিস্তার ভেতরে লোক দুটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে তাদের মাথায় চুলটকুও দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার পেছনের ও পাশের সেই ভিড়ের কেউ আঙুল তুলে দেখাচ্ছে–ঐঠে ঐঠে, ভাসি গেলাক, আগত বাঘারু, হে-ই ডুবি গৈলাক হে। ঐ আঙুল ধরে-ধরে তাকিয়ে সুহাস দু একবার দুটো কাল বিন্দু দেখতে পায় বটে কিন্তু দেখামাত্র ঐ কাল বিন্দু দুটি এত দূরে ভেসে যায়, সে আর চোখ ঠিক রাখতে পারে না। কিন্তু যখন দু-এক মুহূর্তের জন্যে দেখে, তখন তার মনে হয় না ওরা কখনো ফিরতে পারবে, বা ফেরা সম্ভব–তিস্তার এই ধূসর বিস্তারে ঐ দুটি কাল বিন্দু এতই অবান্তর। হে-ই আর দেখা না যায়, চরটা পাই গেইসে।
কে-একজন মদেশিয়া ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, দুই মানুষ চর পাই গেলাক?
হয়। দুজনাই পাই গিছে।
এ্যালায় ফিরিবে।
কনেক বিশ্রাম করিবার নাগিবে ত হে।
শরীল ছাড়ি দিবে, বসি পড়িলে শরীল ছাড়ি দিবে।
বিশ্রাম কেনে হে? যাওয়ায় তানে ত স্রোত ভাসি গেইছে।
স্রোত ভাসিবার আর জোর লাগে না, নাকি হে? ভাসি থাকিবার তানে—
হয়, হয়, রওনা দিছে হে।
কোটত কোটত? ভুরুর ওপর হাতের ঢাকা দিয়ে অনেকেই দেখতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণের স্তব্ধতার পর কেউ বলে, না হে, কাঠ ভাসি যাছে, কাঠখান ভাসি গেলাক আর ভঁয় কইথে ভাসি আইলাক? মদেশিয়া গলায় নিরুত্তেজ রসিকতা, নদীর পানি পিকে মাইত গেলে হে? নদীর ভেতরে ঐ দুইজনের ভেসে যাওয়াটায় নজর রাখতে দৃষ্টি আর মন যে-তীব্রতায় বাধা ছিল, তা এখন শিথিল হয়ে গেছে। ঐ দুইজন নদীর ভেতরের কোনো একটি চরে একটু গা-হাত-পা মেলে দিয়ে যেমন বিশ্রাম নিচ্ছে হয়ত, এই এতগুলো লোকও তেমনি, নদীর ভেতরে ঐ দুজনকে যতক্ষণ আবার দেখতে না-পায় ততক্ষণ, কথায় কথায় একটু এলিয়ে নিচ্ছে।
গয়ানাথই এক বিশ্রাম নিতে পারছে না। সে ভুরুর ওপর একবার ডান হাতের ঢাকা, আর-একবার–হাতের ঢাকা দিয়ে কোনো একটি বিন্দুতে ঐ লোক দুজনকে খুঁজবার চেষ্টা করছে। গয়ানাথ যদি ভুরুটা একটা হাত দিয়েই ঢাকা দিত তা হলে হয়ত তাকে এতটা অস্থির দেখাত না। কিন্তু একবার ডান, আর-একবার বা হাত তোলা ও নামানোর ফলে মনে হচ্ছিল সে বুঝি তিস্তার পুরো বিস্তারটার ওপরই চোখ বোলাচ্ছে। আর, ঐ অত তীব্র স্রোতের অত বিস্তারের দিকে অতক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, এই পাড়টাই ভেসে চলেছে, জাহাজের মত, আর গয়ানাথ ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দূর-দূর দ্বীপে কাকে বা কাদের খুঁজছে।
সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল, অচেতনেই হয়ত। আর ফরেস্টের এত গভীরে, নদীর এত কিনারে চুপ হয়ে গেলে ত এই জায়গাটা তার স্বাভাবিক স্তব্ধতাই ফিরে পায়। তাতে যুক্ত হয় শুধু এতগুলো মানুষের সমবেত শাসপতন শাসগ্রহণ। সেই অবকাশে তিস্তার ওপর থেকে বাতাস লাফিয়ে উঠে গাছগাছড়ার মধ্য দিয়ে গভীরতর বনাঞ্চলে চলে যাওয়ার পথে যেন মুচড়ে দিতে চায় শালগাছকেও।
ফিরি আসিবার ধরিছে, খুব চাপা গলায় কেউ বলে। সবাইকে কথাটা মেনে নিতে হয়, কথটা এমন ভাবে বলা। তারপর খোঁজাখুজি চলে নীরবেই। সুহাসও তার চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখে। কিন্তু সে ত জানেই না কোনদিকে তাকাতে হবে। একমাত্র যখন এই ধূসর সমতলের ওপর কাল বিন্দুটা স্থির দেখা যাবে, তখন সুহাস বুঝতে পারবে-সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে।
ঐ যে, ঐ যে, আসিছে, আসিছে সুহাস দেখে সবাই তার বয়ে আঙুল দেখাচ্ছে। তাকিয়ে থেকেও সে কিছু দেখতে পায় না। কতটা দূরত্ব এই স্রোতের বিপরীতে লোক দুটোকে সঁতরাতে হবে?
সুহাসের পাশ থেকে গয়ানাথ বলে, হে-এ মউয়ামারির সীমানায় ঢুকিল। না! সুহাস বলে ফেলে, অ্যাঁ?
তখন গয়ানাথ সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, দেখিছেন ত, উমরায় আসিছে?
কোথায়?
এই যে বা হাতঠে, গয়ানাথ তার ডান হাতটা সুহাসের মুখের ডাইনে আড়াল দিয়ে বলে, এই বার এইঠে বা দিকে ঘাড় ঘুরান ধীরে-ধীরে, ঘুরান, ব্যস, দেখেন, গয়ানাথ সুহাসকে সময় দেয়, দেখিবার পাছেন?
সুহাস যেন খুব নিশ্চিত নয় এমন ভাবে বলে, হ্যাঁ—
গয়ানাথ সুহাসকে আরো কিছু সময় দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, দেখিবার পাছেন ত স্যার?
হ্যাঁ হ্যাঁ। হ্যাঁ। সুহাস তার নজর স্থির রাখে। এখন ত ওরা সাঁতরে এদিকে আসছে–তাই কালো বিন্দুটা চোখ থেকে সরে যাচ্ছে না, একবার দেখতে পেলে কিছুটা অপরিবর্তিতই থাকছে।
ঐ যেইঠে সাঁতার কাটিবার ধরিছে ওর বা হাতে, মোর বা হাতে, এই সাইডে, বলে বা-হাতটা তোলে, আঠার নম্বর দাগ মউয়ামারি মৌজা আর ডাইনে, এই সাইডে, পাঁচ নম্বর হাঁসখালি মৌজা। দুইখানই মোর দাগ। ষোল আনা নিজ খতিয়ান। ত মউয়ামারিটা বাদ দেন। ঐঠে তে মউয়ামারি শেষ হয়্যা গেইসে। কিন্তু হাঁসখালিটা ধরেন। হাঁসখালির ত ঐঠে শুরু, ঐঠে ঘুরিঘুরি চলি আসিছে। দু-জনকে এখন বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাদের হাতের আর পায়ের কোনো আন্দোলন বোঝা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের মাথা আর ঘাড়ের আন্দোলন। গয়ানাথ তার বনমোরগের গলাটাকে সবচেয়ে ওপরে তুলে, হে-এ-এ বাঘারু, বা-হাত সরি যা সরি যা, বলে ডান হাতটা নাড়ায় সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে। গয়ানাথের এত চিৎকার তিস্তার বাতাসে হুমড়ি খায় গাছের মাথায়।
দেউনিয়া, ঐ পাড়ে রংধামালির বাধে গিয়া চিল্লান, শুইনবার পাবে, এই পার থিক্যা চিল্লালে ত আপনার হাতির পাল আবার ডাইনা শুরু করবি নে–, বেশ ভারী উঁচু গলায় পূর্ববঙ্গের উচ্চারণে কথা কটি কানে আসে।
গয়ানাথ কানে নেয় না। ততক্ষণে সাঁতারু দুজনের হাতে তিস্তার জল-ছিটকনো চোখে পড়ে। গয়ানাথ আবার চিৎকার করে–সরি যা, বায়ে সরি যায়, সতের নম্বর দাগ ধর, ধর-দুজনের মধ্যে যে এগিয়ে ছিল সে সত্যি বয়ে ঘুরে যায় একটু, প্রথমে বোঝা যায় না, কিন্তু তার মাথা নিশ্চিত ভাবে বায়ে ঘোরে–ঐঠে একখান পুকুর আছে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অংশ বন্দোবস্ত, ঐঠে হাতির পাল। জল-খোয়ায় তানে আসিলে হামরালা কিছু করিম না। হে-এ-এ বাঘারু, ডাইনে ঘুর, ডাইনে ঘুর, সিধা আয়।
গয়ানাথ সুহাসকে যেন সময় দেয় সাঁতরে-সাঁতরে লোকটার ঘোরাটা দেখতে ও তার একটা আন্দাজি মাপ নিতে। তারপর বলে, এইঠে শুরু হইল স্যার, সিদাড়োবা, হাতিডোরা, বাঘাড়োবা।
গয়াডোবা–গলা শুনে সুহাস বুঝতে পারে সেই পূর্ববঙ্গের দলটা হবে। কিন্তু এই দলটা এল কখন, দেখে নি ত সুহাস, নাকি প্রথম থেকেই ওখানে ছিল–আড়ালে-আড়ালে।
শালো, তো বাপাডোবা, সুহাসের পাশ থেকেই গয়ানাথ পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচায়। ফলে যে-সমবেত হাসি ওঠে তাতে বোঝা যায় গয়ানাথের এমন আচমকা রাগে সবারই ফুর্তি।
.
০২৮.
গয়ানাথী প্রমাণ
এখন আর নদীর ভেতরে কারো খুব মন ছিল না। লোক দুটি কাছাকাছি এসে গেছে। গয়ানাথ বলে, এইবার দেখেন স্যার, আপনাকে ত দুইখান মৌজা দেখাছি, এ্যালায় দেখেন, এই মৌজার কতখানি আপনারা নদীক ছাড় দিবার ধরিছেন-হে-ই বাঘারু সিধা বায়ে চলি যা। বাঘারু সোজা বয়ে চলতে থাকে। চলতেই থাকে। সুহাস গয়ানাথের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি ওদের উঠতে বলুন, আমি আপনার পয়েন্ট বুঝেছি, কিন্তু বোঝে সে এই জায়গা ছেড়ে না গেলে গয়ানাথও তাকে ছাড়বে না, আমরা ফিরে যাব, আর ফিরে যাচ্ছেই এটা বোঝাতে নদীর দিকে পেছন ফিরে ডাকে, বিনোদবাবু।
সুহাসকে পেছন ফিরতে দেখেই ভিড়টা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। বিনোদবাবুর গলা শোনা গেল, হ্যাঁ স্যার।
চলুন, আমরা ফিরে যাচ্ছি।
হ্যাঁ স্যার।
কিন্তুক হুজুর, মোর ত প্রমাণখান দেখিলেন না, আসল প্রমাণ?
দেখালেন ত সব, আবার কী প্রমাণ? সুহাস দুই পা সরে যায়, ভিড়টাও সরে যায়, গয়ানাথও সরে আসে। তিস্তার ভেতরে দুটো লোক ভাসতে থাকে। সেটা পাছে গয়ানাথ আর সবাই ভুলে যায় সুহাস বলে, ওদের উঠতে বলুন।
কিন্তুক স্যার, আপনি ত নদীখান দেখিলেন, মোর দাগনম্বরখান দেখিলেন না।
পেছন থেকে পূর্ববঙ্গের সেই দলটি বলে, কুঁচকি পর্যন্ত দেখাইয়া ছাড়ছেন ত—
সুহাসের সামনে থেকে গয়ানাথ.ঠাণ্ডা গলায় জবাব দেয়, তোর ধোকর বাপের ঘরখান বাকি আছে রে।
নিশ্চিত ভঙ্গি বা ঠাণ্ডা স্বর বা কথাটির জন্যই এবার গয়ানাথ জিতে যায়। সমবেত হাসিতে সেই অনুমোদন থাকে। সুহাস একটু অপ্রস্তুত হয়েই বোঝে তার ঠোঁটেও হাসিই লেগে আছে। বলাটা ভাল হয়েছে।
এক মিনিট স্যার, এক মিনিট, হে বাঘারু এইঠে আসি খাড়া, এইঠে–সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে গয়ানাথ সুহাসের জন্যে দৃশ্য খুলে দেয়। সুহাস তার জায়গা থেকে নড়ে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। জলের ভেতর গয়ানাথের বাঘারু দাঁড়িয়ে। লোকটার বুক পর্যন্ত জল। মাথার চুল লেপটে আছে। এই লোকটিই কি…,আর-একজন সাঁতারু বোধহয় উঠে গেছে।
বাঘারু, এইবার হাটা ধর, সিধা হাটা ধর, জলের ভেতর বাঘারু মাতালের মত হাটে, সেটা জলের তলার অসমতলতার জন্যই হোক আর বাঘারুর ক্লান্তির জন্যই হোক।
পেছন থেকে আওয়াজ ওঠে, লেট রাইট, লেফট রাইট যেন বাঘারুকে হাঁটার নির্দেশ দিচ্ছে, লেফট রাইট।
বাঘারু এক জায়গায় ডুব জলে পড়ে গিয়েই ভেসে ওঠে। গয়ানাথ তার পকেট থেকে একগাদা দলিল বের করে বলে, এই যে স্যার, মোর খতিয়ানখান, ষোল আনির খতিয়ান। ভাজ খুলে সুহাস দেখে, এই মৌজার যে-এলাকা এখন নদীর ভেতরে তার বিভিন্ন দাগনম্বরের নানা খতিয়ান। সে দ্রুত উল্টে বলে, ঠিক আছে, আমি ত দেখলাম।
কী দেখিলেন স্যার?
আমার যা দেখার দেখলাম।
দেখিলেন ত স্যার, এ্যানং বিশালিয়া নদী, আর এইঠে ক্যানং হাঁটুজল না বুকজল। এইঠে বৃষ্টির জল আসি বসিবার ধইচছে–এইটা নদী না।
ঠিক আছে। আপনি আপনার খতিয়ানগুলো বিনোদবাবুকে দেখাবেন। আমি ত দেখে নিয়েছি। ঐ লোকটাকে মিছিমিছি অত দূর ঘোরালেন কেন, এখান থেকে বাশ ফেললেই ত আপনার কথা বোঝ যেত, নদী নয়, জল।
কিন্তু স্যার, আপনাকে ত ম্যাপের তানে সব বুঝিবার নাগিবে, তাই মৌজার আসল মাথাঠে শুরু। করিলাম। কোটত মাথা আর কোটত ল্যাজ!
সুহাস হাঁটতে শুরু করে। তাকে ঘিরে ধরা ভিড়টাও তার সঙ্গে-সঙ্গে ঘোরে। দু-পা হাঁটতেই সুহাস বোঝে সে একটা ভিড়ের মাঝখানে, ভিড়টা নড়লে তবে সে নড়তে পারবে। ভিড়টা যাতে নড়ে সে কারণে সে এগিয়ে যাবার ভঙ্গি করে। এমন সময় তার বা পাশ থেকে গলা পরিষ্কার করে একজন বলে ওঠে, স্যার, আপনার নিকট আমাদের কিছু বক্তব্য আছে।
সুহাস সেদিকে মুখ তোলে। এই জায়গা দাও, জায়গা দাও বলে পেছন থেকে কেউ ভিড় সরায়। সেই ফাঁকের মধ্যে একজন এসে দাঁড়ায় রোগা, কোরা কাপড়ের পাঞ্জাবি, বাড়িতে জলকাঁচা ধুতি, বগলে ছাতা, চুল আঁচড়ানো নেই, মুখে বসন্তের দাগ, গলায় কষ্ঠির মালা, লোকটি তার জন্যে নির্ধারিত জায়গায় এসে চোখ বন্ধ ও ঘাড় কাত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ঠোঁটে হাসির একটা ভাবও আসে। কাত ঘাড়টাই একটু নাড়িয়ে চোখ বুজেই লোকটি বলে, কথাটা হচ্ছে–আমাদের বক্তব্য এই যে মাল থানার ক্রান্তি অঞ্চলে বিভিন্ন কুখ্যাত জোতদার, যথা এই গয়ানাথ বর্মন
খবরদার রাধাবল্লভ, গয়ানাথ আবার মাটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, মোক জোতদার কহিবার চাও, কহ, কিন্তুক মোক কুখ্যাত কহিবা না।
রাধাবল্লভ চোখ না-খুলে তার দিকে ঘাড়টা শুধু ঘুরিয়ে আর-একটু হাসি দিয়ে বলে, কী কহিব না? তারপর পাশাপাশি লোকদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তার হাসিতে কোঁচকানো মুখে বোজা চোখের ভুরু নাচায়।
হ্যাঁ বলুন, সুহাস বলে, চলুন না ওখানে গিয়ে একে-একে শোনা যাবে। এভাবে শুধু শুনে গেলে কোনোলাভ ত নেই, দাগ নম্বর ধরে-ধরে কাজ শুরু করা যাক, আপনাদের বক্তব্য বলবেন, সুহাস এবার বাইরে যাওয়ার জন্য হটতে শুরু করে। ভিড়টাও তার সঙ্গে-সঙ্গে চলতে থাকে। পেছন থেকে রাধাবল্লভের গলা শোনা যায়, আমাদিগের তাহাতে আপত্তি নাই। কিন্তু এই সমস্ত কুখ্যাত জোতদার যথা গয়ানাথ বর্মন, নগেন মজুমদার, তারানাথ বসু ও নাউছার আলি ইহাদের কথা অনুযায়ী যদি সেটেলমেন্ট হয়, তবে আমরা আমাদের জমি মাপিতে দিব না।
এতজন লোক তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছিল না। রাধাবল্লভ প্রায় সুহাসের ঘাড়ের পেছন থেকে বলে যাচ্ছে। সে যে কথাটা শুরু করেছিল, সেটা শেষ করে থেমে যায়।
সগায় কুখ্যাত আর এক রাধাবল্লভ সাহা সাচা-স্যার, এই ডাকাতিয়া মানষিটার কাথা না-শুনিবেন। গয়ানাথ বলে।
সুহাস একটু সন্দিগ্ধ হয়। আসলে কি এদের জবরদখল জমি, তাই মাপতে দিতে চায় না বলে একটা ওজর দিয়ে রাখছে? কিন্তু কথাটা তুলতে চায় না বলেই কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এবার অবশ্য সরকার জোর দং, অনুমতি দং, বর্গা দং সবই রেকর্ড করাচ্ছে। শুধু খাশজমির জোর দং রেকর্ড না করার অর্ডার দিয়েছে। সুহাসের ধারণা, এ-অর্ডারও বদলাবে। প্রাইভেট ল্যান্ডের জোরদখল যদি রেকর্ড হয়, খাশ ল্যান্ডে কেন হবে না। তাই সে ঠিক করেছে শাদা কাগজে খাশজমির জবরদখলদারদের লিস্ট রাখবে।
সুহাসকে ঘিরে চলা ভিড়টার ভেতর থেকে কমরেড, কমরেড শব্দটা দু-একবার শোনা যায়। কিন্তু সুহাস বুঝতে পারে না, কে কাকে বলছে। রাধাবল্লভ কোনো পাটির লোক নিশ্চয়ই। কিন্তু কোন্। এক হতে পারে কংগ্রেস-আই। আর এক হতে পারে কমিনিস্টরা কেউ। সরকারি পার্টি ছাড়া এত জোর পাবে কোত্থেকে যে বলবে–সেটলমেন্টের শেকল ফেলে দেবে? কিন্তু কমরেড বললে ত আর কংগ্রেস-আই হবে না, যদি অবশ্য রাধাবল্লভকেই ডেকে থাকে। তাহলে কি এখানে অনেক পার্টি আছে? নাকি কংগ্রেস-আই আজকাল কমরেড বলাও ধরেছে?
এই সমস্ত দলটার পথ আটকে, সুহাসের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটি–পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভেজা, সারা গায়ে জল, পরনের কানিটা ঊরুর সঙ্গে লেপটে গেছে। লোকটা একটা ভেজা শালগাছের মত দাঁড়িয়ে থাকে–বানের জল নেমে যাওয়ার পর ডাঙা জমির একটা বিচ্ছিন্ন শালগাছের মত এই ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পাশ কাটিয়ে ভিড়টাকে এগতে হয়।
.
০২৯.
জনসমাবেশ
আদিবাসী-উপজাতি ভিড়টাকে নিয়ে সার্ভে পার্টি যখন বন থেকে বেরিয়ে আসে তখন এখানে, সার্ভে টেবিল আর গয়ানাথের চেয়ার যেখানে পাতা, একটা বেশ সাজানো-গোছানো জনসমাবেশই হয়ে আছে। সমাবেশটা লম্বালম্বিই ছড়িয়েছে। এই জায়গাটা ডাঙার ওপরে, পুবে ঢাল বেয়ে নিচু জমি, একটু দূর থেকেই কাদায় ভরা। এখান থেকে ডাঙাটা বনের পাশ দিয়ে বেঁকে-বেঁকেই সোজা উত্তর-পুবে গেছে। দেখলে মনে হয় এটা যেন ফরেস্টেরই বর্ডার, যেন এই হাত দশ-পনের জমি ছাড় দিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ফরেস্ট বানিয়েছে।
এই রাস্তার মত জমিটার ওপর মোটা মুথাঘাস অসমভাবে বেড়ে উঠেছে। ফলে কোথাও ঘাসের আস্তরণ খুব পাতলা, তলার মাটিই প্রায় বেরিয়ে পড়েছে। আর কোথাও আস্তরণ এত মোটা, যে বসলে ঘাসে লেগে থাকা জলে পেছনের কাপড় চুপসে যায়। এই রাস্তার মত ডাঙার ওপরটা পরিষ্কার, যেন যত্ন করে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হয়। দু-পাশে–ডাইনের নিচু জমিটাতে বা বায়ের ছোট নালীর ওপারে বনের গাছগাছড়ার মধ্যে লম্বা ঘাসের জঙ্গল ঘন ও বড় হয়ে উঠেছে। এ-সব ঘাসবনে বাঘ থাকে। ঝোঁপঝাড়-জঙ্গলও দুপাশে মাটি কামড়ে, গাছ কামড়ে ছড়িয়েছে, বেড়েছে। অথচ রাস্তাটার ওপর কোনো ঝোঁপঝাড় বা ঘাসবন নেই। হাতির পাল এখান দিয়ে জল খেতে আসে। ফরেস্টের নানা জায়গা। থেকে সল্ট লিক এসে এই রাস্তায় মিশেছে। এখন বর্ষাকাল। ফরেস্টের ভেতরেই জল পাওয়া যায়। কিন্তু হাতির পাল অভ্যাসে কখনো কখনো আসা যাওয়া করে। আর সেই আসা যাওয়ায় এই রাস্তার মত ডাঙা পরিষ্কার হয়, হাতির পাল লম্বা নালীঘাস খেয়ে আর ঝোঁপঝাড় মাড়িয়ে সাফসুরত করে দিয়েছে। কিন্তু হাতির শুড়ের নাগালের বাইরে একদিকে ফরেস্টের আর-একদিকে নিচু জমির ঢালে সেই লম্বা নালীঘাস বেড়ে উঠেছে। হাতির পাল ঐটুকু নালী পেরতেও পারে না, আবার ঢাল বেয়ে নীচে নামতেও পারে না।
এখন এই হাতি-লাইন জুড়ে সেই মানুষজন লম্বা হয়ে ছড়িয়েছে। একটু দূরে আপলাদের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা ওদলাবাড়ি গিয়ে ন্যাশন্যাল হাইওয়ের সঙ্গে মিশেছে সেই পাকা রাস্তার ওপরই একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে–আনন্দপুর চা বাগানের। আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অ্যামবাসাডার আর-একটু এগিয়ে। দুই গাড়ির বাবুরা ও সাহেবরা কেউ গাড়ির ভেতরে বসে; কেউ গাড়িতে হেলান দিয়ে, কেউবা গাড়ির ওপর পা তুলে দিয়ে বাইরে, দাঁড়িয়ে। দুই গাড়ির মাঝখানের জায়গাটাতে ঢালের ওপর পা ছড়িয়ে ড্রাইভাররা ও একজন গার্ড গল্প করছে। গার্ডের পিঠে বন্দুক ঝোলানো। দুটো গাড়ির দাঁড়াবার জায়গা থেকে ফরেস্টের দিকে একটা এরকমই পরিষ্কার সল্ট লিক ভেতরে ঢুকে গেছে–সেই ফাঁকাটাতে দুটো-একটা ভাঙা গাছ ছাড়া গাছগাছড়া নেই, সামান্য একটু ঝোঁপঝাড় কোথাও-কোথাও। অনেক দূর পর্যন্ত এই এত ঘন সবুজ শূন্যতা দেখতে কেমন লাগে। ঠিক সল্ট লিকটার মুখে একদল মদেশিয়া বসে, গোল হয়ে। তাদের কারো পরনে গামছার মত রঙিন কাপড়ের ফালি, কারো পরনে হাফপ্যান্ট। কারো উদোম গা, কারো স্যান্ডো গেঞ্জি–ধবধবে, দু-একজনের গোলগলা নাইলনের। অনেকের হাতে ছোটখাট লাঠি।দু-জনের কাঁধে ছোট কুড়ল ঝোলানোকুড়লটাই আংটার মত ঘাড়ে লাগানো।
এই মদেশিয়ার দল আসল ভিড়টা থেকে একটু দূরেই আছে–সামনে যেখানে ম্যাপ-চেয়ার-টেবিল, সেখান থেকে। তারপর খানিকটা ঝোঁপ পেরিয়েই সেই জায়গাটি যেখান দিয়ে সার্ভে পার্টি ঢুকেছিল। এই এত মানুষের পায়ের চাপে জলেভেজা ঘাসগুলোর ওপরও যেন পায়ে চলা পথ তৈরি হয়ে গেছে। নেপালিদের একটা দল গলিটার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, এখন সেখান থেকে সরে উল্টোদিকে এল। সকালে শুরুতে লোক ছিল না। তখন যেন, চায়ের দোকানটা বেশ দূরেই ছিল। কিন্তু এখন চায়ের দোকানটার সামনে-পাশে দুদিকেই মানুষজন। জ্যোৎস্নাবাবুও ঠিক এর পাশেই তার সেরেস্তা খুলে বসেছেন। ফলে সবচেয়ে বেশি ভিড় এই জায়গাতেই। চওড়া জায়গাটার ঠিক মাঝখানে চরের কৃষকদের একটা বিরাট দল বসে আছে। চা খাচ্ছে, বিস্কুট খাচ্ছে। দেখে মনে হয় তারা যেন এখানে সারাদিন থাকতেই এসেছে।
.
০৩০.
কৃষক সমিতির ‘প্রোগ্রাম’
দলবল নিয়ে রাধাবল্লভ এসে এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ায়।
তার বা বগলে ছাতা, ডান হাতটা মাথার ওপরে কনুইয়ে ভাজ ফেলে, ডান হাতের আঙুলগুলো ঘাড়ের কাছে, চোখদুটো প্রায় সব সময়ই বোজা, বোধহয় কোনো অসুখ আছে, চোখের কোণে ময়লা জমে।
সকালে দলবল নিয়ে সার্ভের জায়গায় পৌঁছতে দেরি হয়ে যাওয়ায় রাধাবল্লভ যেন ঠিক ভূমিকা পাচ্ছে না। এমনকি জুতমতো একটা দাঁড়ানোর জায়গাও পাচ্ছে না। ঠিক ছিল, সকালবেলা এখানে ঝাণ্ডা গেড়ে, ভোটর দিন বুথ অফিসের মত একটা অফিসই খোলা হবে, চাটাই-মাদুর পেতে। অন্তত একজন উকিল বা মোক্তারবাবু যাতে অবশ্যই আসেন, কাল কোট আর শাদা প্যান্ট পরে, সেই ব্যবস্থা করতে শহরের পার্টি অফিসে দুদিন আগে তোক গিয়েছিল। শহর থেকে বলেও ছিল, নিশ্চয়ই পাঠাবে। সকালে এখানে একটা ঝাণ্ডাটাণ্ডা নিয়ে অফিস করে বসলে, তাতে উকিল বা মোক্তার একজন থাকলে, লোকজন বুঝত তাদের জোরও আছে, আইনও আছে।
ঠিক ছিল, সার্ভে শুরু হওয়ার আগেই শ্লোগানটোগান দিয়ে রাধাবল্লভ একটা বক্তৃতা করবে। বক্তৃতায় এখানকার কুখ্যাত জোতদারদের নাম বলবে ও অফিসারদের সাবধান করে দেবে যে এদের সঙ্গে যেন কোনো আপস করা না হয়। তা হলে কৃষক সমিত এই জরিপের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ এই সেটেলমেন্টকে কৃষকদের ও আধিয়ারদের পক্ষে প্রথম থেকেই নিয়ে আসতে হবে। আরো সব বক্তৃতায় সারা দিন ধরে এখানকার চা বাগানের জোতদারি, ফরেস্টের জোতদারি, খাশজমির দখলদারি নিয়ে সব বলবে–কিন্তু ধীরে-ধীরে। প্রথমে শুধু সাবধান করে দেবে, তারপর আবার শ্লোগান হবে। হৃষীকেশ বলেছিল, শুধু শ্লোগান কেউ শোনে না, গানও হওয়া চাই। তা করো, তুমি গান বাঁধো আর গাও, ভালই ত, অফিসার বুঝিবে আমরা গানও জানি।
কিন্তু তাদের পৌঁছতে-পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ভগতের এঁড়ে বাছুরটা কাল রাত্তিতে ফেরে নি–সন্ধ্যায় আনতে গেলে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। সেটাকে খুঁজে বের না করে আর সার্ভের এখানে আসে কী করে। গরু অবশ্য পাওয়া গেল পাশের বাড়িরই একজনের গোয়ালে। ভগতের বাছুর চিনে সে রাত্রিতে রাস্তা থেকে বেঁধে এনে রেখেছে। কিন্তু দেরি যখন হয়েইছে তখন জলপাইগুড়ির প্রথম বাসটাতে, উকিল-মোক্তার যেই শহর থেকে আসুক, তাকে নিয়েই ক্যাম্পে যাওয়া ভাল। সেবাসে কেউই এল না। হৃষীকেশ ঠাট্টা করে বলল, ভগতের কোটটা মুই পড়ি যাছ, উকিলের নাথান লাগিবে। ভগতের একটা কাল, কোট আছে–সারাটা শীতকাল নেংটির ওপর সেই কোটটা পরে থাকে।
ওরা দলবল নিয়ে যখন ক্যাম্পে পৌঁছেছে তখন ক্যাম্প পার্টি বনের ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। ওদের ঝাণ্ডা গাড়াও হল না, বক্তৃতাও হল না, শ্লোগানও হল না, গানও হল না। গয়ানাথ যখন বাঘারুকে। ডাকতে এল তখন যেন ওরা এতক্ষণের অপেক্ষার পর হাতে শিকার, পেলবনের মধ্যে গয়ানাথের সঙ্গে অফিসার একা-একা কী করে। ওরাও সকলের সঙ্গে বনের মধ্যে ঢুকল। তারপর ওখানেই রাধাবল্লভ বক্তৃতাটা শুরু করেছিল, প্রোগ্রামের বক্তৃতা অংশটা অন্তত হোক, কিন্তু তখন সবাই বেরচ্ছে। বক্তৃতাটা শেষ হল না। বন থেকে বেরনোর মুখটিতে আবার সেই বক্তৃতাই শুরু করেছিল একটু। কিন্তু তাদের পাশ কাটিয়ে আর-সবাই যে-যার মত বন থেকে বেরিয়ে যায়। তখনো বক্তৃতাটি শেষ হল না। এখন দলবল নিয়ে রাধাবল্লভ এই আসল জায়গাটিতে ঢুকল। ওপরে নীচে তাকিয়ে সে পুরো জায়গাটি, সেই তিস্তাপাড় থেকেঐ ওদলাবাড়ি রোড পর্যন্ত, একবার দেখে–ঐ সীমায় মোটরগাড়ি, জিপগাড়ি, আর, এই সীমায় সার্ভের টেবিলচেয়ার।
চায়ের দোকানের সামনে এসে ওদের দলটা দাঁড়ায়। একে চায়ের দোকানের ভিড় উপচে পড়েছে। তার ওপর চরের লোকজন এসেও ওর সামনেই বসেছে। তদুপরি জ্যোৎস্নাবাবু–আমিন। ফলে ওরা আর এগতেই পারে না প্রায়। রাধাবল্লভ চায়ের দোকানের দিকে পেছন ফিরে জমির ঢাল দিয়ে সোজা পুরে তাকিয়ে থাকে। তার বগলের ছাতাটা নামায় না। ডান হাত দিয়ে একবার চোখ মোছে। বুদ্ধিমান এদিক-ওদিক ঘুরে রাধাবল্লভের পেছনে এসে বলে–কমরেড় লেকচার এইখানেই দাও, এত লোক, ঠিক শুনিবার পাবে, চাও খাছে, কায়ও নড়িবে না, শুনিবার হবে। বলে বুদ্ধিমান আবার হে হে করে হেসে হাততালি দেয়, যেন এই এতগুলি লোককে সেই বুদ্ধি করে এখানে নিয়ে এসে আটকে রেখেছে, এখন কমরেড বক্তৃতা শুরু করলেই হয়। বুদ্ধিমানের ডাকে রাধাবল্লভ ফেরে না। রাবণ এক গ্লাশ চা এনে রাধাবল্লভকে ধরিয়ে দেয়। রাধাবল্লভ সন হাতে চাটা নিয়ে চুমুক দেয়। তারপর বগল থেকে ছাতা না-সরিয়েই বা হাতটা দিয়ে পকেট ঝাঁকিয়ে দেখে পয়সা আছে কি না, একটা পান খেলে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আলবিশ ভগত আর হৃষীকেশ চা খাচ্ছে। হৃষীকেশ ত কোথাও চুপ করে থাকতে পারে না ওখানেই চেঁচামেচি শুরু করেছে।
চা খাওয়া শেষ হলে আলবিশ এসে রাধাবল্লভের কাছে দাঁড়ায়। আলবিশ ভগত পুরোহিত। তাই মাছমাংস খায় না, চুলগুলো কানের দুপাশ দিয়ে কাঁধের ওপর থোকায়-থোকায় পড়েছে। কপালটা বড়। চুলে নিয়মিত তেল ও চিরুনি দেয়। দাড়ি বোধহয় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কম থাকায় দেখার মত হয়ে ওঠে না। জুলপির কাছ দিয়ে খানিকটা নেমে এসেছে আর গোফটা ঠোঁটের ওপর ছেড়-ঘেঁড়া হয়ে ঝুলে আছে। আলবিশের চোখদুটো আর সামনের দাঁতগুলো বড় বড়। সে যখন কথা বলে তখন তার ঘাড়টা সামনে দোলায় আর দাঁতগুলো বের করে চোখটা নাচায়। হে কমরেড, তা এইখানে একখান লেকচার ঝাড়খে চলো, আলবিশ আবার ঘাড় দুলিয়ে হাসে, লেকচার ঝাড়খে, ঘরকে চলো।
আলবিশের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাধাবল্লভ বলে, তোমার এখন ঐ এক কথা। ঘর চললে এখন কী হবে। এমনিই ত আমরা দেরি করি ফেলিলাম। এখনো ত আমাদের বক্তব্য বলাই হল না।
তব বোল কোরো কেনে, বক্তব্য বোল্ কোরো, বলে ভগত একটু সরে যায়। ইতিমধ্যে বুদ্ধিমান ও হৃষীকেশ আসে। বুদ্ধিমান বলে, কমরেড, এইখানে মিটিংখান শুরু করি দাও। হৃষীকেশ কোনো কথাই গোপনে বলে না, চিৎকার করে চার পাশে তাকিয়ে, এক হাতের তালুর ওপরে আর-এক হাতের মুঠোতে ঘুসি মেরে বলে, কমরেড, মিটিংখান শুরু করি দাও।
হৃষীকেশের চেহারা শৌখিন। তার পরনে শার্ট, আর নাইলনের প্যান্ট। পায়ে স্যান্ডেল–চামড়ার। বাগানের এক বাবুর কাছ থেকে সেলাইমেশিন জোগাড় করে লাটাগুড়ি হাটে হৃষীকেশ একটা দর্জির দোকান দিয়েছে। সেটাই তার প্রধান পেশা, এখন। ব্যাঙ্কের লোন পেলে একটা মেশিন কিনবে আর শিলিগুড়ি থেকে কারিগর আনবে। বছর বিশপঁচিশ আগে লাটাগুড়িতে খাশজমির দখলে হৃষীকেশের বাবা ছিল। হৃষীকেশের বাবা মারা গেছে অনেকদিন, সে-জমি অবশ্য দখলে আছে হৃষীকেশ ও তার দাদার মধ্যে দুই ভাগে। হৃষীকেশের ভাগে এখন আধি। সে চাষ করে না বটে কিন্তু তাই বলে কৃষক সমিতি ত আর ছাড়ে নি। কমরেডের সঙ্গে সার্ভে ক্যাম্পে এসেছে-কৃষক সমিতির দাবিদাওয়া নিয়ে। একটা গানও তৈরি ছিল-শখের নাটক আর গানে হৃষীকেশের দারুণ নেশা। কিন্তু আজ আর গানটা গাওয়ার কোনো সুযোগ পাবে মনে হয় না। হৃষীকেশ রাধাবল্লভকে বলে, ঐখানে যেটুকু বলা হইছে–তার পর থিকা বলেন।
রাধাবল্লভ জিজ্ঞাসা করল, বলব?
বুদ্ধিমান বলে, বলেন, বলেন, তাড়াতাড়ি বলেন। সগায় বসিসি চা খাছে, এখন বসিসি শুনিবে। বলেন।
১.৪ রাধাবল্লভের বক্তৃতা
রাধাবল্লভ ছিল চায়ের দোকানের দিকে পেছন ফিরে। সে চায়ের দোকানের দিকে ঘুরল। তার বা বগলে ছাতা ত প্রায় সেঁটে আছে। ডান হাতটা তুলে মাথার ওপর কনুইয়ের ভাজ ফেলে আঙুলগুলো নিয়ে এল ঘাড়ে, মাথার পেছনে। রাধাবল্লভ চোখ বন্ধ করে, ঘড়িটা একদিকে হেলাতেই হৃষীকেশ পাশ থেকে বলে, রিপিট দিবেন না, যা বলা হই গিছে তার পর থিকা বলেন–
যেন এই কথার জবাবেই রাধাবল্লভ শুরু করে, কথাটা হচ্ছে আমাদের এই মাল-লাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে বহু কুখ্যাত
এই পার্টটা ত হয়া গিছে কমরেড।
রাধাবল্লভ চোখ খোলে, আমাকে বলতে দাও হৃষীকেশ।
বলেন, কিন্তু রিপিট দিবেন না।
রাধাবল্লভ আবার চোখ বন্ধ করে। সামান্য সময় নিয়ে ঘাড় হেলিয়ে শুরু করে, কথাটা হচ্ছে আমাদের এই মাল-লাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে বহু কুখ্যাত জোতদার আছে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য কৃষকদের শোষণ করা। কিন্তু কথাটা হচ্ছে কেন? ধরেন, আনন্দপুর চা বাগানের জোতের জমিও আছে, চায়ের জমিও আছে। কিন্তু এই মালিকলোক চায়ের জমিতে ধান চাষ করেন আর ধানের জমিতে চা চাষ করেন। এই মালিকলোক চা বাগানের মজুরদের দিয়ে ধান চাষ করান আর জমির আধিয়াদের দিয়ে চা বাগানের কাজ করান। কিন্তু এই কৃষকরা মজুরদের মতন মাহিনা পায় না। ঠিকা মজুরি পায়। আর মজুররাও কৃষকদের মতন আধি-ভাগ্য পায় না। মজুরির পয়সা পায়। কোম্পানির সব দিকেই লাভ-জোতদারিতেও লাভ, ডিরেক্টরিতেও লাভ। আর মজুর-কিষানের সব কিছুতেই ক্ষতি মজদুরিতেও ক্ষতি, হালুয়াগিরিতেও ক্ষতি রাধাবল্লভ, বোধহয় দম নেয়ার দরকারেই একটু থামে, সেই ফাঁকে হৃষীকেশ বলে, এ কোন লেকচার দিছেন কমরেড, ই ত মজুর কৃষককের মিটিং না হয়, সার্ভের, জমির সার্ভে হছে, জমির কথা কহেন, হৃষীকেশের কথা শুনেই হয়ত, বা হয়ত জমির কথাতে কিছুতেই আসতে পারছিল না বলেই রাধাবল্লভ জোর করে একটা বিরতি নিয়েছিল, আবার শুরু করেই সে সরাসরি জমির কথাতে চলে আসতে চায়, আগের কথার প্রসঙ্গসূত্র ছাড়াই।
আমরা কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে সমস্ত জমির বন্দবস্ত চাই কৃষকের স্বার্থে। যে কৃষকরা খাশ জমি দখলে রেখে চাষ করিছেন, জোতদারের লাঠিগুলি, পুলিশের অত্যাচার, জেল-মামলা-মোকদ্দমা সহ্য করিছেন, তাদের সেই সব জমিতে বন্দোবস্ত দিতে হবে। যে কৃষকরা ফরেস্টের জমি দখলে রেখে চাষ করিছেন, যেখানে শুধু ছিল হায়-হায়-পাথার, সেখানে বানি দিছেন হলহলা ধানের খেত, সেই সব জমি দখলদার কৃষকের নামে বন্দোবস্ত দিতে হবে। কিন্তু ফরেস্টের জমিতে যে-সমস্ত জোতদার চাষ করে তাহাদের হাত হইতে এই সব জমি কাড়ি লইয়া হালুয়া-আধিয়ারের মধ্যে বিলি করিতে হইবে। রাধাবল্লভের কথাগুলিতে আবেগ সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছিল–তাদের কৃষক সমিতির প্রত্যক্ষ নানা অভিজ্ঞতার স্মৃতির আবেগ। আর সেই আবেগের টানে, স্মৃতির প্রবলতায় কেমন অবান্তর হয়ে যায় তার নানা বক্তব্যের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নানা যুক্তি। তার অব্যবহিতকে রাধাবল্লভ চরম গুরুত্বেই সামনে এনে দেয়–যুক্তির পরম্পরায় নয়, অভিজ্ঞতার সবল চাপে। সে একটু ধামে। আপাতত মনে হয় বটে, দম নেয়ার জন্যে, কথাটা শুনে বোঝা যায় সে আর-একটি সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে।
আর আমাদের একটি বিশেষ বক্তব্য আছে চরুয়াভাই কৃষকদের উদ্দেশ্যে। আমাদের এই তিস্তানদীর স্রোত সব সময়ই বদলায়। আজ যেটা কায়েম, কালি সেইটা চর। তাই জোতদারের দল তাদের জমি তিস্তার ভিতর গেলেও সেইখানে দখল রাখে। চরজমিতেও সাধারণ কৃষক দখল পায় না। আবার অন্যদিকে তিস্তার এমন-এমন চর আছে, যাহা শক্ত পাকা, নদীতে ভাসিবার কোনো আর ভয় নাই, কায়েমের থিকাও কায়েম। কিন্তু সরকারের নিয়ম যে পঞ্চাশ বছর ধরি চর যদি চর না থাকে তাহা হইলে কায়েম বলিয়া ডিক্লেয়ার হইবে না। সেই সুযোগে আমাদের পূর্ববঙ্গের হিন্দুভাইগণ আসিয়া এই তামান-তামান চর জমি চাষ করিবার ধরিছেন। যেইঠে আছিল ভামনি বন, বাঘের বাসা সেইঠে এখন ধান, পাট, তরকারি, তরমুজ হছে। কিন্তু এই পূর্ববঙ্গের ভাইরা আমাদের এইঠেকার রাজবংশী আর মদেশিয়াদের চরে ঢুকিতেই দেন না। যেন চরটা একটা
যে-বিরাট দলটা ছড়িয়ে বসে চা খাচ্ছিল তাদের ভেতর থেকে একজন লাফিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে, এই শালা সাহা, চরের কথা এইখানে তোলার তুমি কে?
হৃষীকেশ এদিক থেকে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, খবরদার, লেকচার থামানো চলিবে না। হৃষীকেশের চিৎকার শেষ না-হতেই বুদ্ধিমান চিৎকার করে শ্লোগান তোলে ইন-কি-লাব, আর অত ভিড়ের ভেতরে নানা জায়গা থেকে অনেক হাত ওপরে ওঠে, কোনো-কোনো হাতে চায়ের গ্লাশও ধরা, জিনদাবাদ।
চরের দলের ভেতর থেকে একজন এক লাফে বুদ্ধিমানের সামনে এসে পড়ে–শালা। বুদ্ধিমান পাল্টা আক্রমণে প্রায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, শা-লো। কিন্তু কেউই কারো গায়ে হাত দেয় না। দুজন মুখোমুখি, গায়ে গা লাগিয়ে প্রায়, দুর্গা ঠাকুরের অসুরের ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন যে-কোনো মুহূর্তে মারামারি বাধবে।
এত গোলমালের ভেতর রাধাবল্লভ চোখ খোলে, মৃদু হাসিতে ডান হাতটা তুলে বাইকে বলে, আপনারা শান্ত হন। শান্ত হন। কথাটা হচ্ছে এই মারামারিতে কার লাভ হইবে? কথাটা হচ্ছে। আমাদের এই মাললাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে অনেক কুখ্যাত জোতদার–
যে-লোকটি বুদ্ধিমানের সামনে লাফিয়ে পড়েছিল সে একটা পাল্টা লাফে রাধাবল্লভের দিকে ফিরে বলে, সে জোতদার-টোতদার নিয়্যা যা কওয়ার কও। চর নিয়্যা কিছু কওয়া চইলবে না। চরে জোতদারও নাই, আধিয়ারও নাই, সেটেলমেন্টও নাই, পাট্টাও নাই।
রাধাবল্লভ আবার তার ডান হাতটা তোলে, আপনারা শান্ত হন, কথাটা হচ্ছে চরের বা বাগানের কথা নয়। কথাটা হচ্ছে গত সেটেলমেন্টের পর আমাদের এই মাললাটাগুড়ি-ক্রান্তি এলাকায় অনেক ছু হইয়াছে, ফ্লাডও হইয়াছে, চরও জাগিছে, ফরেস্টও হইছে, জমিও হইছে, নদীও হইছে
হ্যাঁ, ঐ সব বলল সাহা, ফরেস্ট বলল, জোতদারও বলল, চরফর তুইলব্যা না, চরে শালা তোমার কৃষক সমিতি করা চইলবে না।
চরে জমি আছে আর চাষি আছে, চরের দলের ভেতর থেকে চিৎকার করে একজন বলে।
খবরদার। কৃষক সমিতির কথা তুলিলে জিভখান টানি লিব বলে হৃষীকেশ হঠাৎ লাফ দিয়ে ঐ দলটার সামনে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে আলবিশ লম্বা হাত বাড়িয়ে তার পাট-পাট বাবরি ছুঁতেই সে বসে পড়ে।
শালো, কার কথা, কী কথা কুছু শুনবেক নাই, চিল্লাখে ত চিল্লাখে।
যে-লোকটি কৃষক সমিতির কথা তুলেছিল চরের দলের কেউ তার মাথায় চাটি মারে, ঠিক আছে, সাহা, বলো বলল।
কথাটা হচ্ছে, আপনারা জানেন এইবারের, সেটেলমেন্ট কৃষকের স্বার্থে করিতে হইবে।
ঠিক কথা, সাহা, শালা জোতদারগুলাক ঠ্যাঙাও আর জমিগিলা খালাশ করো।
রাধাবল্লভ হঠাৎ থেমে যায়, যেন সে বক্তৃতাটা থামিয়ে দিল মনে হয়। কিন্তু বক্তৃতাটা থামার মত জায়গায় আসে নি। সবাই রাধাবল্লভের মুখের দিকে তাকায়। রাধাবল্লভ হাসার চেষ্টা করছিল।
রাধাবল্লভ জোরে হাসতে পারে না। তার ব্রণের আর বসন্তের দাগভর্তি মুখে অসংখ্য কুঞ্চন দেখা যায়। তারপর, তার নীচের ঠোঁটটা বিস্ফারিত হয়। পান-খাওয়া জিভ আর দাঁত বেরিয়ে পড়ে। রাধাবল্লভ তার মুখের ওপর ডান হাতটা বুলিয়ে বলে, এইটা খুব মজার কথা হইছে, মজাটাতে তার এত. হাসি আসে যে তাকে আবার মুখেচোখে হাত বোলাতে হয়, জোতদাররা কয়, চরের কথা বলো, আর চরুয়ারা কয়, জোতদারের কথা বলো-।
হাসির ঝোঁকে রাধাবল্লভ চোখ ঢেকে মাথা নাড়ায়। আর চরের দলটাই হাততালি দিয়ে ওঠে।
বক্তৃতা থেমে যাওয়া, রাধাবল্লভের গলার স্বর নেমে আসা, হাসাহাসি, হাততালি–এতে আলবিশের মনে হয় বুঝি বক্তৃতা শেষই হল। সে তাড়াতাড়ি একটা পান এনে পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে রাধাবল্লভকে দেয়। রাধাবল্লভ পানটা মুখে দিয়েও হাসতেই থাকে। তার ছোট শীর্ণ ঐটুকুমুখে অত বড় পান আর অতটা হাসি একসঙ্গে আঁটে না। থামানো লেকচার শুরু করা, পুরো হাসিটা হাসা আর পানটাকে চিবিয়ে দলা করে এক গালে ঠেলে নেয়া–এর ভেতরে যেটুকু সময় চলে যায় তাতেই যেন রাধাবল্লভের লেকচারটা শেষ হয়ে গেল বলে সবাই ধরে নেয়। আবার শুরু করতে হলে, রাধাবল্লভকে গোড়া থেকে ধরতে হবে।
রাধাবল্লভ হাসি মিশিয়ে পান চিবয়।
.
০৩২.
হৃষীকেশের গান
হৃষীকেশ সেই যে নীচে বসে পড়েছিল আর দাঁড়ায় নি, সেখানেই-উটকো হয়ে বসে আছে। ঐ বিরতির সুযোগে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল; চরের জমিতে জোতদারও নাই, আধিয়ারও নাই, শুধু গুড় আছে, চাটো আর চাটো, চাটো আর চাটো–
বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রার কুজা মন্থর মত দু-চার পা হাঁটে। তাতেই সবাই বোঝে হৃষীকেশ অভিনয় করবে, সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। পিঠ নুইয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হৃষীকেশ, সেই চরের দলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর তাদের সামনে লম্বা জিভ বের করে হাতটাচাটার ভঙ্গিতে জিভের সামনে ওঠায়নামায়। যারা দাঁড়িয়েছিল বসে পড়ে। এই রিশিকেশ ঘুরে-ঘুরে। হৃষীকেশ হঠাৎ তার পেছনটা অনেক উঁচুতে তুলে দেয়, সেই উঁচু পেছন থেকে গড়িয়ে যেন পিঠটা নেমেছে, মাথাটা আরো নীচে, কিন্তু মুখটা ভোলা, তাতে জিভ বের করা। এটা হনুমানের লঙ্কাপোড়ানোর ভঙ্গি। তখন একটা বিরাট লেজ থাকে–পোয়াল দিয়ে মুড়ে-মুড়ে বানানো। হৃষীকেশ তার উঁচু পেছনটাকে আরো উঁচু করতে ও বেতালে নাচাতে পারে, একবার বায়ে, আর-একবার ডাইনে, দু-একবার দুটোই সমানে। এতে তার খুব নাম। হৃষীকেশ এবার তার পেছনটাকে চরের দলটার সামনে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড দুলিয়ে লাফিয়ে ঘুরে যায় আর হাতটা জিভের সামনে এদিক-ওদিক চাটা:ভঙ্গিতে ঘোরায়। চরের দলের একজন হৃষীকেশের পেছনে মারার জন্য একটা লম্বা লোমশ পায়ে লাথি ঘেঁড়ে কিন্তু হৃষীকেশ এমন পিছলে যায় যে লাথিটা লাগে না। লোকটার পা আছড়ে পড়ে। হৃষীকেশ আবার তারই সামনে পেছনটা ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। সমবেত হাসিতে আর হাততালিতে লড়াইটা জমে ওঠে। আর, ঐ লোকটির পা-চালানো আর তারই মুখের ওপর হৃষীকেশের পেছন-ঘোরানোতে ব্যাপারটাতে যেন নাটকীয়তাই এসে যায়। হৃষীকেশ হঠাৎ মুখ তুলে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে, কহেন আপনারা, এইটা কি চাটিবার ধইচছি আমি? এইঠে এক চাট, আবার ঐঠে এক চাট, কহেন, আপনারা।
হৃষীকেশ আবার হাতচাটার ভঙ্গিটা তার চারপাশে জমা ভিড়টাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। আর মাঝেমধ্যে বলে, কহেন আপনারা, এইটা কিসের চাটন? এক-একবার জিজ্ঞাসা করে আর তার পেছনটা উঁচু হয়ে দোলে। শেষে চরের দলটার সামনে একবার চাটন দেখিয়ে, আর-একবার পেছন নাচিয়ে হৃষীকেশ বলে, এইঠে চাটিলেও মিষ্টি, ঐঠে চাটিলেও মিষ্টি, য্যানং মোর আখি গুড়ের গজা, আর? আর? কহেন আর কী?
হৃষীকেশ গানের ঝোঁকে সোজা হয়ে এক পাক ঘোরে, আর জিজ্ঞাসা করে। ও এমনি ঘুরতে-ঘুরতে গানের পরের লাইনটার মিল খুঁজছে। দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যেও প্রত্যাশা তৈরি হয়ে উঠছে–একটা লাগসই পরের লাইনে গানটা পুরো জমে উঠবে। হৃষীকেশ ঘুরতে-ঘুরতে আবার চরের দলের সামনে এসে পড়ে।
হৃষীকেশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, এক হাত কানের পাশে দিয়ে, আর-এক হাতে ঠোঁটটা ঢেকে চরের দলটার দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে গান ধরে
ও-ও। আমার চরুয়া-হালুয়া ভাই।
তোর গুণের সীমা নাই।
তোর এতোখান জমিতে ভোখো না মেটে
তোর প্যাটের সীমা নাই।
ও-ও আমার চরুয়া-হালয়া ভাই।
তোর প্যাটের সীমা নাই
তোর গলার তলায় প্যাটখান শুরু
হাঁটুর তলায় যায়।
চারদিকে হাততালির তুমুল সমর্থন। হৃষীকেশ থেমে সকলের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু-একটু ঝাঁকিয়ে অভিনন্দন নেয়। পাট-পাট করা বাবরি চুল, ঝকঝকে সঁহ্যাঁত, সুপুষ্ট মুখে তাকে বেশ পেশাদার গায়কই মনে হয়। গানটা সে শুরু করে রাজবংশীদের প্রচলিত সুরেই প্রথমে একটা খুব বড় টান দিয়ে, এক-একটা নিশ্বাসের ঝোঁকে-ঝোঁকে। চরের দলের ভেতর থেকেই একজন একটা সিগারেট ছুঁড়ে দেয়। হৃষীকেশ লুফে নিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।
এরকম একটা গানের আসর বসে যাওয়ায় সবাই এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে-দেখতে একটা যেন পালাগানের মত ভাবই ধরে। সেই ভিড়ের ভেতর রাধাবল্লভ আলবিশও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, শুনছিল। পেছন থেকে কেউ একজন একটা লাঠি দিয়ে আলবিশকে খোঁচা মারতেই আলবিশ পেছন। ফিরে তাকায়। লোকটি রাধাবল্লভকে দেখিয়ে আলবিশ আর রাধাবলভকে বাইরে আসতে বলে। ওরা দুজন যখন দেখি দেখি বলে বেরচ্ছে, হৃষীকেশ ওদের গলা শুনে দাঁড়িয়ে উঠে তাকাতেই চরের দলের একজন উঠে হৃষীকেশের হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, এই পুঙ্গির ভাই, থামবি না, গান যখন শুরু করছিস শেষ করতি হব। হৃষীকেশ দেখে আলবিশ আর রাধাবল্লভ ভিড় থেকে বেরিয়ে গেল, কিছু বলল না। সে আবার সকলের মুখের সামনে নিজের প্রসারিত হাতটা ঘুরিয়ে এক পাক ঘুরে আসে।
আ-আ মুই একি করলু রে
মোর চরুয়াহালুয়া ভাই
তোর সাথে মুই বিয়া বসিলু
বাসর হইল নাই।
চারপাশের ভিড়টা জমাট বেঁধে যায়। অভিজ্ঞতায় তারা টের পেয়ে যায় হৃষীকেশ গানের নিয়ম অনুযায়ীই চরম বিন্দুর দিকে যাচ্ছে। হৃষীকেশ শেষ লাইন দুটো বার দুই গেয়ে ও গানের মুখে ফিরে গিয়ে কৌতূহলটাকে আরো বাড়ায়। এবার বেশ মোটা পেট নিয়ে হাঁটার ভঙ্গি করে ও প্রথম স্তবকটা ফিরে গায়। তারপর একটুও বিরতি না দিয়ে হঠাৎ ধরে বসে,
ও-ও-রে নিঠুর চরুয়া-হালুয়া রে-এ
তোর প্যান্টের তলায় প্যাট ডংডঙাছে
খাড়া কিছুই নাই
এতক্ষণে যেন পুরো গানটা তার প্রত্যাশিত চরম বিন্দুতে ওঠে। হৃষীকেশ ডান হাতটা সামনে নিয়ে কনুই থেকে আঙুল পর্যন্ত ঝুলিয়ে দোলায় আর ঘুরে ঘুরে গায়
তোর প্যাটের তলায় প্যাট ডংডঙাছে।
খাড়া কিছুই নাই
আর তার এক পাক ঘোরার মধ্যে হাসিটা যখন ছড়িয়ে পড়ছে আর উঁচুতে উঠছে তখন সেই চরের দলটার কাছে পৌঁছে হৃষীকেশ নিজের দুই পেটে দুই হাত দিয়ে চরম দুঃখের অভিনয়ে ডুকরে ওঠে
ও-ও রে মোর চরুয়া-হালুয়া রে-এ
মোর প্যাটের ভোখোত মিটাইলি রে
(কিন্তুক) মোর তলপেট ভরে নাই
তলপেট চেপে ধরে ডুকরে কান্নার স্বরে হৃষীকেশ ঘুরে যায় মোর তলপেট ভরে নাই, আর কিছুটা এরকম ঘুরেই হঠাৎ সোজা হয়ে এক হাত মাথার ওপরে, আর এক হাত কোমরে দিয়ে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গেয়ে যায়, মোর তলপেট ভরে নাই, মোর তলপেট ভরে নাই; তারপর ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে এক পা, হাঁটুতে ভাজ ফেলে সামনে ছড়িয়ে, আর এক পা পুরো ভাজ করে, কাওয়ালির ঢঙে বাহাত কানের পাশে নিয়ে ডান হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে কাধ থেকে কনুই পর্যন্ত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দ্রুত লয়ে গেয়ে ওঠে, তলপেট ভরে নাই তলপেট ভরে নাই। চারপাশের সবাই তার গান ও ভঙ্গির তালে হাততালি দিয়ে দিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুত লয় বাড়াতে থকে। বাড়াতে বাড়াতে এক সময় সুরটা চরমে উঠে একটা চিৎকারে শেষ হয়ে যায়। হৃষীকেশ মাটি থেকে উঠে পকেট থেকে সেই সিগারেটটা বের করে ধরায়। তারপর এক মুখ হাসি নিয়ে চরের দলটার দিকে তাকিয়ে ধোয়া ছাড়ে।
.
০৩৩.
কৃষক-মজুর : আলোচনা
হৃষীকেশের গান যখন শুরু হয়েছে, অর্থাৎ রাধাবনভের বক্তৃতা থেমে গেছে–আনন্দপুরের বীরেনবাবু আর ফাগু ওরাও রাধাবল্লভকে ভিড়ের ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। সঙ্গে আলবিশ। তারপর, সেই গাড়িদুটোর দিকে হাঁটতে থাকে। রাধাবভ বলে, এইখানেই কথাবার্তা বলেন, আপনাদের সঙ্গে অতদূরে গেলে এদিকে ত সবাই খোঁজাখুজি করবে।
আরে চলোই না। এখান থেকে কি কেউ দেখতে পাবে না নাকি, যে তুমি ওখানে কথা বলছ।
আলবিশ মাথা দুলিয়ে বলে, চলো, কমরেড, চলল, চলিবার কহথে ত চগে।
সবাই মিলে সল্ট লিক পার হয়ে গিয়ে বসে। একটু দূরে গাড়িতে, ফরেস্টের বাবুরা। সই দিকের মুখে মদেশিয়াদের যে-দলটা বসে ছিল তরা কেউ এদিকে আসেও না, তাকাও না।
বীরেনবাবুই প্রথম কথা শুরু করেন, শোনো রাধাবল্লভ, সার্ভে ত শুরু হল। এখনত মাঠখড়ার কাজ রোজই এগবে। তোমাদের জমি ত বোধহয় আজকালই পড়বে। দু-একদিনের মধ্যেই ত বাগানেও পৌঁছবে। তা তোমরা কী করবে বাগানের ব্যাপারে?
কথা হচ্ছে কিছু করার নাই। আপনাদের জোল্যান্ডের ভেস্ট জমিতে আমাদের কৃষকরা দখল নিয়ে এতদিন ধরে চাষ করে। আমরা সরকারের কাছে পাট্টা চাই।
পাট্টা ত আর তোমার সেটেলমেন্টে হবে না, সে যেখান থেকে চাওয়ার তুমি চাও। কিন্তু তোমরা এখন কোনো বোঝাপড়ায় না-এলে ত দাঙ্গা বাধবে।
দাঙ্গা বাধিলে তা আপনাদেরই সুবিধা। আপনাদেরই মুনাফা। আপনারা ত আপনাদের মজুরদের বুঝাইছেন যে আমরা জমি ছাড়ি দিলেই আপনারা ওদের বন্দোবস্ত দিবেন। তার উপর বলতে লাগছেন আপনাদের বাগান আর বাড়াতে পারেন না–এই জমি ছাড়া। তাই নাকি পার্মানেন লেবারও নিতে পারেন না। কাম যদি এত কমই আপনাদের, বাগানটা ছাড়ি দেন না।
ওটাও ভেস্ট করে দেব? তা বলে, আমাদের তুমি চাকরিবাকরি দেবে? বীরেনবাবু একটু হাসি দিয়ে কথাটা মোলায়েম করতে চেষ্টা করেন। রাধাবল্লভও চুপ করে যায়। একটু পরে বীরেনবাবু আবার শুরু করেন, এবারের সেটেলমেন্ট ত তোমাদের পক্ষেই যাবে। এখনই যা ব্যবস্থা করার করে নাও। এর পরের ভোটে যদি সি-পি-এম হেরে যায় তখন আবার তোমাদের ঝামেলা। এখন মেটানোই ত ভাল। কোম্পানিও বেকায়দায় আছে, রাজি হয়ে যাবে। আর সরকার ত এখন তোমাদেরই পক্ষে। এই অফিসারও ত শুনলাম নকশাল, মানে, ছিল। সে-ও ত তোমাদেরই পক্ষে। এখন একটা বন্দোবস্তকরে নিলে তোমাদেরই সুবিধে।
আলবিশ একটু পেছনে বসে ছিল। সে গলাটা বাড়িয়ে শুনছিল আর মাথা দোলাচ্ছিল, যেন মনে হয় সব কথাতেই তার সম্মতি আছে। মাঝে-মাঝে হ-হ-ও বলছিল। বীরেনবাবুর কথা শেষ হলে সে বলে বসে, হে-এ বাবুমন (বাবুরা], ভঁয় কহথে কি হামনিমন [আমরা] সব জমি ছোড় হুঁ? আউর বাগানিয়া-লোক এসব জমি দখল লে লিবে? ত হামনিমন কাহা যাবে?
বোধহয় অতটা ঝুঁকে আছে বলেই কথার শুরুতেই তার মুখ দিয়ে লালা পড়ার উপক্রম হয়। বার বার সেই লালা ট্রেনে ভেতরে নিতে-নিতে সৈ আবার বলে, তোঁহার মালকিকার (মালিকেরা এতনা ঠিকা মজদুরকো কাম মে লেতা রোজ, লেকিন কইকো পার্মানেন করনেসে ত বুঝ আতা হ্যায়, কিয়া, না-ই বাগানপর কাম হ্যায় বহুত, ইসকো অউর জমিকো জরুরত হ্যায়। কথা বলতে আলবিশ খুব একটা অভ্যস্তও নয়। কিন্তু তার লম্বা চেহারা, লম্বা চুল, বড় মাথায় মনে হয় তার যেন কথা আছে। তদুপরি মদেশিয়া হয়েও বাংলা আর রাজবংশী মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি করে ফেলে, বীরেনবাবুদের সঙ্গে কথা বলছে বলেই।
আলবিশের কথার উত্তরে সেই ফাগু ওঁরাও ছেলেটি রেগে গিয়ে বলে, মালকিকারকে দোষ নাখে [নেই। বাগান বাঢ়নেকো জমিন না থে ত পার্মানেন কাম বানাই যাবে কেইসে?
আলবিশ বেশ জোরে-জোরে মাথা ঝাঁকায়, আর ঘ, ই,করে, যেন এতক্ষণে কথার আসল যুক্তিটা এই ছেলেটি ঠিক ভাবে বুঝতে পারল। ছেলেটি বেশ রেগেই কথাটা বলে। বীরেনবাবু হাত উঁচু করে বলে, ফাগু, এত রাগছ কেন, এতে ত কোনো ঝগড়ার কথা নেই। ফাগু তার লাঠিটা দিয়ে ঘাসের ওপর আস্তে-আস্তে মারে আর মুখটা একটু সরিয়ে রাখে। আলবিশ আবার কথা শুরু করতে চায়। তার ডানহাতটা সে এগিয়ে দেয় প্রথমে উপুড় করে–পঁচ আঙুল ছড়ান, তারপর চিত করে–পঁচ আঙুল, গুটোনো। একবার মুঠিও পাকায়, আলগা। সেটা যখন খুলে যায় তখন তার চওড়া কপালে লম্বালম্বা ভাজ, গভীর। কথাটা বলার চেষ্টাতেই এতটা পরিশ্রম করে, অবশেষে আলবিশ বলতে পারে, ঠিক বাত তু, ঠিক বাত। লেকিন বাগানের কাম বেশি, ফয়দা বেশি, মুনাফা বেশি ত পার্মানেন মজুর ভি বেশি হোগা, খা? তো হতে-হতে ত কোম্পানি কহতে শেকে যে, কি? না, বাগানকো এতনা কাম, আউর বাড়ানে হোগা, ত হামকো জমিন নাহি হ্যায়! হা? কোম্পানিকো হিশাব লাগানে বোলো, কুন সাল পর কেনা পার্মানেন লেবার হ-আ-আ এই শেষ হা-আ-আ-টায় এতটাই লম্বা করে ঘাড় হেলিয়ে ফেলে আলবিশ যে তার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে তার নিজেরই হাতের ওপর পড়ে। পড়ার পর সে টের পায়। টের পেয়ে হ-আ-আ বলার জন্য মুখটা যে-ই করেছিল, সেটা বন্ধ করে। ঝোল টানার মত শব্দ করে লালা টেনে নেয়। হাতটা উল্টে ঘাসের ওপর মুছে নেয়। তারপর হাতের তালু দিয়ে ঠোঁটটা মোছে।
আলবিশের কথার পর সবাইই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এখানে যারা আছে তারা সবাই ব্যাপারটা এত বেশি জানে, যে কথাটা উঠতেই সবাই বুঝে যায় একথার উত্তর দেওয়া মুশকিল। কোম্পানির অজুহাত যে চা বাগানের এলাকা না বাড়ালে নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না, সুতরাং আনন্দপুরের জোতল্যান্ডের যে-অংশ ভেস্ট হয়েছে সেটা আনন্দপুর চা কোম্পানিই সরকারের কাছ থেকে লিজ নেবে চা বাগিচা বাড়ানোর জন্য। অর্থাৎ ভেস্ট জোল্যান্ড আবার তার জোতদারের কাছেই ফিরে যাবে ইনডাশট্রিয়াল ল্যান্ড হয়ে। সুতরাং সেই ভেস্ট জমি দখল করেছে যে কৃষকরা তাদের জমি ছাড়তে হবে। কিন্তু কোম্পানির পার্মানেন্ট শ্রমিক প্রতি বছরই কমছে। আগে কোম্পানি তার পার্মানেন্ট শ্রমিকের সংখ্যা বছর পঁচ-সাত আগে যা-ছিল তার সমান করুক, তবে ত বোঝা যাবে যে আরো নতুন শ্রমিকের দরকার। রিটায়ারমেন্ট, ছুটিছাটা, মৃত্যু এসব কোনো খালি জায়গাতেই কোম্পানি পার্মানেন্ট শ্রমিক নিয়োগ করে না। সব কাজ ঠিকা শ্রমিক দিয়ে সারছে। তাহলে এখন এই ছুতোয় ভেস্ট জমির কৃষকউচ্ছেদের এই চেষ্টা কেন?
আলবিশের কথার রেশটা কাটতে যতক্ষণ লাগে, তারপরে বীরেনবাবু বলে, কিন্তু একটা ত মীমাংসা তোমাদের করতে হবে। নইলে বাগানের শ্রমিকরাই বা তাদের হক ছাড়বে কেন?
রাধাবল্লভ তার ডান হাত দিয়ে মুখটা মুছে বলে, কিন্তু কথাটা হচ্ছে এই কথাটা আপনারা কেন সবাই। বুঝেন না চা বাগানের মজুরের হক কোম্পানির সঙ্গে, আর আমাদের এই ভেস্ট জমির হক, সরকারের সঙ্গে। আপনারা আমাদের ভিতর লড়াই লাগাচ্ছেন কেন?
রাধাবল্লভের কথার উত্তরে বীরেনবাবু একটু রাগ করেই বলেন, এই সব কথা বলে কোন লাভ নেই রাধাবল্লভ। সে কোম্পানির সঙ্গে যা তাদের করার মজুররা করবে, কিন্তু কোম্পানিকে বললেই ত বলছে আমাকে জমি দাও, আমি বাগান বাড়াব, বাগান বাড়লেই মজুরের লাভ হবে।
বীরেনবাবু রেগে ওঠায় রাধাবল্লভ আরো একটু বেশি রেগে জবাব দেয়–দেখেন বীরেনবাবু, আপনি ত কোম্পানি না?
তা ত না-ই, আমি ত কোম্পানির চাকরি করি।
তা হলে আপনি কোম্পানির হয়ে এত কথা বলেন কেন?
তুমিও ত রাজবংশী না রাধাবল্লভ, তা হলে তুমিই বা রাজবংশীদের নিয়ে এত কথা বলো কেন?
রাধাবল্লভ উঠে দাঁড়ায়, এই আলবিশ চলেন, এদের সঙ্গে আর কী কথা হবে। ঠিক আছে, আপনারা যা করার করেন। এখন হাটে-হাটে ঢোলাই দেন রাধাবল্লভ সাহা ভাটিয়া, ও কেন রাজবংশীদের নিয়ে জমি দখল করে। তারপর চাদা দিয়া মানষি দিয়া একটা উত্তরখণ্ড পার্টি খাড়া করেন।
.
০৩৪.
কৃষক মজুর : লেনদেন
বীরেনবাবু বোঝেন একটা ভুল কথা বলে ফেলেছেন। কিন্তু এখন যদি একটা মীমাংসার সূত্র বের না করা যায় তা হলে সব মাঠে মারা যাবে। সেই কথাটাই বলতে পারলেন না। আসলে রাধাবল্লভ তার চাকরি নিয়ে কথা তুলেই মাথাটা গরম করে দিল। বীরেনবাবু ফাগুকে একটা তঁতো মেরে বলেন, এই ধরে আন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, যা, তাড়াতাড়ি যা।
ফাগু দৌড়ে গিয়ে আলবিশ আর রাধাবল্লভের পথ আটকায়। সল্ট লিকের কাছের ভিড়টা থেকেও দু-চারজন গোলমালের আভাসে উঠে আসে। ফাগু তাদের দিকে ফিরে ধমক দিয়ে বলে, কিছু না খে, তফাত যাও। ফাগুর কথা শুনে তারা আর এগয় না, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে।
ফাগু রাধাবল্লভকে ধরে বলে, হে কমরেড চলল, চলো, বাতচিতমে ঐসা ত হোতাই হ্যায়। তোমকো ভি কৃষক সমিতি লাল ঝাণ্ডা, হামকো ভি মজদুর ইউনিয়ন লাল ঝাণ্ড। তো বাতচিত ত হোনাই চাহে।
রাধাবল্লভের রাগ তত ছিল না কিন্তু যেন ক্লান্তি ছিল, সে বলে, আরে ভাই, এত কথা বলি কী কাজ হইবে? তোমরা কোথায় আমাদের পাকে কোম্পানিকে বলিবেন যে খাশজমির কৃষক উচ্ছেদ করা চলিবে না তা না, উল্টা কোম্পানিই তোমাদের দিয়া আমাদের উচ্ছেদ দিছে। এরপর একদিন তীরধনুক দিয়া মারামারি লাগাই দিবে আর তোমরাও লাগি যাবা।
আলবিশ রাধাবল্লভের কথার খেই ধরে বলে, আর ব্যস, লাগ যাবে দেশিয়া আর মদেশিয়ার ফাইট, পুলিশ আয়গা ব্যস–ফটাফট দুই দলের কমরেডমন এ্যারেস্ট। ফাগু বলে, আরে, ছোড় দোও উসব বাত। কায় না জানে তোমার খাশজমিঠে দেশিগা-ভাটিয়া-মদেশিয়া সব কোই হায়, চলো-চলো, বাত খতম করো
রাধাবল্লভ ফিরতে-ফিরতে বলে, ঐটাই ত তোমাদের কোম্পানির বিপদ, না-হইলে কত দাঙ্গা বান্ধাইত।
আলবিশ রাধাবল্লভকে সমর্থন দিয়ে বলে–ত–য়? তারপর দুজনেই বসে।
ফাগু তার উদ্যোগ ছাড়ে না। সে বীরেনবাবুকে বলে, আপনি ঐ সব আলগা বাত করবেন না। ই ত রাধা কমরেডনে বোলা, হামরা লেবাররাভি বলব, খাশজমিঠে কৃষকলোগকো হঠানা নাহি চোলেগা। আউর উলোক ভি হামকো বাত বোলেগা। কিয়া, ঠিক হ্যায় না রাধা কমরেড?
রাধাবল্লভ বলে, ঠিক ত হ্যায় কিন্তু বোলেগাটা কী?
আলবিশ বলে, হ-আ, বোলো, কিয়া তোঁহার মতলব, বোলো
ফাগু বীরেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করে, কিয়া বীরেনবাবু, ঠিক হ্যায় না?
বীরেনবাবু বলে, হা, এখন তোমরা ঠিক করো কী বলবে। তোমরা যদি দুই পক্ষ এক হয়ে কিছু বলো, সরকারও সেটা মানতে বাধ্য হবে, এই তোমার সেটেলমেন্টেই সেটা রেকর্ডও হয়ে যাবে।
ফাগু বলে, তো থোলো, কিয় বোলেগা?
ফাগু কথাটা কাকে বলে বোঝা যায় না, কারণ কথাটা সেই তুলেছে এবং জবাবটা তারই দেয়ার কথা। কিন্তু আবার বোঝা যায় যে সে এই কথাটারই জবাব বীরেনবাবুর কাছ থেকে জেনে নিতে চায়। বীরেনবাবুই তাদের আসল মুখিয়া কিন্তু তার কথার জবাবেই ত আর বীরেনবাবু শর্তটা দিতে পারে না, তাই তাকে চুপ করে থাকতে হয়। যেন ব্যাপারটা নিয়ে তারা সবাইই ভাবছে, বীরেনবাবুও। শেষে বীরেনবাবু শুরু করে, যারা জমি দখল করে আছে, মানে রাধাবাভের লোকেরা
বাধা দিয়ে রাধাবল্লভ বলে, আমার কোনো লোক নাই বীরেনবাবু, লোক থাকে ভদ্রলোকদের আর জোতদারদের। আমি ত ভদ্রলোকও না, জোতদারও না।
কেন? তোমাকে ত সবাই বাবু বলেই ডাকে, সে যাকগে, যারা জমি দখল করে আছে তাদের যাতে জমি থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ না হয় সেটা দেখতে হবে, এই ত?
শুনি না, আপনাদের কথাটা শুনি।
ফাগুরা কী বলবে বলুক। কী ফাগু?
না, সে ত, বলনেই হোগা, জরুর।
কিয়া? বীরেনবাবুই আবার প্রশ্ন করে।
ঐ যে, রাধাবল্লভমনকো উচ্ছেদ নাহি চলেগা।
নাহি ত চলেগা কিন্তু জমিটা ত তোমাদেরও সই?
জরুর। চাবাগানকো খাশ, বাগানকো দেনা হোগা।
সবই ত হোগা। কিন্তু সেটা হবে কী করে সেটা বলল।
সে ত জরুর বলনে হোগা বলে ফাগু থেমে যায়। আবার কিছুটা চুপচাপ থেকে বীরেনবাবু বলে, তা হলে তোমাদের জমিটা মাপামাপি হোক আগে।
এইবার রাধাবল্লভ বলে ওঠে, মানে, আমাদের জমি আবার মাপামাপি কিসের? সরকারের ভেস্ট জমি। সরকার মাপামাপি করে দাগ নম্বর ধরি ধরি দখল নিছে। ব্যস-সরকারের ফর্ম দেখি সেটেলমেন্টে দাগ নম্বর মিলাবে। আমাদেরও পাট্টা দেয় নাই। আমরাও মাপতে দিব না। পাট্টা দিলে মাপ হবে, পাট্টা নাই ত, মাপ নাই।
বাঃ! তোমরা যদি পুরো জমিটা কার কত দখলে আছে তার একটা হিশাব বের করতে না দাও তা হলে মীমাংসাটা কী হবে?
কায় হিশাব কিয়েগা? হাম ত জানেথে কিসকো কেতনা জমিন।
আলবিশ কথা শুরু করলে রাধাবল্লভ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, চু যান ভগত, চুপ যান। বীরেনবাবু আমাদের জমি মাপাইতে চায়। তো চাউক। যায় পারে স্যায় মাপুক।
রাধাবল্লভ, শোনো। যদি তোমার কথাটা মেনেও নেই, তা হলেও ত দেখতে হবে কে কতটা জমি দখল করে আছে? তাহলে কোম্পানিও সরকারকে বলতে পারে যে তোমাদের আইন-অনুযায়ী কৃষকদের পাট্টা দাও। তারপর দিয়েথুয়ে যা বাকি থাকবে সেটা কোম্পানি বাগানের জন্য লিজ নিবে। ফাগুরাও সেই কথা বলবে। কী ফাগু?
জরুর। হামনিমন বলেগা সব পাট্টা দোও, উসকে বাদ কোম্পানিকো দোও।
মানে, বীরেনবাবু, আপনারা আমাদের বলিছেন আমরা দুই বিঘা জমি নিজেদের দখলে রাখিয়া বাকি জমিটা আপনাদের দিয়া দিব?
সরকারের ত তাই নিয়ম। যা নিয়ম তাই ত করতে হবে। নইলে তোমাদের ওখানে এক-একজনের ত একহাল জমিও আছে। হৃষীকেশ ত দর্জিগিরি করে। ওর কী করে জমি থাকে?
ঐ সব কথা বাদ দেন। আমরা বিশ বছর ধরে জমি দখল রাখছি। আপনারা ত আমাকে গুলিও করছেন। মাথায় বুকে না লাগিয়া হাতে লাগিল, রাধাবল্লভ ডান হাত দিয়ে তার বা বাহুটা চেপে ধরে–বা বগলেই ছাতা, সে ত আর জমি ছাড়িবার জন্য না।
রাধাবল্লভ, তোমাকে গুলি কি আমরা করেছি? এই সব কথা বলো কেন?
ঠিক আছে। ঠিক আছে। সেটা কোনো কথা না। কথা হচ্ছে, এই যদি আপনাদের কথা হয় তবে কথাবার্তা এখানেই শেষ। আমরা জমি ছাড়িবও না, জরিপও করতে দিব না। ভেস্ট জমি ত খাশজমি। খাশজমির খতিয়ান আলাদা। তার আবার মাপামাপি কিসের?
বীরেনবাবু বুঝে যায় তার আসল প্রস্তাবটা রাধাবল্লভ প্রত্যাখ্যান করল। সেও তখন বলে, বাঃ বাঃ তোমরা খাশজমিতে আধিয়ারি চালাবে আর মজুররা বাগানের জমিতে নিজেদের হক পাবে না, না?
ঐটা বাগানের জমি না, সরকারের জমি। ঐখানে মজুরদের কোনো হক নাই। আপনারা মজুরদের সঙ্গে আমাদের দাঙ্গা বাধাচ্ছেন- রাধাবল্লভ উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে আলবিশও। ফাগুও উঠে দাঁড়ায়। বীরেনবাবু বসে থেকেই বলেন, দাঙ্গা ত আমরা করতে যাব না–তোমাদের পার্টির ইউনিয়নই যাবে। তখন তাদরে সঙ্গে বুঝে। বাগানের ওয়ার্কাররাই দাবি করছে যে এই খাশজমি কতটা কার দখলে আছে, মাপা হোক।
ঠিক আছে বুঝব–আমরা জমিতেই আছি। আপনারা অফিসার ধরি আসেন। দেখি কে কার জমি মাপে রাধাবল্লভ উঠে পড়ে।
.
০৩৫.
কৃষক-মজুর : শ্রেণীসংগ্রাম
বেরিয়ে এসেই রাধাবল্লভ বলে, ভগত, তাড়াতাড়ি জমিতে চলেন, গোলমাল হইতে পারে। তারপর সেই গানের আসরের দিকে তাকিয়ে বলে, বুদ্ধিমানকে ডাকি আনেন। রাধাবল্লভ দাঁড়িয়ে থাকে না, সে উল্টোদিকে সোজা হাঁটতে শুরু করে। আলবিশ ভিড়টার দিকে প্রায় ছোটে। তার বয়স হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গেলে পিঠটা নুয়ে যায়, যেন পা যে যথেষ্ট তাড়াতাড়ি চলছে না, সেটার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সে কোমর থেকে মাথাটা এগিয়ে দিচ্ছে। আলবিশ ভিড়ের ভেতরে বুদ্ধিমানকে খুঁজে বেড়ায়। এক পাক ঘুরে দেখে চায়ের দোকানে বসে হৃষীকেশের গানের সঙ্গে তাল দিচ্ছে।
হেই বুদ্ধিমান উঠো, উঠো।
বুদ্ধিমান না তাকিয়ে বলে, আরে ভগত বসি যাও কেনে, দেখেন না শালো রিশিকেশ ক্যানং পালা বান্ধিছে, চরুয়ার পালা। ভিড়ের ভেতর থেকে হৃষীকেশের তারস্বর ভেসে আসে। ভগত আর দেরি করতে চায় না। রাধাবল্লভ আবার একা-একা গেছে। সে বুদ্ধিমানের পিঠে তার হাঁটু দিয়ে একটা গুতো মারে। এইবার বুদ্ধিমান আলবিশের মুখেরদিকে তাকায়, আলবিশ হাতের ইঙ্গিতে তাকে উঠতে বলে।
গত প্রায় পনের বছর ধরে বুদ্ধিমান কৃষক সমিতির সঙ্গে। আর এখানে কৃষক সমিতি মানেই এই খাশজমি দখলে রাখা, চাষ করা, লোন পাওয়া, মামলা করা এই সব। এক-একবার ভোটে এক-এক রকম সরকার এক-এক রকম আইন জারি করে। কিন্তু এই দখলি খাশজমির কোনো মীমাংসাই হয় না। দখলে রাখাই ত আইনের বার-আনি। সেই এত রকমের অভিজ্ঞতায় বুদ্ধিমান মুহূর্তে বুঝে ফেলে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আলবিশের কানে কানে বলে, কী হইল?
কমরেড তোঁহাক জুমিত যাবার কইসে।
কেন? কুনো গোলমাল বাধি গেইল?
না জানি। বাহির চল।
আলবিশ আর বুদ্ধিমান তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে। বুদ্ধিমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, রিশিকেশকে ডাকি
আলবিশ দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু ভাবতে পারে না। হৃষীকেশকে ডাকা মানে ত এখন এই গানের আসরটা ভাঙতে হবে। তার মানে, এই এতগুলো লোকই ত জেনে যাবে। তার মানে, গোলমাল ত আরো পাকাতে পারে। কিন্তু গোলমাল ত এখনো শুরু হয় নি। হতে পারে। বীরেনবাবু শালোঠো ধমকসে বাত করলেক। কমরেড একেলা হো৷ না। ছোড় দে; আগারি চলো থ।
বুদ্ধিমান পা ফেলে বলে, চলো, চলো।
ওরা তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। বুদ্ধিমান বেঁটে আর আলবিশ ঢ্যাঙা। ফলে বুদ্ধিমানের অস্থির পা ফেলার সঙ্গে আলবিশের লম্বা লম্বা পা ফেলা মিলে যাচ্ছিল।
আলবিশ বুদ্ধিমানকে বলল, শালো বীরেনবাবুঠো—
কোন বীরেনবাবু?
আরে, শালো আনন্দপুরকো।
অ। অয় শালার ত চাকরি হবা ধরিছে হামরালার উচ্ছেদের তানে–উকিল।
কায় উকিল হো?
ঐ শালার বীরেন। বীরেন-উকিল।
ধুত। উকিল ত কোর্টমে যাথে, কালা কোট পহিনকে। উকিল হোকে বাগানমে কিয়া করথে!
তোমার মাথা করেগা। এ্যানং বড় উকিল যেইলার একখান মক্কেলও নাই। সেই তানে চা-কোম্পানি উমরাক চাকরি দিয়া নিয়া আসিছে–এ্যালায় এই খাশ-জমির হালুয়া-আধিয়ারের পাছত কাঠি দাও। ক একখান অফিসার হইছে, বাগানের। কী কহিছে শালা?
কহিছে কি তোমলোগ দু-বিঘা করকে লেকে বাকি জমিন ছোড় দো।
কেনে, শালোর বনুসের (বউ) পোকর মানষির তানে?
আলবিশ রেগে দাঁড়িয়ে পড়ে, আরে আগারি ত বাতঠো শুনেগা, না, এইসা বাত কর যায়গা?
কখন বলিবার ধরলেক হে, তোমাক ঐ শালো, এ্যানং কাথা?
এই, যব কমরেডকো লেকচারঠো—
কোন লেকচার? কমরেড ত তামান টাইমেই নেকচার ঝাড়িছে, ঘুমের ভিতরও কহে কুখ্যা জোতদার
এবার আলবিশ হেসে ফেলে, আরে এই গানবাজনা কো আগারি।
কী? তোমরা ডাকি নিয়া গেইসে?
হয়।
কায় ডাকি নিল?
ফাগু আর বীরেনবাবু। তো হামনিমন্ ত গাই। উসকে বাত, বইঠকে বইঠকে উমনিমনকো সা বাতচিত হোথে লাগেল।
এককেবারে বইঠকে বইঠকে বাতচিত? খাড়কে খাড়কে না?
ওরা হাতির রাস্তার সেই বাকটার কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, বায়ে ঘুরলেই সামনে, ডাইনে, সেই খাশজমির এলাকা শুরু, বয়ে ফরেস্টই চলে। চা বাগান আরো অনেক দূরে।
বাকটা ঘুরতেই ওরা দেখে সেই জমির ভেতরে আর হাতিরাস্তার ওপরে কিছু লোকজন। সেই সার্ভের লোকজনকেও দেখা যাচ্ছে। ওরা দু-জন দাঁড়িয়ে পড়ে। শালো, চেইন ফেলাচ্ছে–জমি মাপিবার ধইচছে?
বুদ্ধিমান ডাইনের ঢাল বেয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে আলে-আলে দৌড়তে শুরু করে। আলবিশও তার হটার গতি বাড়ায়। কিন্তু সে ঢাল বেয়ে আলে নামে না। কাদায় থকথক করছে নতুন রোয়া মাঠ, আলে-আলে অত লাফাতে পারবে না আলবিশ।
কিন্তু ঘটনার জায়গাটিতে কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো ঘটনাও নেই। সার্ভের লম্বা চেইনটা এই জমিগুলোর ওপর দিয়ে মরা সাপের মত পড়ে আছে। তার ওপর বসে আছে বেটিছোঁয়ারা, জেনিমন (মদেশিয়া চৌরা), ছাওয়া-ছোটর ঘর, লেড়কা-লেড়কি। রাধাবল্লভ সামনে কিছু লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই জমিটার একটা ঢাল ওপরে, কিছু দূরে চা বাগানের মজুরদের একটা ভিড়–কেউ-কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। আর বাঁ পাশে হাতির রাস্তার মোড়টাতে সুহাস, বিনোদবাবু, প্রিয়নাথ, অনাথ দাঁড়িয়ে বীরেনবাবু ও আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে।
বুদ্ধিমান এসে রাধাবল্লভের সামনে দাঁড়ায়। দীর্ঘ একটি শ্বাসে বুক ভরে জিজ্ঞাসা করে, কী হইছে কমরেড? তারপর নিশ্বাসটা ছাড়ে। মনে হয় বুদ্ধিমানের শ্বাস-প্রশ্বাসের চাপে তার গেঞ্জিটা ছিঁড়ে যাবে। এখন এতটা হেঁটে ও এইটুকু দৌড়ে আসায় তার চোখের নীচের উঁচু হাড়দুটোতে যেন ঘাম চকচকায়, ঐ দুটো আরো প্রখর হয়ে উঠতে পারে। নিশ্বাসে আন্দোলিত বুকের জন্যই কী না, বোঝা যায় না, বুদ্ধিমানের হাতদুটোও তার শরীরের পাশে ফুলে ফেঁপে দোলে।
ততক্ষণে আলবিশও পৌঁছে গেছে। রাধাবল্লভ চোখটা বন্ধ করে, ডান হাতটা মাথার ওপর কনুইয়ে ভেঙে আঙুলগুলোকে ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়, তারপর রোগা বুকটা চিতিয়ে, একটু কেতরে বক্তৃতার মত শুরু করে, কথাটা হচ্ছে, আমরা যখন আজ সার্ভের অফিসারের নিকট কৃষক সমিতির বক্তব্য বলিবার ছিলাম, তখন আমাকে আর আলবিশ ভগতকে আনন্দপুর চা বাগানের বাবু বীরেনবাবু আর ঐ ইউনিয়নের ফাগু উরাও ডাকি নিয়া আলোচনায় বসিবার চাহেন। আমরা আলোচনায় বসি। তাহারা অ্যালাং-প্যালাং বহুত কথা কহিছে। সেই সব কথা এখন আর বলিয়া কুনো কাম নাই। সে যাই হোক, বীরেনবাবু কহেন যে আমাদের জমি ছাড়িবার লাগিবে, মাথাপিছু দুই বিঘা করিয়া জমি থাকিবে আর এই তামান জমি মাপামাপি হওয়ার ধরিবে।
এই কথাতে, চারপাশে এমন গুঞ্জন ওঠে যাতে রাধাবল্লভকে থামতে হয়। সে হাত তুলে তাদের থামিয়ে বলে, কিন্তু সেইটাও কুনো কথা নহে। আমরা এই সব কথায় ঐ আলোচনাকক্ষ ত্যাগ করি। কিন্তু সেইটাও কুনো কথা নহে। আমরা যেই টাইমে ঐ সব আলোচনা করিবার ধইচছি, আলোচনা আর কথাবার্তা চলিছে, আর আমাদের কুননা মানষি যখন জমিতে নাই, সগায় গেইসে সার্ভের জায়গায়, রিশিকেশ গান গাহিবার ধরিছে, স্যালায় এই বীরেনবাবুর ঘর, এই কোম্পানির ঘর, আমাদের পাছত দিয়া, লুকাইয়া আমিনবাবুকে দিয়া, এইঠে আমাদের জমিতে চেইন ফেলিছে।
দম নেবার জন্য রাধাবল্লভকে থামতে হয়। তখন তার গলার সবগুলো রগ ফুলে উঠেছে। যে কণ্ঠস্বরে ও যে-ঘৃণায় সে এই কথাগুলো বলতে চায় তার সবটুকু যেন সে উগরে দিতে পারছে না। তাই তার মুখটা একটু ডাইনে বেঁকে গেছে–যদিও তার শ্রোতারা বেশির ভাগই বায়ে। আর তার নীচের ঠোঁটটা চেবড়ে যাচ্ছে। তাতে তার ক্ষয়ে-যাওয়া দাঁতের কালচে গোড়ায় জমে ওঠা থুতু দেখা যায়। রাধাবল্লভ ধিক্কারে বলে ওঠে, বীরেনবাবু আনন্দপুর চা-কোম্পানির চাকরি করেন। তিনি আলোচনার নামে আমাদের বনের আড়ালে নিয়া গিয়াছেন। আর সেই ফাঁকে এই আমিনকে চেইন দিয়্যা এইখানে জমি মাপিবার কাজে পাঠাইছেন। এইঠে আমাদের বেটিছছায়া, ছাওয়া-ছোটর ঘর সেই চেইনখান চাপি ধরি এইঠে বসি গিছে। আর সেই সময় চা বাগানের ইউনিয়নের এই শ্রমিকরা এইখানে আসিয়া লাই বান্ধি এই সব বোটিছোঁয়া আর ছাওয়া-ছোটর ঘরকে হুমকি দেখায়, ভয় দেখায়। আমি যখন এইখানে আসি পৌঁছাই তখন দেখি এই অবস্থা। আপনারা সবাই প্রস্তুত হোন। আমরা আমাদের দখলের জমি ছাড়িব না! এই জমি মাপিবার দিব না। চা-কোম্পানির আর আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেন।
রাধাবল্লভ তার পাঞ্জাবির হাতায় মুখটা মোছে। রাধাবল্লভের পাশে দাঁড়িয়ে যারা তার কথা শুনছিল তারা আলগা হয়ে যায়। বুদ্ধিমান হঠাৎ লাফ দিয়ে সামনের আলটার ওপর উঠে মজুরদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার পায়চারি করে। বুদ্ধিমানকে দেখিয়ে মজুরদের লাইনের মেয়েদের ভেতরে একটু হাসাহাসির ভাব আসে।
.
০৩৬.
কৃষক-মজুর : ভাষণসংগ্রাম
বুদ্ধিমান যে বড়, উঁচু আলটায় দাঁড়িয়েছিল, সেটা পশ্চিমে গিয়ে হাতির রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখান থেকে সুহাস ঐ আল ধরে এদিকে আসে, একা। আমিন আর চেইনম্যানেরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। বীরেনবাবুও।
সুহাস কাছাকাছি আসতেই বুদ্ধিমান শ্লোগান দিয়ে ওঠে, খাশজমির দখলদারি, আর সমবেত উঁচু আওয়াজ ওঠে, ছাড়ছি না, ছাড়িম না–
খাশজমি মাপামাপি
নাহি চলেগা, নাহি চলেগা
খাশজমির পাট্টা চাই
লোন চাই, সার চাই
বুদ্ধিমানের গলা থেকে রাধাবল্লভ শ্লোগানটা নিয়ে নেয়। হাতটা তুলে টেনে বলে, কৃষকদের বিরুদ্ধে বাগানের মালিক ও আমলাদের ষড়যন্ত্র এই শ্লোগানটা এরা জানে না, চুপ করে থাকে। পেছন থেকে একটি মেয়ের ক্ষীণ গলায় একবার চলিবে না শোনা যায়। দম নিয়ে রাধাবল্লভই শ্লোগানের জবাবে আরো চিৎকার করে, ব্যর্থ করো। দ্বিতীয় ব্যর্থ করোতে অনেকেই গলা দিতে পারে।
এর মধ্যে সুহাস লাফিয়ে আল থেকে নেমে এদের সামনে চলে আসে।
শ্লোগান থামলেও সুহাস কথা শুরু করে না। তখন এরা আরো একটু চুপ করে, মজুরদের লাইনটাও একটু-একটু এগিয়ে আসে। সুহাস গলা না তুলে, বরং একটু হাসি মিশিয়ে বলে, আপনাদের জমি মাপা হবে না। আপনারা চেইনটা ছেড়ে দিন।
কথাটা সুহাস এত ঠাণ্ডা ভাবে বলে যে সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়। কয়েক মুহূর্তের একটা ইতস্তত ভাব আসে, কী করা উচিত এই নিয়ে। সুহাস পাশের দিকে তাকায়। তারপর আবার মুখ ঘোরায়। অনাথবাবু আর প্রিয়নাথবাবুকে ডেকে চেইনটা গোটাতে বলবে কিনা ভাবে।
কিন্তু ওঁরা কেউ এদিকে আসছেনই না একেবারে।
ততক্ষণে রাধাবল্লভ চোখ বুজে ঘাড় কাত করে ফেলেছে। সে আর গলা চড়ায় না। কিন্তু তার শীর্ণ চোখেমুখে রাগ, ধিক্কার, কষ্ট এই সবের ছাপ বড় বেশি স্পষ্ট। রাধাবল্লভ বলে, আমরা সরকারের চেইন আটকাতে চাহি না। বিশেষত বামফ্রন্ট সরকারের চেইন, বামফ্রন্ট সরকার জনগণের বন্ধু-সরকার। কিন্তু যাহাদের চক্রান্তে এই চেইন খাশজমিতে ফেলা হইছে তাদের বিচর করিতে হইবে।
দেখুন, চক্রান্ত-টক্রান্ত কিছু নেই। আমরা এখন দাগনম্বরওয়ারি জমি মেপে যাচ্ছি। তাতেই আপনাদের জমিতে চেইন পড়েছে। আমাদের এখন এই জমি মাপার কথা নেই। আমরা চেইন তুলে নিচ্ছি, আপনারা ছেড়ে দিন। বিনোদবাবু, অনাথবাবু, প্রিয়নাথবাবু কেউই এগচ্ছেন না–সুহাস মনে-মনে একটু রেগেই আবার ডাইনে তাকায়। এখন চেইন যদি এরা ছেড়ে দেন, দিয়েছেন মনে হয়, তা হলে কি সুহাসকেই চেন গোটাতে হবে।
স্যার, এ-বিষয়ে আমাদের সমস্ত বক্তব্য শুনিলেই বুঝিবেন যে কত বড় ষড়যন্ত্রের মধ্যে এই চা-কোম্পানিরা বামফ্রন্ট সরকারকে ঠেলি দিচ্ছে।
সুহাসকে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু রাধাবল্লভ তার কথা শুরু করতে পারে না। মজুররা লাল ঝাণ্ডা তুলে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে আসে বড় আলটার ওপরে। তারপর সুহাসের উদ্দেশে আওয়াজ তোলে, খাশ জমিনকো সেটেলমেন্ট করনে হোগা, করনে হোগা, খাশ জমিনমে আধিয়ারি নাহি চলে গা, নাহি চলে গা, বামফ্রন্ট সরকারকো কানুন মাননে হোগা মাননে হোগা।
রাধাবল্লভকে বুদ্ধিমান জিজ্ঞাসা করে, কমরেড, রিশিকেশকে ডাকিব?
ডাকো ডাকো, সগাক ডাকো, খবর দাও, রাধাবল্লভ চোখ না খুলে বলে। বুদ্ধিমান ভিড়টার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে মাঠ বরাবর ছুট দেয়–লড়াই বান্ধিবে। পেছনে শ্রমিক আর সামনে কৃষক নিয়ে সুহাস মাঝখানে। পেছনের শ্লোগান থামলে সে রাধাবল্লভকে বলে, দেখুন, আমি ত সার্ভে করতে এসেছি। আপনাদের জমি আমরা মাপব না, এ নিয়ে আর কী বক্তব্য আমি শুনব? শুধু সার্ভে নিয়ে কেউ কিছু যদি চলতে চান, বা, উত্তরাধিকার বা অংশ নিয়ে, দখল নিয়ে, সেইগুলো শুনতে পারি।
সুহাস আগেই আন্দাজ করেছিল যে এই দলের সবাই একটা এলাকায় এক লতে খাশজমি দখল করেছে। তাতে প্রায় প্রত্যেকেরই নিশ্চয় এক-দেড়-দুইহাল জমি আছে। এখন মাপামাপি করতে গেলে সেটা ধরা পড়বে। তখন ভেস্ট জমি আবার ভেস্ট হবে। তাই এরা প্রথম থেকেই আওয়াজ তুলেছে জমি মাপতে দেবে না। খাশজমি দখলে রেখেছে যে কৃষক সে ত বরং তাড়াতাড়ি রেকর্ড করাতে চায়। গবমেন্ট অর্ডার প্রথমে ছিল, খাশজমি মাপা হবে ও দখলদারদের নাম রেকর্ড হবে। পরে অর্ডার এসেছে, এখন ও-সবের দরকার নেই। দ্বিতীয় অর্ডারের কারণ নিশ্চয়ই এই রকমই আরো সব ঘটনা।
এতক্ষণ আনন্দপুরের এস্টেট অফিসারে নথিপত্র আর মৌজা ম্যাপ দেখে সুহাসের এই ধারণাটাই প্রমাণিত হয়েছে। চা-কোম্পানির মতলবও সুহাস বুঝতে পেরেছে। কিন্তু, সেই বিবাদ-মীমাংসায় তার কোনো ভূমিকা নেই। বরং সে একটু বিরক্তই হয়, বিনোদবাবু তাকে না বলে এই জমিতে চেইন ফেলে প্রথম দিনই এরকম একটা গোলমাল বাধালেন কেন?
যে-দলটা ঢালটার ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল, তারা কিছুটা চুপচাপই সুহাস ও রাধাবল্লভের কথা শুনছিল। সুহাসের কথার পর চা বাগানের শ্রমিকদের দলের ভেতর থেকে বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়, সাথিমন, চাবাগানকো লেবারলোক অউর কিষানলোক দুষমন নাখে। ভাই-ভাই হায়। সাথি-সাথি হায়। এককো দুখ অউরকো বুঝনা পড়লেক। নাহি বুঝলে ঔ মালিকমন মজুরকো অউর কিষানকো খতম করনে পড়ে। লেকিন সাথিমন, হামার এই ক্ষেতিপর এক খারাপি কাম হলেক, কী, না, চিয়া বাগানকো ভেস্ট ল্যাণ্ডপর কিষানলোর্কো জবরদখল কায়েম করতা-থে। এতনা জবর দখল যে ই গবমেন্টকো সেটেলমেন্ট ভি উ হোনা নাহি দেগা। লেকিন বামফ্রন্ট সরকার জনগনকো সাথি সরকার হ্যায়। ইসকো সব কাম ঠিক-ঠিক করনা পড়েক। ত হাম বলে কি, সরকারকে যো অফিসার হ্যায়, হিয়া, উ অফিসারকো সরকারকে কানুন ত সাফ-সাফ করনে তোগা। হামনিমনকো ই ডিম্যান্ড হ্যায় কি যযা ই-ভেস্ট জামিনকো পুরা মাপ করনে হোগা, অউর কোন কো পাশ কেতনা জমিন হ্যায় ইসকো লিস্ট বাহার করনে হোগা। সাথিমন, মজুরো অউর কিষানো দুষমন নাখে। মজুরকো ইউনিয়নকো লালঝাণ্ডা লাল, লাল পার্টি আর কিষান সমিতিকো ভি ওহি ঝাণ্ডা ওহি পার্টি। হামলোগ সাথি হ্যায়। উ হি দফে হামনিমন কি ডিম্যান্ড ই হায় যে সব খাশজমিকো তালাশ করনে হোগা, করনে হোগা। ই অফিসারলোগো অউর জোতদারলোগোকো যো কলকজা হোতা হ্যায়, যোক্যাপাসিটি হোতা হ্যায় উ খতম করনে হোগা। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ফাগু উরাওঁ বক্তৃতা শেষ করে আবার শ্লোগান দেয়, ইনকিলাব। কিন্তু এই শ্লোগানের জবাবে কোথায় যেন একটা মজাও মিশে থাকে। মদেশিয়া মেয়েদের অকারণ হাসিতে শ্লোগানের সুরটা রিনরিন বেজে ওঠে, বাজতে থাকে। তাতে শ্লোগানের একটা আদিবাসী ধরন ধরা পড়ে–কোনো কিছুই যেন গান ছাড়া বা নাচ ছাড়া হয় না, তেমনি আবার সন্দেহও উঁকি দেয় এই শ্লোগানের দল লড়াইয়ে আসে নি, এই শ্লোগানটার আদায়-অনাদায়ের সঙ্গে তাদের বাঁচামরার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই।
সুহাস রাধাবল্লভের দিকে পেছন ফিরে, বাগানের দলকে বলে, আপনাদের এস্টেট অফিসারকে আসতে বলুন।
কৌন কে?
এস্টেট অফিসার, এস্টেট অফিসার, আমাদের সঙ্গে যিনি কথা বলছিলেন, ওখানে।
ফাগু হুকুম দেয়, বীরেনকো বোলো, বীরেন এস্টেট অফিসার।
হো বীরেনবাবু, বীরেনবাবু হো-অ, ডাকটা বাগানের দলটার সামনে থেকে পেছনে চলে যায়।
রাধাবল্লভের দিকে তাকিয়ে সুহাস বলে, দেখুন, এখন ত আমাদের রোজই সার্ভে করতে হবে। কাজটা তাড়াতাড়ি না হলে ত আপনাদেরও অসুবিধা। কিন্তু এসব হাঙ্গামা ত আমরা মেটাতে পারব না, মানে আমাদের ত এটা কাজ নয়।
কী আপনাদের কাজ নয়, স্যার, বামফ্রন্ট সরকার জনগণের বন্ধু সরকার সুতরাং
না। সে ত ঠিক আছে কিন্তু যার যা কাজ সে ত তাই করবে, আমি ত আর ধরেনফরেস্ট রেঞ্জারের কাজ করতে পারব না, এটা আমাদের, মানে সেটেলমেন্টের কাজ নয়।
কোনটা স্যার আপনাদের কাজ নয়?
এই যে, এই খাশজমি এক-একজন কতটা করে দখল করছেন, তারা পাবেন নাকি চা-কোম্পানি পাবে, এটা ত আমরা ঠিক করতে পারব না।
রাধাবল্লভ বলে, স্যার, আপনি যদি আমাদের মাপতে চান, চলুন স্যার মাপিবেন, আমরা চেইন ঘাড়ে করি আপনাকে মাপি দিব। মাপাই ত আপনার কাজ। আমরাও মাপাই চাই।
শুনুন, এই ভেস্ট জমিগুলো ত দাগে-দাগে মিলিয়ে সরকার মেপে তুবে দখল নিয়েছে, আমরাই নিয়েছি, সুতরাং এই জমির খানাপুরী বুঝারতের কাজ হয়ে আছে, আমাদের মৌজা ম্যাপেই আছে। আর, কার দখলে কে কতটা রেখেছেন সরকার তা রেকর্ড করতে নিষেধ করেছেন। অনেক জায়গায় তার একটা লিস্টি আমরা নিয়েছি। যদি সরকার চায়, আমরা জমা দেব। আপনারা যদি চান, সেরকম একটা লিস্টি বানিয়ে আমাকে দিতে পারেন।
ভগত বলে, সে আমরা লিশ্চয় দিব স্যার, আপুনি চাহিলে দিব স্যার, আমরা ত সরকারের সহিত বন্দোবস্তই চাহি স্যার, কিন্তুক খাশ জমি মাপিবার দফে বাগানের মজুরদের দাবি কেন স্যার, ই মাপামাপিতে ওদের ত কুনো ফায়দা নাই। না কি, ঐ বীরেনবাবুকো মারফৎ কোম্পানি দাঙ্গা বাধাবার ধরলেক, স্যার।
আপনি কি আমাকে ডেকেছেন? বীরেনবাবু ঢালের ওপর থেকে বলেন, নীচে নামেন না। সুহাস অপেক্ষা করে উনি নামবেন, কিন্তু বুঝে যায় নীচে কৃষক সমিতির লোকজনের ভেতর নামতে তার ভয় হচ্ছে। সুহাসের এই অপেক্ষা আর বোঝার মাঝখানের ফাঁকটুকুতে রাধাবল্লভ বলে, স্যার, এই বীরেনবাবু লোকটা আমাদের ফরেস্টের ভিতর নানান কথায় ভুলাইয়া রাখি এই সব আমিনবাবুর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া এইঠে চেইন ফেলিছে আর এ্যালায় বাগানিয়া মজুর আউর বস্তির কৃষকের ভিতর দাঙ্গা বাধিবার তাল করিছে।
বীরেনবাবু ওপর থেকে চিৎকার করে ওঠে, রাধাবল্লভ, বি কেয়ারফুল– সেটাও একটা শ্লোগানের মত শোনায়। বাগানের দল যেন তার জবাবেই বলে ওঠে, নাহি চলেগা, নাহি চলেগা।
সুহাস কৃষক সমিতির দিকে পেছন ফিরে বীরেনবাবুকে ধমকে বলে, শুনুন, আপনার ত এখানে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, তবে আপনি কেন আমাদের কাজে এত ইনভলভড় হচ্ছেন আর একটা ল-অ্যান্ড-অর্ডার সিচুয়েশন তৈরি করছেন?
আমি আপনাদের কাজে কোনো ভাবেই বাধা দেইনি।
আপনি ত এদের সঙ্গে একটা কমপ্রোমাইজের চেষ্টা করছিলেন যখন এখানে চেইন পড়েছে–আর ঠিক তখনই কৃষক সমিতির দলটা পেছন থেকে আচমকা জিন্দাবাদ শ্লোগান তোলে আর হকার দিতে-দিতে হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমান পেছন থেকে ছুটে আসে।
.
০৩৭.
কৃষক–মজুর : সম্মুখসংগ্রাম
হৃষীকেশ মৌজ করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছিল। কিন্তু চরের দলটা প্রায় একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ওঠে। তারপর হৃষীকেশকে বলে, হালায় আর সিগারেট ফুঁইকতে হবে না, তাড়াতাড়ি দৌড় লাগা। আনন্দপুরের জমিতে কাইজ্যা লাইগ্যা গিছে। চল চল।
হৃষীকেশ লাফিয়ে ওঠে। কেমন বিহুলের মত চারদিকে একবার তাকায় তাদের দলের কৈউই নেই। যারা এতক্ষণ গান শুনছিল তাদের কেউ-কেউ চায়ের দোকানটার কাছে, জ্যোৎস্না আমিনের সামনে কয়েকজন। অনেকে সোজা সেই হাতির রাস্তা ধরে উত্তরে আনন্দপুরের দিকে যাচ্ছে বেশ তাড়াতাড়ি, যেন এখানকার গানের পালার শেষে ওখানে আরো .. লম্বা পালা আছে। হৃষীকেশ কয়েক পা আস্তে-আস্তে হাঁটে। আবার আশেপাশে তাকায়। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারে না তাদের দলের কেউ নেই। চরের দলের কেউ-কেউ তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। হৃষীকেশ পেছন ফিরে একবার তিস্তার দিকে তাকায়। সেই চেয়ারটা খালি পড়ে আছে, আর একটু দূরে সেই টেবিলটা। হৃষীকেশের এটা বুঝে নিতেই একটু সময় লাগে, যে-ভিড়টার মাঝখানে সে এতক্ষণ ছিল, সে-ভিড়টাতে সে এখন নেই। সিগারেটটা এতক্ষণ টানে নি। এইবার জোরে-জোরে দুটো টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। চায়ের দোকানটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আরে, এই, কী হইছে? ভিড়টার ভেতর থেকে একজন চেঁচিয়েই জবাব দেয়, জানি না কী হবার ধরিছে–সগায় ত ঐঠে, হাকিম আমিন সগায়, শনিবার পাছ তোমরালার সমিতির তানে বাগানের মদেশিয়াগিলার মারামারি হবার ধরিছে।
অ্যাঁ?–এই একটি কথাতে হৃষীকেশ সম্বিৎ ফিরে পায়। এরকম একটা মারামারি লাগার আশঙ্কা ত সব সময়ই থাকে। আজ সার্ভের ব্যাপার নিয়েই সেটা লেগে যেতে পারে। কিন্তু হৃষীকেশ ছাড়া মারামারি হবে কী করে? হৃষীকেশ সঙ্গেসঙ্গেই দৌড়তে শুরু করে, যতটা জোরে পারে। কমরেড ত আর মারামারি করতে পারবে না। আলবিশও পারবে না। আর ত সব চ্যাংরাছোঁড়ার দল।তাদের কী করতে হবে, সেটা হৃষীকেশ ছাড়া আর-কেউ ঠিকই করতে পারবে না। এক বুদ্ধিমান আছে। কিন্তু বুদ্ধিমান ত একা পড়ে যাবে। হৃষীকেশ চরের লোকগুলোকে পেরিয়ে চলে যায়। এই খাড়া খাড়া, চ, আমরাও ত যাচ্ছি। হৃষীকেশ দাঁড়ায় না, দৌড়তে-দৌড়তেই ভাবে বাগানের মদেশিয়ারা যদি বস্তির মধ্যে এসে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে থাকে? তাহলে ত…•! হৃষীকেশ আন্দাজের চেষ্টা করে চিয়াড়ি (তীর-ধনুক] চালানোর মত দল তাদের ভেতর পাকাতে কত সময় নেবে? কিন্তু সবই ত নির্ভর করে কে বেশি তৈরি, তার ওপর। আনন্দপুরে সমিতির সঙ্গে মারামারি বেঁধেছে আর সে এখানে গান করছে অথচ তাকে একবার না-ডেকেই সবাই চলে গেল! ডাকার টাইম পায় নাই? একটা হাঁক দিলেই ত হত, হৃষীকেশ চলি আইস–এখন দৌড়তে-দৌড়তে হৃষীকেশ সেই ডাক শোনার চেষ্টা করে। না কি ডেকেছিল, হৃষীকেশ শুনতে পায় নি, আর ওরা ভেবেছে হৃষীকেশ ত আসিছেই। তাহলে ত..। না কি, কেউ রোঝেই নাই। হঠাৎ শুরু হই গিছে? কিন্তু হৃষীকেশ ছাড়া একটা মারামারি এতক্ষণ চলছে কী করে। ততক্ষণে হৃষীকেশ আনন্দপুরের জমির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই হাতির রাস্তাটা সামনে বায়ে বেঁকেছে–সেই বাকটা নিলেই আনন্দপুরের ভেস্ট জমির এলাকা। জমির কাছে এসে হৃষীকেশ বোঝে সে এত জোরে দৌড়চ্ছে যে জমিতে পৌঁছে আর দম পাবে না। সে তাড়াতাড়ি তার দৌড়ের বেগ কমিয়ে দেয়। কমিয়ে দিতেই তার বুক আর কানের পাশের শিরার দবদব শব্দে যেন কানে তালা লাগে।
হৃষীকেশ যখন বাকটার কাছাকাছি তখন দেখে উল্টোদিক থেকে বুদ্ধিমান ছুটে আসছে। হৃষীকেশকে দেখেবুদ্ধিমান দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে, রি-শি-কেশ,ল-ডা-ই,ল-ডা-ই, বুদ্ধিমান এক লাফে নালীটা পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে পড়ে। সে ছোট কোঁতকার মত একটা ডাল নিয়ে আবার লাফিয়ে নালীটা পেরতেই হৃষীকেশ লাফ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হৃষীকেশ ডালফাল কিছু পায় না। সে একটা গাছের নিচু ডালটাই টেনে নামিয়ে ভাঙে। ডালটা ভাঙে বটে কিন্তু সেটাকে গাছ থেকে ছেঁড়া যায় না। সমস্ত শরীর দিয়ে ডালটাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করতে থাকে হৃষীকেশ। তখন বাইরে থেকে বুদ্ধিমান ডাক দেয়, হে-এ হৃষীকেশ চলি আয়, চলি আয়, এই লাঠিখান ধর।
বুদ্ধিমানের গলা শুনে হৃষীকেশ নালীটা লাফিয়ে পার হয়ে দেখে রাস্তার ওপর একটা সাইজমত ডাল। ফেলে রেখে বুদ্ধিমান সোজা দৌড়চ্ছে। হৃষীকেশ ডালটা তুলে নিয়ে একটা বিরাট হকার তুলে রে। এ-এ-এ করে সামনে হাতির রাস্তার ভিড়টার দিকে ছুটল। বুদ্ধিমানও হকার দিতে শুরু করেছে। আর হাতির রাস্তাটা দবদব করে ওঠে ওদের ছুটন্ত পায়ের দাপটে। সেই দৌড়ে, সেই হকারে আর লাঠিদুটোর ভঙ্গিতে সামনে বুদ্ধিমানের গেঞ্জিপরা আর পেছনে হৃষীকেশের জামাপরা শরীরে পেশির যেন নর্তনও দেখা যায়।
সামনে এই হাতির রাস্তাটার ওপরই ভিড়–সেখান থেকে ডাইনে জমি নেমে গেছে। সেখানেও ভিড়। দৌড়তে-দৌড়তে বোঝা যায় না কে কোন দিকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বুদ্ধিমান জায়গাটা দেখেই গিয়েছিল, তাছাড়া তারা জানেই কোন দল কোথায় দাঁড়াতে পারে। হাতির রাস্তার ওপরের ভিড়টা ঐ দুইজনের উদ্যত আক্রমণের সামনে ভাগ হয়ে গিয়েছিল–ওরা যাতে মাঝখান দিয়ে গলে যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই প্রথমে বুদ্ধিমান, পেছনে হৃষীকেশ ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যায়। সামনে একটা থকথকে কাদা জমি ছিল, লাফ দিয়ে তার আলে ওঠে। তারপর দুই-চারটা আল পেরিয়েই আবার একটু মাঠ। ভিড়টার কাছে ওরা ততক্ষণে প্রায় পৌঁছে গেছে। বুদ্ধিমান আর হৃষীকেশ লাঠিদুটোকে মাথার ওপর তুলে শা–লা, মাথা ফাটি দিম, শালা, বলে আরো জোরে হকার তুলতেই ভিড়ের ভেতর থেকে ইনকিলাব হকার উঠে ওদের গলার সঙ্গে মিশে যায়। সব সাজিয়েগুছিয়ে যেন হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমানের জন্যই ওরা অপেক্ষা করছিল। তাদের আওয়াজ শুনেই ভিড়টা সরে তাদের ঢোকার জায়গা করে দিয়েছিল। ওরা পেছন থেকে ভিড়টার ভেতর ঢুকে পড়ে, এক লাফে বড় আলের ওপর উঠে সামনে বাগানের মদেশিয়াদের দিকে তেড়ে যায়। অত বেগে ঐ আওয়াজ তুলে মাত্র দুজনের ঐ তেড়ে আসায় বীরেনবাবু এক লাফে মদেশিয়াদের লাইনটার ভেতরে ঢুকে যান। তাতে আবার মদশিয়াদের ভেতর যারা সামনে ছিল তারা হঠাৎ দুপা পেছিয়ে যায়। তারা পেছিয়ে গেলে তাদের পাশাপাশি যারা তারাও দু-এক পা পেছিয়ে যায়। ফলে মদেশিয়া লাইনটাই একটু বেসামাল হয়ে পড়ে। এইটুকুর অপেক্ষাতেই যেন কৃষক সমিতি ছিল। রাধাবল্লভের চিৎকার শোনা যায়–ইন-কি-লাব; একটা দীর্ঘ প্রলম্বিত জিন্দাবাদ আওয়াজের সঙ্গে, যেন শ্লোগানটা শেষ করলেই দম ফুরিয়ে যাবে, কৃষক সমিতি প্রায় মিছিলের মত করেই বড় আলের ওপর উঠে মদেশিয়া লাইনটার ওপর আছড়ে পড়ে। মদেশিয়ারা সবাইই প্রথমে এক-পা দু-পা করে, তারপর প্রায় যেন দৌড়ের মত করেই, পেছুতে থাকে। এটা টের পেয়ে রাধাবল্লভ আবার রণধ্বনি তোলে–ইনকিলাব।
কিন্তু একেবারে আচমকা তাদের থেমে যেতে হয়। মদেশিয়ারা পেছুচ্ছে দেখে তাদের পেছনে এক ঢিবির ওপর থেকে তিনজন মজুর তিনটি চিয়াড়ি (ধনুক] বাগ করে ধরছে রাধাবল্লভদের দিকে। বুদ্ধিমান চিৎকার করে ওঠে, খবরদার। হৃষীকেশ ঘাড়টা ঘুরিয়ে তার দলের লোকদের চিৎকার করে বলে, চিয়াড়ি জোতো, চিয়াড়ি জোতো। কিন্তু কৃষক সমিতি বোধহয় চিয়াড়ি বের করার সময় পায় নি। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ দুজনই পেছন ফিরে আঁতিপাতি খুঁজে নেয়, তাদের দলের চিয়াড়ি বেরিয়েছে কি না। কোথাও খুঁজে পায় না। ওদিকে মদেশিয়াদের চিয়াড়িতে তীর লাগানো হয়ে গেছে। একমাত্র উপায় সবাই মিলে আরো জোরে ছুটে চিয়াড়ি ছোঁড়ার আগেই ওদের ওপর হামলে পড়া। বুদ্ধিমান হকার তোলে–ইন-কি-লাব। কৃষক সমিতির দলটা নতুন উদ্যমে ছুটে যাওয়া শুরু করতেই–এবার আর বাধভাঙা বন্যার জলের মত নয়, এইবারের ছুটে যাওয়ার মধ্যে যেন মুহূর্তে একটা হিশেব হয়ে যায়, তিনটি চিয়াড়ি একবারও ছোঁড়া হলে তিনজন মারা যাবে, ওদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে কবার ছুঁড়তে পারবে, কত জন মারা যাবে–আলবিশ ভগত পেছন থেকে দৌড়ে সামনে এসে মদেশিয়াদের দিকে মুখ করে দুই হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। কৃষক সমিতির দলটাও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে, বুক চিতিয়েই, আলবিশের ভঙ্গিতেই।
আলবিশের তখন চোখ দুটো আরো বড় হয়ে গেছে, কপালের লাইনগুলো যেন আরো গভীর, বাবরি চুল থোকা-থোকা ঘাড়ের ওপর আর হা করে থাকায় তার বড় বড় দাঁত, পান-খাওয়া লাল জিভ বেরিয়ে এসেছে।
সামনে ঢিবির ওপরে যারা চিয়াড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চিৎকার করে ওঠে, ভগত, তফাত হো। কিন্তু ভগত তফাতে যায় না, কোনো কথাও বলে না। আলবিশ ওঁরাও, ওদের একটা গোত্রের একটা অংশের পুরোহিত। কিন্তু পুরোহিত ত পুরোহিতই। ভগত ত ভগতই। কৃষক সমিতি হলেও ভগত। লালঝাণ্ডা হলেও ভগত। বুদ্ধিমানকে রাধাবল্লভ সঁতে দাঁত চিপে বলে, বুদ্ধিমান, শ্লোগান দিও না। চিয়াড়ির দলটা ভগতের ওপর তীর ছুঁড়তে ইতস্তত করছে, এত সামনাসামনি, যেন তাতে ভগতকেই মারা হয়। এখন শ্লোগান দিলে ওরা চিয়াড়ি ছাড়ার ছুতো পেয়ে যাবে। কিন্তু হৃষীকেশ আর রাধাবল্লভ এটাও বোঝে এখন যদি ওরা চিয়াড়ি ছাড়েই তাহলে তিনের বদলে ত্রিশ জন মারা যাবে। এখন আর ছুটে গিয়ে ওদের ওপর হামলে পড়া যাবে না। আর কৃষক সমিতির সবাই যেমন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে চিয়াড়ি ছাড়লেই তিনজন পড়বে। সামনে দৌড়তে-দৌড়তে চিয়াড়ি বা গুলি খেলেও দল সামনেই ছোটে। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন মারা গেলে, পুরো দল পেছন ফিরে দৌড়বে। তখন একের পর এক পড়তে থাকবে। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ তাদের বুকের আর কপালের শিরার দবদব শব্দে যেন হিশেব কষে যায় জনা.দু-তিনের মৃত্যুতে তারা যেটা জিততে পারত, কতজনের মৃত্যু দিয়ে সেটা এখন হারতে হবে। বুকের এক-একটা আওয়াজে যেন এক-একজন করে মরছে।
কিন্তু আলবিশ কিছু একটা টের পায়। সে তার ওরাওঁ স্বভাবে বুঝে যায়–চিয়াড়ি-ছাড়ার চরম সময়টা পেরিয়ে গেল–এর পর আর চিয়াড়ি ছেঁড়া যায় না। কিন্তু দলটা, তৈরি চিয়াড়ি নামাতে পারছে না–তাতে তাদের হার মেনে নেয়া হয়। আলবিশ ঝট করে মদেশিয়াদের দিকে পেছন ফিরে দুই হাত তুলে কৃষক সমিতির দলকে চিৎকার করে বলে, বৈঠ করো, সবকোই বৈঠ করো, বৈঠ করো। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ সবচেয়ে আগে বসে পড়ে। তারা পেছন থেকে টেনে বুদ্ধিমানকে বসায়। কৃষক সমিতির দল হুড়মুড় করে বসে পড়তে থাকে। আলবিশ ছাড়া।
.
০৩৮.
কৃষক মজুর : ঐক্যের সংগ্রাম
মাঠের ভেতর সুহাস একা দাঁড়িয়ে।
সদ্যরোয়া ধানখেত তখন পায়ে-পায়ে কাদা। চারাগুলো কাদার মধ্যে ঢুকে গেছে। এত মানুষের পা এই খেতটুকুকে দলেছে যে মাটির ভেতরের জল ওপরে উঠে এসেছে। সেই কাদাগলা জলে কিছু চারা ধান ভাসছে।
সার্ভের লোহার চেইনটা লম্বা হয়ে পড়ে আছে–ওদিকে সবুজ মাঠের ভেতর থেকে এখানে কাদামাটির ভেতর দিয়ে, ওদিকে হাতির রাস্তা পর্যন্ত।
বড় আলের নীচে সুহাস একা দাঁড়িয়ে জমিমাপার চেইনটা উদ্ধারে ব্যস্ত। তার কথার মাঝখানে চিৎকার করে দুজন ঢুকে পড়ার পর যেকাণ্ড শুরু হল–দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া সুহাসের কিছু করার ছিল না। কিন্তু সিনেমার মত দেখেও সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না ওরা কি বুড়ো সাঁওতালকে দেখেই তীরধনুক নামিয়ে নিল, নাকি ভয় দেখানোর জন্যই তুলেছিল, ছোঁড়ার জন্য তোলে নি।
আজ থেকে মাত্র বছর দশ আগে ধনুক, সাওতাল, আদিবাসী, জমিন, লড়াই, টোটা, তীর..এই সব নিয়ে সুহাস যা-যা শুনত, ভাবত, দেখত, সেসব এখনই তার ওপর দিয়ে ঘটে গেল, ঘটে যাচ্ছে। অথচ এই ঘটনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দু হয়েও সেই অতীতের, মাত্র বছরদশেকের অতীতের, কোনো ঝিলিক তার মনে কোথাওই খেলে গেল না। এতগুলো আদিবাসী মুখের ভিড় সত্ত্বেও না।
তাহলে, হয়ত বছর দশেক পরে স্মৃতিতে আজকের এই ঘটনাটায় সেই রূপকথা আবার ঝিলিক দিয়ে উঠবে, স্মৃতিতে এই ভিড়টাকে চেনা যাবে–আদিবাসীর, এই লড়াইটাকে চেনা যাবে–জমির। দশ বছর অতীতের স্বপ্ন আর দশ বছর পরের সম্ভাব্য স্মৃতির ভেতর বর্তমানে সুহাস বায়ে তাকিয়ে দেখে বিনোদবাবু, অনাথবাবু, প্রিয়নাথবাবু হাতির রাস্তা থেকে তার দিকে আসছেন। সুহাস এগিয়ে যায়, লাফিয়ে আলের ওপর ওঠে। তারপর ওদের দিকে হাঁটে। দূর থেকে বিনোদবাবু জিজ্ঞাসা করেন, স্যার, আপনার কিছু হয় নি ত?
না, তা হয় নি, কিন্তু আপনারা চেইন ফেললেন, অথচ এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?
স্যার, যেরকম মারামারি দেখলাম, আমরা আর সাহস পেলাম না।
না। আমার জন্য বলছি না। কিন্তু চেইনটা গোটাতে হবে আপনাদের। আর আমি বুঝতে পারছি না বিনোদবাবু, চেইনটা এই জমিতে ফেলতে কে বলল।
কেন স্যার। আমরা ত পর-পর করে যাচ্ছি।
না। তা ত করে যাচ্ছেন। এটা ত আর বর্ডার লাইন নয়, একেবারে ভেস্টেড ল্যান্ডের মাঝখানে। আমরা ত ভেস্টেড ল্যান্ড মাপছি না, মাপার কথাও নয়।
আমি ত দেখি নি স্যার, কী প্রিয়নাথ, তোমরা বিনোদবাবু বলেন। প্রিয়নাথ উত্তর দেয়, আমরা ত আর দাগ নম্বর চিনি না স্যার, আমরা যেমন লাইন বেঁধে চেইন টানছিলাম তেমনি টানছি।
অনাথ লাফিয়ে নেমে চেইন গুটোতে শুরু করে।
সুহাস ওঁদের তিনজনের দিকেই তাকিয়ে বলে, দেখুন, এরকম ভুল যেন আর না হয়, এত গোলমাল বেধে গেল এই এক কাণ্ড থেকে।
বিনোদবাবু একটু চুপ করে থেকে বলেন, আপনি কিছু বলছেন স্যার?
না। তেমন কিছু হলে ত বলতামই, তবে এরকম অদ্ভুত ভুল হওয়া ত নিরাপদ নয়।
সে ত স্যার আজকে একটা আপনার ডেনজারই হয়েছিল। তা হলে এখন ত ক্যাম্পে ফিরব স্যার?
হাঁ চলুন।
আগে আগে সুহাস ও পেছনে-পেছনে বিনোদবাবু ফেরা শুরু করতেই স্যার, স্যার বলে পেছন থেকে হাঁকাহাঁকি শুরু হয়। সুহাস দাঁড়িয়ে পড়ে। রাধাবল্লভ, সেই বুড়ো সাঁওতাল, হাফপ্যান্ট-পরা একজন নিশ্চয়ই বাগানের, আর তাদেরও পেছনে বীরেনবাবু, ওপর থেকে এই আলে নেমে এদিকে আসছে। কাছাকাছি এসে রাধাবল্লভ, বলে, স্যার, আমরা ত আপনার জন্য বসি আছি স্যার।
আমার জন্য কেন?
না, আপনি তখন কী একটা কথা বলছিলেন, তার ভেতর একটা মিস্-আন্ডারস্ট্যানডিং মানে, ওরা দুজন, হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমান, বীরেনবাবু বলেন। সুহাস বুঝতে পারে ওদের যুদ্ধের সমাপ্তিঘোষণার একটা উপলক্ষ চাই। তা হলে দুই পক্ষেরই একটা যুক্তি জোটে যে সরকারি অফিসারের কথা-অনুযায়ী তারা আপস করছে। নইলে তাদের নিজেদের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ধারণের দায় চাপে।
সুহাস বলে, আমি ত আমার চেইন উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। এখন ক্যাম্পে ফিরে যাব। আপনাদের কি মিলমিশ হয়ে গেল?
ফাগু একটু হেসে বলে, মিলমিশ তো হোনা হোগা, কিষান অউর মজদুরকো এক পার্টি, এক ঝাণ্ডা। কিষান অউর মজদুরকে একাই
ফাগুকে থামিয়ে দিয়ে ভগত হাতিরাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, আরে, এম-এল-এ আসি গেলাক, এম-এল-এ।
সকলেই ঘুরে দেখে।
বিনোদবাবু বলেন, আমরা তা হলে এই স্যার। আপনি
সুহাস দাঁড়িয়ে থাকে। এম-এল-এ এসে গেলে সে আর যায় কী করে?
.
০৩৯.
এ কি কৃষক না মজুর?
বড় আলপথটা দিয়ে বীরেন্দ্রনাথ রায়বর্মন এম-এল-এ আসছে–ধুতি-পাঞ্জাবিতে বেঁটেখাট মানুষটির চলনে কোনো জড়তা নেই। পেছনে গয়ানাথ। গয়ানাথের পেছনে সেই সার্ভে ক্যাম্পের চেয়ার উল্টো করে মাথায় নিয়ে বাঘারু।
এম-এল-এ-কে দেখা যাওয়ায় ওপরের লোকজন সব উঠে দাঁড়িয়েছে ও মারামারি হতে-হতে–হওয়ার ফলে যে-একটা সাজানোগোছানো ভাব এসেছিল সেটা ভেঙে গেছে। ওদের কাছাকাছি আসতেই গয়ানাথ পেছন ফিরে বাঘারুকে বলে, যা, ঐ দিক দিয়া উঠি আগত চেয়ারখান পাতি দে।
বাঘারু আল থেকে লাফিয়ে নীচে নামে, সেই বিধ্বস্ত ধানখেতে, তারপর ছোট আল দিয়ে এগিয়ে আবার বড় আলে উঠে, ঐ ভিড়টার কাছে পৌঁছয়। বাঘারু ভিড়ের পেছন দিয়ে ঢুকেছে। আর ভিড়টা সোজাসুজি এম-এল-এর দিকে মুখ করে আছে। ফলে, বাঘারুকে পেছন থেকে চেয়ারটা মাথায় নিয়ে ঠেলে-ঠেলে একেবারে ও-মাথায় ভিড়টার সামনে গিয়ে পৌঁছতে হবে, এম-এল-এ ওখানে পৌঁছনোর আগেই। এদিকে ভিড়ের পেছন থেকে বাঘারু যাকেই ঠেলা দেয় সেই হে-ই বলে চিৎকার করে ওঠে। ঢাকবার জায়গা আর বাঘারু পায় না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে এমেলিয়া ওদিক দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাঘারু এতক্ষণ চেয়ার মাথায় ঢোকবার পথ খুঁজছিল, কারণ ফাঁক না পেলে লোকজনের মাথায়-ঘাড়ে চেয়ারের ধাক্কা লাগতে পারে। কিন্তু এখন, যখন দেউনিয়া এমেলিয়াকে নিয়ে প্রায় পৌঁছে গেছে তার আর-কিছু করার থাকে না। সে চেয়ারটা মাথা নিয়েই পেছন থেকে ঢুকে পড়ে। হে-ই, হে-ই, কায় রে হেই, হেই, বলতে বলতেই একটা গোলমাল পড়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই সবাই তাকিয়ে চেয়ারটা দেখে ফেলে সরে ফাঁক করে দেয়। লোকজন পেছনে চেয়ারের দিকে একবার আর সামনে এম-এল-এর দিকে একবার ঘাড় ঘোরায়। বাঘারু যখন প্রায় হাত দুয়েক দূরে, তখন এম-এল-এ দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর, হাত দুয়েক দূর থেকেই বাঘারু চেয়ারটা মাথা থেকে নামিয়ে হুমড়ি খেয়ে এম-এল-এর সামনে চেয়ারটা মাটিতে রাখে। এম-এল-এই আচমকা দুপা পেছিয়ে যায়।
শালো, বলদ, চেয়ারের ওপর মানষি বসিবে, না মানষির উপর চেয়ার ফেলাছিস? চেয়ারটার মাথায় হাত দিয়ে এম-এল-এ দাঁড়ায় আর বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা নামিয়েছিল সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে থাকে–তার নেংটিপরা ঢ্যাঙা শরীরটা নিয়ে। যদি বাঘারু ছোটখাট হত, বা অন্তত একটু রোগা, ভিড়ের ভেতর দাঁড়ালেও যদি ওকে দেখা না যেত, যদি মিশে যেত ভিড়ের সঙ্গে, তা হলেও তাকে খেয়াল না করে থাকা যেত। কিন্তু এই বাঘারুটা ত একটা পুরনো শাল-গাছের মত–তার শ্যাওলা-ছাতাধরা শরীরে সবাইকে আড়াল করেই তাকে দাঁড়াতে হয়। এমনকি তার নেংটিটাও তার শরীরের সঙ্গে এমনই মিশে আছে যে বাঘারু যেন সত্যি একটা গাছই। কৃষক-মজুরের সমাবেশেও বাঘারু বেমানান। এখানে চা বাগানের মজুররা আছে। তাদের হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি। কারো কারো নাইলনেরও। মাথায় তেল ও কাল চুল আঁচড়ানো। ধুতি পরাও যারা, একটু বয়স্ক, তাদের খাকি হাফশার্ট আর ধুতি ফর্শাও বটে। এখানে কৃষক সমিতির দলের সবাই হৃষীকেশ নয়, এমন-কি বুদ্ধিমানও নয়। আলবিশই আছে–তার পরনের কাপড় তু প্রায় নেংটিই, এত খাটো। কিন্তু তারও তৈলাক্ত বাবরি ঘাড়ের ওপর দোল খায়। অথচ এত বড় একটা বাঘারু, তার শরীরের চামড়া গাছের বাকলের মত, মুখ-চোখে কোনো ভাষা নেই, মাথার চুলের আলাদা রং নেই। সত্যি এখানে চলে না। এখানেও চলে না।
এ হে-ই বাঘারু, সরি যা কেনে।
হে পাহাড়টো, তফাত হো ভাই।
হে-ই–
বাঘারু টের পায় না। আর তখন এম-এল-এ, তার একেবারে নাকের সামনে এরকম একটা প্রাচীরের মত লোক খাড়া থাকায় দুবার গলা খাকারি দেয় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। গয়ানাথ পেছন থেকে এম-এল-এর পাশে এসে আঙুলটা তলার খেতের দিকে দেখিয়ে বলে, হে-ই বলদখান, ঐঠে গিয়া খাড়া, খাড়া থাকিব।
বাঘারু সঙ্গে-সঙ্গে সোজা হেঁটে এম-এল-এর পাশ দিয়ে, গয়ানাথের পেছন দিয়ে পরে আরো দু-একজনকে ঠেলা দিয়ে নীচে নেমে যায়। তার চেহারাটাই এমন যে অনেকখানি জায়গা না-হলে তার চলে না। ফলে, সে চলে যাওয়ার পর অত মানুষজন সত্ত্বেও জায়গাটা একটুক্ষণের জন্য একটুখানি খালি-খালি লাগে।
সেই সুযোগটা নিয়ে সুহাস এম-এল-এর সামনে এসে মনস্কার করে বলে, আমি এখানকার হলকার চার্জে
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনারা ত হাটে ক্যাম্প করেছেন, দেখে আসছি, এইখানে কোনো প্রবলেম নাই ত? শুনলাম কি মারামারি নাকি—
সুহাস তাড়াতাড়ি না, আমার কোনো প্রবলেম নেই, বলে সবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে যোগ করে, এদের যদি কিছু থাকে এরা বলবেন। আমি তা হলে যাই, আমাদের ক্যাম্পের লোকজন ওয়েট করছেন, ওঁদের তা আবার গিয়ে রান্নাবান্না- হ্যাঁ, হ্যাঁ, এম-এল-এ ঘড়ি দেখে, দুটা ত প্রায় বাজে। আমিও ত বসতে পারব না। আমি যাব সেই ফুলবাড়ি বস্তি, মাঝখানে ফরেস্ট, তাড়াতাড়ি যাওয়া লাগবে, ঐখানে একটা ক্যালভার্ট নিয়ে গোলমাল।
বাগানের জিপটাকে খবর দিচ্ছি, বীরেনবাবু বলেন।
ফুলবাড়ি বস্তিতে জিপও যায় না। নদী আছে, হাঁটতেই হবে। আর আপনাদের জিপগাড়ি বেশি চড়লে হাটা ভুলে যাব। তারপর আপনারা যখন জিপ দেবেন না? এম-এল-এ হাসে। সুহাসের সন্দেহ হয়, আসলে লোকটা বাগানের জিপের খোঁজেই এসেছিল, অন্তত নদী পর্যন্ত যেতে পারত, কিন্তু এখন আর জিপ নেয়া যায় না। এম-এল-এ যখন, জিপ নেবেই বা না কেন?
কিন্তু আপনি আমাদের এইখানে ক্যাম্পে হাত পুড়াবেন রান্না করে, সে ত আমাদের দুর্নাম।
না, না, ঠিক আছে, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, নমস্কার।
হ্যাঁ, নমস্কার।
এইবার এম-এল-এ সোজা তাকিয়ে বলে, শুনেন, আমাদের সরকারের আমলে অন্তত আধিয়ার-রেকর্ডটা করে ফেলার জন্য এই সেটেলমেন্টের ব্যবস্থা। জলপাইগুড়িতে তিস্তা ব্যারেজের জন্যে এই এলাকার সেটেলমেন্ট অত্যন্ত দরকার। এখন আধিয়ার মানে যে আধিয়ারই, তা ত নাও হতে পারে। কিন্তু চাষটা কে করে সেইটা রেকর্ড হওয়া দরকার। সেটা অনুমতি দং-এও যদি হয়, তোক। কিন্তু হোক। কিন্তু এই সব নিয়ে নানারকম গোলমাল ধাবার চেষ্টা হচ্ছে। এখন আমাদের মধ্যে যদি গোলমাল থাকে, মারামারি থাকে সে-সব পরে মীমাংসা করা যাবে। এখন আপনারা গোলমাল করবেন না। কী রাধাবল্লভদা।
রাধাবল্লভ হেসে, চোখ বুজে, ঘাড় কাত করে থাকে। তারপর বলে, কথাটা হচ্ছে, আপনি আসছেন এ ত আমাদের সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু আপনি ত থাকিতে পারিবেন না। একদিন আসেন আমাদের এইখানে, বসি আমাদের সব সমস্যা শুনেন, মীমাংসা করি দেন, তা হলি আর মারামারি হবে না।
হ্যাঁ। সে একদিন তাহলে, আপনাদের সুবিধেমত একদিন, যখন আমাদের সেসন বন্ধ, ঠিক করে বসলেই হবে।
আমাদের ত রোজই সুবিধা। আপনি সময়সুযোগ করি আসিবেন, আগে খবরদিবেন আর একদিন পুরা দিন পুরা রাত থাকিবেন। আসিলেন আর গেলেন এ্যানং নয়।
আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে, আমি জানাব চেয়ারের মাথা থেকে এম-এল-এ হাতটা তোলেন, কী ফাগু, তাহলে আমাকে ত আজ আবার ফুলবাড়ি যেতে হবে। গয়ানাথ পাশ থেকে সরে নেমে যায়।
উত ঠিকো বাত খে, সব করনে হোগা, ফাগু মাথা নাড়ে।
কিন্তু কথাটা হচ্ছে আপনার বোধহয় আর-একটা বিষয় একটু জানা ভাল, রাধাবল্লভ বলে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেন, বলেন, এম-এল-এ এক পা এগিয়ে আসে।
কথাটা হচ্ছে বাগানের, চা বাগানের, কোম্পানি কোন অফিসার রাখবে, তার কী কাজ হবে, সেই সব ত আমাদের বিবেচনার বিষয় নয় কিন্তু একটা কথা আপনি কোম্পানির সঙ্গে করিবেন যে, কী যেন, এস্টেট অফিসারের কাম কী ইউনিয়ন করা?
বীরেনবাবু সামনেই ছিলেন, এম-এল-এর পাশে। তিনি হঠাৎ চাপা গলায় বলে ওঠেন, হাইলি অবজেকশনেবল। ফাগু
ফাগু ব্যাপারটা ধরতে পারে না। সে মাথাটা নাড়ায়। এম-এল-এ গলাটা একটু বাড়িয়ে অন্য গলার স্বরকে চাপা দিয়ে বলেন, সেটা ত রাধাবল্লভদা ইউনিয়নই বুঝবে, আপনি-আমি ত আর বলতে পারি না। কিন্তু এর ফলে যদি আমাদের ক্ষতি হয়, তা হলে ইউনিয়নের সঙ্গে বসতে হবে। আপনারা নিজেদের মধ্যে বসতে পারেন। আবার, আমি যেদিন আসব সেদিনও এই নিয়ে কথা বলা যাবে। কেমন? একটু থেমে তিনি যোগ করেন, কিন্তু আজ ত আর আমি থাকতে পারছি না, এখন রওনা হলেও ফুলবাড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর লেট করা ঠিক না রাধাবল্লভের কথাটা আসলে সমষ্টিমতেরই প্রকাশ, এখানকার অভিজ্ঞতায় যা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য থাকতেই পারে না।
.
০৪০.
বাঘারুর জিপারোহণ
অনেকেই এম-এল-এ-কে এগিয়ে দিতে আসে। রাধাবল্লভ মোটা আলটায় নামে, সঙ্গে ভগত। হৃষীকেশ মোটা আলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, রাধাবল্লভের সঙ্গে আর এগয় না। ফাগু এম-এল-এর পাশাপাশিই চলে। বীরেনবাবু একটু পেছনে। ফাগু বোঝাচ্ছিল, আপ কুচ শোচথে মাত। ই ত হামরা ঘরকা মামলা, ঘরমে ফয়শালা হোনা, কিয়া রাধা দাদা?
রাধাবল্লভ পেছন থেকে বলে, তুমি ত সবই বেশ বুঝমানের মত বলল সেই হল বিপদ, যে যাই বোঝায় তাইই বোঝো। শুনে এম-এল-এ ঘাড় ঘুরিয়ে রাধাবল্লভের দিকে তাকিয়ে হাসে।
ফাগু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, ই ত ঠিক বাত।
এম-এল-এ তখন ফাগুর বাহুটা চেপে ধরে বলে, এই ফাগু কমরেড, শুনো। সব বাতই ত ঠিক বাত। লেকিন তোমাকে এইটা ভাবতে হবে, তোমার পার্টির পক্ষে কোন বাতটা ঠিক। সেইটা হচ্ছে সবার বড় ঠিক বাত।
হাঁ জরুর, ফাগু মাথা হেলায়। এম-এল-এ সহ সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে।
না। শুনো। এই যে আজ যদি আমাদের পার্টির মধ্যেই একটা দাঙ্গা হত, মারামারি-খুনাখুনি হত, পুলিশ আসত, কাগজে খবর ছাপা হত–সেটা ত আমার সরকারের বদনাম হত—
জরুর। লেকিন ঐ রিশিকো মাথা গরমাগরম্। উ কাহাসে লাঠি লেকে জিন্দাবাদ দেকে, আরে বাবা, বলে ফাগু হেসে নিতে কথা থামায়।
হ্যাঁ। নিশ্চয় রিশিকেশের দোষ। রিশিকেশ–এম-এল-এ পেছন ফিরে দেখে হৃষীকেশ নেই। রাধাবল্লভ হাসে, আর বলেন,কেন, একদিকে রিশিকেশ, সব কিছুতেই লাঠি, আর-একদিকে আমাদের ফাগু, সব কিছুতেই ঠিক বাত–এদের যে যায় বুঝায়, তাই বুঝে, রাধাবল্লভ বীরেনবাবুর দিকে তাকায়। এম-এল-এ চোখ সরিয়ে নেয়, যেন, এই ইঙ্গিতটা সে বুঝতে চায় না।
ওরা হাতির রাস্তায় উঠেছিল। রাধাবল্লভরা দাঁড়িয়ে পড়ে–আমরা আর আগাই না–তাহালি আপনি ত আসিবেন, তখনই সব কথা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে, আপনারা যান। একটু মাথা ঠাণ্ডা করে চালাবেন। আমি আসার আগে চিঠি দিব।
আপনি কি একা-একা যাবেন নাকি ফরেস্ট দিয়া? পেছন থেকেই রাধাবল্লভ জিজ্ঞাসা করে। এম-এল-এ না ঘুরে হাত তুলে বলে, না না সে যাবে কেউ-ফাগুর বাহু এম-এল-এর হাতে ধরাই ছিল। ফলে, মনে হয় যেন এম-এল-এ চায়ই সে তার সঙ্গে আরো কিছুটা চলুক। হাত না-ছাড়লে আর গিয়ে থাকে কী করে? বীরেনবাবু একটু পেছন-পেছনই আসছিলেন। কিন্তু রাধাবল্লভরা চলে যাওয়ার পর, মনে হচ্ছে, তিনি এই দলের সঙ্গে যাচ্ছেন।
ওরা ওদলাবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটার মুখের দিকে এগচ্ছিল–ফরেস্টের ভেতর দিয়ে যে বড় রাস্তাটা ওদলাবাড়ি গেছে। দূর থেকে দেখাই যাচ্ছিল রাস্তাটার মুখে আনন্দপুরের জিপটা দাঁড়িয়ে। গয়ানাথ জোতদারও কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এম-এল-একে আসতে দেখে দু-পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সেই মোড়, জিপগাড়ি ও গয়ানাথ কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে বীরেনবাবু বলেন, কী ফাগু, বাগানের জিপ ত দাঁড়িয়েই আছে।
ফাগু সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুরে বীরেনবাবুকে বলে, হ। কমরেডকো পৌঁছ দোও, ফুলবাড়ি বস্তি। এই ঘোরার ফলেই ফাগুর বাহু থেকে এম-এল-এর হাত খসে যায়।
বীরেনবাবু একটু হেসে বলেন, তা হলে বাহাদুরকে ডাকো।
বাহাদুর জিপের পাশেই মাটিতে বসেছিল বলে তাকে দেখা যায় নি। সে উঠে দাঁড়াতেই বীরেনবাবু বলেন, বীরেনবাবুকে ফুলবাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসো।
এম-এল-এ বলে ওঠে, আরে এইটুকু ত হাঁটিই চলে যাব, তার উপর বস্তি পর্যন্ত ত আর গাড়ি যাবে না, মাঝখানে ত নদী।
গয়ানাথ জিপের সামনের সিটের দিকে আঙুল তুলে বলে, উঠেন, উঠেন, ঐ নদী পর্যন্ত গাড়িতে যান, তার বাদে নদী পার করি দিবে–হে-এ বাঘারু।
যখন আঙুল তুলল তখন মনে হল গয়ানাথ জিপটার মালিক, যখন কথা বলল তখন মনে হল এম-এল-এর মালিক আর যখন বাঘারুকে ডাকল তখন মনে হল বাঘারুর মালিক।
গাড়িটা পেরিয়ে রাস্তার মুখে এলে বীরেনবাবু সামনের সিট দেখিয়ে বলেন, নিন, ওঠেন। কী, ফাগুও যাবে নাকি?
হাঁ, জরুর–এম-এল-এ উঠে ব্রিফ কেসটা কোলের ওপর তুলে একটু ডাইনে সরে জায়গা দেয়, ফাগু সামনের সিটে বসে। গয়ানাথ এগিয়ে এসে বলে, এই যাচ্ছে, মোর মানষি। আপনাকে নদীখান পার করি দিয়া, ফুলবাড়ি পৌঁছাই দিয়া, আসিবে।
এম-এল-এ বাঘারুকে ঠিক দেখে কিনা বোঝা যায় না। গয়ানাথ বলে, হে-এ বাঘারু, পাছত ওই কেনে।
জিপগাড়িটা তখন স্টার্ট দিয়ে তৈরি। এতই লম্বা বাঘারু যে সে মাটি থেকে পা তুলেই জিপের ভেতর ঢুকে যেতে পারত। কিন্তু পায়ের দৈর্ঘ্য আর জিপের উচ্চতার তুলনা ত কোনোদিনই তার অভিজ্ঞতায় আসে নি। তাই জিপ গাড়িটা যেন একটা পাহাড়, তাতে উঠতে বাঘারু পেছনের লোহার ডালাটার ওপর দুই হাতে শরীরের ভর দিয়ে ভেতরে গলে যেতে চায় কিন্তু তার মাথা ছাতে ঠেকে যায়। আর তখনই গাড়িটা চলতে শুরু করলে বাঘারু প্রায় হুমড়ি খেয়ে ঐ ঢাকনার ওপরই পড়ে। কিন্তু পড়তে-পড়তেই তাড়াতাড়ি হাতের ভরে উঠে, পা দুটো উঁচু করে, ডান হাঁটু ঐ রেলিঙের ওপরে তুলে দিতে পারে। ফলে রেলিংটার ওপরই বসে পড়ে। বাঁ পায়ের পাতা রাস্তায় ঘসে। তখন সে জিপের ভেতর গড়িয়ে যায়। তার লম্বা, পেশল, নগ্ন, রোমহীন, বা পাটা জিপের পেছনে শূন্যতার ফ্রেম জুড়ে অনেকক্ষণ থাকে। তার মাটিলেপা, থ্যাবড়া, হুকওয়ার্মের ফুটোয় দাগি পায়ের তলাটা খুব শাদাসিধে সোজা টাঙানোই যেন, ওখানে, পোস্টারের মত। আর ঐ পাটা অমনই যেন থাকার কথা ওখানে। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে ঢোকাতে থাকে বাঘারু, যতক্ষণ তার মাথা সামনের সিটের পেছনে গিয়ে ঠেকে না যায়। আর নুড়িছড়ানো বর্ষার রাস্তার খানা-খন্দে লাফিয়ে-লাফিয়ে হেলেদুলে, কাতরে-বেঁকে জিপ গাড়িটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ানো বোল্ডারের মত বেতালে-বেচালে গড়িয়েই যাচ্ছিল। তাতে বাঘারুর এই ঝাপানো আর গড়ানো টেরই পাওয়া যায় না। শুধু বাহাদুর একবার টেরিয়ে দেখে নিয়েছিল। জিপের অতটুকু জায়গায় নিজের অতবড় শরীরটাকে সেঁদিয়ে, কাত হয়ে, উপুড় হয়ে, হাঁটু আর হাতের পাতার ওপর ভর দিয়ে উঠে, বসে, শেষে আবার ঘুরে বাইরের দিকে তাকানো–এমনিতেই মেহনত ও কৌশলের ব্যাপার, তদুপরি জিপের ঝাঁকুনিতে প্রায় অসম্ভবই হয়ে উঠতে চায়। শেষ পর্যন্ত জিপের মেঝেতে বসে, পেছন ফিরে, পেছন থেকে ফরেস্টের দিকে তাকাতে পারে বাঘারু।
এমনভাবে ফরেস্টেকে ত আর দেখে না, ফরেস্ট সব সময়ই প্রথমে বাঘারুর সামনে, তারপরে সে ফরেস্টের ভেতরে, তারপরে ফরেস্ট তার সব দিকে-ওপরে-নীচে, ডাইনে বায়ে, সামনে-পেছনে, শেষ পর্যন্ত ফরেস্ট তার গায়ের সঙ্গে মিশে যায়। এমনি হয়ে আসে বরাবর। কিন্তু পেছনে বসে ফরেস্টের উঁচু-নিচু, মাথা-গোড়া, কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সেই আড়াল থেকে ফরেস্ট দুপাশে হু-হুঁ গলে গিয়ে রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছে। ফরেস্ট স্থির থাকে, পাহাড়ের মত, আর বাঘারুই সেখানে ঢোকে। জিপের পেছনে সেই স্থির, ফরেস্ট তার দুপাশ দিয়ে সরে যায়। যেন ফরেস্টের ভেতর সে ঢুকছে না–ফরেস্টের ভেতর এই কাল রাস্তাটা সিদচ্ছে। পেছনে যতদূর চোখ যায় কাল রাস্তাটা লম্বা থেকে লম্বা হয়ে যাচ্ছে, আরো লম্বা। বাঘারু একটু বেশি লম্বা বলেই হয়ত তার চোখ একটু ঠেকে যায় সামনের ফাঁকটার ওপরে। তাই সে গাছের মাথা দেখতে পায় না। শুধু তাই নয়, তার মনে হচ্ছিল যেন এই বনের তলার জংলার ভেতর দিয়ে একটা পাতালের মত বনে সে ঢুকে যাচ্ছে। পাতালের মত বনে-যেখানে বনের মাথা দেখা যায় না, শুধু তলা দেখা যায়।
এই কি ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মনের ফরেস্ট? এর ত কোনো কিছুই সে চিনতে পারছে না, কোনোদিন যে এই ফরেস্টে সে ছিল তাও যেন মনে হচ্ছে না। অথচ চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলে, বর্ষার এই জংলায় আর লতায় পা-জড়িয়ে যেতে পারে বটে, কিন্তু বড়, পুরনো কোনো গাছের সঙ্গে ঠোক্কর খাবে না, নিশ্চয়ই। এখন জিপের ভেতর থেকে, পেছনে সে বুঝতেই পারছে না, কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে।
জিপ গাড়ির পেছন থেকে, গাড়ির ভেতরে ঝাঁকুনি খেয়ে লাফাতে-লাফাতে, কাত হয়ে, হোঁচট খেয়ে বাঘারু তার এই চিরকালের ফরেস্টটাকেই অচেনা হয়ে যেতে দেখে, যেমন সে দেখে যখনই কখনো এরকম গাড়িতে দেউনিয়া তাকে তুলে দেয়। আসিন্দিরের ভটভটিয়ার পেছনে তাকে বসালে এরকম লাগে না। তখন ত সবই সামনে, তার বুকের সামনে। তাই, গাড়িটা থামার পর, প্রথমে ফাগু লাফিয়ে ও তার পরে এম-এল-এ ব্রিফকেসটা নিয়ে একটু ঘষটে, নেমে গেলেও বাঘারু নামতে পারে না। ফাগু আর এম-এল-এ নেমে যাওয়ার মানে যে তারও নামা–এই অভ্যস্ত প্রয়োজনীয় বোধটাও অর লোপ পেয়ে বসে থাকে মোটর গাড়িতে গতিতে অতিক্রান্ত দূরত্বটুকু বুঝতে। এত তাড়াতাড়িই কি ফুলবাড়ির নদীর পারে পৌঁছে যাওয়া যায়? এ যেন ফরেস্টটাকে টেনে ফুলবাড়ির নদীটার কাছে আনা। চারপাশের বনজঙ্গলের যে-পরিচয় অন্তত বাঘারুকে কিছু আশ্বস্ত করতে পারত–তাও এই জিপের আড়াল থেকে অদৃশ্য।
বাহাদুর হঠাৎ গিয়ার বদলে সঁ-আঁ করে জিপটা পেছিয়ে নেয়। তখন ফরেস্টটা বাঘারুর সামনে, সবটুকু দেখতে না পেলেও, সামনেই। ফরেস্টের ভেতরে সেই ঢুকছে, ফরেস্টটা স্থিরই আছে–এই বোধটুকু সে অন্তত ফিরে পায়।
কিন্তু পরক্ষণেই বাহাদুর আবার একটা ধাক্কায় সামনে এগিয়ে যায়। বাঘারু হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গাড়িটা সবটুকু ঘুরিয়ে আনন্দপুর ফিরে যাওয়ার জন্য দাঁড় করিয়ে বাহাদুর ঘাড় না-ঘুরিয়ে বলে, উতরো।
তখন বাঘারুর সামনে, একটু দূরে, ব্রিফকেস হাতে এম-এল-এ আর ফাগু। গাড়িটা ঘুরে দাঁড়াতেই ফাগু ছুটে এসে সামনের সিটে বসার পরও বাঘারুর জিপ থেকে নামা শেষ হয় না। সে, বাহাদুরের কথা শোনামাত্র দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মাথায় ঠোক্কর খেয়ে বসে পড়েছে। তারপর ঘষে-ঘষে ঐ পেছনের ডালাটার কাছে এসে এক পা বের করে। কিন্তু সে পা মাটিতে রাখার আগেই জিপ গাড়িটা হু-স করে বেরিয়ে যায়। ফাগু পেছন ঘুরে লাল সেলাম বলে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘোরায়, কিন্তু এম-এল-এ-কে পায় না। তখন রাস্তা জুড়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে এম-এল-এ ডাকে, চলেন ভাই, ঝট করি নদীখান পার করি দেন।
জিপগাড়ি যখন আর দেখা যায় না, তখনো আওয়াজ আসছে। বাতাসে পেট্রলপোড়া গন্ধ। বাঘারু হাঁটতে শুরু করে। পেছনে এম-এল-এ। বাঘারু একটা ছোট ডালকে লাঠি বানায়। সেটা দিয়ে দু-পাশের জঙ্গল সরায়। একটুখানি বন পেরলেই মাঠ। মাঠ পেরলেই নদী। নদী পেরলেই ফুলবাড়ি।
.
০৪১.
মায়ের বাঘারুপ্রসব, বাঘারুর ব্যাঘ্ৰনিধন ও এম-এল-এ তরণ এবং বাঘারুর প্রথম সংলাপ নিয়ে আদিপর্বের শেষ অধ্যায়
কয়েক-পা যেতেই বনের গন্ধ সারা শরীরে ভর করে। ঝিঁঝির ডাক ক্রমে বাড়ে। দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। যেন, এরকম অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে, ওদের, যেমন হয়, বনে।
এম-এল-এ পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালার নামখান কী হে?
বাঘারু তার হাতের লাঠিটা দিয়ে সামনের জঙ্গল সরাতে-সরাতে বলে, ঐখান ত বড় লজ্জার কথা বাবু।..
কোনখান?
ঐ। মোর নামখান।
ধুত, নামতে আর লজ্জা কী আছে? নাম ত নামই।
মোর নামখানি বাড়ি যাছে।
কায় বাড়ি যাছে?
যত টাইম যাছে, মোর নামখান সলসল করি বড় হয়্যা যাছে। এ্যালায় এ্যাতখান বাড়ি গেইছে যে ঐ নামখানে মুই আর আটো না। ঢলঢলাছে।
ত নামখান ক কেনে, শুনি।
কছি, এমেলিয়া বাবু। কিন্তু তোমাক মোর নামটা ছোট করি দিবার নাগিবে। য্যানং সগার নাম ছোট হবার ধরে, মোর নামখানও ছোট হওয়া নাগিবে।
বাঘারু খুব নিচু গলায় কথা বলছিল। আর লাঠিটা দিয়ে সামনের জঙ্গলটা সরাতে-সরাতে এগচ্ছিল। এম-এল-এ দেখে, জঙ্গলটা যেন কোনো সময়ই বাঘারুর কোমর ছোয় না। সে যেন মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটছে, এমনি তার হাঁটা, আস্তে-আস্তে। বাঘারুকে চালু রাখতে এম-এল-এ একটু অন্যমনস্ক গলায়ই বলে, নামখান আবার কার ছোট হইল রে?
সগারই ত ছোট হয় বাবু, মোরখানই এক বাড়ি যাছে। ধরো কেনে, মোর দেউনিয়া গয়ানাথ রায়বর্মনখান হয়্যা গিছে গয়া-জোতদার–
এম-এল-এ খুক করে হেসে ফেলে, আর?
ধরো কেনে, রাধাবল্লভখান হয়্যা গিছে রাধু-লিডার
এম-এল-একে এবার আর-একটু বেশি হাসতে হয়, আর?
ধরো কেনে, তোমার নামখানও ত ছোট হবার ধরিছে। ছোট হয়্যা যাছে, আর বাড়িবে না।
কেনে?
আগত আছিল বীরেন্দ্রমোহন রায়বর্মন, এ্যালায় হছে এ্যামেলিয়া।
ধুত, এইটা কি নাম নাকি, এইটা ত কাম।
ঐ ঐ বাবু, কামতই ত নামখান হয়। মোর ত সেইটাই গোলমাল। হাজারিয়া কাম। হাজারিয়া নাম। কামও বদলি যাছে, নামখানও বাড়ি যাছে। এক কামের পরে আরেক কাম, এক নামের পর আরেক নাম।
এম-এল-এ বলে ওঠে, তায় তোমাক মালষিলা ত বাঘারুই কয়?
মুখ না ফিরিয়ে চলতে-চলতে বাঘারু বলে, মানষিলা ত মোক বাঘারু নামখান দিয়াই খালাশ, কিন্তু মুই লাগাম কুনঠে? মানষিলা জানে না, মোর আর-একখান নাম আছিল। গয়ানাথ দিছে।
গয়ানাথ নাম দিছে?
হয়। গয়ানাথ ত মোক নাম দিয়ে বাবু। গয়ানাথ মোর মাও-এর দেউর্নিয়া, মোর দেউনিয়া, জমির দেনিয়া, ফরেস্টের দেউনিয়া, তিস্তা নদীর দেউনিয়া, ভোটের দেউনিয়া। ত ধরো, এ্যানং একখান ভোটের আগত কহিল, হে বাউ, ভোটত তয় নামখান দিয়া দিছু। ত মুই পুছিলো, কী মোর নামখান। ত কহিল, ফরেস্টচন্দ্র বর্মন, মনত রাখিস ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। ত মুই মনত রাখি দিছু ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। মনত রাখি ভোট দিছু–গয়ানাথের ভোট। কিন্তু তার বাদে একেদিন সাহেব দেখিলো–পায়ে গামবুট, মাথায় টুপি, মিলিটারির নাখান ফরেস্টারসাহেব ফরেস্টের ভিতর হাঁটিছে, য্যান মাখনা হাতি। ত মুই মোর নামখান বদলি ফরেস্টার করি নিছু, মোর পাকা নাম। লিখা আছে ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। কিন্তু মুই কহি ফরেস্টারচন্দ্র বর্মন। এম-এল-এ ততক্ষণে বাঘারুর পেছনে। তাকালে সে দেখতে পায়, বাঘারুর উদোম পিঠে ও পাছায় নানা দাগ–গাছের কাণ্ডে ফাটা-ফাটা যেমন কত দাগই থাকে।
তা তোর নামখান শেষ হইল কুনঠে?
ঐটাই ত কাথা। মুই ত সবখান নামই রাখি দিছু–ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। বর্মন এইঠে অনেক মিলিবে, ফরেস্টচন্দ্রও অনেক পাবেন, রায় বর্মনও আছে, কিন্তু বাঘারু-বর্মন এই একোখান। নামখান। এ্যানং বড় হয়্যা গেইল যে ঢলঢলাছে, খলখলাছে, খুলি-খুলি যাছে।
ত মানষি ত তোমার নামখান কাটছাট করি টাইট করি নিসে?।
ক্যানং?
সগায় ত তোমাক বাঘারুই ডাকে, তুমিই ত এ্যালায় নামখান বড় করিবার ধরিছেন।
হে-এ এমেলিয়া বাবু। তোমরালার ক্যানং কাথা? আরে বাঘারুখান ত মোর নাম না-আছিল। মানষিলা দিসে–
তার আগত কী আছিল?
কহিছু না, ফরেস্টারচন্দ্র বর্মন। তার আগতও আছিল একখান।
তার আগতও তোমার নাম আছিল?
আছিল ত। মোর জন্মিবার আগতও মোর একখান নাম আছিল।
জন্মিবার আগত?
হয়। হয়। মোর ত একখান মা আছিল। হয়।
তা ত থাকিবার নাগেই হে।
ত মুই এখান এ্যানং চায়ের বাগানের ফ্যাক্টরির চোঙের নাখান মানষি। মোর এখান মা না থাকিলে চলে? মা না থাকিলে মুই আসিম কুনঠে?
ত ঠিকই। কোটত আছিল তোমার মাও?,
মোর মাওখান ত গয়ানাথেরই আছিল। কাজকাম করিত। খোয়া খাইত। আর ফরেস্টের ভিতরত গিয়া শুখা কাঠ, ডালপালা কুড়ি আনিবার নাগিত। আস্ত-আস্ত ডাল। আস্ত-আস্ত গাছ। আনি গয়ানাথের খোলানে পাঞ্জা করি রাখিত। দিন নাই, রাতি নাই, কাঠ কুড়ি যাছে, কুড়ি যাছে। য্যালাই পাহাড়ের নাখান উচা হবার ধরিত, গয়ানাথ একখান ট্রাক ধরি আনি বেচি দিত। মুই য্যালায় মোর মাওয়ের প্যাটত আসিছু, প্যান্টের ভিতরত আসি গেইছু, মাওয়ের প্যাটখান বড় হওয়া ধরিছে, সগায় জানি গেইছে মুই আসিম, মুই আসিম, স্যালায় সগায় মোক ডাকিবার ধইচছে–কুড়ানিয়ার ছোঁয়া–
ত, এইখান তোমারালার প্রথম নাম।
তার আগত মোর নামখান আর আসিবে কোটত। কিন্তু মুই মাওয়ের প্যান্টের ভিতর ত বড় হওয়া ধইচছি আর মাওয়ের প্যাটখান এককেরে ঢাক হয়া যাছে, ফাটি যাবে কি যাবে না, সেই টাইমত একদিন বাঘারু ঘুরে এম-এল-এর মুখোমুখি দাঁড়ায়, মাওয়ের মোর প্রসববেদনা উঠিবার ধরিছে। মুই জন্মিবার ধইচছি। মাওয়ের প্যাটখান ফালা ফালা করি বাহির হওয়া ধইচছি। আর মাওখান মোর জমিত লুটাপুটি খাছে, লুটাপুটি খাছে–
বাঘারু তার কোমর বরাবর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে, যেন ওখানে ওর মা এখনো ছটফটায়। তার সেই দেখাটা চলতে থাকে নিজের জন্ম দেখা পর্যন্ত। তার থেকে কয়েক হাত দূরে এম-এল-এ সেই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মুইত বাহির হয়্যা গেছু। মাওয়ের প্যাট থিকা বাহির হয়্যা গেছু।
আবারও তাকে চুপ করতে হয়–মাটির ওপর শ্রান্ত মা ও নতুন বাচ্চাকে দেখতে। দেখা শেষ হলে, ফিস ফিস করে বলে, মুই ত এ্যানং কান্দিবার ধরিছু যে জঙ্গলের গাছঠে পাখি উড়ি গেইসে, সেই শালগাছ থেকে ওড়া পাখিদের দেখতে ও আকাশে চোখ তোলে। এম-এল-এও ঘাড় ভেঙে ওপরে তাকায়, যেখান থেকে আকাশ ভেঙে বনস্পতি মহীরুহ নেমে আসছে। বাঘারু দেখে, পাখিগুলো আকাশে পাক দিচ্ছে, শালগাছের মগডালে বসছে, আবার উড়ছে, পাক দিচ্ছে। সেই পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাক ওপরে। আর সেই বাচ্চার তীক্ষ্ণ কান্না নীচে। ঐ নিস্তব্ধ ঝিঁঝি-ডাকা বনান্ত তোলপাড়। বাঘারু খুব গোপনে বলে, মূই কান্দি আর পাখি চিল্লায়। পাখি চিল্লায় আর মুই কান্দি। কিন্তু নাড়ী কাটিবে কায়? ক্যানং করি? বাঘারু চোখ তোলে না। বনতলে নাড়ীতে বাধা এক মা ও এক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
মোর মাও-এরঠে একখান ছোট কুড়ালিয়া আছিল। এই ধরো কেনে, ডাল কাটিবার তানে। সারাদিন ত কাটাকুটি চলিত। ধারও আছিল চকচকা। ঐ ছোট কুড়ালিয়াখান দিয়া মাও নিজের। নাড়ীখান কাটি দিল। ব্যস। কাটি দিল। বাঘারু তার বুক ও বাহুর দিকে তাকায়, ফিরে-ফিরে তাকায় আর এম-এল-একে দেখায় যেন তার এই সাবালকতা সদ্য, ঐ নাড়ীকাটার পরই। তারপর বলে, একটু হাসি মিশিয়ে, ওর তানে ত সগায় মোক কহিত,কুড়ালিয়া-কাটা। ত দেখো কেনে, জন্মিবার আগতঠে মোক নিয়া একখান পালাগান বান্ধা হওয়া ধরিছে–কুড়ানিয়ায় ছোঁয়া। কুড়ালিয়া কোটা।
বাঘারু আবার হাঁটতে-হাঁটতে, জঙ্গল সরাতে-সরাতে বলতে শুরু করে, রাবণের যেইলা গরু আর মহিষ, গয়ানাথের স্যানং বাথান। গয়ানাথের য্যানং গরুর বাথান, মহিষের বাথান, স্যানং গয়ানাথের মানষির বাথান, স্যানং গয়ানাতের জমির বাথান। য্যানং এই পৃথিবীর তামান মানষি গয়ানাথের আধিয়ার আর হালুয়া, এই পৃথিবীর তামান গরু আর মহিষ গয়ানাথের বাথানের গরু আর মহিষ, স্যানং এই পৃথিবীর তামান জমি গয়ানাথের জমি, তামান ফরেস্ট গয়ানাথের ফরেস্ট, ফরেস্টের ভিতর য্যালা হাতি আর বাঘ স্যালায় গয়ানাথের হাতি আর বাঘ–
ত এ্যানং একোদিন, আপলাদের ফরেস্টের ভিতরঠে দুপহরের টাইম মুই আসিবার ধরিছু। মনত না আসে কোটত আসিছু, কোটত যাছু। কিন্তুক কোটত-না-কোটত ত যাছুই। আপলাদের ফরেস্ট ত মোর ধরো কেনে গয়ানাথের খোলানবাড়ির নাখান। কত কাজ এইঠে থাকিবার পারে। ঐঠে গয়ানাথের চষিবার জমি আছে। চড়িবার গরু আছে। হালুয়া আর রাখোলিয়া মানষি আছে। মুইও আছি। ত মনত নাই এ্যালায়–কোটতঠে কোটত যাছি। কিন্তু হঠাৎ এক শালগুড়ির আড়ালঠে– না, কাথাটা ঠিক না হইল! মোর হাতত আছি একখানা গঠিয়া লাঠি। ধরো, এই দেড়হাতি একখান গাটিয়া লাঠি, এই লাঠিটার ঠে ছোট। মুই ত যাছি। আর, একবার এদিক, একবার ওদিক ঝোঁপ ঝাড়ত লাঠি চালাছি। এ্যানং এ্যানং করি।
বাঘারু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একবার বায়ে একবার ডাইনে ঘুরে নাচের মত নিজেকে দোলায়। আর সেই নাচের সঙ্গতিতেই একবার বায়ে, আর একবার ডাইনে, এ্যানং এ্যানং করি, বলে বলে হাতের লাঠিটা দিয়ে জঙ্গলে মারে, বর্ষার জঙ্গলের মাথা ভেঙে-ভেঙে যায়। কিন্তু বাঘারু যে-ছন্দে ডাইনে বায়ে দুলছে। আর যে-ছন্দে তার হাতটা ওঠানামা করে সেটা কিন্তু দ্রুত হয় না। বাঘারু তার হাঁটা বোঝনোর জন্য তাড়াতাড়ি হাঁটে, একটু, ছুটে-ছুটে যাওয়ার ভাব এনে। এম-এল-এর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে বেশ কয়েকটা গাছের আড়ালে চলে যায় সে। তারপর থেমে পড়ে। তারপর সেই গাছগুলোর ভেতর একটা গাছের মতই একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়ায় দুই পা ফাঁক, কোমর থেকে বুক ঠেলে জেগেছে, আবার কাঁধদুটো উঁচু থেকে ঝুঁকে পড়েছে সেই বুকের চড়াইয়ে। মুহূর্তের জন্য বাঘারুর পুরো আকারটা যেন সেই জঙ্গলে, গাছগুলোর ভেতর খোদা হয়ে যায়। কিন্তু পরমুহূর্তে সেই ক্ষোদিত মূর্তিটা ভেঙে ফেলে সে কোমর; ভেঙে নিচু হয়ে বলে, এ্যানং করিতে করিতে যেই মুই এক শালগুড়ির তলার ঝোঁপটাত এ্যানং করি খোঁচা দিছু, দিয়া আবার চলিবার ধইচছি, বাঘারু একটি পা ফেলে বোঝায়–সে চলে যাচ্ছিল, অমনি পাছতঠে এ্যানং করি একখান বাঘ আসি মোর পাছত এক পা আর ঘাড়ত এক পা দিয়া মোর ঘাড়খানের বগলত অর হাঁ করা মুখোন নিয়া আসিছে, উঃ কি গন্ধ বাঘের মুখত। এম-এল-এ ঐ গল্পটার দিকে এগচ্ছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল।
বাঘারু নাকে হাত দেয়, পরমুহূর্তে আবার সোজা হয়ে বলে, বাঘায় হামাক ঠেলিবার ধরিছে, ফেলি দিবার চাহে আর মুই পাও দুইখান গর্ত করি মাটির ভিতরত সিন্ধাবার চাহি, খসা ঝরা পাতায় য্যান মোর পাও দুইখান পিছল না খায়, পড়িলে ত সর্বনাশ আর এ্যানং করি ঘুরি গিয়া মোর ঐ দেড়হাতি লাঠিখান বাঘারুর মুখের ভিতর সিন্ধাই দিয়া দুই হাতত ঠেলিবার ধরিছু–কায় কাক ফেলিবার পারে–বাঘ মোক না মুই বাঘক, প্রায় দমবন্ধ করে বাঘারু বলে, চলিছে, ঠেলাঠেলি চলছে, আর, তারপর সে কেমন পেঁচিয়ে ঘুরে যায়, যেন তার পেছনে, তার পিঠের ওপর এখন সত্যিই বাঘ থাবা গেড়েছে, আর তার সেই মুচড়ে যাওয়া শরীরে সে দুই হাতে দুদিক থেকে বাঘের মুখের ভেতর আড়াআড়ি ঠেকানো লাঠিটা ঠেলছে, ঠেলছে। ফরেস্টের এই আবছায়ায় তার সেই স্থির অথচ প্রচণ্ড বেগের মূর্তিকে যেন দুর্গাপ্রতিমার অসুরের মূর্তি মনে হয়–কিন্তু অসুরের মত ত সে পিঠটা বাকাবার জোর পায় না, অসুরের মত ত সে বুকটা চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে না। দুটো হাতের ওপর তার মোচড়ানো শরীরের সমস্ত ওজন, লাঠিখান একটু ঢিলা হবা ধরিলেই ত বাঘ মোর ঘাড়ত দাঁত বসাইবে, আর, দুই পা যেন একটুও না টলে, মোর ত জানা আছে আপলাদ ফরেস্টের জমিখান ঐঠে নরম, কুনতিঝরার জলকাদায় আর পাতাপচায়। বাঘা ত আর আপলাদের জমি চিনে না। মুই চিনো। কিন্তু পা দুইখান পিছলি যাবারও পরে ত–তাই গোড়ালিখন শক্ত করি দিছু। আবার, সেই শক্ত পায়ের চাপে মাটি কাপে, বাঘা মুখোন এদিক-ওদিক করিবার ধরিছে, বাঘারু নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝায়, কিন্তু মুই ত আর না পারো, মোর হাঁটুখান ভাঙি যাছে যেন হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে এমন একটা ভাজের মত আভাস আসে কোমরে, কাথাটা হইল,কায় আগত পড়ি যাবে, মুই না বাঘায়। যায় পড়িবে স্যায় হারিবে, ব্যস, মুই য্যালা ধরি নিছু মুই পড়ি যাম-যাম, এই মোর হাটুখান–ডান হাঁটুখান-ভাঙি গেইল-গেইল, আর পারিলো না হে, মুই বাঘারুর প্যাটত গেইল, গেইল হে, স্যালায়, ঠিক স্যালায়, বাঘান মোর ঘাড়ঠে আর পাছাঠে থাবাখান চট করি নামি নিল আর মোর দুই হাতত মোর দেড়হাতি লাঠিখান ধরা, মোর হাতটাও নামি যাছে, নামি যাছে, বাঘারু নিচু হতে-হতে দেখায় সেও কেমন বাঘের দিকে নেমে যাছে, স্যালায় মুই বুঝি গেইলু, আরে, আরে, বাঘাখান ত মোক ছাড়ি দিছে, ব্যাস, যেই বুঝিনু–সড়াত করি লাফ দিয়া সামনের গাছটাত চড়ি গেইল, চড়ি গেইল।
বাঘারু লাফ দিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝুলে ডান পা-টা তুলে ডালের ওপর রেখে বা-পা-টা তোলার ভঙ্গি করে, তার বাদে আরো উপরত উঠিবার ধরি, নিচু হয়ে দেখায় তরতর করে ডাল বেয়ে ওপরে উঠল, একেবারে উপরত গিয়া চাহি দেখি, একটু ঝুঁকে, দেখার ভঙ্গি করে, যেন তলায় বাঘ, আর সেই গলের ওপর বসে হেসে কুটিপাটি হয়, সে হাসি আর থামো না, মোর ঐ দেড়হাতি লাঠিখান এ্যানং করি বাঘারুর মুখত চাপি গেইছে যে বাঘারুর সঁতের ফাঁকত লাঠিখান সিন্ধি গেইছে। আর বাঘা বাহির করিবা পারে না, শুধু মাথা ঝাঁকাছে ত ঝাঁকাছে, এ্যানং এ্যানং করি, বাঘারু দাতে লাঠিটা বাঘের মত মাথা ঝাঁকায়, স্যালায় মুই উপরের ডালঠে য্যালায় একখান বড় বাঘারুর মতন আওয়াজ ছাড়িছু-হালু-ম–স্যালায় ঐ বাঘা দাঁত কাঠিখান নিয়া চো চা দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়। বাঘারু আবার কিছু হেসে নেয়।
ব্যস। বাঘা গেইল অর বাড়ি। আর মুই জলপাইগুড়ির হাসপাতাল এ্যানং করি–কায় জানে ছয় মাস না দুই মাস। একখান চাষও চলি গেইল, মোর হালও চলি গেইল–সে দেখায় কী ভাবে শুয়ে ছিল।
সেইঠে মোর নাম হয়া গেইল বাঘারু। বাঘাখানক মুই হারি দেছু, স্যালায় মোর নাম হইল বাঘারু। যায় জেতে তার নামখান ত একড় [রেকর্ড] হয়। বাঘাখানা মোক মারিলে ঐ জায়গাখানের নাম ধরিত বাঘাথোয়া। তা, ধরো কেনে, পুরা একখান পালাটিয়া গান বান্ধ্যা হয়্যা গেইল-কুড়ানির ছোঁয়া, কুড়ালিয়া-কোটা, বাঘারুয়া, ফরেস্টুয়া, চন্দ্র বর্মন।
বাঘারু পেছন ফিরে পথ দেখিয়ে আবার চলতে শুরু করলে তার দেশিয়া ঘরের এম-এল-এও দেখে বাঘারুর পিঠে-পাছায় মাংস-খুলনো বাঘের থাবার দাগ–শাল-গাছের কাণ্ডে যেমন কত দাগই না থাকে। ঘাড় না ঘুরিয়ে বাঘারু বলে, এমেলিয়াবাবু।
কহেন।
মোক একখান ছোটনাম করি দেন।
কহিলেন ত আপনার পালাটিয়া-গানের মতন নাম। মুই ত গান বান্ধিবার পারো না।
মুই না চাও পালাটিয়া-গান। নামের পালাটিয়াখান ঢলঢলাছে, খলখলাছে। মোক একখান মানষির নাম দেন।
এম-এল-এ কোনো জবাব দেয় না। চলতে-চলতে বাঘারু আবার বলে, তুমি একখান জ্যান্ত এমেলিয়ার ঘর। বাগানিয়া মানষিক ঝাণ্ডা দিছেন, বস্তির মানষিক জমি দিছেন আর মোক একখান নাম দিবার না পারেন? এ ক্যানং হাকিম হবা ধরিছু ই, এমেলিয়া?
জঙ্গলটা শেষ করে ওরা সেই পাথারে পড়ে। নিধুয়াপাথার। উঁচু ডাঙা, বরমতল, পাথার, পাথারের। পর নদী–ব্রিজহীন।
বাঘারু বলে, আসেন এমেলিয়াবাবু, পার হওয়া নাগে।
এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে, ক্যানং করি?
বাঘারু বলে, মোর ঘাড়ত উঠেন।
এম এল-এ একবার চারপাশে তাকায়। জঙ্গল, পাথর, আকাশ আর এই নদী। বাঘারু নদীর পাড়ে বসে বলে, উঠেন।
ব্রিফকেস মাটিতে রেখে, জুতোটা খুলে বা হাতে নিয়ে বাঘারুর ডান কাঁধের ওপর দিয়ে এম-এল-এ পাটা নামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে মাথাটা চেপে ধরে বা পা-টাও বাঘারুর বা কাধ দিয়ে নামাতে পারে। জুতোটা ডান হাতে বদলি করে নিচু হয়ে বা হাতে ব্রিফকেসটা তুলে নেয়। একহাতে ব্রিফকেস আর এক হাতে জুতোসহ বাঘারুর মাথাটা চেপে ধরে। বাঘারু জিজ্ঞাসা করে, টাইট করি বসিছেন?
বসিছু।
খাড়াম?
খাড়া।
এম-এল-একে কাঁধে নিয়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে দু-পা ফেলতেই জুতো-ব্রিফকেস নিয়ে বাঘারুর মাথাটা চেপে ধরে এম-এল-এ চিৎকার করে ওঠে, পড়ি যাছে, মোর ব্রিফকেস পড়ি যাছে। পেছিয়ে এসে বাঘারু বসে পড়ে। প্রথমে জুতোজাড়াটা মাটিতে ফেলে দিয়ে ব্রিফকেস সহ এম-এল-এ নেমে আসে, মুই না পার এ্যানং করি পার হবার
মোক গয়ানাথ কইছে. পার করি দিবার নাগিবে তোমাক।
ক্যানং করি পার হম? তরিবার পারি। সাতরিম? জামা কাপড় খুলি
না-হয়, না-হয়। ভিজা গাওত আবার জামা কাপড় পরিবেন কেমনে? গা শুখাবার টাইম নাগিবে। মোর পিঠত ঝুলো। নাও ঝুলো কেনে।
এই জুতা? ব্যাগ?
মোক দাও– বাঘারু এক হাতে জুতো আর-এক হাতে ব্যাগটা নেয়। কিন্তু এম-এল-এ বাঘারুর পিঠে ঝুলতে গেলে মাটিতে তার পাছা ঠেকে যায়। বাঘারু তখন পাড়ের নীচে পিঠ নুইয়ে দাঁড়ায়। আর এম-এল-এ তার গলা ধরে পেছনে ঝুলে পড়ে, দুটো পা দিয়ে বাঘারুর কোমর পেঁচিয়ে।
ঠিক আছে? হাটিম?
হয়। হাট।
বাঘারু জুতো আর ব্রিফকেস দুলিয়ে-দুলিয়ে, পেছনে এম-এল-এ ঝুলিয়ে জলে পা দিতেই এম-এল-এ বলে ওঠে, হে বাঘারু, না হয় রে– কেনে? বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে।
হাত খুলি যাছে। মোক নামি দে। বাঘারু আবার পেছিয়ে পাড়ের কাছে নিচু হয়। এম-এল-এ তার পিঠ থেকে নামে। জুতো আর ব্রিফকেস ফিরিয়ে দিতে দিতে বাঘারু বলে, নিজের ওজনখান হাতত ধরিবার পার না? ত খাড়াও কেনে, খাড়াও।
এম-এল-এ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
জুতা আর বাক্স দুই হাতত টাইট করি ধর।
বাঘারু তার আপাদমস্তক ন্যাংটো শরীরের সঙ্গে দুহাতে জাপটে নেয় এম-এল-এ-কে। বাঘারুর শরীরের ওপর তার শরীরের পুরো ভারটা দিয়ে জুতো আর ব্রিফকেসসহ এম-এল-এ বাঘারুর গলাটাও জড়িয়ে ধরে। ধুতি, পাঞ্জাবি, জুতো, ব্রিফকেস সহ একটা আস্ত এম-এল-এ যেন বিসর্জনের ঠাকুর, বাঘারুর কাধ ছাড়িয়ে-জলের ঠিক ওপরেই, ঠিক ওপরেই। নদীর জলে ধীরে-ধীরে বাঘারুর হাঁটু ডোবে, কোমর ডোবে। তখন এম-এল-এর পেছন আর জুতো-ব্রিফকেস প্রায় জল হেঁয়-ছোয় যেন, আর দু-এক পা গেলেই সেই গভীর জল, সেখানে বাঘারু তলিয়ে যাবে-পরমুহূর্তে ভারমুক্ত ভেসে উঠতে।
কিন্তু বাঘারু জানে, আর দুই পা গেলেই জল আবার কমতে শুরু করবে। এই নদীটার সঙ্গে কোনো বরফগলা ঝোরার যোগ নেই–বাঘারু জানে।
না থাকলেও নদী ত! আকাশ ছাড়া কোনো ঢাকনা নেই।
নদী ত! স্রোত এসে বাঘারুকে ঘা মারলে ফুলে ওঠে–বানভাসি ফরেস্টে এক একটা শালগাছের গোড়ায় যেমন হয়।
চলন্ত শালগাছের মতন মাঝনদীতে বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার স্রোত সামলে এম-এল-এ কাঁধে পা বাড়ায়।
.
তিস্তাপারের এই বৃত্তান্তের আদিপর্ব এখানে–এই মাঝনদীতেই, আপাতত শেষ করা যায়। সামান্য কয়েক-পা গেলেই ওপারে ফুলবাড়ি বস্তি। নদীটা ব্রিজহীন হলেও, ফুলবাড়ি বস্তি ও তার আশেপাশে আরো, সব বসতি-এলাকায়, খেতিতে, চা বাগানে ছোট ছোট ঝোরায় বা স্রোতে অনেক জায়গায় ক্যালভার্ট আছে, যেমন থাকে। যা এখনো মাঝে-মাঝে দুটো-একটা তৈরি হচ্ছে, যেমন হয়। সেরকম একটা ক্যালভার্ট তৈরির ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের গোলমালের ব্যাপারেই এম-এল-এ যাচ্ছে। তার মানে, এঞ্জিনিয়ার, কনট্রাক্টার, ওভারসিয়ার, সিমেন্টের মিকশ্চার, লোহা, বালি, পার্সেন্টেজ, ইউনিয়ন, কৃষক মজুর, লিডার, অফিসার থেকে এম-এল-এ, আবার এম-এল-এ থেকে…,মিটিং, মিটিং ইত্যাদি। সেখানে ত ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন আবার অবান্তর, এখনো যতক্ষণ-না একটা পথহীন ফরেস্ট বা ব্রিজহীন নদী পথে পড়ে।
কিন্তু সে ত বৃত্তান্ত আর-এক–
২.১ বনপর্ব – বাঘারুর নির্বাসন
এম-এল-এ ফিরে এল
ক্রান্তি হাটের হাটখোলায় সন্ধ্যা নেমে গেল। রাস্তার ওপরের মিষ্টির দোকানের হ্যাজাকের আলোতে মাঠের ঐ কিনারাটা উজ্জ্বল দেখায়। অন্য দোকানগুলোতেও আলো জ্বালানো হয়েছে। ফলে সুহাসের, এই বারান্দা থেকে রাস্তার ওপরটাকে, দোকানগুলোর চালাঘরের ওপর দিয়ে উজ্জ্বলতর দেখায়। ধীরে-ধীরে রাস্তার ধারের গাছগুলির নীচের পাতাগুলোতেও আলোর ছিটে লাগে।
সুহাসের বারান্দা থেকে রাস্তার এক অংশ দেখা যায় না, কিন্তু ওপরের আলোর আভা বোঝা যায়। সেটুকু বাদ দিয়ে হাটখোলার বাকি অংশটা সন্ধ্যায় অন্ধকারে দুমড়েমুচড়ে আছে। নড়বড়ে সব বাশের ওপর ভামনির ছাউনিগুলো মাটিতে আরো থুবড়ে পড়ে। সন্ধ্যা যত বাড়ে, মাটি আর আকাশের মাঝখানের ফাঁকটাও ততই বাড়ে।
একদল লোক মাঠটা পার হয়ে হলকা ক্যাম্পের এই ঘরের দিকে আসছে। সুহাস বারান্দায়, বসেছিল। অতজন লোককে একসঙ্গে আসতে দেখে সুহাস অনুমান করে, সার্ভের ব্যাপারে কিছু বলার জন্য দল পাকিয়ে আসছে। সে ঠিক করে ফেলে, কথা বলতে হলে সার্ভের সময় বলতে হবে আর আপত্তি থাকলে লিখিত দিতে হবে-সে সরকারি দলই তোক আর বিরোধী দলই হোক। প্রথম থেকেই সুহাস এ ব্যাপারটায় আইন-অনুযায়ী চলতে চায়, যাতে কারোই কিছু বলার না থাকে।
দলবলটা যখন মাঠের মাঝখানে, সুহাস শুনতে পায়, আপনার এখানে একটু বসব।
শুনেও প্রথমে সুহাস বুঝতে পারে না। চেয়ার থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে একটু এগিয়ে যায়। অন্ধকারে তখনো চিনে নিতে পারে না, কে। তারপর হঠাৎ হাঁটার ভঙ্গিটা দেখে বুঝে ফেলে, এম-এল-এ।
ঘরের ভিতর থেকে প্রিয়নাথ এসে আগেই দাঁড়িয়েছিল। সে এবার লণ্ঠনটা, এনে দরজার বাইরে রাখে। আর, এম-এল-এ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে-উঠতে বলে, আপনার এখানে একটু বসব।
আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আসুন, বলে সুহাস প্রিয়নাথের দিকে তাকাতেই প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে বাইরে দেয়। চেয়ারটা বাইরে আনতে-আনতেই এম-এল-এ উঠে এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তা হলে চেয়ারটা দেবে কোথায়? এম-এল-এই সরে জায়গা করে দেয়। প্রিয়নাথ প্রথমে সিঁড়ির মাথাতেই চেয়ারটা রাখে। কিন্তু বোঝে, তাতে ওঠা-নামার অসুবিধে হবে। তাই একটু সরিয়ে দেয়।
এম-এল-এ চেয়ারটা দেখে। তারপর সেটাকে আর-একটু কোনাকুনি করে নিয়ে বসে, পাশে মাটিতে তার ব্রিফকেসটা রেখে। বসে পড়তেই এম-এল-এর ডান পাশে সিঁড়ি, বাপাশে ঘরের দরজা, সামনে বারান্দা, আর কোনাকুনি মাঠটা পড়ে। ঠিক কোথায় বসলে সবটাই তার সামনে পড়বে এ যেন এম-এল-এ অভ্যেসেই ঠিক করে নিতে পারে।
সুহাস প্রিয়নাথকে বলে, একটু চা এনে দেয়া যাবে, প্রিয়নাথবাবু? সে তার ঘরের দিকে যায় পয়সা আনতে। প্রিয়নাথ তার পেছন-পেছন দরজার কাছে সুহাসকে ধরে বলে, স্যার, স্টোভটা জ্বালিয়ে বানিয়ে দেই স্যার? আমাদের ত রান্নাও চাপাত হবে।
জ্যোৎস্নাবাবু–বিনোদবাবুরা কোথায়, জানেন?
কাছাকাছিই আছেন কোথাও স্যার, চলে আসবেন। অনাথ একটু গেছে কাঁঠালগুড়ির মোড়ের দিকে, ওদের দেশের একটা দল নাকি ওখানে থাকে।
আচ্ছা, চা করুন তা হলে।
আপনি খাবেন ত স্যার?
দেবেন এক কাপ, সুহাস কিছু ভাবে, প্রিয়নাথ ফেরার জন্যে ঘুরলে বলে, এখনই রান্না চাপাবেন না, ওঁরা এসেছেন—
প্রিয়নাথ একটু অবাক হয়ে বলে, কেন স্যার?
ওরা কেন এসেছেন বুঝতে পারছি না ত, যদি আমাদের কাছেই কাজকর্ম থাকে।
প্রিয়নাথ একটু হেসে বলে, স্যার, তা হলে ত আপনার কোনোদিনই খাওয়া-ঘুম হবে না, এ ত লেগেই থাকবে।
প্রিয়নাথের হাসিতে অভিজ্ঞতার এমন ছাপ ছিল যে সুহাসকে মেনে নিতে হয়।
প্রিয়নাথ ফিরে যায়।
সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী ভাবে তৈরি হবে। হতে পারে, এম-এল-এ তাকে কিছু কাগজপত্র দিয়ে যাবে। সুহাস রেখে দেবে। তারপর সুহাস ভাবে, রশিদও দেবে। এই কাগজগুলোর একটা আলাদা ফাইল করবে। কিন্তু এখানে ত আর অফিসের আর-কেউ নেই। সে নিজেই ফাইলটা রাখবে। যদি জবাব দেয়ার থাকে, জবাবও দেবে। সুহাস যেন বুঝতে পারে, ঐরকম একটা নিয়মকানুনের বেড়া ছাড়া সে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। সুহাস ফেরে। প্রিয়নাথের রাখা লণ্ঠনের লাল আলোতে মেঝেটা চকচক করছে, এম-এল-এর চেয়ারের পায়া আর এম-এল-এর বাঁ পায়ের ওপর ওপর তোলা ডান পায়ের আঙুলগুলোতে আলো পড়েছে। এম-এল-এ পা-টা নাচাচ্ছে বলে বারান্দার সিলিঙে লণ্ঠনের আলোটায় ছায়া পড়ছে আর আলো হচ্ছে। এম-এল-এর মুখটার ছায়া দেয়ালের কোনায় একটু লেগে বাইরে চলে গেছে।
.
০৪৩.
জমির আল ও এসেম্বলির মাথাধরা
এম-এল-এ সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার এখানে আর গোলমাল হয় নাই ত?
সুহাস একটু আলগা দাঁড়িয়েছিল। চেয়ারটা নিয়ে সে এম-এল-এর কাছে বসে না। আবার, চেয়ারটা এখন যেখানে আছে, সেখানেও যায় না। চেয়ার আর এম-এল-এর চেয়ারের মাঝখানে দাঁড়ায়, ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। যদি এম-এল-এ তার কছেই এসে থাকে তা হলে সেটা আগে বলুক। এম-এল-এর কথার জবাবে সুহাস বলে, না-আ, তারপর বোঝে আরো কিছু বলা দরকার, যোগ করে, আমাদের সঙ্গে আর কার কী গোলমাল হবে?
এম-এল-এ একটু জোরে হেসে ওঠে, এই আপনি ভাবছেন নাকি? আপনার সঙ্গেই তো গোলমাল।
কেন? আমাদের সঙ্গে আর গোলমাল লাগবে কি সে, এম-এল-এ কথাটা যে-হালকা চালে বলে সেটা সুহাসকেও ঘেঁয়; যেমন দেখব, তেমন লাইন টানব– এখানে আল, এখানে রাস্তা, এখানে গাছ।
ঐ সব আল, গাছ এইসব দাগ দিবেন কেন? বেশ হাসি-হাসি মুখেই এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে, যেন ধাঁধা।
আছে, তাই দেব।
হ্যাঁ, ঐ ত মজা। ঐটা যদি না থাকে তয় ত একজন বলিবার পারে ঐ জায়গাটায় গাছ নেই।
না থাকলে বলবে, নেই।
না হয়, না হয়। যার সম্পত্তির সীমা ধরেন ঐ গাছ পর্যন্ত, সেইলা ত চাহিবে গাছটা না-থাকুক।
কেন?
কহিবার পারিবে, গাছ নাই ত মোর জমিখানারও সীমা নাই।
সুহাস হেসে ফেলে, তা অবিশ্যি পারে।
আর নিভৃত আলাপের সুরে এম-এল-এ বলে, তা উ ত আপনাকে আসিয়া বলিবে যে ম্যাপে গাছটা দিবেন না।
সুহাস আরো হেসে বলে, হ্যাঁ, তা পারে–
এম-এল-এ তখন হেসে বলে, দেখেন না, এক বিঘত জমি নিয়া খুনাখুনি পর্যন্ত হওয়া ধরে? আর, আপনি ত এই তামান জমির সীমা টানাটানি করিছেন।
সুহাস হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে। এম-এল-এ একটু চুপ করে থেকে বলে, গোলমাল তো আপনার সঙ্গেই হইবে, কত গোলমাল।
এম-এল-এর কথার ভেতর নিভৃত আলাপের ভঙ্গি ছিল। তার একটা কারণ, আলাপটা সত্যিই নিভৃত ছিল। আর-একটা কারণ, সুহাস অনুমান করতে চায় কি এই নিভৃত আলাপে এম-এল-এ তাকে কিছুটা সমর্থনই দিয়ে যেতে চায়! ভেবে ফেলেই সুহাস সাবধান হয়, এই সমর্থনটুকুর বদলেই হয়ত যাওয়ার আগে তাকে কোনো ব্যক্তিগত ও দলগত কাজের কথা বলবে। সুহাস আসলে বুঝতে পারছে না–এম-এল-এ তারই বারান্দায় এসে বসল কেন। সেটা না-বোঝা পর্যন্ত সুহাসের অস্বস্তি কাটবে না।
প্রিয়নাথ কাঁচের গ্লাসে চা এনে দেয়। তার পর জিজ্ঞাসা করে, একবার এম-এল-এর দিকে, আর একবার, সুহাসের দিকে তাকিয়ে, একটা বিস্কুট দেব?
দাও, একখান বিস্কুট দাও, এম-এল-এ বা হাতে চায়ের গ্লাশটা নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে রাখে। প্রিয়নাথ বিস্কুট আনতে যায়। সুহাস তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করে, আপনাকে কিছু খাবার এনে দেবে?
আরে নানা, প্রিয়নাথ বিস্কুটটা এনে দিলে এম-এল-এ গ্লাশের চায়ে নরম করে করে খায়। সুহাস বিস্কুট নেয় না। চায়ে চুমুক দিয়ে এম-এল-এজিজ্ঞাসা করে, আপনি ত এই প্রথম এই কাজে আসছেন, না?
জবাব দিয়েও সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, সে লোকটিকে পছন্দ করছে, না অপছন্দ করছে। লোকটার কথা বলার ভাষাটা এমন–রাজবংশী ভাষার সঙ্গে চলতি বাংলার মিশেলটা নিয়ে কোনো অস্বস্তি নেই। বলতে বলতে বলতে বলতে তার নিজের এই ভাষা তৈরি হয়ে গেছে। সেটা দিয়ে সে। সবার সঙ্গে সব জায়গাতেই কথা বলতে পারে–কলকাতাতে, নিশ্চয় তার পাটিটাটিতে, আবার তার এই সব গ্রামেও নিশ্চয়। লোকটাকে বেশ কাজের লোক বলে মনে হয় তার মুখের কথা শুনেই। আবার চেয়ারটা ভরে বসেছে একেবারে পাইকার-দেউনিয়ার মত, পায়ের ওপর পা তুলে, জামাটা ঘাড়ের পেছনে ঠেলে দিয়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে এম-এল-এ আবার বলে, গ্রামের জমিজমার ত ধরেন কেনে দখলই হচ্ছে আইন। দখল যার জমি তার। আপনি যদি একখান লাইন টানি দিয়া আমার জমিখানের ভাগ, ধরেন, আর-একজনের জমির ভিতর ঢুকাইয়া দেন, তা হলি ত আমি পরের দিন লোকজন লাঠিসোটা নিয়া ঐ জমিটার দখল নিয়া নিম। ব্যাস, কথাটা শেষ করে এম-এল-এ বলে, ত আপনার সঙ্গে গোলমাল হবে না? প্রত্যেকদিন গোলমাল হবে আপনার মাপামাপি নিয়া। তবে আপনি ত শক্ত অফিসার। জোতদারদের বাড়ি খাবেন না, বলে দিছেন। জোতদাররা ভয় খাইছে, এম-এল-এ এবার বেশ জোরে-জোরে হেসে ওঠে।
সুহাস যেন নিজের অবস্থাটা বোঝানোর জন্য বলে, আমরা তো আর প্রপাটিরাইট মামে সম্পত্তি কার সে-সব ঠিক করছি না, সে-সব ত সিভিল কোর্টের ব্যাপার।
প্রপাটি রাইট-টাইট ত আপনার গয়ানাথ জোতদার, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট আর আনন্দপুর চা বাগানের ব্যাপার। আর-সব মানুষের রাইট মানে ত এক বর্ষার চাষ। ব্যাস। কোর্টে যাইতে আমাদের সব মানষি ভয় পায়। সেইখানে ধরেন গ্রামের মাতব্বর, কি ধরেন পার্টির নেতা, কি ধরেন আপনাদের মতন, অফিসার যা হুকুম দেন সেটাই সবাই মানি নেয়। মানি নিবার চায় অন্তত। সাধারণ মানুষের কাছে ত সরকার মানেই সরকারি অফিসার–এই ধরেন ডি. সি, এস.ডি.ও, জে এল আর ও, থানার দারোগা আর আপনাদের মতন আরো সব অফিসার। অফিসার ভাল না-হলে ত সরকার বদলি যায়। এই দেখেন না, সাতালডির ব্যাপার। সব ইঞ্জিনিয়ারগুলা মিলি শয়তানি করে।
সুহাস একটু চমকে বোঝে, এই লোকটি এখানকারই এম-এল-এ বটে, কিন্তু সত্যি করেই তার পেছনে অভিজ্ঞতার এমন একটা ভূমি আছে, যেখান থেকে কোনো সময়েই লোকটা সরে না। আর সেই কারণেই এতক্ষণ তার কথায় এমন ঘনিষ্ঠতা বোধ করে ফেলছিল সুহাস। এই লোকটিও কি সেই কারণেই সুহাসের কাছে এসে বসল? সুহাসও এখানকার লোক নয়, তাই তাদের ভিতর, এখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে, এই সব কথা বিনিময় হতে পারে।
সুহাস জিজ্ঞাসা করে, আপনাকে তো নিশ্চয়ই এসেম্বলিতে প্রায়ই বলতে হয়।
মাঝে-মাঝে বলতে হয়, লোকাল ব্যাপার-ট্যাপার থাকলে, আর দু-এক সময় কোশ্চেন জিজ্ঞাসা করতে হয়। আমাদের অন্য কমরেডরা আছেন সব, তারাই বলে দেন।
লোকটি থেমে গেলে.সুহাস জিজ্ঞাসা করে বসে, আপনার ভাল লাগে এসেম্বলি? এম-এল-এচুপ করে যায়। সুহাস বোঝে, সে ভেবে নিচ্ছে কথাটার জবাব দেবে কি দেবে না। নাকি আসলে জবাবটাই ভাবছে, এমন করে কোনো কথা হয়ত তার এর আগে মনে হয় নি? অথবা, কতটা বলবে আর কতটা বলবে না, তার সূক্ষ্ম হিশেব?
এম-এল-এ নীরবে একটু হাসে, আপনি খুব জবর প্রশ্ন করলেন, আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, হয় সত্যি জবাব দিব, না-হয় ত চুপ করি থাকব, আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, আমিও আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সুহাস বোঝে না এই ভাষায় প্রশ্নটা আসলে করাই হল কি না। এম-এল-এ বলে, কিন্তু সেটা ত আমি জানি, আপনারা কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করেন জানি, আমি ঠিক উত্তরটাই দিব।
একটু সময় নিয়ে এম-এল-এ বলে, প্রথম থিকেই বলি। বড় ঘুম পায়।
সুহাস হাসে, আমরা ত তাই শুনি, এসেম্বলিতে ভাল ঘুম হয়।
হ্যাঁ। এয়ার কনডিশন ত। আর কলকাতায় সে গরম। ঘামিটামি ঢুকিলেন আর অনং ঠাণ্ডা। শরীরটা চট করি ছাড়ি দিবার চায়। প্রথম প্রথম ত চোখ দুইখান খুলা রাখাই এক হাঙ্গামা হয়া গেইল। যখনই যাই তখনই ঘুমাই। তার পর ভাত না খাইয়া রুটি খাওয়া ধরিলাম।
এসেম্বলির জন্যে খাওয়া বদলালেন?
না বদলাই করি কী। আমরা ত ভাত খাই, জানেনই, হাইজাম্পের নাখান। অত ভাত খায়া ঐ হলে ঢুকিবার বাদে মরার মতন ঘুম আসে। এখন ঘুমটা কমি গেইসে। ইচ্ছা করিলে ঘুমাবার পারি। ইচ্ছা করিলে জাগি থাকবার পারি। কিন্তু মাথাধরাশান মোর এ্যালায়ও সারে নাই।
মাথা ধরে?
হ্যাঁ।
বক্তৃতায়?
না। ঐ এয়ার কনডিশনে। যখন বাহিরে আসি কেমন গা গোলায় আর মাথা ধরে আর বুকটা ঠাণ্ডা লাগে।
তা হলে যান কেন? আপনাকে ত আর অত ঘন-ঘন বলতে হয় না!
আমাকে বলতে হয় না কিন্তু আমাদের সব প্রফেসর কমরেডরা আছে, উকিল কমরেডরা আছে। ভাল বলে। ইউনিয়নের নেতারাও ভাল বলে। তাদের সব পয়েন্ট দেই, কী কেস বুঝাই, কোর্টের মতন আর কী!
কোর্টের মতন?
ঐ আর-কি। আপনি আমি কি আর কোর্টে গিয়া সওয়াল করতে পারি? তার জন্য উকিল-মোক্তার। লাগে। কালা কোর্ট লাগে। ওরা সব কোর্টের আইন জানে। তেমনি এসেম্বলিরও নিয়ম আছে সব। কখন কোনটা বলা যায়। বললে ঠিকমত লাগবে। কখন কোন কথাটা তুলতে হয়। সেই সব যারা জানে তারাই বলা-কওয়া করে।
আপনিও তো উকিল। মেম্বার
জুনিয়র জুনিয়র বলে এম-এল-এ হো হো করে হেসে উঠে যোগ করে, আপনি আমার ভোটার না ত তাই বলি দিলাম। ভোটারকে বলি আমি না গেলে ত এসেম্বলি অচল বলে এম-এল-এ আরো হাসে। সুহাসও তার সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তাহলে যান কেন ওখানে?
এইটা আপনারা কী বলেন? এম-এল-এ হাসি কমাতে কমাতে বলে, পার্টি করি মানে তো ক্ষমতা চাই। এসেম্বলিতে যে-পার্টির মেম্বার বেশি সেই পার্টি ক্ষমতায় আসে। আমরাও ক্ষমতায় আছি। পাটি করিবেন কিন্তু ক্ষমতা নিবেন না এ ক্যানং করি হবে? বিয়া বসিবেন কিন্তু বউয়ের সঙ্গে শুবেন না–এ কি হয়? সে ত হিজড়ারাও কবার পারে–গর্ভ ধরে শুয়াররা আর এক মানষিই পারে হিজড়া হবার। এম-এল-এর হাসি উত্তাল হয়ে ওঠে। সুহাসকে, যেন পরাজিতের মত স্মিত থাকতে হয়।
.
০৪৪.
এম-এল-এ–র চা খাওয়া
এম-এল-এ-র সঙ্গে যে-দলটা এসেছিল তার কেউ-কেউ চায়ের দোকানে গেছে আর কেউ-কেউ সিঁড়ির ওপর হেলান দিয়ে বসে। প্রিয়নাথের লণ্ঠনে এত কালি পড়েছে সেটার আলোতে আর-কিছু দেখা যায় না, শুধু সেটাকেই দেখা যায়। কিন্তু ক্রান্তি হাটের মত জায়গার একটা আস্ত এম-এল-এ এরকম অন্ধকারে একটা বারান্দায় বসে থাকবে-এটা ত খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। পরন্তু এম-এল-এ আজ দুপুরেই সার্ভে ক্যাম্প দেখে, সেখানে সকলের সামনে একটা বক্তৃতা দিয়ে, ক্রান্তি হাট দিয়ে, আপলাদ ফরেস্ট দিয়ে, সেই ফুলবাড়ি বস্তি চলে গিয়েছিল। আবার, সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এসেছে। সঙ্গে ফুলবাড়ির লোকজন। লোকজন অবিশ্যি এম-এল-এর সঙ্গে সব সময়ই থাকে। কিন্তু দুপুরে ক্রান্তি হাট থেকে গিয়ে, আবার সন্ধ্যাতেই ক্রান্তি হাটে ফিরে আসা, এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। এম-এল-এরা সব সময় ফোঁড়াখুঁড়ি করে চলে। এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরয়। এই বীরেনবাবু এম-এল-এ ফুলবাড়ি থেকে মানাবাড়ি-ওদলাবাড়ি দিয়ে বেরলে টুরে তার ঐ—-জায়গাটাও দেখা হয়ে যেত, লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারত। তা না করে যখন সে ফিরে এসেছে তখন ঘটনা খুব পাকিয়ে উঠেছে, নিশ্চয়। এসে, আবার বারান্দায় বসে আছে? এম-এল-এ কখনো এক জায়গায় বসে থাকে না, মিটিং ছাড়া। এম-এল-এ মানেই চলছে–হয় হেঁটে, নয় গাড়িতে, না-হয় প্লেনে, না-হয় ট্রেনে। মিটিং ছাড়া এম-এল-এ একা-একা বসে আছে, মানে, ঘটনাটাও বসে পড়ার মত।
এই রকম একটা ঘটনা ক্রান্তি হাটেই ঘটে যাবে, আজ সন্ধ্যাবেলায়, এর জন্য কেউ তৈরি ছিল না। এম-এল-এ কাউকে খবর দেয় নি। যাবার সময় বলেও যায় নি, ফিরে আসবে। সোজা হলকা ক্যাম্পে গিয়ে বারান্দায় বসেছে, অন্ধকারে! আর, এখানকার লোকজনকে সে-খবরটা শুনতে হয়, ফুলবাড়ি বস্তির যারা এম-এল-এর সঙ্গে এসেছে, চায়ের দোকানে তাদের কারো কারো কথা থেকে। হাটবার ছাড়া ক্রান্তি হাটের এই চায়ের দোকানে এতগুলো অচেনা মুখের লোক যদি একসঙ্গে বসে চা খায়, তা হলে তাদের কথাবার্তায় কান পাততেই হয়, আর তাতেই খবরটা জানা যায়। তখন তাদের সরাসরি জিজ্ঞাসাও করা যায়–কেন এসেছে, কোথায় আছে, কী ব্যাপার। ফুলবাড়ির ফুলঝোরার ওপরে যে ক্যালভার্টটা তৈরি হচ্ছিল, তাই নিয়ে গোলমাল। এম-এল-এ নাকি রেলিংটাতে এক লাথি মেরেছে আর রেলিংটা ভেঙে গেছে। ইনজিনিয়ারকে ডাকতে মালবাজারে তোক গেছে। ইঞ্জিনিয়ারকে এখানে ধরে নিয়ে আসবে।
দোকানপাতিতে যারা বসে ছিল, তারা ত হাট-কমিটির ঘরের দিকে, এখন হলকা ক্যাম্পের দিকে, হাঁটা দেয়ই, এম-এল-এর পার্টির লোকদের খবর দেয়ার জন্যেও কেউ-কেউ, ছোটে, আর কেউ-কেউ যায় তাদের দেউনিয়াদের জানাতে। গেরিমাটি রঙের জামাপরা ভদ্রলোক সিঁড়ি বেয়ে উঠে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, এইঠে কখন আসি বসিছ?
এই তো অ্যালায় আইচচু।
ফুলবাড়িঠে?
হয়।
ঐঠে কি লাথি দিয়া ব্রিজ ভাঙি দিছ!
না-হয়, না-হয়, বলে এম-এল-এ হাসে।
ত চলো কেনে, ঘরতে চলল, হাত মুখ ধোও, তার বাদে আসি বসিও, এইঠে কি মিটিং দিবেন আজি?
না-হয়, না-হয় মিটিং দিম কেনে?
কায় যে কহিল মালবাজারঠে ইনজিনিয়ার আসিবে।
আসিবে। মোরঠে কাথা আছে।
রাস্তা থেকে একটা দল মাঠে নামে। তাদের পেছনে একটা খুব চড়া আলো ঝুলিয়ে কেউ আসে। আচমকা ভাবটা কেটে গেলেই বোঝা যায়, হ্যাজাক। মাঠের লোকজনের লম্বা-লম্বা ছায়া বারান্দার আর ঘরের দেয়ালের আলোকে অন্ধকার দিয়ে ফালাফালা করতে করতে ক্রমেই ওপরে উঠে যায়। সেই লোজন, আর তাদের পেছনে একজন একটা টিনের থালার মধ্যে কয়েক কাপ চা আর একটা ডিশে মিষ্টি আর সিঙাড়া নিয়ে, এসে দাঁড়ায়। যার হাতে হ্যাজাকটা ছিল সে পেছন থেকে সামনে এসে বারান্দার ওপর আলোটা রাখায় লোকজনের খাড়া ছায়া বারান্দার দেয়াল থেকে বারান্দা গড়িয়ে মাঠে লম্বা হয়ে যায়। হ্যাজাকের পাশেই চা-মিষ্টির থালাটা নামিয়ে রেখে খালি গায়ের ছেলেটি বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলে, ঐ দোকানঠে পাঠাই দিছে, এততি
সেই গেরিমাটি-জামা ভদ্রলোক এতক্ষণে বারান্দায় উঠে এসে মিষ্টির ডিশটা তুলে এম-এল-এর সামনে ধরে বলে, ন্যাও; খ্যাও কেনে। একটা সিঙাড়া তুলতে-তুলতে এম-এল-এ সুহাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, সাহেবকে দেন।
ভদ্রলোক সুহাসের সামনে নিয়ে যায়। সুহাস একটা ছোট মিষ্টি তুলে নেয়। ভদ্রলোক আবার এম-এল-এর সামনে ধরে বলেন, তুমি খাও ত বীরেন, আত্তিরে রাত্রিতে) এইঠে থাকিবেন ত?
আরে না-হয়, মোক কালি জলপাইগুড়ি যাবা লাগিবে, মিটিং আছে, বলে, এম-এল-এ একটা মিষ্টি তুলে মুখে ফেলে আঙুলটা পায়ে মুছে বলে, মুই আর খাম না, তারপর মিষ্টির ঢোকটা গিলে ফেলে বলে ওঠে, আরে আবার চা-টা কোথায়?
গেরিমাটির জামাপরা ভদ্রলোক মিষ্টির ডিশটা থেকে একটা করে মিষ্টি ভাগ করে করে বিলি করতে করতে বলে, দিছু খাড়াও, তারপর তাড়াতাড়ি এসে ঐ থালাটার ওপর ডিশটা নামিয়ে রেখে, থালায় উপচনো চায়ের জলে আঙুলটা ধুয়ে, একটা কাপ তুলে এনে এম-এল-একে দেয়। এম-এল-এ চায়ের কাপে চুমুকটা দিয়েই বলে, এ-হে, এ তো ঠাণ্ডা হয়া গেইসে–, বলে এক চুমুকে কাপটা শেষ, করে দেয়।
সুহাস একটু আড়ালে চলে গিয়েছিল তার নিজের ঘরের দিকে। এম-এল-এ যে চা-টা মুখে দিয়ে কথাটা বলে ওঠে এতে যেন তাদের দুজনের মধ্যে অভিজ্ঞতার একটা বিনিময় ঘটে যায়, নাগরিক অভিজ্ঞতার। সে জিজ্ঞাসা করে, কী, চা খাবেন নাকি আর-এক কাপ?
সুহাসের কথার ভেতরই ইঙ্গিত ছিল–সে বানানোর কথাই বলছে, দোকান থেকে আনার কথা নয়।
আপনি খাবেন? তা হলে আমিও খাই, বলে এম-এল-এ হাসে।
সুহাস তার ঘরের কাছ থেকে এগিয়ে এসে প্রিয়নাথের ঘরে ঢোকে। প্রিয়নাথ তখন রান্না চাপিয়ে দিয়েছে, প্রিয়নাথবাবু, আপনার হাতের চা ত আমাদের ভাল লেগে গেছে।
বসেন স্যার, আমি দিচ্ছি করে, প্রিয়নাথ তরকারি কুটতে কুটতে বলে।
আপনি একা বঁধছেন?
ওঁরা এসে যাবেন স্যার। ও তো আমাদের ঠিক হয়ে গেছে স্যার।
সুহাস বেরিয়ে আবার তার ঘরের সামনে এসে চেয়ারটিতে বসে পড়ে।
তার মানে, এই এম-এল-এর রুচি-স্বভাবে কলকাতার ছোঁয়া লেগে গেছে? এই অঞ্চলের ভেতর প্রোথিত এই মানুষটির স্বাদে ও অভ্যাসে নাগরিকতা এসে যাচ্ছে? কলকাতা ও নাগরিকতার সেই টানেই কি লোকটি ফুলবাড়ি বস্তি থেকে এসে তার এখানে বসেছে, একই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লোভে?
এই একটু আড়াল থেকে সুহাস মনের এই প্রশ্নগুলি নিয়ে এম-এল-এর দিকে তাকায়। এম-এল-এ তখন তার পা নাচিয়ে-নাচিয়ে হাসতে-হাসতে সামনে মাঠের ভেতর ও পেছনে সিঁড়িতে দাঁড়ানো লোকগুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
.
০৪৫.
এম-এল-এ ও গয়ানাথ
আলো ফেলে রাস্তায় একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আওয়াজ করতেই বোঝা যায় মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল চলার সময় যত আওয়াজ করে, দাঁড়ালে আওয়াজ হয় তার চাইতে বেশি। কয়েকবার হেঁচকি তুলে মোটরসাইকেলটা আবার চলতে শুরু করে। আস্তে-আস্তে চলছে বলে হ্যান্ডেলটা নড়ে আর আলোটা ব্যায়ের জঙ্গল আর ডাইনের বাড়িঘরের গায়ে আছড়ায়–যেন কিছু খোঁজাখুজি চলছে। আলোটা মাঠের ভেতর কিছু চলে আসে, আবার ঘুরে যায়। মোটর সাইকেলের আওয়াজটাও # বাড়ে-কমে। তারপরই মোটর সাইকেলের আলোটা এই বারান্দার দিকে পড়ে আর আরো আওয়াজ তুলে এদিকে ছুটে আসে। হেডলাইটের আলো বারান্দা টপকে ঘরের ভেতর চলে যায়, হ্যাজাকের আলোটা মুছে দিয়ে। কিন্তু মোটর সাইকেলটা হঠাৎ থেমে যায়। আওয়াজ বাড়ে, আলো বাড়ে কিন্তু মোটর সাইকেলটা আর এগয় না। সিঁড়ির ওপর থেকে কেউ বলে, ফাঁসি গেইছে। এম-এল-এ বলে ওঠে, দেখেন ত কায়, ঠেলি দিয়া আসেন কনেক। দুজন লাফিয়ে নেমে মোটর সাইকেলের আলোটার দিকেই ছুটে যায়–বলদের গাড়ি কাদোত গাড়ি গেইছে, ঠেলো এ্যালায়। আলোটা একটা আওয়াজ তুলে নিবে যায়।
তখন বারান্দায় হ্যাজাকের আলোতে দেখা যায় মোটর সাইকেলের ওপর একজন বসে আছে, আর-একজন, বেঁটেমত, সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করেছে। গয়ানাথ জোতদারকে চিনতে এইটুকু আলোরও দরকার ছিল না, শুধু গলার আওয়াজ শুনলেই হত। সিঁড়ির ওপর থেকে কেউ বলে, ব্যাস, ভটভটি জোতদার আসি গেইল।
তার মানে, এখন এই ভিড়ে শুধু ফুলবাড়ি বস্তির লোকজনই নেই, এখানকার লোকজনও কেউ-কেউ আছে–যারা গয়ানাথকে সকালে ভটভটিয়াতে চড়ে সার্ভের জায়গায় যেতে দেখেছে। গয়ানাথের এই নামকরণ এর আগে কখনো হয় নি। জামাইয়ের ভটভটিয়াতে সে সাধারণত ওঠে না, এমন কি জলপাইগুড়ি যাওয়ার জন্যে বাস ধরতেও না। কিন্তু সকালে সার্ভে পার্টি পৌঁছে গেছে দেখে চড়তে হয়েছিল। আর, এখন এই সন্ধ্যায় আসিন্দিরই গিয়ে খবর দিল এম-এল-এ আবার এসে বসে আছে। একই দিনে দুই-দুইবার ভটভটিয়া চড়ে একই জনসমাবেশে নামলে ত একটা নামকরণ হয়েই যায়। কিন্তু নামটা টিকবে কি না তা নির্ভর করবে ভটভটিয়া সম্পর্কে গয়ানাথের পরবর্তী ব্যবহারে।
গয়ানাথ তখন তার কাপড় এক হাতে তুলে, আর-এক হাত নেড়ে আসিন্দিরকে শাসাচ্ছে, শালো, ভটভটিয়াখান তোর পাছত ঢুকাই দিম। মাঠে চষিবার ধইচছে এই এক দো-চকিয়া। কহিছু মোক আস্তার [রাস্তার ওপর নামি দে, নামি দে। না, চলো কেনে, চলো কেনে, এ্যালায় তো যাছি তর শ্বশুরবাড়ি। শালো, তর কোন জারুয়া [জারজ] বাপ মাঠের ভিতর দিয়া হাইওয়ে বানাই থছে? শালো ডাঙ্গুয়া [প্রৌঢ়া বিধবার যুবক সঙ্গী] ঢেমনা। সিঁড়ির ওপর ও মাঠে যারা দাঁড়িয়ে ও বসে ছিল তারা। হাততালি দিয়ে ওঠে।
এম-এল-এ চিৎকার করে ডাকে, হে গয়ানাথ কাকা, চলি আসেন এইঠে, ও ঠেলি দিবে উমরায়, চলি আসেন।
সেই ডাকে গয়ানাথ এদিকে আসতে শুরু করে বটে কিন্তু দুপা এসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে, শালো ঢেমনা, তারপর হন হন করে এগিয়ে আসে, যেন এইটুকু গালগালই বাকি ছিল। গয়ানাথ কাছাকাছি আসতেই কেউ বলে, আসিন্দিরের পাছাখান কত ফাঁক হে, একখান আস্ত ভটভটি ঢুকি যাবে?
গয়ানাথ সেদিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে, তর বাপের পাছত ঢুকিবে–
এম-এল-এ চিৎকার করে বলে, হে কাকা, ক্যানং বুদ্ধি তোমার, জোয়াইঅক [জামাই] কছেন অ্যালাং-প্যালাং?
গয়ানাথ তখন সিঁড়িতে পা দিয়েছে। চিৎকার করে ওঠে, কায় কহিছে ঐ ডেঙ্গুয়া মোর জোয়াই? মুই অক তালাক দিম।
পেছনে এবার হাততালির সঙ্গে চিৎকারও। এম-এল-এ হো হো হাসে। গয়ানাথ গিয়ে বারান্দায় ওঠে। আর তখনই মোটর সাইকেলের আলোটা সগর্জন জ্বলে হু–স করে বারান্দার সামনে চলে এসে আওয়াজটা দুই-চার বার বাড়িয়ে কমিয়ে হো-হো করে হেসে, বাইকটা ঘুরিয়ে, আসিন্দির রাস্তার দিকে চলে যায়। আসিন্দিরের ওপর রাগের ঝোঁকে গয়ানাথ হন হন করে বারান্দার ওপর উঠে এসেছিল। এখন বুঝতে পারছে বারান্দায় তার বসার বা দাঁড়ানোর জায়গা নেই। গয়ানাথ সামনের অফিস বরেও ঢুকতে পারে না, মেঝের ওপর ধপাস করে বসে পড়তেও পারে না। পারে, কিন্তু আর-কেউ ত তেমন বসে নেই। তার চাইতে মাঠে বা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করাটাই ভাল ছিল–এম-এল-একে একবার মুখ দেখিয়ে। কিন্তু এম-এল-এ ফিরে এসে এই হা ক্যাম্পেই বসে আছে কেন, সেটা তার জানা দরকার। তখন গয়ানাথের বাঘারুর কথা মনে পড়ে। একবার তাকায়, তাকে কোথাও দেখা যায় কি না। তা হলে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারত ফুলবাড়ি বস্তিতে কী হয়েছে। কিন্তু বাঘারুকে কোথাও দেখা যায় না। বাঘারুর কথা মনে হতেই গয়ানাথ ভাবে যে তার ত হকই আছে এম-এল-এর, ভালমন্দের খবর নেয়ার, কারণ তার লোকই ত সঙ্গে ছিল নদী পার করে দিতে। গয়ানাথ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করে, কুননা অসুবিধা হয় নাই ত তোমার?
কেনে? কী অসুবিধা? এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।
এই, ফুলবাড়ি গেলেন, আবার চলি আসিলেন?
ই আর অসুবিধা কী। ঐ ইনজিনিয়ার খবর দিবার গিসে। এইঠে বসিবার সুবিধা, তাই বসি আছি।
উমরায় ঠিক মতন পার করি দিছে ত নদীখান?
কায়?
আরে, ঐ বলদটা, তোমার নগত যায় গিছে ফুলবাড়ি যাওয়ার বাদে।
হয়, হয়, এম-এল-এর মনে পড়ে যায়, বাঘারু। কী বাঘারু? এম-এল-এ মনে আনতে চেষ্টা করে।
গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, হয় হয়। বাঘারু। ঐটা ফিরে নাই তোমার নগত?
তা ত কহিবার পার না। ফিরিবার পারে। ফিরিবার টাইমে ত নৌকা আছিল। আহা কহেন না কাকা–
কী?
তোমার ঐ মানষিটার নাম, কী, বামারু বর্মন ত?
বর্মন? অর বাপা বর্মন!
আরে, উমরার একখান পুরা নাম, নাম্বা নাম আছে না?
বাঘারুর একখান নাম আছে? তোমাক কহিছে?
কহিছে ত কত কথা। উমরাক তো বাঘ ধরিছিল?
হয়। তোমার তানে কথা কহিছে ঐটা, এত্ত?
সে কি একখান কাথা? কত কাথা? অর জন্মকথা। অর মাই-এর কথা। মানষিটা বড় ভাল হে তোমার কাকা
বলদ।
উমরাক একখান আধিয়ারি দিছেন?
কাক?
উমরাক?
বাঘারুক?
হয়।
বাঘারুক আধিয়ারি?
হয়। এ্যানং কামের মানষিটা–
উ কহিছে তোমাক? আধিয়ারি দিবার কাথা?
না-হয়, না-হয়। মুই কহিছু।
উ তো হালের আগত থাকে। হালের পাছত বান্ধিলে উল্টা চাষ হবা ধরিবে।
কী কহিছেন? চারি পুহে এ্যাত জমি তুমার আর ঐ মানষিটাক একখান আধিয়ারি দিবার না পারেন?
আরে তোমরালা তো মোকই একখান আধিয়ার বানাবার ধইচছেন। মুই আর কাক আধিয়ারি দিম? খাড়াও কেনে। ঘরতে চলল। হাতমুখ ধোও। তার বাদে এইঠে আসি মিটিং দাও। আসিন্দিরক ডাকি, ভটভটিখান নি আসুক। গয়নাথ, হয় কথাটা এড়াতে, নয়, সামাজিকতার তাড়ায় বারান্দা থেকে নেমে রাস্তার দিকে হনহন করে হাঁটে। এম-এল-এ পেছন থেকে চেঁচায়, হে কাকা শুনেন, হে–
.
০৪৬.
এম-এল-এর লাথি
গাড়ির আওয়াজটা পাওয়া গিয়েছিল আগেই। সেটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তার পর, উত্তরে, কাঁঠালগুড়ির মোড়ে যে এদিকে ঘুরল সেটাও বোঝা যায় আওয়াজ থেকেই। তার পর, আলোটা রাস্তায় পড়ে। আর, সেই আলোটা আর আওয়াজটা বাড়তে থাকে। এই বারান্দায় বসে, এই মাঠটা পার হয়ে রাস্তায় গাড়িটাকে আসতে দেখা, যেন নদীর বান-আসা দেখার মত। কেউ একজন বলেও বসে, আসি গেইছে।
গাড়িটা একটু এগিয়ে আড়াল হয়, যা হওয়ার কথা। ঐ মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছে, যা করার কথা। এম-এল-এ শুধু বলে দিয়েছিল, ক্রান্তি হাটের হলকা ক্যাম্প।
গাড়িটাতে আওয়াজ ওঠাপড়া শুরু হয়। তারপরই আলোটাকে দেখা যায় ফাঁক-ফোকর দিয়ে হাটখোলায় পড়ছে আর সরে যাচ্ছে। শেষে এই বারান্দাটাকেও একটু ছুঁয়ে ঘুরে যায়। এইবার গাড়িটা একটা জোর আওয়াজ তুলে মাঠের দিকে ঘোরে। হেডলাইটের আলো এসে বারান্দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যে-ভাবে গাড়িটা মাঠ বরাবর মোড় নিয়েছিল তাতে হু-স করে মাঠ পেরিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াবার কথা। তার বদলে ব্রেক কষে গো-গো করতে থাকে আর মাঠ বরাবর আলোটা শুধু পড়ে থাকে।
গাড়ি থেকে একজন, দুজন, তিনজন, চারজন, পাঁচজন নামে। তারা মাঠটা পার হয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে। গাড়িটা রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়ানোর জন্যে পেছুতে গেলে, এদের ভেতর দুজন হাত তুলে না করে। বারান্দা থেকে সেই হাত-তোলা নিষেধটা ছায়ার মত দেখায়। আলোতে মাঠের কাদা-জল। দেখে-দেখে এরা সাবধানে এই ঘরবারান্দার দিকে এগয়।
এরকম দেখে-দেখে আসে বলেই, সময় নেয়। বা, এদের আসাটা এরকম দেখতে হচ্ছে বলেই মনে হয় সময় লাগছে। তাছাড়া পঁচজন কারা কারা সেটাও এই বারান্দা থেকে সবাই বুঝে নিতে চায়। বারান্দার ওপরে ত এক কোনায় এম-এল-এ চেয়ারে, আর-এক কোনায় সুহাস চেয়ারে। প্রিয়নাথও দরজায় আসে। সিঁড়িতে যারা ছিল তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। আর, ঐ পাঁচজনের পেছনে-পেছনে আরো অনেকে ওদিককার দোকানগুলো থেকে বেরিয়ে চলে আসছে। এতক্ষণ সবাই নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অপেক্ষা করছিল, এখন জড়ো হয়ে যাচ্ছে।
ঐ পাঁচজনের দলটার ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, হে-ই বীরেনদা, তুমি কি আর মিটিং ডাকার জায়গা পাও নাই নাকি, এই কাদা মাঠ? আরে, মণিদা আসছেন নাকি? এম-এল-এ তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে সোজা হয়, তার পর উঠে বারান্দার কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। এবার এম-এল-এই চিৎকার করে ওঠে, আরে মণিদা, আপনি আবার কোথা থিকে আসছেন?
বাঃ বাঃ, এবার পাঁচজনের দলটা একেবারে কাছে চলে এসেছে, সিঁড়ির কাছের লোকজন সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে, যাতে দলটা বারান্দার উঠে যেতে পারে, তুমি গিয়ে লাথি মেরে সব ক্যালভার্ট ভাঙতে পারো আর আমি এইটুকু আসতে পারি না?
এম-এল-এ হে-হে করে হেসে ওঠে, কিন্তু সে-হাসির আওয়াজটা একটু অন্যরকম শোনায়। তাকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথকে বলতে হয়, একটা বিছানা-মাদুর-টাদুর কিছু পাওয়া যাবে, এখানে বসার জন্যে? প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। সুহাসকে তার ঘরের সামনে চেয়ারটা ছেড়ে দাঁড়াতেই হয়। সে একবার ভাবে, চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে। এই মিটিঙের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। তার থাকাও বোধহয় উচিত নয়।
প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে কয়েকটা চট বের করে আনে। সেগুলো একা-একা বিছিয়ে দিতে চেষ্টা করলে এম-এল-এ সিঁড়ির লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলে, এই ধরেন কেনে আপনারা। দুজন তাড়াতাড়ি উঠে এসে চটটা ধরে। গাড়িটা এতক্ষণে রাস্তার ওপর ওঠার জন্যে পেছুতে শুরু করলে মাঠটা ও বারান্দাটা একটু অন্ধকার ঠেকে। হ্যাজাকটাতে একজন এসে পাম্প দিতে শুরু করে।
এম-এল-এ কি ভেবেছিল, সে চেয়ারে বসে থাকবে আর ইনজিনিয়ার-অফিসাররা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? তা না-হলে বারান্দার ওপরে একটা বসার ব্যবস্থার জন্যে সে ত অনেক আগেই বলতে পারত।
মণিই প্রথমে বারান্দায় ওঠে–আমি তোমার জন্যে মালবাজারে বসে আছি, আর তুমি এখানে খুব মিটিং করছ, মণি পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বের করে।
আরে আমি ভাবলাম ত ওদলাবাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় একটু দেখাশোনা করি রাত্রিতে মালবাজারে চলি যাব। আপনার ত আজকে মালবাজারেই আসার কথা–কাল জলপাইগুড়ি যেতে হবে না?
সেই জন্যেই ত এলাম। এসে শুনি তুমি নাই।
আরে ফুলবাড়ির ঐ জায়গাটা নিয়ে গোলমাল চলিছেই। আমার ত মাস-দুই-তিন আসাই হবে না, ভাবলাম গোলমালটা আজিকৈ চুকাই দেই।
তা চুকাও। কিন্তু এর পর ত তোমাকে সার্কাসের দলে নিয়ে নেবে–তুমি লাথি দিয়ে ক্যালভার্টের রেলিং ভেঙে দিলে?
সিঁড়ির কাছের ভিড় থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলে, সিমেন্টের বদলে বালি দিলে ত পোলাপানও লাথথি দিয়্যা ভাঙবার পারে। তা হালেই বোঝেন কী দিয়া ব্রিজ বানাইছে?
মণি সিগারেটে টান দিতে দিতে সিঁড়ির ভিড়ের কথাটা শোনে। তার পর আস্তে করে এম-এল-একে জিজ্ঞাসা করে, একটু সময় দিয়ে, কিন্তু সবাইকে শুনিয়ে, আমি ত ভাবলাম, তোমার পা ভেঙেছে তাই এখানে পড়ে আছ, নিয়ে যেতে হবে। তা এঁরা বলছেন, না, উনি ঠিক আছেন–ক্যালভার্ট ভেঙেছে।
এম-এল-একে এবার হেসে উঠতেই হয়। বলতে হয়, আমার কথা ছাড়ি দেন। ফুলবাড়ির মানষিদের সঙ্গে ত ইনজিনিয়ারদের দেখা হওয়ার দরকার।
ইনজিনিয়ারদের ত অফিস আছে।
সে অফিস-টফিস হইয়া গিছে মণিদা, উনি ফুলবাড়ির লোক শুইনলেই কয়্যা দ্যান দ্যাখা হব না, সিঁড়ির ওপর থেকে একজন চেঁচায়।
সে বলবেন, ওঁরা ত এসেছেন, এত চেঁচাচ্ছেন কেন? মণি সিঁড়ির দিকে দু-পা গিয়ে একটু কড়া গলায় বলে।
এই চুপ যা চুপ যা মিটিং শুরু হোক।
না, আমিও ত কথার কথাই কইছি।
দেখি, দেখি, বলে সেই গেরিমাটি রঙের জামাপরা ভদ্রলোক ঢোকেন, পেছনে একজন মাথায় শতরঞ্চি। উনি বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে লোকটিকে বলেন, টান-টান করি পাতি দেন। এতজন উঠতে থাকার ফলে সিঁড়ির মুখটাতে একটা ভিড় হয়। হাট কমিটির মেম্বার ওপরে ওঠেন। মণি নেমে আসে এম-এল-এ নেমে আসে। আর-একজন সিঁড়ির দুই ধাপ উঠে বলে, নমস্কার, মণিবাবু।
আরে গয়ানাথবাবু, আপনিও এসে গেছেন?
আসিবার নাগে ত, কহেন? আমাদের ক্রান্তি হাটের আজি কত সৌভাগ্য।
কী হল, এত সৌভাগ্য?
এই যে আপনারা সব মিটিং করিবার সেন্টার বানিলেন, সৌভাগ্য না? বলে গয়ানাথ ইনজিনিয়ারদেরও দেখায়। তারা একটু দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের নিয়ে কিছু বলা হল দেখে একজন একটু হেসে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বললেন?
মণি সিগারেট তুলেই না জানায়।
গয়ানাথ মণিকে বলে, হেই মণিবাবু, শুনেন একটু। সিঁড়ি থেকে নেমে একটু সরে দাঁড়ালে গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, আতিত [রাত্রিতে] কতজন থাকিবেন? পাকাবার শুরু করি?
আরে না, না, আমরা এখনই যাব, এখনই, ও সব করবেন না।
.
০৪৭.
ভাষণ ও ভাবন
হাট কমিটির এই শতরঞ্চিটা এত বড়, সুহাসের দরজা পর্যন্ত প্রায় গেছে। চওড়ার দিকটা মুড়ে দিতে হয়েছে। সুহাসের দরজার কাছে, শতরঞ্চির মাথায় দুটো চেয়ার পাশাপাশি সাজানো। হ্যাজাকটা চেয়ার দুটোর কাছাকাছি রাখা। হাট কমিটির মেম্বার ভদ্রলোক সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলে, মণিবাবু, বসেন এইঠে। আগত কহি রাখিলে ত টেবিল-চেয়ার আনা যাইত কিন্তু এ্যালায় ত ইশকুল বন্ধ আর মাস্টার ত থাকে সেই মানাবাড়ি
আরে না না, টেবিল চেয়ার লাগবে কিসে, এ ত আপনারা জনসভার ব্যবস্থা করছেন।
আমাদের আর কতক্ষণের মিটিং হবে? কী? বীরেনদা?
হ্যাঁ। এ ত মিটিং না হয়, কথাবার্তা কহিবার জন্যে, বলতে-বলতে এম-এল-এ বারান্দায় ওঠে। জুতো খুলে হাতে নিয়ে একেবারে হ্যাজাকের সামনে গিয়ে বসে। আর এম-এল-এর পেছনে-পেছনে সব্বাই বারান্দায় উঠতে শুরু করে। যে যার, জুতো খুলে হাতে নিচ্ছে। একটা দল গিয়ে হ্যাজাকের সামনে এম-এল-এর মুখোমুখি, কিন্তু বারান্দার কোনার দিকে বসে। সবাই বসে পড়ার পর দেখা যায় জায়গার তুলনায় তোক অত বেশি নেই। এম-এল-এ ডাকে, মণিদা আসেন, আর দেরি করা যায় না।
মণি স্যান্ডেলটা বারান্দার ওপরে খুলে রেখে আসে। পেছন থেকে ইনজিনিয়ারদের একজন বলে, আপনারা দরকার হলে ডাকবেন, আমরা এখানে আছি।
কেন। কথা হবে আপনাদের সঙ্গে আর আপনারা ওখানে থাকবেন কেন, এম-এল-এ ইনজিনিয়ারদের দিকে তাকিয়ে বলে, যোগ করে, মুখোন পাছত করি করি কথা কহিবার নাগিবে?
ইনজিনিয়াররা এবার একে-একে উঠতে শুরু করে। তাদের প্রথম জনের পায়ে ফিতেওয়ালা জুতো বলে নিচু হয়ে খুলতে হয়। একটু সময় নেয়। পেছনের দু-জন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই পা তুলে জুতোর বেল্ট, খুলে নেয়। আর-একজনের পায়ে স্যান্ডেল। মণিবাবুর জুতোর পাশে জুতোগুলো খুলে রেখে ওরা একটু এগিয়ে, সকলের পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে বসে।
হঠাৎ গয়ানাথ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে আসে, তার পর সরু গলাটা তুলে জিজ্ঞাসা করে, মণিবাবু ও আমাদের এম-এল-এ মেম্বার, আমার একটা প্রশ্ন ছিল। সবাই তাকালে গয়ানাথ বলতে থাকে, প্রশ্নটা হছে কি, এই মিটিংটা কি প্রাইভেট দিছেন না জনসভা দিছেন? য্যালায় প্রাইভেট মিটিং হবা ধরে, মোরা থাকিম না। কেনে। না, মোরা আপনার পার্টির মানষি না। আর যদি জনসভা দিছেন ত আমরা থাকিবার চাহি। কেনে। না মোরা জনসভার মেম্বার এবং মণিবাবু ও হামরালার এম-এল-এ মেম্বারের ভাষণ শুনিবার চাহি। কেনে–
গয়ানাথকে থামিয়ে দিয়ে মণি বলে ওঠে, কী, বীরেনদা?
এম-এল-এ গয়ানাথকে বলে, আরে বসেন না বসেন, এ ত সবার কথাই হচ্ছে, আপনি থাকিলে ত ভালই হয়। মোরা কহিবার পারিম গয়ানাথবাবুও এই মিটিঙে ছিলেন। আরে, যার ঘরত আসি বসিলাম, তিনিই নাই, এম-এল-এ দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকে, কই, আপনিও আসেন না।
সুহাস ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, আমি আর এখানে কী—
আরে, বসুন না, বসুন, মণি ডান হাতটা ডাইনে ছড়িয়ে যেন জায়গা দেখায় ইনজিনিয়ারদেরই দিকে। সুহাস এম-এল-এর সামনে দিয়ে আবার প্রথম দলটার পাশ দিয়ে গিয়ে ইনজিনিয়ারদের কাছাকাছি দেওয়াল ঘেঁষে বসে।
গয়ানাথ আবার বলে, ঠিক আছে। আপনারা আলাপন শুরু করেন। মোর অনুমতিখান ত থাকিল। আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা দেখি আসি, বসিম।
এম-এল-এ এমন ভাবে মুখটা তোলে যে সকলেই বোঝে এইবার সে কিছু বলবে। কিন্তু এম-এল-এ হঠাৎ পাশে তাকিয়ে ঘাড় উঁচু করে সিঁড়ির দিকটা দেখে, ঘাড় ফিরিয়ে, চেয়ারের ওপরটা দেখে, বলে ওঠে, আমার ব্রিফকেসটা? সকলেই একবার খোঁজে যেন। প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে ব্রিফকেসটা দেয়।
ব্রিফকেসটা পাশে রেখে এম-এল-এ বলে, শুনেন, এখন কথাটা আরম্ভ হওয়া দরকার। এই কথাটা হওয়া উচিত ছিল ফুলবাড়িতে। কিন্তু সেখানে আমাদের এসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার সাহেব ছিলেন না। আর মালবাজারে তার অফিসেও আমি কথাগুলি বলতে পারতাম। কিন্তু একটা মুখোমুখি কথার দরকার ছিল। তাই আমি এইখানে আসার জন্য বলি। উনি দয়া করে আসিছেন। আমাদের জিলা কৃষক সমিতির সম্পাদক কমরেড মণি বাগচিও আসছেন। সুতরাং এখন কথাবার্তা হইতে পারে। তা হলে আমার অনুরোধ ফুলবাড়ির মানষি যারা, এইখানে আছে যারা, তাদেরই উচিত প্রথমে সব বলা। তাদের কী বলার আছে। তার বাদে আমরা ইনজিনিয়ার সাহেবের কথা শুনিব। ত কন, ফুলবাড়ির কমরেডরা, কেউ কহেন।
যে দলটা এম-এল-এর মুখোমুখি বারান্দার কোনার দিকে একসঙ্গে ছিল, তারা নড়েচড়ে বসে। সামনের একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলে, হে-ই নকুইল্যা, তুই ক কেনে।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, কাকা কহেন।
যাকে কাকা বলা হয় সে মাঝামাঝি বসে ছিল। সে বসে থেকে এম-এল-এর দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় শুরু করে, এর মধ্যি এত কওনের-শোননের কী আছে, জানি না। য্যাখন থিক্যা ঐ ফুলবাড়ির ফুলঝোরার উপর একখান ব্রিজ হইব বইল্যা ঠিক হইয়াছে, তখন থিক্যাই নানা গোলমাল লাইগ্যাই আছে। আমরা গিয়্যা খোঁজ নেই, তা কয়, কেডা কইছে ব্রিজ হব, আঁ, লোকটি একবার এম-এল-এর দিকে, একবার মণির দিকে, আর একবার মাথা ঘুরিয়ে ইনজিনিয়ারদের দিকে তাকায়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, কেডায় কইছে ব্রিজ হব, আঁ, কেডায় কইছে? নে বাবা, আমরা ত পইডল্যাম গিয়া সাত হাত জলের তলায় ত ধরেন গিয়্যা, ঐ ফুলঝোরার ব্রিজ নিয়্যাত গত ত্রিশ বচ্ছর ধইর্যাই কত কাণ্ড! আমি যখন ধরেন বিশ বছরের জুয়ান তখন খগেন দাশগুপ্ত মন্ত্রী। আর সেই কী কয়, আরে তখুন মালবাজার জেনারেল সিট, কী নাম, সেই এম-এল-এ, তারে তখুন ত কইলেই কয়, হয়্যা গ্যাল গা, এই ধর সামনের বর্ষার আগেই হয়্যা যাবে নে, একবার ত কাণ্ড।
লোকটি গল্প বলতে-বলতে একবার এম-এল-এর দিকে, একবার মণির দিকে, আর একবার ইনজিনিয়ারদের দিকে ঘাড় বারবার ঘোরাতে-ঘোরাতে নিজেই ধীরে-ধীরে ঘুরে যায়। এখন তার মুখ মণির দিকেই। মণি আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু এলিয়ে বসে আছে। মণি হেড়ে লম্বা। ফলে মনে হয় নিজেকে ভেঙেচুরে বসেছে যেন। তার মুখেচোখে বিরক্তির ভাবটা সে গোপনের চেষ্টা করে সিগারেটের ধোয়ার ছলে। লোকটি তখন বলতে শুরু করেছে, হইল কী, আমরা ত সেইবার পূর্তমন্ত্রীরে সবাই মিল্যা বলছি যে ব্রিজ নাই ত ভোট নাই। তাই শুইন্যা মন্ত্রী কয় কী, সে কী? ব্রিজ হয় নাই? আমাদের ত জানা হইয়া গেল ব্রিজ হইছে, তার টাকাপয়সা সুদ্ধ্যা দেয়ানেয়া শ্যাষ। আমরা ভাবলাম, খাইছে। মিথ্যা কইর্যা যদি একবার ব্রিজের টাকা বাইর হয়া থাকে, আবার কি আর হইব ব্রিজ? ব্যাস, খোঁজ-খোঁজ, কোথায় গেল ব্রিজ। অফিসাররা খুঁইজব্যার ধরল জলপাইগুড়ির অফিসের কাগজে-কই গেল ব্রিজ। মন্ত্রী খুঁইজব্যার ধইরল কইলকাত্তার কাগজে–কই গেল ব্রিজ। আর আমরা হককলে যুইজবার লাইগল্যাম এইখ্যানে, কই গেল ব্রিজ। লোকটি থামে। সে জানে এখানে হাসির জন্যে সবাই একটু সময় নেয়। সে নিজে খানিকটা হেসে সেই সময়টুকু দেয়। মণি এম-এল-এর দিকে তাকিয়ে হাতের পাতা একবার উল্টোয়। এম-এল-এর চোখ দেখে বোঝা যায় না, সে সেটা দেখল কিনা। কিন্তু গল্প যে বলছিল সে দেখে ফেলে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, মণিবাবু, আমি তাড়াতাড়ি কয়্যা দিচ্ছি। আচ্ছা, ছাড়ান দ্যান সেই গল্প। এখন কথাটা হইল কি–
পেছন থেকে একটি ছেলে গলাটা তুলে বলে, কাকা, মুই কম? এইবারকার কথাখান মুই কম?
কাকা আবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ক না ক্যা, আমি ত তগ কইতেই কই। আমি কথা শুরু কইরলেই সাত কইল্যানা কথা মনে আছে। আর তগ কাম হচ্ছে এই কল্যানা। ধরেন কেনে, আমাগো সময় নেতা ছিল নরেশ চক্কত্তি-পটল ঘোষ, আর এখন আমাগো মণিবাবু লিডার, তারপর কী কয়, বীরেনবাবু এম-এল-এ। এ্যাহন ত তরাই কবিক, ক।
কাকার গলার স্বরটা একটু উঁচুতে। সে টেনে-টেনে, নানা ভঙ্গিতে, স্বর তুলে নামিয়ে গল্পটা যখন বলছিল তখন কিন্তু ধীরে-ধীরে সেই গল্পের একটা আবহাওয়া তৈরি হচ্ছিল। এমন-কি, এইখানে যারা ভদ্রলোক, সুহাস আর ইনজিনিয়াররা আর প্রিয়নাথ, যদি মণিকে নাই ধরা হয়, তারাও যেন গল্পটার একটা টান বোধ করে ফেলছিল। এম-এল-এ এমন বসে ছিল যাতে মনে হয় গল্পটা সারারাত চললেও তার আপত্তি নেই, বা এখন থেমে গেলেও তার আপত্তি নেই, বা একমাত্র সে জানে কখন গল্পটা আপনি থেমে যাবে। একমাত্র মণি বাগচিই অধৈর্যে বারবার সিগারেট ধরাচ্ছিল। কিন্তু এই এলাকাটা বীরেনের। বীরেন এখানে বসে থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারকে ডাকিয়ে এনেছে। সুতরাং কী-হবে না-হবে সেটা বীরেনই ঠিক করবে। পরে নিশ্চয়ই বীরেনকে সে বলবে, এইভাবে যদি অফিসারদের হ্যারাস করা হয় তা হলে কোনো অফিসার আর-কোনো কাজ করার উৎসাহ পাবে না। কিন্তু মণি জানে, বীরেনও তাকে জিজ্ঞাসা করে বসতে পারে যে এ্যসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার গিয়ে বলল আর মণি অমনি গাড়িতে কেন চড়ে বসল–এটা জেনেশুনে যে বীরেন ক্রান্তি হাটে নিজে বসে আছে। তাতে ত সবার ধারণা হল যে পার্টির ভেতর অফিসারদের খুঁটি হচ্ছে মণিবাবু। কিন্তু এমন আশঙ্কা আছে বলেই মণি ভেবে রেখেছে তার কৈফিয়ৎ। বীরেনবাবু লোকজন নিয়ে ক্রান্তি হাটে বসে থেকে যদি ইনজিনিয়ারদের ডেকে পাঠায় আর তারা যদি প্যানিকি হয়ে মণির সাহায্য চায়, তা হলে ত অফিসারদের মর্যাল রাখার জন্যেই মণিকে অফিসারদের সঙ্গে আসতে হয়। মণি জানে, তাদের পার্টির ভেতর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা, অফিসাররা যেন ডিমর্যালাইজড না হয়, তাতে দু-এক জায়গায় লোকজন একটু ভুল বুঝলে, বুঝবে। মণিব ধারণা, পাটির ভেতরের এই ঝোঁকগুলো বীরেন বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তাই বলে মণি ত আর বীরেনের এলাকায় নাক গলাতেও পারে না।
.
০৪৮.
এম-এল-এ ও অফিসার : সংলাপের আরেক ধরন
তখন সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে উঠে বলতে শুরু করে, কমরেডমন।
এম-এল-এ হাতটা তুলে বলে, বসি-বসি বলো হেমেন, বসি-বসি বলো।
কাকা তখন একগাল হেসে একটা হাত তুলে নাড়ায়। কিন্তু হাসির বেগে কথা বলতে পারে না। কাকার ভঙ্গিতে অথবা এম-এল-এর কথায় ঐ দলটা হেসে ওঠে। দলটার ভেতর যে একটা বেশ উত্তেজনা পাকিয়ে উঠছিল, সেটা সত্ত্বেও সবাই হেসে ওঠে। হাসির ফলে উত্তেজনাটা যে একটু শিথিল হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও হেসে ফেলে। আর হেমেন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে।
আরে, আরে, হল কী, হল কী, বলো, হেমেন, মণি সোজা হয়ে বসে বলে। মণির দাঁতগুলো বড়বড়। ফলে তার সব কথাই একটু রাগী রাগী শোনায়। আর এর মধ্যে কাজের কথার শুরুটাও যে ঘটে না এতে ত মণি একটু বিরক্তই ছিল। ইনজিনিয়ারদের কাছে সে ঘটনাটা শুনেছে। কিন্তু এদের তরফের কথাটা ত শোনে নি। যদিও না-শুনেও সে বুঝে ফেলতে পারে, ঘটনাটা কী হয়েছে। অফিসারদের কথা থেকেই সত্য ঘটনাটা জানা যায়। মণি বুঝতে পারছে না, বীরেন ব্যাপারটাতে কতটা জড়িত! স্বাভাবিক ছিল, মালবাজারে গিয়ে ইনজিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলা। বীরেন যখন তা করে নি, তখন মণিকে আগে বীরেনের মনটা বুঝতে হবে। মণির কথাতে একটু বিরক্তি থাকায় এই দলের হাসিটা থেমে যায়। কাকাও হাসি বন্ধ করে বলে, আরে, ঐটা ত তোতলা। কথা কইব্যার পারে না। তাই খাড়া হইয়া ভাষণ দিব্যার ধইরছে। ভাষণ দিলে হেমেন আমাগ তোতলায় না- কাকার কথাতে আবার একটা হাসির দমক ওঠে। কিন্তু হেমেন হাতের ভেতর থেকে মুখ তোলে না।
ছাড়ি দ্যান, মুই কহিছু, জব্বর দাঁড়ায়। ফুলবাড়ির সবচেয়ে বড় জোতদারের ছোট ছেলে। কংগ্রেসের বাড়ি, বড় ভাইরাও সব কংগ্রেস। জব্বর সাতষট্টি সালে প্রথম সি-পি-আই হল। তার পর বছর দুই পর-পর পার্টি বদলিয়ে এখন আবার বামফ্রন্টে ঘুরে এসেছে। টেরিলিনের প্যান্ট আর টেরিলিনের গেঞ্জি পরনে জব্বর দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে, শুনেন, কথাটা ত সবারই জানা। আমাদের ফুলঝোরার ক্যালভার্টটা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা প্রথম থিকেই এই ঠিকাদারের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারি নাই। আমরা কেউই পারি নাই–আমার বাবাও পারে নাই, আবার জগদীশ কাকাও পারে তাই। এইটা পার্টির কথা না। আমাদের সবাইয়ের কথা। আমাদের ভয় ছিল ব্রিজটা ভাঙি পড়িবে। ত মাজ আমাদের এম-এল-এ সাহেবের পায়ের আঘাতেই সেইটা হল। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য। কারণ—
জব্বরের কথায় বাধা দিয়ে ইনজিনিয়ারদের ভেতর থেকে কেউ বলে, একটু জোরে বলুন, শুনতে পাচ্ছি না।
জব্বর আঙুল নাড়ায় যত বেশি, তত জোরে কথা বলে উঠতে পারে না। গলাটা একটু তুলে সে বলে, আজ আমাদের সৌভাগ্য এম-এল-এ সাহেব ফুলবাড়িতে গিয়াছিলেন এবং আমাদের অভিযোগ সত্য কি না, ব্রিজ ভাঙি যেতে পারে কি না, সেটা পরীক্ষার জন্য ব্রিজের রেলিঙে নিজেই লাথি মারিলেন এবং ব্রিজের রেলিঙ ভাঙি গেল। অর্থাৎ কিনা, আমরা যদি পরে বলতাম তা হলে ফুলঝোরার মানুষের সবই দোষ হইত যে তোমরা নিজেরাই ব্রিজ ভাঙিছ, বুঝেন, অমাদের ব্রিজ আমরাই ভাঙিব? যে-ব্রিজের জন্য আমাদের কত মানুষের কত কষ্ট গিয়াছে জব্বরের গলা উঠতেই এম-এল-এ হাত তুলে তাকে থামায়।
ঠিক আছে, জব্বর বসে পড়ে। এম-এল-এ পরিষ্কার করার জন্যে দু-তিনবার গলা ঝাড়ে। মুখের, ওপর দুই-একবার হাত বোলায়। বোঝা যায়, নিজেই এবার বলবে। ইনজিনিয়ারদের দলটা দেয়াল থেকে পিঠ সরিয়ে সোজা হয়। মণি আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে পা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসে। মণি বুঝতে চাইছে, বীরেন কী চায়। আর ব্যাপারটার সঙ্গে এমন আচমকা জড়িয়ে পড়ে মণি একটা সমাধান তাড়াতাড়ি বের করে নিতে চাইছে। বীরেন সমাধান চায়, না, আরো পাকাতে চায়–তা অবিশ্যি মণি জানে না। আর, এখন, এই জব্বর ছোকরার কথা শুনতে-শুনতে মণির মনে হতে থাকে যে সাব-এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারের কাছে খবর পেয়ে আচমকা এখানে আসতে হচ্ছিল বলেই এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার তাকে বুঝিয়েছে সে ব্যাপারটি মেটাতে চায়, মণিদেরই কথা মত, যদিও মণিদের পার্টির লোকজনের কথা ঠিক নয়। আজকের এই মিটিংটা একবার পার হয়ে গেলে ঐ অফিসারই নানা প্যাঁচ কষতে পারে। যদি প্যাঁচ কষাকষিই চলে, তা হলে বীরেনের প্যাঁচটাই পড়ক আগে। মণি, তার স্বভাব-অনুযায়ী, এতক্ষণ যা ভেবে আসছিল, তার বিপরীত সিদ্ধান্ত নিতে ঝুঁকছে। ততক্ষণে এম-এল-এ কথা শুরু করে দিয়েছে। গয়ানাথ, হাট কমিটির মেম্বারসহ আরো অনেকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে শতরঞ্চির মাঝখানটাতে বসে–সুহাসের পাশে, ফুলবাড়ি বস্তির দলের পেছনে। শুদ্ধ্যা– এটা ফুলবাড়ি বস্তির সবাই বলতে পারে যে তারা এই কনট্রাকটারের ব্যাপারে আমাকে, সরকারকে ও ডিপার্টমেন্টকে অনেক চিঠি দিছে। আমার পক্ষ থিকে বলতে পারি যে আমি সেই সব চিঠির জবাব দিতে পারি নাই। কিন্তু আমি স্থানীয় পি-ডবলু-ডির এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারের অফিসে সেই সব চিঠি পাঠাইছি। আমাদের কি এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার সাহেব একটু আলোচনা করিবেন সেই চিঠিগুলি বিষয়ে যে তিনি পাইছেন কি না, কী করিলেন, এই সব বিষয়?
এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার এই ধরনের মিটিঙে অনভ্যস্ত ত বটেই, একটু ভয়ও পেয়েছে। উঠে দাঁড়ায়। এম-এল-এ বলে, আপনি বসেন, আমরা শুনতে পাব, বসে বসে বলেন।
ইনজিনিয়ারকে একটু সময় নিতে হয় কী ভাবে শুরু করবে স্থির করতে, সভাপতি মহাশয়, না, বন্ধুগণ, না, কমরেডস। কমরেডস বলা চলে না, কারণ বোঝাই যাচ্ছে এখানে সব পার্টির লোকই আছে। আর, জীবনে কোনোদিনই ইনজিনিয়ারকে বন্ধুগণ বলতে হয় নি, বসে বসে বন্ধুগণ বলা যায় কি না বুঝতে পারে না। সভাপতি মহাশয় অবিশ্যি বলা যায় কিন্তু এটা সভাপতির সভা, না, এম-এল-এর সভা? খুব কম সময়ের ভেতর এতগুলো কথা তাকে ভেবে নিতে হয়। আর তখনই শোনে এম-এল-এ তাকে প্রশ্ন করে, আপনি এদের ডেপুটিশন আর আমার পাঠানো চিঠি ত পেয়েছেন?
হ্যাঁ। এই ব্যাপারটা ত আমাদের এস-এ-ই মিস্টার মণ্ডল ডিল করেন। উনি বলতে পারবেন।
ওনার সঙ্গে ত আমাদের কথাবার্তা হইছে। উনিই ত আপনাকে খবর দিছেন। আমি জানতে চাই যে আপনি কখনোই চিঠিপত্রগুলা দেখিছেন, কি দেখেন নাই? এম-এল-এ খুব ঠাণ্ডা ভাবে প্রশ্ন করে। কিন্তু ফুলবাড়ির ভিড়টা এই কথাতে যেভাবে একসঙ্গে মাথা নাড়ে তাতে মনে হয় প্রশ্নটা খুব দরকারি।
ইনজিনিয়ার তখন বলতে শুরু করে, আসলে সরকারি অফিসেও এক-একজন অফিসার এক-একটা কাজের চার্জে থাকেন, সেই সব কাজের করসপনডেন্স ফাইলগুলোও তারাই দেখেন। আমাকে যখন জানান তখন আমি জানতে পারি।
এই কথায় এম-এল-এ হেসে ওঠে, সামান্য, তারপর বলে, আপনার অফিসের জন্যে এই নিয়মটা ত আপনার ভাল নিয়ম। সেটা আমি জানতাম না বলেই সব গোলমাল পাকি গেইছে। কিন্তু এক-এক সরকারি অফিসে এক-এক নিয়ম হইলে আমাদের মত মানষির বিপদ হয়।
সব সরকারি অফিসেই ত মোটামুটি এই নিয়মই হয়, এক-এক ফাইল এক-এক অফিসারের চার্জে। আমি ত ফুলঝোরা ক্যালভার্টের ফাইল সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
সে ত আজ এখন আনবেন, আমরা সব এইখানে বসি আছি, ত আনবেন। কিন্তু আপনি য্যানং সরকারি অফিসের আইন জানেন, আমরাও ত দুটা-একটা জানি। আমি এমন সরকারি অফিসের কথা জানি অফিসের কোনো নতুন বিয়া বসা মেয়ের চিঠি আসিলেও অফিসার নিজে পড়ি দেন–
একটা চাপা হাসির দমক ওঠে। গয়ানাথ ঘন-ঘন মাথা ঝাঁকায়, যেন এ-রকম তারও অনেক জানা। হাট কমিটির মেম্বার চুপচাপ হাসে। আর মণি একটু অবাক হয়ে বীরেনের দিকে তাকায়। বীরেন এত থেমে-থেমে, এত গুছিয়ে-গুছিয়ে, ইনজিনিয়ারকে অপদস্থ করে দিচ্ছে? এসেম্বলিতে বীরেন অবিশ্যি দুটো-না-তিনটে বক্তৃতা করেছে, কাগজে উঠেছিল। বক্তৃতা ও ভাল করে। আর এম-এল-এ হয়েও খাটে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাই বলে এতটাই বদলে গেছে?
মণির যেন আর মনে থাকে না সে ইনজিনিয়ারদের কাছে শুনে তবে এখানে এসেছে। তার মনে হয়–বীরেনের এই পরিবর্তন দেখাটাই তার লক্ষ ছিল।
এম-এল-এ বলে, তা হলে এই কথাটা এই মিটিঙে আর তোলার দরকার নাই যে আমরা আপনার চিঠির জবাব কেন পাই না।
না, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু আমাদের অফিসে ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ মাত্র দুজন। আর, টাইপিস্ট একজন। তিনি মেটার্নিটি লিভ নেয়ায় নতুন রিলিভিং হ্যান্ড আসে নি। আমাদের একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট, টাইপের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেও তিনি কোঅর্ডিনেশন কমিটির মেম্বার বলে–
সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি ত আপনাদের এইখানকার এম-এল-এ।
এবারের হাসিতে ইনজিনিয়ারও যোগ দেয়, মণিও হেসে ফেলে। এম-এল-এ তখন বলে, আমি কি আমাদের এই এলাকায় যে-সব কাজ হচ্ছে তা নিয়ে কোনো কথা জানাবার থাকলে আগে জানি নিব কোন অফিসার কোন কাজের চার্জে আছেন, তার পর তার কাছে লিখব?
না সেটা কেন হবে, আপনি আমাকেই লিখবেন।
কিন্তু আপনি ত আমার চিঠিরও কুনো জবাব দেন নাই। আমি আগে আপনাকে চিঠিতে জানালাম যে আজ আমি ফুলবাড়ির ঐ ব্রিজটা দেখতে যাব। কিন্তু ঐখানে দেখি আপনাদের মিস্টার মণ্ডল আছেন। কিন্তু কথা ছিল ত আপনার সঙ্গে।
আমি ওটা বুঝি নি। আমি ভেবেছি মিস্টার মণ্ডল কাজটার চার্জে আছেন, উনি থাকলেই হবে।
আমার যদি আপনার সঙ্গে কোনো কথা থাকত আমি আপনার অফিসে যেতাম। কিন্তু আসলে এই কথাটা ঐ ব্রিজের সামনে হওয়া দরকার। কারণ এই অভিযোগটা হচ্ছে যে কনট্রাক্টার এই কাজটা ঠিকমত করে নাই–
.
০৪৯.
ঠিকাদার আর ইনজিনিয়ার…
এই সব কমপ্লেন যদি একটু স্পেসিফিক না হয়, কী পার্টিকুলার কমপ্লেন, তা হলে ত ডিপার্টমেন্টের পক্ষে এনকোয়ারি করা মুশকিল। এতে আবার সব কাজেরই প্রগ্রেস হ্যামপার করবে। কনট্রাকটাররা ডিমর্যালাইজড হবে।
সে যদি ফুলবাড়ি বস্তির লোকেরা আপনাকে বলতেই পারত যে কী কী দোষ হচ্ছে তা হলে ত ওরাই ইনজিনিয়ার হত। কিন্তু যে কথাটা বারবার হচ্ছিল যে কনট্রাকটার বালি আর সিমেন্টের মিশাল ঠিকমত বানাচ্ছে না। ফুলঝোরা দিয়া বর্ষায় ত বড় স্রোত যায়। ঐ রকম পাতলা মিশাল ভাসি যাবে। এইটা কি আপনাদের কানে যায় নাই?
হ্যাঁ। আমরা শুনেছি, কিন্তু স্পেসিফিক কমপ্লেন ত ছিল না, তাই
মিশালের
ফুলবাড়ি বস্তির ভিড় থেকে কেউ একজন বলে, মশলার।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মশলার মিশাল কি আপনারা কেউ পরীক্ষা করে দেখছেন?
না। তা করা হয় নাই ঠিক। কিন্তু এইরকম ত কখনো করা হয় না। একজন কনট্রাকটার কেন ওরকম করতে যাবে সমবেত হাসিতে ইনজিনিয়ারের কথাট চাপা পড়ে যায়। ইনজিনিয়ার একটু অপ্রস্তুত হয়ে থেমে যায়।
এইটি আপনি কী বললেন? কনট্রাকটাররা কাজে কেন ফাঁকি দেবে বা চুরি করবে তা আপনি জানেন না? মণি খুব হেসে সিগারেটে টান দেয়।
ঠিকাদার আর ইনজিনিয়ার
দ্যাশখান কইরল ছারখার।
এই বর্ষাকাল আইল, কুথায় কুন ফরেস্টের মধ্যে কুন নদী ভাঙল, ব্যাস, ফেল পাথর। কার পাথর, কেডায় ফ্যালে আর কেডায় হিশাব রাখে, কন! এক-একডা পাথর জলে পইড়লে ঠিকাদারের বার আনি আর সাহেবের চার আনি। আর যে-পাথরডা তুলাও হয় না, ফেলাও হয় না–সেই পাথরের চোদ্দ আনি সাহেবের, দুই আনি ঠিকাদারের।
এই রকম কথা হলে ত মুশকিল।
কাকা, চুপ করেন, এই সব কথা বলবেন না, যদি ধরতে পারেন স্যালায় কহিবেন, এম-এল-এর কথায় ফুলবাড়ির কাকা হো-হো করে হেসে ওঠে, এইডা ভাল কইছেন, তা হালি ত তিস্তাবুড়ির তানে হিশাব লইতে হয়, কী, না, বুড়ি কয়ডা পাথর পাইছ?
আজকা সকালে ঢালাই হল। আমি, ধরেন, সন্ধ্যার মুখে বা তার আগেই পৌঁছাই। আমি পরীক্ষা করার জন্য পা দিয়া একটা ঝাঁকি দিছি। আপনাদের মিস্টার মণ্ডলও ছিলেন। কিন্তু পুরা রেলিং ঝর ঝর করি পড়ি গেল। এইটাও কি প্রমাণ না? আপনার মিস্টার মণ্ডল তখন আমাকে বুঝান যে সব জায়গাতেই নাকি এরকম হয়– এম-এল-এ বলে।
মিস্টার মণ্ডল কিছু বলতে ওঠে কিন্তু ইনজিনিয়ার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়, কোনো ঢালাইই ত চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে জমে না, সে যত সিমেন্টই দেয়া হোক। বার ঘণ্টার মধ্যে পা দিয়ে ধাক্কা দিলে হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশনের বানানো রেলিঙও ভেঙে যাবে–, ইনজিনিয়ার এতক্ষণে হাসার সুযোগ পায়। ইনজিনিয়ারদের অন্য কারো হাসি তার সঙ্গে মেশে না বটে, কিন্তু বোঝা যায়, ঐ দলটাতে একটা সমর্থনের নড়াচড়া ঘটে। এতক্ষণ এম-এল-এ যেরকম ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছিল, ইনজিনিয়ারের গলায়। এতক্ষণে সেই ঠাণ্ডা ভাবটা আসে। তার কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, এই বিষয়টা তার জানার সীমার মধ্যে আর এ-বিষয়ে তার কোনো ইতস্তত নেই।
এম-এল-এ জানত তার জন্যে এই বিপদটা অপেক্ষা করে আছে আর কথাটা এখানে আসবেই। তার অভিজ্ঞতায় সে জানে, এই নিয়ে আলোচনা যত এগবে, ইনজিনিয়াররা তত বেশি সুবিধে পাবে। আর, এই এম-এল-এ তার কাজকর্মে বারবারই এখানে এসে ঠেকে যায়। তার ঠেকে যাওয়ার আরো অনেকগুলো জায়গা আছে, কিন্তু সে সব কিছুর ভেতর এই জায়গাটা এলে যেন পুরো আটকে যায়। এম-এল-এ মাথা ঠণ্ডা রেখে বলে, শুনেন, এইটা ত তর্ক করি মীমাংসা হবে না। আমাদের সন্দেহ ঠিক কি বেঠিক তার ত একটা পরীক্ষা হওয়ার নিয়ম আছে। সেই নিয়মটা আপনি বলেন আমরা শুনি।
ইনজিনিয়ার ঠাণ্ডা গলাতে জবাব দেয়, ঐ মিকশ্চারের স্যাম্পল নিয়ে স্টেট টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে। তারা রিপোর্ট দেবে।
এই কেসটাতে আপনারা সেটা করতে রাজি আছেন?
আমাদের রাজি-অরাজির ত কোনো কথা নেই। আপনারা যদি করতে বলেন আমরা পাঠাব। কিন্তু তা হলে ত যতদিন রিপোর্ট না আসে ততদিন কাজ বন্ধ রাখতে হবে?
কাজ আর বন্ধ থাকবে কী? রেলিংটা আর বানাবেন না, এই ত? কী? আপনাদের কি রেলিং ছাড়া খুব অসুবিধা হবে?
ঐ ব্রিজ তুমি নি গেলেও হামরালার কুনো অসুবিধা নাই, আজি বাদে কালি ত ভাঙি পড়িবেই, অ যতই ইনজারি বলেন না কেন, ফুলবাড়ির দলের ভেতর থেকে কেউ বলে।
এম-এল-এ ধমকে ওঠে, আজেবাজে কথা ছাড়েন, শুধাছি সেইটার জবাব দেন।
এর ভেতর ইনজিনিয়ারদের ভেতর কিছু কথা হয়। ইনজিনিয়ার বলে, আপনি শুধু রেলিং বলছেন কেন, প্ল্যাটফর্ম আর রোডের মধ্যে আর্থ ওয়ার্কও বাকি আছে, সেটাও হবে না। মানে ব্রিজটা ইউজ করা যাবে না। তা ছাড়া স্যাম্পল ত শুধু রেলিং থেকে নিলে হবে না, সব পার্ট থেকেই নিতে হবে।
খাড়ান, একে একে কন। মানে রাস্তা আর ব্রিজের মাঝখানের ফঁকখান বুজান হবে না, এই ত?
হ্যাঁ।
আপনারা একবেলা কাম করি বুজি নিবার পারিবেন না? ফুলবাড়ির দলটাকে এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।
হয়। কনট্রাকটার বুজালেও ত আমাগো দিয়্যাই কইরত। এইডাও আমরাই কইরব। বিনা পয়সায়।
মণি বুঝে উঠতে পারে না, বীরেন কোন দিকে যাচ্ছে ও কেন যাচ্ছে। ফুলঝোরার এক দুই-হাতি ক্যালভার্ট নিয়ে কোথায় স্যাম্পল পাঠাবে, আর, এই সুযোগে অফিসার আর ঠিকেদার মিলে এদিককার সব কাজ বন্ধ কর দেবে। তা ছাড়া এই ব্যাপারটা নিয়ে এতদূর কেন যাওয়া হবে, মণি তাও বুঝে উঠতে পারে না। ফুলবাড়িতে তাদের পার্টির লোকজন কোনো কালেই নেই, এই সরকার হাওয়ার পর হয়েছে। সরকার চলে গেলেই চলে যাবে। আর বীরেন এতদূর যাচ্ছেই বা কেন। এর সঙ্গে ত নীতির প্রশ্ন জড়িত। পার্টির ভেতরে বারবার আলোচনা হয়েছে, এমন কিছু কখনোই কেউ করবে না যাতে লোক্যা থানা বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বা গবর্মেন্ট অফিসাররা ছুতো ধরতে পারে। মণি বোঝে, তার এবার কথা বল উচিত। কিন্তু সে ঠিক করতে পারে না, এখানে যা হয় তা হতে দিয়ে, পরে, মানে, এখান থেকে ফিরে মালবাজারেই, ইনজিনিয়ার আর বীরেনকে নিয়ে বসে একটা মিটমাট করে দেবে, নাকি, এখানেই সে কথা বলবে। কিন্তু বীরেনের সঙ্গে আগে ত কথা বলে নি। সে জানে না, বীরেন এতটা রেগে আছে কেন।
তা হলে আজ রাত্রিতে বীরেনের সঙ্গে কথা বলে, কাল সকালে ইনজিনিয়ারকে আসতে বলতে পারে।
আর-একটা কথা কী বলছিলেন?
স্যাম্পল ত সব জায়গা থেকেই নিতে হবে, সেই কথা।
তার জন্যে কি পুরা ব্রিজ ভাঙতে হবে, নাকি?
না, তা কেন, একটু নিলেই হবে ভেঙে।
তা হলে কি তাই ঠিক হবে? এম-এল-এ সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
.
০৫০.
এম–এল-এর রাগ ও মিটিঙের শেষ
কনট্রাকটারের পক্ষ থেকে এই লোকটি কিছু বলতে চায়–ইনজিনিয়ার তাদের দলের মধ্যে বসে থাকা একজনকে দেখিয়ে বলে।
হ্যাঁ, বলেন, আপনি ঠিকাদারের লোক? এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।
লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, হ্যাঁ, স্যার। আপনারা এই মিটিঙে যা ঠিক করবেন সে আমার মালিক বুঝবে, আমি কাল জলপাইগুড়ি গিয়ে মালিককে জানাব। কিন্তু আমাদের নিয়ে ত অনেক কথা এইখানে হল। আমরাও তা হলে কিছু কথা বলতে চাই, সেইটা আপনি বলেন।
বলেন, আপনি কী বলতে চান, বলেন, এম-এল-এ বলে। আপনারা ত কনট্রাকটার এই সব নিয়ে এত কথা বললেন। কনট্রাকটার ত আর এক রক না। আমার মালিক বড় কনট্রাকটার। এই সব ছোট কাজ করেন না। সে এই সাহেবরা জানেন। মণিবাবু জানেন। এম-এল-এ বাবুও জানেন। কিন্তু হল কি, আমি ওর সঙ্গে নানা সাইটে কাজ করছি পাঁচ-সাত বছর। এই রকম ছোট কাজ আমি মালিককে বলে ওনার নামে টেন্ডার দেই। আমার ত আর লিস্টে নাম নাই। আমার মালিকের টেন্ডার থাকলে সেটা ত সবাই জানবেই। আর রেট অনেক লো ছিল। কেন, না আমি নিজেই রাজের কাজ জানি। আমার দুই ভাই আছে, ওরাও জানে। আর কিছু লোক লাগাই। তাতে আমরা লো-তে কাজ তুলে দিয়ে মোটামুটি লাভ করতে পারি। এখন হল কি, মালিক যদি দেখে তার কোম্পানির নাম নিয়ে এইসব গোলমাল হচ্ছে, তাতে মালিকের বদনাম হয়ে যাবে, মালিক আমাকে বরখাস্ত করে দেবে। মানে চাকরি যাবে না ঠিকই, কারণ আমি মালিকের বিশ্বাসের লোক। কিন্তু এই যে আমি ছোট-ছোট কাজ করে নিজের একটা কাজ বানাচ্ছি এইটা আমার একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, লোকটি কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এম-এল-এও তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বোঝা যায়, এই লোকটির কথাতে অবস্থাটা আবার বদলাতে শুরু করেছে। মণি ভাবে, এই সুযোগটা সে নেবে। সে সিগারেটটায় টান দিয়ে কথা শুরু করার আগেই এম-এল-এ বলে ওঠে, সেটা তুমি অফিসারদের বলো। আমরা ত তাদের কবে থিকে বলছি যে এই ব্রিজ নিয়া একখান গোলমাল পাকি যাবার ধরিছে। ত অফিসার আমাদের কথার কোনো ত দামই দেন নাই। ত যাউক, টেস্ট-মেস্ট হইয়া আসুক
লোকটি বলে, এইটা নিয়ে আমার কথা আছে। আমি এতদিন বলি নাই। কিন্তু এখন ত আমার বিপদ হয়ে যাচ্ছে। তাই বলতেই হচ্ছে। আমি কারো নাম বলব না। আপনারাও জিগেস করবেন না। আমরা যখন প্রথম এইখানকার কাজ ধরি, মানে সাইটে আসি, তখনই এখানকার কয়েকজন এসে বলেন আমরা সরকারের পার্টির লোক, আমাদের পাঁচ বস্তা সিমেন্ট দিতে হবে। আমি কীভাবে কাজ করি তা ত আপনারা শুনলেন। পঁচ বস্তা সিমেন্ট দিলে আমার আর কী থাকবে। আমি বললাম, ভাই, একটু-আধটু নিতে হয় না, কিন্তু এত সিমেন্ট আমি কোথা থেকে দেব। কিন্তু তারা রাজি হয় না। উনি ওর একটা ঘরের বাইরের জায়গাটা ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাতে চান। সেইটা আমি রাজি হই নাই বলেই আমার এই অবস্থা। আগে জানলে আমি দিয়ে দিতাম। কিন্তু তখন বুঝি নাই যে এত কাণ্ড হবে। আমি এতদিন এ-কথা বলি নাই। কিন্তু আজ না বললে আমার বিপদ বলেই বললাম, লোকটি বসে পড়ে। ফুলবাড়ির দলটার মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মণি তার আগেই এম-এল-একে আস্তে করে বলে, আমি একটু বলছি। তারপর দাঁড়িয়ে ওঠে।
কিন্তু, সঙ্গে-সঙ্গেই গয়ানাথ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মণিবাবু, আমাদের ত এইটা একখান সৌভাগ্য কিনা তোমরালা সকলে, এম-এল-এ আর এ্যানং সব ইনজিনিয়ার মোর এই ক্রান্তিহাটত আসিছেন। ত হামরা তোমাক চা খিলাবার চাই। যদি বলেন ত এ্যালায় আনিবার কহি।
আনেন, চা খাওয়াবেন সে ত ভাল, বলে মণি অপেক্ষা করে, গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বার উঠে নীচে নামা পর্যন্ত, তারপর বলে, আমার এর মধ্যে কোনো কথা বলা উচিত না, আমি হঠাৎ এসে পড়েছি। কিন্তু আমার মনে হল কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, না হলে এরকম ঘটনা কেন ঘটবে, এত ত ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে। একটু আগে সাবধান হলে বোধ হয় এত গোলমাল। হত না। আমাদের ইনজিনিয়ার যদি আমাদের এম-এল-এর চিঠির জবাব দিতেন বা তাদের ভেতর যদি যোগাযোগ হত, তা হলে অনেক আগেই এ সব মিটে যেত। কী বলেন, ইনজিনিয়ার সাহেব?
ইনজিনিয়ার সে-ইঙ্গিত বুঝে ফেলে, বলে, আমার এটা নিশ্চয়ই দোষ হয়েছে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম মিস্টার মণ্ডল
ইনজিনিয়ারকে থামিয়ে দিয়ে এম-এল-এ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, আপনার মানষিলার খুব প্রেস্টিজ লাগে, না, সিডিউল সিটের এম-এল-একে পাত্তা দিতে?
মণি হঠাৎ চমকে গিয়ে বলে ওঠে, এই বীরেনদা, কী বলছ? এম-এল-এ মণিকে বলে ওঠে, আপনি চুপ করেন, আপনারা এইসব বুঝবেন না, আপনাদের সঙ্গে ত এরা এরকম করে না। আপনারা ইংরাজি কহিলে ইংরাজি কহিবার পারেন। আমিও এই সব বুঝিতাম না, এম-এল-এ না হইলে। না-হইলে উনি মালবাজারের এক এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার, উমরার সাহস হয় কী করি, মোর চিঠি আগত পাইছেন তবু ঐঠে হাজির না থাকিবার? আর এ্যালায় যদি জলপাইগুড়ি কি ধূপগুড়ির এম-এল-এ চিঠি দিত তার বাদে দশবার গিয়া স্যার স্যার করিতেন। ত হউক কেনে, বিচার হউক। যাউক মশলা টেস্ট করিবার। কিন্তু যদি দোষ বাহির হয়, তবে ঐ একখান গরিব ঠিকাদার আর ঐ আর-একখান সিডিউল কাস্ট মণ্ডলের উপর দোষ চাপানো চলিবে না; ইনজিনিয়ারক দায়ী হওয়া লাগিবে।
এই কথার জবাবে ইনজিনিয়ার বুঝি কিছু বলতে চায়, কিন্তু মণি হাত তুলে থামায়। মণি দাঁড়িয়েই থাকে। সে দাঁড়িয়ে আছে একমাত্র এই কারণে যদি বীরেনদা চুপ করে। মণি যে ইনজিনিয়ারকে থামিয়ে দেয় সেটা দেখে এম-এল-এ আবার বলে ওঠে, উমরাক থামাছেন কেনে, কহিবার দ্যান, আর নতুন কী কহিবেন? য্যালায় দেখিলেন ঐ সব টেস্টমেস্ট বলিয়াও হামরাক ঘাবড়ান গেইল না, স্যালায় ঠিকাদারের মানষিক দিয়া বলিবার ধইরছে যে এই ফুলবাড়ির মানষিগিলাই চোর।
ফুলবাড়ির দলটা একসঙ্গে ফুঁসে ওঠে, নাম কহেন, নাম কহেন, আমরা তাক ডাকি আনিব, দলের ভেতর থেকে দু-চারজন দাঁড়িয়ে উঠে ইনজিনিয়ারদের দলটার দিকে চেঁচায়। মণি তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, বসি পড়েন, এই বসো।
এম-এল-এর রাগ ঠিক সেই সময় চরমে ওঠে, করিবেনটা কী? ঠিকাদারের চুরি ধরিলে আপনাকে চোর বানাবে, ইনজিনিয়ারক ফাঁকি ধরিলে আপনাক ঠক বানাবে, আইন ধরি চলিবার রাজি হইলে আপনাক বেতাইন বানাবে, কালি..গিয়া খবরের কাগজ-এডিওতে প্রচার করি দিবে–আবার ডুয়ার্সে গণআদালত, ইনজিনিয়ারদের বিচার।
মণি নিচু হয়ে এম-এল-একে অত্যন্ত দ্রুত কিছু বলে, তারপর সোজা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, শোনেন, আপনারা যদি না বসেন আমি এ মিটিং এখনই ভেঙে দেব, বসেন বসেন।
ধমকে ফুলবাড়ির দলটা বসে পড়তেই মণি চিৎকার করে বলতে শুরু করে, শোনেন, এমন কিছু হয় নাই যে এখানে একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যাবে। এখানকার ইনজিনিয়ারদের ব্যবহারে আমাদের এম-এল-এ খুব দুঃখিত হয়েছেন। এম-এল-এ আমাদের সকলের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সুতরাং এমএল-এর দুঃখ আমাদের সকলের দুঃখ। তার দুঃখ আমাদের দূর করতে হবে। কিন্তু তিনি ত কোনো ব্যক্তিগত কারণে দুঃখ পান নাই। দেশের একটা কাজে এরকম একটা গোলমাল হয়ে গেছে বলেই তার দুঃখ। সরকারি কাজকর্মের নিয়মই আলাদা। সেই নিয়মে হয়ত ইনজিনিয়ারসাহেব ভেবেছেন যে ছোট ইনজিনিয়ারই সব বুঝিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ইনজিনিয়ারসাহেবের উচিত ছিল এম-এল-এ সাহেবের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু এই সব রাগারাগি দিয়ে ত আর আমাদের এই অঞ্চলের কাজকর্ম চলবে না। তার ওপর আমরা ঠিকাদারদের কথাও শুনলাম। সেও একজন অতি ছোট্ট ঠিকাদার। সে যদি আজ আইনের প্যাঁচে পড়ে যায় তা হলে বড় ঠিকাদার তাকে বাঁচাতে আসবে না, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। তাই আমি প্রস্তাব দিচ্ছি যে, এই সভায় ত সব খোলাখুলি আলোচনা হল। এখন এইটুকু একটা ব্রিজ নিয়ে হিল্লিদিল্লি করার দরকার নেই। মালবাজারে একদিন এম-এল-এ, ইনজিনিয়ার, ঠিকাদার ও আপনাদের ফুলবাড়ির দুইজন লোক মিলে বসে সব মীমাংসা করে নেন। তাতে ব্রিজের কোনো অংশ ভেঙে যদি আবার তৈরি করতে হয়, তৈরি করে দিতে হবে। আর দুটো-একটা বর্ষায় ব্রিজের কোনো ক্ষতি হয় কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্যেও সময় দিতে হবে।
ঠিক এই সময়, গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বার আগে-আগে ও তাদের পেছনে-পেছনে একটি ছেলে একটা বড় কেটলি, আর-একটি ছেলে একটা ঝুড়ি, আর-একটি ছেলে আর-একটা ঝুড়ি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে বারন্দায় উঠে একেবারে শতরঞ্চির মাঝখানে চলে এলে, মিটিংটা যেন ভেঙে যাবার মত হয়। সেই ভাঙা মিটিঙের ওপর দুটো হাত তুলে মণি জিজ্ঞাসা করে, তা হলে এইটাই ঠিক ত? তা হলে এইটাই ঠিক থাকল?
গয়ানাথ আর মেম্বার মিলে চা দেয় হাতে-হাতে, চা নয়, চায়ের গ্লাশ। আর কেটলি হাতে ছেলেটি গ্লাশগুলোতে চা ঢালে, হেই দেখিস কেনে, ফেলিস না গাওত। ঐটুকু ছেলের অত বড় কেটলি নাড়ানোর অভিজ্ঞতা এমনই যে সে কোনো গ্লাশেই এতটা চা ঢালে না,যাতে উপচে যায়। গ্লাশ দেয়া হয়ে গেলে গয়ানাথ আর মেম্বার মিলে আর-এক ঝুড়ি থেকে প্রত্যেককে একটা করে সিঙাড়া আর একটা করে মিঠা নিমকি হাতে-হাতে দিতে শুরু করে।
এইসব মিটিং যেমন ভাঙে, এই মিটিংটাও তেমনি ভাঙতে শুরু করে। কথাবার্তা, ঝগড়াঝাটি, রাগারাগি, মিলমিশ এই সবের ভেতর দিয়ে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব আসে। খুব বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া এত রাতে এতগুলো মানুষ একই সঙ্গে এক জায়গা থেকে বেরচ্ছে এমন ঘটনা ক্রান্তিহাটে খুব হয় না। ফলে, মিটিং ভাঙার মধ্যে একটা নতুন অভিজ্ঞতার আরামও জোটে।
গাড়ি করে যারা মালবাজারে ফিরে গেল, মণি, এম-এল এ ও ইনজিনিয়ার, ঠিকাদার, আর, এখানে সুহাস, এই আরামের ভাগিদার নয়। আর নয় গয়ানাথ, কিছু পরিমাণে।
২.২ এক মিটিঙের তিন ফল
চা-সিঙাড়া খেতে-খেতে মিটিংটা ভাঙার পর সবাই নানা দলে ভাগ হয়ে যায়। ক্রান্তিহাটের দল মালবাজারের গাড়ি চলে গেলে যে যার বাড়ি চলে যাবে। গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বারকে এম-এল-এ বলে, শতরঞ্চিটা রেখে দিতে যাতে ফুলবাড়ির ওরা রাতটা ঘুমতে পারে, আর সুহাসকে বারবার দুঃখ জানায় তার ঘাড়ে এসে মিটিংটা করল বলে। মিষ্টির দোকানদার হ্যাজাক নিয়ে যেতে লোক পাঠায়। সেই লোকটি হ্যাজাক ধরে পথ দেখিয়ে এম-এল-এ, ইনজিনিয়ার ও মণিবাবুকে জিপ গাড়ির সামনে নিয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তৈরিই ছিল বলে বিদায় নিতে দেরি হয় না।
গাড়িটা মিনিট দু-এক চলার পরই ইনজিনিয়ার এম-এল-একে বলে, বীরেনবাবু, আমি না বুঝে আপনার সেন্টিমেন্টকে আঘাত দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, সত্যি আমি ওরকম কিছু ভেবে কিছু করি নি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আর এই ব্রিজের ব্যাপারটা আপনি ভাববেন না, আমি দেখব।
আপনি আগে দেখলেই ত এত গোলমাল হত না। আমিও জানি লোক্যাল ঘটনা সব আছে। ধরেন, ঐ জব্বরের দাদারাই ত কনট্রাকটরি করে। ওরা সব যেই দেখছে এদিকে এই সব কাজ শুরু হইছে–অমনি বলাকওয়া শুরু করে দিছে যে লোক্যাল কনট্রাকটারদের দিয়া কাজ করিবার লাগবে। এই মিটিঙেই সেই কথা তুলত, নেহাত সুযোগ পায় নাই। আবার এই ভদ্রলোক ঐসব বললেন, এই নিয়ে সাত কথা হবে।
আমি স্যার বুঝি নাই, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললাম।
না ঐ কথাটা তুমি বলতে গেলে কেন, তুমি ত আর নামধাম বলবে না, সে কথা কি আর দশ জনের সামনে বলা যায়, সাব-এ্যাসিস্টান্ট ইনজিনিয়ার মণ্ডল বলে।
যাক, ছেড়ে দিন। আসলে এসব লোক্যাল ইস্যু বাড়তে দিলেই বাড়ে। তার ওপর নানা রকম ইন্টারেস্ট আছে। পলিটিক্যাল ইন্টারেস্টই কি কম। আপনারা একটু ট্যাক্টফুলি চলবেন। বীরেনদাও যদি আপনাদের ওপর রাগ করেন, তা হলে আর আপনারা কাজ করবেন কাকে নিয়ে? বীরেনদাইবা অত। রেগে গেলে কেন? আরো যাও লাথি মেরে রেলিং ভাঙতে, এখন পা ব্যথা করছে?
আরে না, না, আমি কি আর জোরে লাথি মারতে গেছি? তবে আপনারা যাই বলেন, ঐরকম পাটকাঠির মতন রেলিং কোনো ব্রিজের থাকে না। আপনি ও নিয়ে ভাববেন না স্যার, আমি কাল সকালে ঠিকাদার আর মণ্ডল দুজনকে নিয়ে গিয়ে দেখে কী ভাবে কী করা যায় ঠিক করে আসব। আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।
.
সে শুধুই দর্শক আর শ্রোতা ছিল যে-মিটিংটাতে, তার অভিজ্ঞতা সুহাস নিজের কাছে ছকে নিতে চায় কিন্তু পারে না। শেষ পর্যন্ত ত ধরা পড়ে যায় গ্রামের ভেতরের কোন-একটা ছোট নদীর ওপর তৈরি ক্যালভার্টে নিয়ম অনুযায়ী সিমেন্ট-বালি-লোহা এই সব ব্যবহার করা হয়েছে কি না তা নিয়ে এম-এল-এর এত গভীর উদ্বেগের আসল কারণ তার চিঠি পেয়েও এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার না এসে সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট এসেছে কেন, আর তাকে স্যার বলা হয় না কেন। যদি ইনজিনিয়ারটি ফুলবাড়িতে যেত, তা হলে ত আর এরকম একটা মিটিং হত না। যদি কোথাও কোনো গোলমাল থাকত তা হলে সেটা ঐ ইনজিনিয়ারের অফিসেই মিটমাট হত–যেমন এখনো হবে। যে-নিয়ম ও আইনকানুনের কথা বারবার ইনজিনিয়ার ভদ্রলোক বলছিলেন, সুহাস তা মেনে ন নিয়ে পারে না, শুধু এই নেহাত ব্যক্তিগত কারণে যে তার কাজের ভেতর এ-রকম হস্তক্ষেপ হলে তারও ত একমাত্র রক্ষাব্যবস্থা সরকারি ঐ আইনকানুনই। আর এত মিটিং-টিটিং সত্ত্বেও সকলের চোখের সামনেই ত ইনজিনিয়ার ওদের কৃষক সমিতির সম্পাদককে গাড়ি করে নিয়ে এল। এটা আর কে না বুঝবে ঐ ভদ্রলোক ইনজিনিয়ারদের। নিরাপত্তার গ্যারান্টিই শুধু ছিলেন না, এমন-কি এম-এল-এর সঙ্গে ঝগড়ারও একমাত্র মীমাংসাকর্তা ছিলেন তিনিই।
এই সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে সুহাস গ্রাম ও কৃষক নিয়ে এক জাগরণের অনির্দিষ্ট অথচ যেন সম্ভাব্য চিন্তায় মগ্ন ছিল। অনির্দিষ্ট বলেই তাতে এমন সব নেহাত বাস্তব ঘটনার জায়গা করে দিতে পারে না সুহাস যে সরকারি পার্টির লোক হবার সুবাদে কনট্রাকটারের কাছ থেকে কিছু সিমেন্ট আদায় করার চেষ্টা আর ঠিকেদারদের কাজের ওপর এমন নজর রাখা একই সঙ্গে ঘটতে পারে। বাস্তবে, ঘটনার গায়ে ঘটনা, কার্যকারণের শৃঙ্খলা ছাড়াও যে লেগে থাকে, আর সেই একটি ঘটনার ভূমিকা যে অন্য ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল থাকে না সব সময়, কোনো-কোনো সময় আলাদা ও স্বাধীন হয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা সুহাস ত জানে না। তাই তার ব্যক্তিনিরপেক্ষ মহত্তর-বৃহত্তর কামনাবাসনায় গ্রহণই লেগে থাকে সুহাসের। বীরেন্দ্রনাথ রায়বর্মনের মত এক স্থানীয় এম-এল-এ-র সঙ্গে সরকারি চাকরির ঐতিহ্যবান ইনজিনিয়ারদের এই মোকাবিলায় এম-এল-এ যে ইনজিনিয়ারকে তাদেরই খেলার নিয়মে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল টেস্ট হাউসে পরীক্ষা করতে পাঠানোয় আরজি হয়ে গিয়ে, সেটা ত সুহাসের কাছে একটা কৌশলমাত্র। সেই কৌশলটা যে এম-এল-এ আয়ত্ত করতে পেরেছে এটা তার কাছে ধরা পড়ে না। এতটা পরিবেশনিরপেক্ষ হলে সুহাসকে নিজেরই চারপাশে পাক খেতে হবে। সুহাস নিজেকে ঘিরে আর-একটা পাক জড়ায়।
গয়ানাথ তার বাড়ির বাইরে উঠোনে ঢুকতে-ঢুকতেই চেঁচায়, হেই বাঘারু, বাঘারু, হেই বাঘারু। গয়ানাথের গলা শুনে ভেতর থেকে একজন একটা লণ্ঠন নিয়ে আসে। সেই লণ্ঠনের আলোতে গয়ানাথের এই বাড়িঘর সর লম্বা হয়ে মাটিতে দোল খায়।
গয়ানাথের বৌ ভেতরে চিৎকার করে ওঠে, নিজের বাড়িত কি ডাকাতি করিবার আইচছেন?
আসিন্দির মোটর সাইকেলটা ঠেলতে-ঠেলতে ভেতরে নিয়ে রাখে। চেঁচায়, এই, কায় আছিস, লণ্ঠনখান ধর এতৃতি। যে লণ্ঠন নিয়ে আসছিল সে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর পথ দেখাতে উঁচু করে ধরে।
গয়ানাথ আবার চিৎকার করে ওঠে, হে-ই বাঘারু, বাঘারু। তার পর হঠাৎই তার একেবারে সামনে, প্রায় তার ওপরে, বাঘারুকে দেখে চমকে ওঠে, শালো বলদ, জবাব দিবার পারিস নাই? শালা, বোবা ত হাম্বা ডাক কেনে। যা, দূরত যা, দূরত যা।
বাঘারু একটু দূরে সরে যায়। কিন্তু তখনো গয়ানাথ তার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। বস ঐঠে, শালো বলদ, বস কেনে, খাড়া হইছে য্যান ফরেস্টের শালগাছ।
গয়ানাথের কথা শুনে বাঘারু বসে পড়ে, মাটির ওপরে। হয়ত রাত্রি বলেই, বসার পর বাঘারুর সামনে গয়ানাথকে যেন আরো ছোট দেখায়। গয়ানাথ তার ফাটা বাঁশের মত চেরা অথচ সরু গলায় চিৎকার করে ওঠে, কী কহিছিস এম-এল-অক?
বাঘারু জবাব দেয়, কিছু কহ নাই।
কহ নাই? যেইলা উমরাক ফুলবাড়িতে নিয়া গিছিস, কী কহিছিস?
মোর নামখান কহিছু।
খুব নাম চিনবার ধইচছিস, না?
মোর জন্মকথাখানা কহিছু। তুই শালো অবতার হবার ধইচছিস, না? নিজের জন্মকথাখান নিজেই শুনাবার ধইচছিস মানুষক? আধিয়ারির কথা কহিস নাই, এম-এল-অক?
কী কাথা?
আধিয়ারির কাথা। এম-এল-এ হামাক কহিল, তুই কহিছিস আধিয়ারির কাথা। এম-এল-এ হামাক কহিল, উমরাক একখান আধিয়ারি দ্যান কেনে। শালো, জমিন মোর, না তোর এম-এল-অর?
মুই কহ নাই।
কহিছিস কি কহিস নাই, বুঝিবু এ্যালায়। তুই কালি সূর্য উঠিবার আগত এই তিস্তাপার ছাড়ি চলি যাবি। হু-ই নাগরাকাটাত ডায়না নদীর চরত মহিষের বাথান আছে, ঐঠে থাকিবু। বুঝলু? আর কান্দুরা ঐঠে আছে। পাঠাই দিবি। বুঝলু?
.
০৫২.
বাঘারু ও চাঁদ
পরদিন, রাত না পোহাতে বাড়ি থেকে নেমে বাঘারু দেখে, আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে, আকাশ ঝকঝকে সবুজ, সেখানে একটা শাদা চাঁদ।
বাঘারু ডাঙা থেকে লাফ দিয়ে নীচে নামে। আর চাঁদটাও তড়াক করে লাফ দিয়ে আপলাদ ফরেস্টের মাথা থেকে তার মাথার ওপর এসে পড়ে। লাফ দিয়ে নেমে বাঘারুকে দাঁড়াতে হয়। চাঁদটাও আকাশে আটকে যায়। বাঘারু মাঠ দিয়ে চলা শুরু করে দক্ষিণ হাঁসখালির দিকে। চাঁদটাও গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে। চাঁদটা টাকার জলছাপের মত। চার পাশে আলো ফুটলে আর দেখা যাবে না। আকাশটা এত ঝকঝকে সবুজ, আলো ফুটতে দেরি হবে না।
তিস্তা এখন তার পেছনে। তাকে তিস্তা পার থেকে চলে যেতে হচ্ছে। দেউনিয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। আসিন্দিরজোয়াইও ওঠে নি। ওরা উঠে দেখবে বাঘারু নেই। জানে, বাঘারু থাকবে না। বাঘারুকে ডাকবে না।
বরসোজা উত্তরে-পুবে, এই আনন্দপুর বাগানে ঢুকে ও চাঁদটা আরো বায়ে
এখন নিজের চোখের সামনেটা পরিষ্কার। বিঘাখানেক দূরের জায়গা নজরে আসে না। দূরে, বাড়ি-টাড়ি জলছিটানো কুয়াশায় ঢাকা। এই ধোয়া ধোয়া ভাবটা কাটতে সময় নেয়। সারা দিনই কিছু-না-কিছু লেগে থাকে গাছের মাথায়, নদীর ওপরে। এগুলো আকাশের কুয়াশা নয়–বনের বা নদীর কুয়াশা। সোজা তাকিয়ে হাঁটলে মনে হয় চাঁদের আলোয় হাঁটছে, সামনে কী আছে জানে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে বেশি দূর দেখা যায়। বাঘারু ঘাড় কাত করে আকাশেই তাকায়।
গোচিমারি থেকে হাঁসখালি পর্যন্ত অনেকখানি ঢাল জমি–তিন পাশের সব জমিই উঁচু, কোনো-কোনোটা ত বেশ উঁচু। এই ঢালটার ওপরে, এই সবুজ আকাশ যেন ঢাকনা। গোচিমারির ঢালের মাঝখানটা কড়াইয়ের মত। সেখানে নামতেই চাঁদটা এক লাফে তার মাথার ওপর এসে পড়ে। চার পাশে উঁচু ডাঙার জন্যে আর-কিছুই দেখা যায় না। দূরে ফরেস্টের গাছগুলোকে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল। সেই খাদের ভেতর বাঘারু আকাশের চাঁদের মুখোমুখি।
বাঘারু চাঁদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। হেসে বাঁ দিকে মুখ ঘোরায়-চঁদ ডাইনে সরে। ডাইনে মুখ ঘোরায়, চাঁদ বয়ে সরে। বাঘারু একটা ঢেলা কুড়োয়। সেটা চাঁদের দিকে ছোঁড়ার জন্যে কয়েক পা দৌড়তেই চাঁদটাও তাড়াতাড়ি গড়িয়ে সরে যায়। ঢেলাটা ছুঁড়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে। চাঁদটাও থেমে যায়। একটু দূরে ঢেলাটা পড়ে যাওয়ার ধুপ আওয়াজ হয়। চাঁদটার দিকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাঘারু আবার হাঁটতে শুরু করে হাঁসখালির বাঁধের দিকে। চাঁদও গড়াতে থাকে আপলাদের দিকে। এখন বাঘারুকে আবার একটু-একটু করে উঁচুতে উঠতে হচ্ছে–কড়াইয়ের গা বেয়ে। চাঁদটাও একটু-একটু করে ওপরে উঠে যেতে থাকে–আরো উত্তরে। এখন আবার ডাঙার ওপরের গাছগাছড়া দেখা যাচ্ছে। ফরেস্টটা মাটিতে নেমে আসছে। সেই ফাঁকে চাঁদটা আড়ালে সরে যায়। বাঘারু বোঝে, দেখা না-গেলেও কোথাও আছে। সে হাঁসখালির বাধে উঠে পড়ে। আর দেখে, বাঁধ বরাবর সোজা উত্তরে-পুবে, একেবারে তার সামনাসামনি, চাঁদটা আকাশের গায়ে সেঁটে আছে। এই হাঁসখালির বাধ বা হাতির রাস্তাটা সোজা আনন্দপুর বাগানে ঢুকে গেছে। আপলাদের ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা ওদলাবাড়ির দিকে গেছে, সেটা বয়ে রেখে বাঘারু সিধে হাঁটে। চাঁদটা আরো বায়ে ফরেস্টের মাথায় চলে যায়। বাঘারু ফরেস্টের মাথার ফাঁক দিয়ে দিয়ে চাঁদটাকে দেখে। ফরেস্টের ভেতরটায় এখনো অন্ধকার–শেষ রাত্রি। সেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আকাশটা আরো সবুজ ও চাঁদটা আরো স্পষ্ট দেখায়–সকালের শাদা চাঁদ নয়, রাত্রির জ্বলজ্বলে চাঁদ। এখন, এই হাতির রাস্তাটা ছেড়ে ফরেস্টের ভেতর ঢুকলে চাঁদের সেই আলো পাওয়া যাবে। ফরেস্টের ভেতরের এই রাত্রির আড়ালে-আড়ালে চাঁদটা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে। মাঝখানে একটা আগুনলাইনের সড়ক–ফরেস্টটাকে দু-ভাগ করছে। বাঘারু বায়ে ঘুরে, দাঁড়িয়ে পড়ে। ফরেস্টের ভেতরের রাত্রির ওপরে চাঁদটা ডাইনে লেগে আছে। যে-আগুনলাইনের দিকে মুখ করে বাঘারু দাঁড়িয়ে সেটাতে গাছপালা নেই। তাই একটু আলো আছে। কিছুদূর গিয়েই সে আলো আবার আবছা। এখনো আকাশে দিনের আলো এত জমে নি যে এই আগুনলাইনটা পুরো দেখা যাবে। মাঝখানের সেই অন্ধকারের পরে ঐ আগুনলাইনের শেষের আভাস দেখা যায়–আকাশের সবুজ আর নদীর বালির শাদায়। মনে হয়, সেখানে আরো বেশি সকাল হয়ে আছে।
বাঘারু যে-ভাবে আগুনগলির সামনে দাঁড়িয়ে, সেভাবে সাধারণত বনের পশুরা দাঁড়ায়, যেন পথ ঠিক করতে পারছে না। লম্বা হাত দুটো নাড়িয়ে ফরেস্টের বাতাস কেটে বাঘারু গন্ধ শোকে–ফরেস্টের। একবার ডাইনে ঘাড় ঘুরিয়ে হাতির রাস্তা ধরে আনন্দপুরের দিকে তাকায়। আবার, ঘাড় কাত করে আকাশের চাঁদটাকে দেখে। তার পর, ফরেস্টের ভেতরটা একবার দেখে। শেষে, ডাইনে ঘুরে সোজা হাঁটতে শুরু করে বাগানের দিকে।
এখন, বাঘারু যতই বাগানের দিকে এগয়, চাঁদটা ততই গাছের ডালে-ডালে তিস্তার দিকে পেছয়। মাঝেমধ্যেই তাকিয়ে-তাকিয়ে বাঘারু দেখে নেয়। ঘাড়টা তাকে বারবারই বেশি ঘোরাতে হয়। আনন্দপুরে ঢুকে যাওয়ার পর ঘাড় ঘুরিয়েও চাঁদটাকে হয়ত আর দেখা যাবে না। আরো খানিকটা সকাল ত হল– বেশিক্ষণ আকাশ সবুজ থাকবে না। আলো পড়লেই প্রথমে নীল, তার পর শাদা হতে শুরু করবে। তখন ঐ জলছাপ চাঁদ আর দেখা যাবে না। বাঘারুর হাটার বিপরীতেই যখন ঐ চাঁদের গতি আজ, তা হলে চাঁদটা তিস্তার ওপর গিয়ে পড়বে। ওপরে নীলচে শাদা আকাশ, নীচে তিস্তার শাদা ঘোলাটে জল–ও চাঁদ তখন কোথায় মিশে যাবে?
এখন এই ফরেস্ট, খেতবাড়ি, নদী, হাট, বাড়ি-টাড়িবস্তি, এই বাতাস, ভেজা ঘাস, আপথ, বাঁশ ঝাড়, চা-বাগানের ফ্যাকটরির নল, এই-সব কিছু নিয়ে একটা নতুন দুনিয়া তৈরি হয়ে উঠেছে আবার একটা দিনের জন্যে।
সেই নতুন দুনিয়ার এখন পর্যন্ত এক বাঘারু আছে আর ঐ চাঁদ আছে।
.
০৫৩.
ভোরের আগে চা-বাগান
মাঠে-মাঠে খেতবাড়িতে, জঙ্গলবাড়িতে, ধানবাড়িতে যেমন হাটে বাঘারু, তেমনি হটছে, এখন। নদীর বা ফরেস্টের জঙ্গলের ভেতর আলাদা হাঁটা–ঠেলে-ঠেলে। আর-সব হাঁটাই এক রকম–আকাশের অনেক ওপরে পাখির ডানা-ভাসানো ওড়ার মত ভেসে-ভেসে হাটা, পায়ে-পায়ে খুব বেশি ধুলো ওড়ে না, খুব বেশি দাপাদাপি হয় না–মাটির ওপর নিজের ওজন ছাড়া। তিস্তার খুব টান-টান স্রোতে শালগাছ যেমন হালকা হয়ে যায়, এই বহুদূর পর্যন্ত ছড়ানো মাঠের টানে বাঘারুর লম্বা শরীর, চওড়া বুক-পিঠ, লম্বা-চওড়া, বাহুকজি, শক্ত কাঁধ আর লম্বা পা দুটোর তেমনি সব ভার চলে যায়।
কিন্তু মাঠেরও স্রোত আছে আর বাঘারুও শালগাছ বলে হাঁটাটা মাটির ভেতর গেঁথে যায়। এতটাই, যেন মাটিটা হাঁটে–ফরেস্ট, হাট, টাড়ি-বাড়িসহ এই মাটিটাই। তখন সামনে যাই আসুক, গতি প্রতিহত করা যায় না। হয় বাঘারুকে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে নামতে হবে, নয় সামনের বাধাটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।
বাঘারুর ত আর রাস্তা দিয়ে যাওয়া নয়। রাস্তায় সামনে অনেকখানি দেখা যায়, রাস্তাটাও দু-পাশের সঙ্গে মিশে যায় না, আলাদা থাকে, দু-পাশটাই বদলায়।
কিন্তু তাই বলে ত মাঠজঙ্গল ভেঙে হাতির পাল, মোষের পালের মত যাওয়া বাঘারুর নয়। তার পায়ের একটা আন্দাজ আছে–নির্ভূল। তাকে যদি চালসার পুবে ডায়না নদীর চরে পৌঁছতে হয় তা হলে তাকে প্রায় সিধে উত্তর-পূবে হাঁটতে হবে। এখন থেকে সিধে কোনাকুনি চললে রাস্তা ছোট হয়ে আসবে। কিন্তু রাস্তা ছোট করার জন্যে বাঘারু ত আর তার চেনা লাইন, চেনা জায়গা ছাড়তে পারে না।
আনন্দপুর চা-বাগানে ঢোকার একটা গেট আছে। গেটের আগে জলনিকাশী বড় নালার ওপরে লোহার পাইপ একটু-একটু ফাঁক করে সাজিয়ে তৈরি করা ক্যালভার্ট। গরু-ছাগলে ঢুকতে পারে না, পাইপে পা পিছলে ফাঁকে আটকে যায়। চওড়া বেঁটে গেটের পাশে লোহার খুঁটি সানজির। (দুই আঙুলের মাঝখানের ফাঁক] মত–যাতে মানুষজন যাতায়াত করতে পারে, গেট বন্ধ থাকলে। ওখান থেকেই বাগান ঘেরা তারের বেড়া।
আনন্দপুরের গেটটা পার হতেই সকালটা যেন শুরু হয়ে যায় কেন, বাঘারু বোঝে না। এতক্ষণ যে বাঘারু হেঁটে এল আকাশ আলো-গাছপালা-হাওয়া সব এক হয়ে মিলেমিশে ছিল। আনন্দপুরে সবই সাজানোগোছানো, আলাদা-আলাদা। দু-পাশে চা-বাগানের কাটাছাটা সমান বেড। সেগুলোর মাথার ওপরে ছায়া-দেয়া গাছের সমান মাথা। মাঠের মত সমান চা-বাগানের বেডের ওপরে ছাতির মত সমান। গাছের মাথা। বেড়গুলো তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, ওপাশে গভীর নালা। জল যা যাওয়ার যায়, কিন্তু বেডের ভেতর হাতি ঢুকতে পারে না ঐ নালীর জন্যে। মানুষজনের যাতায়াতের জন্যে মাঝেমধ্যে ইটের সিঁড়ি, কোথাও-বা কাঠেরও সিঁড়ি, দুই-এক জায়গায় আবার আঙুলফাঁক লোহার খুঁটি।
মাঠঘাট বনবাদাড় পেরিয়ে এসে বাঘারুকে এই চা-বাগান আনন্দপূরে শুধু রঙ দেখতে হয়। বাবুদের বাড়ির টিনের চালের সবুজ বাংলোর দোতলা চালের সবুজ, জানলা-দরজার সবুজ–চার পাশের এত সবুজের মধ্যেও এই সবুজগুলো আলাদাভাবেই চোখে পড়ে। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে লাল-শাদা রঙের খুঁটিগুলোর বাক অনেক দূর থেকে দেখা যায়। আর, মোড়ের যেন শেষ নেই। একটা মোড় পেরনোর সময় ডাইনোয়ে সামনে-পেছনে তাকালেই দেখা যায় চারদিকে লাইন বেঁধে মোড়ের পর মোড়, মোড়ের পর মোড়। আর মোড় মানেই ত রাস্তা, রাস্তার পর রাস্তা। একই রকম শিরীষ গাছের তলায়, একই রকম চাবাগিচায়, একই রকম রাস্তায়, তার পর একই রকম মোড় হয়ে হয়ে যাওয়ায় সোজাসুজি রাস্তারই একটা গোলক ধাঁধা তৈরি হয়। এত রাস্তা দিয়ে কত লাক হাঁটে। এত রকম বাড়িতেই বা কত লোক আঁটে। ছোট-ছোট বারান্দার বাড়ি, লম্বা-লম্বা বারান্দার বাড়ি, ছাদের বাড়ি, টিনের বাড়ি, ভামনির বাড়ি, কাঠের বাড়ি, দালানের বাড়ি, বেড়ার বাড়ি।
আনন্দপুরের লোকজন এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি, অন্তত ফ্যাক্টরি আর অফিসের এই রাস্তায় আসে নি। কিন্তু গোচাবাড়ি থেকে বেরবার পর মাঠে, হাঁসখালির বাধে, হাতির রাস্তায়, আকাশের আর মাটির রঙে সকালটা যেরকম হচ্ছিল আনন্দপুরে তা বদলে যায়। শিরীষ গাছের ছাউনি আর চা-গাছের মাথার মাঝখানে ত আর-কিছু নেই–সমস্তটা ফাঁক। আকাশ নয়, মাটি নয়, আকাশ-মাটির মাঝখানের ঐ জায়গাটা ফাঁকা। আর চা বাগানে ত ঐ মাঝখানের জায়গাটাই আসল। ঐ ফাঁক দিয়ে আলো, আকাশের মতই, ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বাঘারু সেই বানানো সকালের মধ্যে, ডাইনে বয়ে করতে করতে, বাগানের পুর সীমার দিকে চলে–বেরিয়ে যেতে। বাঘারু ভেবেছিল পুরগেট দিয়ে বেরিয়ে ডাইনে বেঁকে মাঠ-বরাবর বারঘরিয়ায় উঠবে। কিন্তু একটা মোড় থেকে ডাইনে তাকিয়ে সে বেঁকে যায় মনে হয়, এদিককার বেড়া গলে ওদিকের মাঠে নেমে যেতে পারবে।
কিন্তু এগিয়ে দেখে গলতে হবে না, বেরবার একটা রাস্তা আছে, দু-আঙুলের ফাঁকের মত লোহার খুঁটি।
বাইরে যাবার রাস্তা, এত বর্ষার পরও শক্ত। পায়ে চলা রাস্তাতেও ঘাস গজায় নি। রাস্তার পর রাস্তা, মোড়ের পর মোড়, মোড় থেকে মোড় দিয়ে ঘেরা ছক, ছকের ভেতর মাঠের মত সমান চা-গাছ আর ছাতার মত সমান শিরীষ গাছ–এমন চা-বাগান ছেড়ে বাঘারু এখন, আল বেয়ে, আরো-আরো আল দিয়ে দিয়ে ছক কাটা, অসমান, নানা আল দিয়ে নানা অসমান ছককাটা মাঠে নামে। এই সামান্য একটু উঁচু থেকে বাঘারুর মনে হয়, মাঠটার আলগুলো শীতকালের নদীর মতন; কোথায় শুরু, কোথা দিয়ে বয়, কখনো সরু, কখনো মোটা।
মাঠের ভেতর নেমে এলে আর তেমন লাগে না। তখন মাঠেরই দূরের কোনো অংশ তার থেকে উঁচুতে, আবার সামনের আলটাই ছোট্ট একটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছে। বাগানের গা-লাগা জমিটা একটা ঢাল। তার পরই ডাঙা। ঢাল জমিটাতে ভাল ধান হয়েছে। কিন্তু তার পরই পাথুরে বরমতল। এখন ত চা বাগান আর ফরেস্ট শুরু হবে। ধানি জমি কমে আসবে। খেতবাড়ি তিস্তাপারেই ভাল।
সেই নিচু জমির আলটা দিয়ে চলতে-চলতেই বাঘারু দেখে,সামনের ডাঙারও ওপারে আকাশটা লাল হয়ে উঠছে, যেন ঐ ডাঙাটা আকাশটারই ঢাল। বাঘারু খুশি হয়ে ওঠে। গোচামারিতে বাড়ি থেকে বেরতে-বেরতেই যদি সূর্যটা উঠত, তা হলে তার পেছনে পড়ত, সে সূর্যোদয় দেখতে পেত না, অবিশ্যি আকাশটাও অনেকক্ষণ তার মাথার ওপর ছিল–সেখানে রঙের খেলা দেখতে পেত। কিন্তু এখন ত তার মুখোমুখি সূর্যোদয়, এই ঢাল পেরিয়ে ঐ ডাঙায় উঠলেই। যেন এই সূর্যোদয়ের কারণেই এই বারঘরিয়ার মাঠে বাঘারুর আসা–এমনই লাফিয়ে লাফিয়ে সে ডাঙাটার দিকে ছোটে।
ডাঙাটাতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সামনে কোণাকুনি বারঘরিয়ার মাঠটা ছড়িয়ে গেছে সেই পুব-দক্ষিণে কান্তদিঘি কুমারপাড়া পর্যন্ত। কান্তদিঘি কুমারপাড়ার ঐ দিক থেকে সূর্য উঠছে। এখন, বাঘারুকে যেতে হবে এই সূর্যটাকে ডাইনে রেখে একটু উত্তর বরাবর। কিন্তু, এমন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি পড়ে বাঘারু যেন আর নড়তে পারে না। ডাঙার ওপরে উঠেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর, যেন একটা ভাল জায়গা বেছে, শ্যাওড়া গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সামনে, অর্ধবৃত্তাকার প্রান্তরের শেষে দিগন্তে সূর্যোদয়ের দৈনন্দিন ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে গেছে।
.
০৫৪.
বাঘারু ও সূর্যোদয়
কান্তদিঘিকুমারপাড়ার দিকে মুখ করে বাঘারু দাঁড়িয়ে। তার পুবে কুমলাই, তার পুবে মাথাচুলকা, মাথা চুলকার পুবে ধূপঝোরা। এই সূর্যোদয়ের ভূগোল বাঘারুর এই পর্যন্তই জানা। সে যেখানে যাচ্ছে, সেই ডায়না নদীর জঙ্গলে ত পুব দিক আছে। সেই সব পুব দিকের নাম তার জানা নেই। সূর্য ত সেখান দিয়েও উঠছে। পুবের রাস্তা, সেখানে, আরো পুবে, আসামের দিকে গেছে। সেই সব পুবদিক দিয়েও এই একই সূর্যোদয়। এখন বাঘারু সেই না-জানা পুবদিকেই চলেছে বলে এই সূর্যোদয় আকাশময় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই জানা-অজা মেশানো সারাটা পুবদিকই বাঘারুর সামনে খুলে যাচ্ছে।
কান্তদিঘি-কুমারপাড়া আর কুমলাইয়ের আকাশটা আগুনরাঙা। সেই আগুন ফরেস্টের বড় বড় গাছগুলোর মাথা উঁল। এতদূর থেকে ফরেস্ট ত সবুজ না, ছাই-ছাই। যেখানে-যেখানে আগুন লাগছে, ছাই ফেটে অন্য রঙ বের হচ্ছে। দূর থেকে দেখায়, ফরেস্টের ভেতর এক-একটা আলগা-আলগা গাছে আগুন লেগেছে, এক-একটা গাছে যেমন বাজ পড়ে।
ফরেস্টের ছাই-ছাই রঙ আর নদীর ওপরে বা মাঠের শেষে দিগন্তের ছাই-ছাই এমনই মিলে গেছে, কোনটা ফরেস্ট বোঝা যাচ্ছিল না, এখন বহু দূরে-দূরে ঐ আগুন রঙ লেগে যাচ্ছে বলে বাঘারুর চোখের সামনে, গাছগাছড়া জলজঙ্গলের রঙগুলো আলাদা-আলাদা হয়ে যায়।
কিন্তু সূর্যের সেই আগুনরাঙা আলো সারা আকাশে ত একই রকম লেপে যাচ্ছে না। গয়ানাথের বাড়ি থেকে তার মাথায়-মাথায় চলে আসছে যে-আকাশ, সবুজ নাগান, সেই আকাশের বহুদূর পর্যন্ত আগুনরঙের ফালি চলে গেলে তার ভেতর থেকে সবজে ফালিগুলোও বেরিয়ে থাকে। আকাশের সবুজের নীচে, কোথাও-কোথাও কিছু-কিছু মেঘ ছিল। সেই সব জায়গায় আকাশের রঙ, মেঘের রঙ, আলোর রঙ মিলে আর নানা রকম রঙ তৈরি হচ্ছিল।
কুন অং [রং] কুখন ফুটে উঠে আর মিলি যায়, না-দেখা যায়, না-বোঝা যায়। চক্ষুর পলকখান একবারে ফেলিবার মধ্যে আকাশখান আর-এক ঝলক বদলি গিছে। আগুনের নাখান অংটা দূরত-দূরত চলি যাছে, হু-ই পচিম পাখত তিস্তানদীর পারত, তার পচিমে জলপাইগুড়ি সদরত, তার পচিমে কোটত কোটত আজগঞ্জ—-সবখানের আকাশ নাল [লাল টকটকা হবা ধরিছে হে। এ্যালায় কুমলাইয়ের পুবত অংখান পাতলা হবা ধরিছে। কায় য্যান ঐ লাল অংটা ধুইবার ধইচচে। আর-হুঁ-ই তিস্তাপারের পচিম পাখ তক পাতলা হয়্যা যাছে। কোটত আলো কোটত যায়।
বন্যার তিস্তায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেমন সামনে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বাঘারু স্রোতের ছক বুঝে নেয়, জলের ঢক দেখে নেয় আর নিজের মনে-মনে একটা নকশা ভেবে নেয়, তেমনি করে ডাইনে আপলাদের দিকে তাকায়–উচা উচা গাছার মাথত আগুন লাগি গেইসে–পেছন ফিরে মাথার ওপরে শ্যাওড়া গাছটাকে দেখে পাতাগিলা ঝলঝল করিবার ধইচছে য্যান বিষ্টি হবা ধরিছে,–বাঘারু তার নিজের শরীরের দিকে তাকায়—-সারা শরীলখান কায় অং মাখাছে–বাঘারু পায়ের তলার ঘাসের দিকে তাকায়–ঘাস গিলা সব আয়না হয়্যা যাছে
আলোর সেই নিমজ্জনে বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে, খাড়া। এতটা এমন বেগে হাঁটার পর তার গা জুড়ে ঘাম ফুটে উঠতে শুরু করে। সেই বরমডাঙার [ব্রহ্মভাঙা] এক সীমায় দাঁড়িয়ে আর-এক সীমার তাদৃশ্য পেছন থেকে ঘটে যাওয়া সূর্যোদয় দেখতে-দেখতে বাঘারু ঘামে। এই বারঘরিয়ার মাঠটায় ঠিক এই সময় উঠতে না পারলেই ত বাঘারু আর এই সূর্যোদয় পেত না। গোচিমারি থেকে হাঁসখালির পথে ঘটে গেলে ত পেছনে থাকত। হাতির রাস্তা ঘটে গেলে ত কোনাকুনি থাকত। আনন্দপুর বাগানের ভেতর ঘটলেও ডান কোনায় পড়ত। এই বারঘরিয়র মাঠে সে কখন পৌঁছবে তার জন্যেই যদি সূর্যোদয় অতক্ষণ ঠেকে থাকে, তা হলে ত বাঘারুকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতেই হয়, দেখার জন্য দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘামতেও হয়।
সেই দেখা আর ঘামার মধ্যেই বাঘারুকে এক সময় এইটা বুঝতে হয়, মুই খালি-খালি খাড়া আছি। আর সত্যি যে শুধু তার এই উদোম ঢ্যাঙা শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তার শরীরের ভারহীনত দিয়ে তাকে বুঝে নিতে হয়। তার কাঁধে লাঙল নেই–গয়ানারে লাঙল। মোর কাঁধত গাছ নাই–গয়ানাথের গাছ। বাঘারুকে গয়ানাথ নির্বাসন দিয়েছে। ডায়না নদীর জঙ্গলে তার মহিষের বাথান আছে–বাঘারু সেখানেই যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে ত তার এই শরীরটা নিয়েই শুধু। বরমতলায় সেই সূর্যোদয়ের সামনে নির্বাসনের পথে বাঘারুর শরীরে-মনে কেমন মুক্তির বোধ এসে যায়। আর সেই বোধটাকে নিজে নিজে বুঝে নিতে, নিজেই নিজের শরীরের দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়।
কোনো অদৃশ্য আড়াল থেকে উৎক্ষিপ্ত রঙের এই আকাশমাটিব্যাপী বিস্ফোরণে আর নিজের এই শরীরটার এমন মুক্তিতে বাঘারু হাসে। বাঘারু ত তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে দিয়ে আলাদা-আলাদা কাজ করতে পারে না। সে যা করে তার সারাটা শরীর দিয়েই করে। শুধু ঠোঁট দিয়ে হাসতে পারে না ত বাঘারু, তাই সেই আলোর রঙের ধাক্কায় বাঘারুর সারাটা শরীরই হেসে উঠে কাঁপতে থাকে–বাতাস লাগা শিরীষ গাছের মত। বাঘারুর ত শরীর ছাড়া কিছু নেই–তাও আবার এত বড় একটা শরীর যে, শুধু শরীরটাই আছে বললেও তাকে যেন ততটা সর্বস্বহীন বোঝায় না। অত বড় শরীরটা রঙিন আলোর আঘাতে শিহরিত হতে থাকে।
শরীরের এই শিহরণ ত বাঘারুর চেনা নয়। বা, এমন কিছুই ত তার চেনা নয়, যা এই শিহরণের মত ব্যক্তিগত। তাই বাঘারু তার নিজের শরীরের কম্পনে নিজেই হে-হে হাসে। এমন একা-একা হাসা নিজের হাসির আওয়াজে বাঘারু আরো হেসে ওঠে। আর তাতেই তার আরো হাসি উঠে আসে। নিজের হাসির আওয়াজ বাঘারুর ত খুব চেনা নয়।
দুহাতে মুখ ঢেকে বাঘারু হাসিটা ঢাকতে চায়। তার হাত এত শক্ত যে এখন আর আঙুলগুলো বেকানো যায় না। তবু, হাত যখন, একটা তালু থাকে। আর তালু যখন, তখন আঁজলা হয়। বাঘারু মুখ ঢাকতে দুই হাত তুললে, হাতের তালু আলোতে, রঙে ভরে যায়, যেন বাঘারু নিচু হয়ে মাঠ থেকে আঁজলা ভরে আলো আর রঙ তুলে আনল। এখন তার চোখের সামনে দুই অঞ্জলি থেকে সেই রঙিন আলো ঝরঝর ঝরে পড়ে শরীরে।
নিজের হাতের আঁজলায়, নিজের শরীরে, এই প্রথম রঙ-আলো ঢালছে বাঘারু। শরীরটা এই প্রথম তার নিজের হয়ে উঠছে যেন।
হাত দুটো মাথার ওপরে, বা হাতে ডান হাতের মগরা (কজি চেপে ধরে বাঘারু পিঠটা ধনুকের মত বাকায়, পেছনে। কাঁচা বাশের মত তার শরীরটা ঐ রকম হেলে থাকে আর হেলানোর ভার বইতে তার পায়ের মচকা [বাটি], থলমা [উরু] আর পেটের বুকের পেশিগুলো টুকরো-টুকরো হয়ে ফুলে-ফুলে ওঠে। আড়মুড়ি ভাঙছে বাঘারু। আবার, পেছন ফিরে দুই হাত মাথার ওপর তুলে ধনুকের মত বাকায়, সামনে। তার পাথরের চাঙাড়ের মত পিঠটার ঢাল মাটির দিকে নেমে গেলে নড়ডারুর গিঠগুলো প্রখর জাগে, যেন ঐ শিরদাঁড়া বেয়ে এখনই কোনো ঝরনা ঝপাবে। কাঁধে, ঘাড়ে, পিঠে, বাহুতে, কোমরে, উরুতে, কটিতে আলোর স্বাদ পেতে ভালো লাগে বাঘারুর–আলোর উষ্ণ স্বাদ। সে একটু ঘুরে দাঁড়ায়, বায়ে, আলো তার বা পাজর দিয়ে, বা তলবুক থেকে বা তলপেটে চলে যায়। খানিকক্ষণ ও-রকম থেকে বাঘারু ডাইনে ঘোরে, আলো তার ডান পাজর থেকে ডান তলপেট পর্যন্ত লেপটে যায়।
খাড়া হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘারু দেখে, সূর্যের প্রথম আলো তীক্ষ্ণ রেখায় প্রান্তরের অপর প্রান্ত থেকে বাঘারুর দিকে ছুটে আসছে সঁ সঁ। বাঘায়ু আলোর দিকে ছুটে যায় কিন্তু সে পৌঁছনোর আগেই আলোর তীক্ষ্ণ সূচিমুখটা ফেটে যায় আর আলো ছড়িয়ে পড়ে মাঠময়। বাঘারু মাটিতে গড়িয়ে পড়ে মাটি থেকে আলো সর্বাঙ্গে মাখতে থাকে।
.
০৫৫.
বাঘারুর সঙ্গীতলাভ
বারঘরিয়ার মাঠ ছেড়ে বাঘারু নিপুছাপুরের দিকে চলতে শুরু করে। ডান দিক জুড়ে সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরের মাঠের দিকে তাকিয়ে বাঘারু বিড়বিড় গুনগুন করে! আর, একবার করেই থাকেম না। বার বার ঘুরেফিরে করে। করে, আর হাঁটতে-হাঁটতেই দোলে।
উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর চিকচিক্যানি দিয়্যা
উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর আগুন-টকটক হয়্যা
খুলি দিছু দেহবাড়ি ছ্যাকা দিয়্যা যান।
জল যাউক, হিম যাউক, খাড়াউক শরীলখান।
কোলের বাচ্চাদের চপচপ করে তেল মাখিয়ে সূর্যের দিকে ধরে দোলাতে-দোলাতে এই গান মায়েরা গায়। বাঘারুর দুই হাতে কখনো কোনো শিশু দোল খায় নি। আর এখন সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দোলানোর মত শিশু যখন বাঘারুর হাতের মধ্যে নেই, তখন বাঘারু নিজেকেই দোলাক। এই কম হাঁটতে-হাঁটতে যতটা দোলানো যায়, দোলাক। আর যতটা বিড়বিড় গুনগুন করা যায়, করুক। বাঘারু এখন তার নিজেরই শিশু।
কিন্তু একবার বলেই ত আর থামতে পারে না বাঘারু, এমন কি, বারকয়েক বলেও না। এই ছড়া একবার মাথার ভেতর সেঁদিয়ে গেলে আর বেরতে চায় না। তার ওপর আবার হাঁটার দোলনটাও ছড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। হাটা না থামালে আর এই বিড়বিড়-গুনগুন থামবে না। এই দোলানি আর ছড়ানি কবে সেই জন্মকালে বাঘারুর মাথার ভেতর সেঁদিয়ে আছে–তার ব্যস্ততাহীন নির্জন মাথায়। তারপর পাখির ডাক, জীবজন্তুর মুখ আর আলো-হাওয়ার গতি যেমন.চেনা হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে, যখনই তেমন সময় আসে, তখনই, এই ছড়ানিগিলা চলি আসিবার ধরে এ্যানং নাম্বা লম্বা হাঁটনে, কামছাড়া গাওছাড়া এ্যানং নাম্বা হাঁটেন, ছড়াগিলা গানগিলা পিপিড়ার মত চলি আসিবার ধরে এককারে লাইন বান্ধি, একোটার পর একোটা, কোটত আসে কোটত যায় কায় জানে।
বাঘারু চলতে-চলতে দোলে আর দুলতে-দুলতে বলে
বেলা ঠাকুরের মাই গে
সিন্দুর ফেল্যান কেনে, সিন্দুর ফেল্যান কেনে?
না ফেলিছু, না ফেলিছু, কৌটা উলটি গেইছে।
দাওয়া লালাইছে তায়।
সূয্যি ঠাকুরের মা, সিঁদুর ফেলেন কেন? ফেলি নাই, সিঁদুর ফেলি নাই, সিদুরের কৌটো উল্টে গেছে। আকাশ তাই লাল।
বেলা ঠাকুরের মাই গে
জল ঢালিছেন কেনে, জল ঢালিছেন কেনে?
না ঢালিছু, না ঢালিছু ছোঁয়াক নোহাইছু
মাটি ভিজেন তায়।
সুয্যি ঠাকুরের মা, এত জল ঢালেন কেন? ঢালি নাই, জল ঢালি নাই, ছেলেকে নাইয়েছি, সেই জলে। মাটি ভেজা।
বেলা ঠাকুরের মাই গে
ঝাঁটা ঝাড়িছেন কেনে, ঝাটা ছাড়িছেন কেনে?
না-ঝাড়িছু, না-ঝাড়িছু, ছোঁয়াক শুকাইছু
বাও উঠেন তায়।
সূয্যি ঠাকুরের মা, সকালে এত ঝাড়েন কেন, হিমেল বাতাস দেয় কেন? ঝাড়ি নাই, ঝাড়ি নাই, আঁচলের বাতাস দিয়ে, ছেলের গায়ের জল শুকাই, তাই বাতাস ওঠে।
বেলা ঠাকুরের মাই গে।
ঘর বোয়া কইচছিস কেনে, ঘর থোয়া কইচছিস কেনে?
না করিছু, না করিছু ছোঁয়াক ছাড়ি দিম
এগিনা ধুছি তাই।
সূয্যি ঠাকুরের মা, ঘরদোর এত বোয়া-মোছা করছেন কেন আকাশ নীল ঝকঝকে? মুছি নাই, ঘর মুছি নাই, ছেলেকে ছেড়ে দেব বলে আঙিনা, আকাশ, ধুচ্ছি।
বেলা ঠাকুরের মাই গে
ছোঁয়াক ছাড়েন কেনে, ছোঁয়াক ছাড়েন কেনে?
মোর ছোঁয়াটার ছ্যাঁক নাগিলে তোর ছোঁয়াটা উঠে
ছোয়াক ছাড়িছু তাই।
সূয্যি ঠাকুরের মা ছেলেকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমার ছেলের ঘঁহ্যাঁকা খেয়ে তোর ছেলে উঠবে, তাই।
হেই গে মোর বেটাখান
হেই গে মোর ছোয়াখান।
হেই গে মোর ছাওয়া-ছোটর ঘরখান
নিন্দ ভাঙ্গি উঠি গেইছে।
হা করিছে, ভ্যা করিছে
আর তোর ছোয়াখানেক দেখি পুটপুটাইয়া হাসিবার ধইরেছে…
আমার ছেলে উঠে গেল, আমার বেটার ঘুম ছুটল, হাই তুলছে, কাঁদছে আর তোমার ছেলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর চিকমিক্যানি দিয়া….
বাঘারুর কবিতার সঙ্গতিতেই আকাশের লাল রঙ ধুয়ে ঝকঝকে নীল রঙ বেরিয়ে পড়ে। আর কান্তদিঘি কুমারপাড়া, কুমলাই, মাথাচুলকার আড়ালে-আড়ালে যে সূর্য উঠছিল সেটা যে এখন সারা দুনিয়াতেই উঠে গেছে, অন্তত বাঘারুর সারা দুনিয়াতে, নিপুছাপুরের ফ্যাক্টরির টানা লম্বা বাঁশিতে তা রটতে থাকে।
সেই দুনিয়ার এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তের দিকে বাঘারুর এই চলার সামনে এখন এই বারঘরিয়ার প্রান্তরের ঢাল। ঢাল বেয়ে শিশুর মত গড়াতে গিয়ে বাঘারু তার শরীরের দোলা আর ছড়ার দোলা হারিয়ে ফেলে।
ছড়ায় শিশু ছাড়া সকাল নেই। শিশু ছাড়া কবিতা নেই। বাঘারু এখন তাই নিজেই নিজের শিশু।
.
০৫৬.
শ্রমিকদের দৈনিক উৎসব
বাঁশি শুনে নিপুছাপুর চা বাগানের লাইনগুলো থেকে সবাই বেরিয়ে পড়েছে। সবার কাঁধে একটা ছাতা। কাঁধে কাঁধে রুমালের মত থলি, লম্বা ডাণ্ডির মাথায় ছোট চ্যাপ্টা কোদাল, হাতের আঙুলের মত কাটা কোদাল, বাকা দাও, লম্বা কলম ছুরি। যার কাঁধে যেমন ঝোলানো বা আটকানো সে তেমন হাঁটছে। যার কাঁধে রুমাল দোলে সে নিজে যেমন খুশি দুলতে পারে। কোদালগুলো যাদের কাঁধে তারাও খানিক হেলতে পারে। কিন্তু দাও আর ছুরি যাদের কাঁধে লাগানো তারা সেই কাধটা নাড়ায় না।
মরদদের বেশির ভাগেরই পরনে উরু কামড়ে থাকা ছোট হাফ প্যান্ট–সামনে পেছনে অনেক সেলাই ও পকেট। আর গায়ে নানা রকমের গেঞ্জি-গোলগলা, কলার, ভিকলার, কলারের সামনে-পেছনে দাগ, বুকে-পিঠে নকশা। গেঞ্জির রঙ নানা রকম। কিন্তু সব রঙই মরে গেছে, মাঝে-মাঝে আচমকা এক-একটা টাটকা রঙ ছাড়া। বয়স্ক কারো কারো পরনে ধুতি-হাঁটুর ওপর টেনে তোলা, ও গেঞ্জি। কারো কারো খাকি প্যান্টের ভেতর হাফশার্ট গেঁজা। বেশির ভাগই খালি পা। আচমকা দু-একজনের পায়ে মোজাসহ বুটজুতো, চকচকে। তেমন দু-একজনের হাতে ছোট স্টিকও আছে। কেডস-পরাও আছে কয়েকজন। তারা এমন হাঁটে, যেন খেলতে যাচ্ছে। তেল চকচকে কাল চুল পাট-পাট আঁচড়ানোর নানা বাহার–পেছনে বাবরি, দু-পাশে বাবরি, সামনে সিঙাড়া, মাঝখান দিয়ে চিরে চিরে দু-পাশে সিঙাড়া, মাঝখান দিয়ে সমান চিরে আবার মিশিয়ে দেয়া, কপালের ওপর একটু এগনো-ফেল্ট ক্যাপের মত, আবার কপালের ওপর একেবারে ভুরু পর্যন্ত লেপটিয়ে নামিয়ে গোল করে তুলে দেয়। কিন্তু বাহার শুধু সামনের নয়, পেছনেরও। কোনো ঘাড় বাবড়ি, কোনো ঘাড় বব, কোনো ঘাড় মোটা ভাবে হেঁটে তোলা, কোনো ঘাড় ইংরেজি ইউ-এর মত, কোনোটা ইংরেজি ভি-এর মত, কারো দুকান সম্পূর্ণ ঢাকা, কারো অর্ধেক, কারো পেছনটাও সিথির মত চেরা। এরই ভেতর দু-একজন আছে, সম্পূর্ণ ন্যাড়া।
মেয়েদের শাড়ির চড়া রঙ। শাড়িগুলো একটু উঁচু করে পরা। আঁচল নেই। সামনের দিকটা একটু বেশি তুলে আঁচলটা বুক থেকে নেমে এসেছে। কারো কারো আঁচল নেই-ই, পুরো শাড়িটাই বুকের ওপর থেকে গোল হয়ে নেমে এসেছে। চুলের বাহার পরনের বাহারকে হার মানায়। কারো চুল মাঝখানে সিথির দু-পাশে পাট করা। কারো বা দুই বেণী মাথার ওপর তুলে গিঠ দেয়া। কারো আবার ছোট চুল, ঘাড়ের কাছে গিঠ। কারো একটু উঁচুতে ঘেঁপা বাধা। প্রায় সবার চুলেই ফুল। সকালে যে যা হাতের কাছে পেয়েছে, সেই ফুলই খুঁজে দিয়েছে। দু-একজনের মাথায় বড় বড় গাদা। কাল রাত্রিতে বাংলো থেকে তুলে এনে রেখেছে। বেগুনি রঙের ছোট-ছোট ঘাস ফুলও কেউ-কেউ ঝাটার কাঠিতে গেঁথে গুঁজে দিয়েছে। ফুলের কাঠি মাথার ওপর উঠে আছে, চলার সময় কাঁপছে।
মেয়েদের অনেকেরই পিঠের ঝোলায় বাচ্চা। ঝোলার বাইরে বাচ্চার ন্যাড়া মাথা বেরিয়ে আছে। চলার তালে দোলে। পা আর হাত দুটোও বেরিয়ে ঝোলে। বোধহয় চলার দুলুনিতেই, সব বাচ্চাই প্রায় ঘুমিয়ে।
মেয়েরা এত রঙিন বলেই হয়ত শাদা শাড়ি আর জামায় দুএকজন মাঝবয়সিনীকেও রঙিনই দেখায় মাঝে-মাঝে।
কিন্তু মেয়েমরদ, বুড়োবুড়ি, ছোকরাছুকরি–এইরকম ভাগ-ভাগ করে দেখলে কুলি লাইনের রাস্তাটা ধরে এই যে সবাই এক সঙ্গে সকালের বাঁশি শুনে কাজে চলেছে, সেই এক সঙ্গে যাওয়াটাকে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এখন এই বাঁশি শুনে, এই সকালে, এক সঙ্গে যাওয়াটাই সব চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাতে কাউকে আলাদা করা যায় না, সব মিলেমিশে একটা ঘটনা ও একটা দৃশ্য হয়ে ওঠে। পোশাকেআশাকে চলনেবলনে কেউ যদি আলাদা হয়ে যায় সেটাও যেন এই সমগ্রতাকেই স্পষ্ট করে। কত রকমের হটাতেই না এই চলাটা তৈরি হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে কেউ প্রায় দুলে-দুলে চলে, কেউ কোমরটা বেশি নাচিয়ে ফেলে, চুলের গোছার দোলায় কারো হাঁটার ছন্দও অন্য রকম দেখায়, কোনো আধবুড়ো হাঁটুর কাছে ঝোলা হাফ প্যান্টে মাটির দিকে তাকাতে-তাকাতে ছোট-ছোট পায়ে এগিয়ে চলে। এত বিচিত্র হাঁটা সত্ত্বেও কাজের জায়গাতে পৌঁছবার তাড়া যে-গতি আনে সেটাই প্রধান হয়ে ওঠে–সব বৈচিত্র্য সত্ত্বেও।
দুটো নতুন সাইকেল ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে–অত ভিড়ের মধ্যে। মাঝে-মাঝে বেল বাজাচ্ছে। সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলে প্লাস্টিকের দড়ির গুচ্ছ–চালালে ওড়ে। এইটুকু রাস্তা ত চড়লেই ফুরিয়ে যাবে। তার চাইতে সবাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে সাইকেলটা টেনে নিয়ে যেতে ত অনেকটা সময় লাগবে। এতটা সময়ই তো সাইকেলটা নতুন থাকবে। এখন কিছুদিন চলবে–ঠেলে-ঠেলে কাজের জায়গায় নিয়ে গিয়ে আবার ঠেলে-ঠেলে ফিরিয়ে আনা। সাইকেল আছে বলে বাবু তাকে কোনো জরুরি কাজে পাঠাতে পারে। তেমন হলে, পুরো বাগানটাই টহল দিয়ে আসতে হতে পারে। তখন, একা-একা সাইকেলটা চালাতে খুব ভাল লাগে। দু-পাশের বেডে বা রাস্তায় কাজ করছে যারা, তারা তাকিয়ে দেখে, কে সাইকেল কিনল। চেনাজানা লোক আওয়াজও দেয়। মেয়েগুলো খিলখিল হাসে। আর এই সবে প্যাডেলের জোর বেড়ে যায়। দু-পাশের ঘন সবুজ চা গাছের ভেতর দিয়ে চকচকে সবুজ সাইকেলটা চলে। শুধু রঙের জন্যে পঁচাত্তর টাকা বেশি। হ্যাঁন্ডেলের লাল ঝালরগুলো বাতাসে ওড়ে দু-পাশে। হ্যাঁন্ডেলের সঙ্গে লাগানো দু-দুটো আয়নায় পেছনের চা-বেডগুলো সঁ সঁ সামনে ছড়িয়ে যাবে। দুটো আয়নার জন্যে পঞ্চাশ টাকা বেশি। পেছনের লাল আলো চার পাশের সবুজের ভেতর জ্বলজ্বল করে। যেন আলো দেখেই চিনে নেয়া যায় কার সাইকেল চালাতে হলে সাইকেল ঐরকম চালানোতেই সুখ–যেন, সার্কাসের খেলোয়াড় খেলা দেখাচ্ছে, চার পাশে গ্যালারি, আওয়াজ, হাততালি। আর, যদি এমন হয়, যেখানে চালাচ্ছে, তার দু-পাশে কেউ নেই, তা হলেও ত নিজের কানের দু-পাশে নিজেরই ছোটার হাওয়া লাগে, যত লাগে সাইকেলের গতি তত বাড়ে। চালাতে হলে ঐ রকম সাইকেল চালাতে হয়, না-হলে, ভো শুনে সবার সঙ্গে হেঁটে যাওয়াই ভাল, সাইকেলটাও যেন কাজে যাচ্ছে।
সারাটা মিছিল জুড়েই ট্রানজিস্টার বাজে। চামড়ার ব্যাগে কারো কাঁধে ঝোলানো, ব্যাগছাড় কারো হাতে ঝোলানো, কারো হাতের পাতায় আটা, কানে কানে সাটা। যে যার মত সেন্টার ধরে আছে–বিবিধ ভারতী, সিলোন, করাচি। রাশি রাশি গান বাজছে। এক-একটা গানের পাশে জোট বেঁধে সেই শ্রোতারা ছুটছে। কেউ-কেউ সঙ্গে-সঙ্গে গায়। কেউ হাততালি দেয় তালে-তালে। দু-হাত ওপরে তুলে কেউবা দুই হাতেই তুড়ি বাজায়।
এত গান এত জোরে একসঙ্গে বাজছে যে সেই সব মিলে একটা অর্থহীন কোলাহলের আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে ওঠে। এতগুলো লোকেরএকসঙ্গে ছোটা, কথা বলা, গান গাওয়া, হাসাহাসি ইত্যাদির ফলেও সেই আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে ওঠে। চোখ বুজে শুনলে মনে হতে পারে একটা অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন কোলাহল বাগানের এই রাস্তাটা ধরে ছুটে চলেছে। সেই আওয়াজের কোনো উদ্দেশ্য নেই বলেই তাতে কোনো আকস্মিকতা থাকে না। আর থাকে না বলেই মাঝে-মাঝেই কৃত্রিম নাটকীয়তায় উচ্চগ্রামে উঠে আবার আচমকা নেমে যায়।
কিন্তু যারা এই কোলাহলের মাঝখানে আছে তারা যে-যার মত গান শুনছে, অথবা শুনছে না। যে-যার পছন্দমত গান বেছে নিতেও পারছে। এক গান শেষ হলে, অন্য রেডিয়োর অন্য গান ভাল লাগলে একটু সরেও যাচ্ছে। আর নিজেদের এই ভাল লাগাটা কোনো-না-কোনো ভাবে জানিয়েও দিচ্ছে–গেয়ে, বা হাত-তালিতে, বা তুড়িতে, বা উল্লাসে। যে-ভাললাগার বিষয় নিজেরা কোনো-না-কোনো ভাবে তৈরি করে নি, সে-ভাললাগার ওপর এদের যেন পুরো স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না।
এত কিছুর পরেও এই এত মানুষের ভিড়ের এমনি ছোেটার ভেতর অভ্যাস আর দৈনন্দিনের এক ছন্দ থাকে। কখনোই মনে হয় না–এটা ছুটির দিন। এটাও কখনো মনে হয় না-কাজে যাবার আগের শেষতম মুহূর্তটি পর্যন্ত নিজেদের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাটা আস্বাদ করে নেয়ার স্বাসরুদ্ধকর এক তাড়াতেই এমন হৈ-হল্লা। চা বাগানের কাজকর্মের ভেতর অনিবার্যতই কৃষিকাজের অবকাশ ছড়ানো থাকে কিছু। তাই বাগিচার পাশেই এই সাইকেল দাঁড় করানো থাকবে, রেডিও চা-গাছের ওপর শোয়ানো থাকবে। এই রঙ, এই সাজগোছ, এই গান, এই তালের ভেতর দিয়ে এরা সবাই কাজে চলেছে–রোজকার কাজে, বাগানের বাঁশির সঙ্গে-সঙ্গে। যেন উৎসব। কাজে যাওয়াটা ত শ্রমিকদের রোজকারই উৎসব।
.
০৫৭.
বাঘারু ও শ্রমিকশ্রেণী
বাঘারু এই উৎসবের কেউ নয়। বারঘরিয়ার মাঠ থেকে নেমে নিপুছাপুরে ঢুকে সে এই উৎসবের পথে, উৎসবের ভেতর আটকা পড়ে গেছে। বারঘরিয়ার মাঠ নিচু হয়ে ঢলে পড়েছে নিপুছাপুরেরই বাগিচার বাইরের জমির ওপর। কোম্পানি এগুলো অল্পস্বল্প আধিতেও দেয় কুলিদের। সেই ধানি জমিগুলো দিয়ে তারের বেড়া টপকে কুলি লাইনের ভেতরের রাস্তায় বাঘারু পড়ে। প্রথমে সে বোঝে নি আটকা পড়ে যাচ্ছে। ভো শুনে যে যার মত হাঁটছে, বাঘারুও হাঁটছে। কিন্তু অমন কয়েক পা হাঁটতে-হাঁটতেই রাস্তায় দু-দিকের বাড়িঘর, ফঁকফোকর, ওদিকের বাড়িঘর, ভেতরের ফাঁকফোকর এই সব কিছু থেকে কিলবিল করে মানুষজন বেরতে থাকে। জানলে, তখনো বাঘারু সরে দাঁড়াতে পারত। এরা চলে গেলে, নিজের পথে যেত। কিন্তু ততক্ষণে এই ভিড়টা তৈরি হয়ে গেছে আর ভিড়টা ছুটে চলেছে নিজের বেগে, নিজের নিয়মে। আর বাঘারু নিজে টের পায়, সামনের ও পাশের লোকটি যে-গতিতে ছুটছে, যেমন করে পা ফেলছে, তাকেও সেই গতিতে ছুটতে হচ্ছে ও সেই মত পা ফেলতে হচ্ছে। বাঘারু দু-একবার থেমে পড়তে চেয়েছে। কিন্তু পারে নি। এমন নিজে ভেবে থেমেঘর্তে সে শেখেনি পারে না। যদি পড়ে যেত আর তার ওপর দিয়ে এরা চলে যেত, বা যদি সবাই মিলে ধাক্কিয়ে তাকে বের করে দিত যে সে এই লাইনের লোক না, তা হলেই বাঘারু এই মিছিল থেকে আলাদা হতুে পা-কিন্তু বাঘারু ত কোনোদিনই ঘটনা ঘটিয়ে উঠতে পারে না, তাকে নিয়ে ঘটনা শুধু ঘটে যায়। যতক্ষণ তা না ঘটে, ততক্ষণ বাঘারুকে এই ভিড়ের আর এই মিছিলের চলার সঙ্গে ছুটতে হচ্ছে, এরা যেদিকে যায় সেদিকেই।
তাতেও কিছু হত না। বাঘারু ত মিশেই যেতে পারত এই বিচিত্র মিছিলে। বাঘা যদি একটু ছোটখাট হত কারো নজরই পড়ত না তার ওপর। বা, বাঘারুর অত বড় শরীরটা যদি একটু ঢাকা থাকত। বাঘারু ঐ ভিড়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে যখন ভিড়েরই বেগে ছোটে, তখন, তাকে দেখায় যেন ঐ ভিড়ের মাস্তুল। বহু পেছনের মানুষও বাঘারুর মাথা দেখেই দিক ঠিক করবে। কিন্তু সত্যিকারের মাস্তুলের গায়েও অন্তত আলকাতরার বা রঙের যে আবরণটুকু থাকে, বাঘারুর তাও নেই। একটি ছোট, নেংটি তার কোমরের সামনে বাধা। গাছের পাতাতেও এর চাইতেও বেশি ঢাকে। ফলে, সেই একমুখো ভিড়ের সঙ্গে স্রোতের বেগে ছুটলেও বাঘারু স্রোত হয়ে যেতে পারে না। সে স্রোত নয়, স্রোতোবাহিত-তিস্তার স্রোতের টানে. যেমন পড়ানো শালগাছ ছোটে। মেয়েদের যে-দলটা বাঘারুর ঠিক পেছনে গিয়ে পড়ে, তারা বাঘারুকে হঠাৎ দেখে ফেলেই হাসতে শুরু করে দেয়। এমন উৎসবের পথে হাসি ত সংক্রামক, দেখতে-দেখতে হাসিটা ছাড়িয়ে পড়তে থাকে। যারা কাছাকাছি তারা ত হাসির কারণ চোখের সামনেই দেখতে পায়। আর-একটু ভাল করে দেখতে তারা কাছে আসতে চায়। মেয়েদের ভেতর একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এ ওকে ঠেলে এগতে চায়, পারে না। বাঘারুর পেছনে যারা প্রথম সারিতে ছিল, তারা কিছুতেই জায়গা ছাড়ে না। পেছন থেকে ক্রমে কেউ-কেউ তার ভতরেই ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ে। দেখতে-দেখতে বাঘারুকে ঘিরে একটা ঘের-মত হয়ে যায়; প্রধানত মেয়েদের।
জলে একটা ঢিল পড়লে যেমন জলের কাঁপন চলতেই থাকে, এই ভিড়ে বাঘারুকে নিয়ে হাসির কাপন তেমনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যারা বেশ দূরে তারা বাঘারুকে ভাল করে না দেখেও হাসতে থাকে। কেউ-কেউ আঙুল তুলে বাঘারুকে দেখায়। আর হাসিটা আরো দূরে-দূরে ছড়ায়। শেষ পর্যন্ত। বাঘারু এই সম্পূর্ণ অথচ ক্রমবর্ধমান মিছিলের অন্তর্গত চলমান দৃশ্য হয়ে পড়ে।
.
প্রতিদিন কাজে যাওয়া মানুষজনের এই মিছিলের ভিড়ের ভেতর পড়ে গেছে বলেই যেন বাঘারুকে কেমন আউলাভাউলা দেখায়। তার চুল জটপাকানো-ধুলো-মাটিতে। সারা গায়ে ধুলোমাটিরই রঙ। যেন ধুলোমাটি থেকে উঠেই সে এমন লাইনে ঢুকে গেছে। এত বড় একটা লাইনের এত মানুষজন বাঘারুতে যেন একটা খেপাবাউড়া পেয়ে যায়। মিছিলের একটা অংশ তাকে ঘিরে খেপাতে-খেপাতে চলছে।
একটা লোক বেশ লাফিয়ে-লাফিয়ে চলছিল। টাইট ছোট প্যান্ট আর টাইট গোল গলার গেঞ্জি, পায়ে মোজাসহ কেডস, হাতে একটা মাথা বাঁধানো স্টিক। সে মাঝে-মাঝেই স্টিকটা দিয়ে কেডসটাতে মারছিল আর নিজেই লাফিয়েলাফিয়ে উঠছিল। সেই লোকটি যেন তার স্টিকার আরো ভাল ব্যবহার খুঁজে পায়, বাঘারুর সামনে এসে পঁড়ায়। তার পর যেন পেছনে পা ফেলে মার্চ করে করে চলছে এই রকম করে পা তুলে-তুলে হাঁটে। বৃঘারুর সারা শরীরে তখন মিছিলের হাঁটা বা ছোটার গতি ধাক্কা দিয়েছে। এমন দলবদ্ধ ছোটায় ত সে অভ্যস্ত নয়। আর তার এত বড় শরীরে ছোটার একটা গতি এসে গেলে, শরীরটার ভারও সেই গতিটাকে ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে থাকে, পাথরের পাহাড় গড়ানো যেমন। মাথায় লোকটি বাঘারুর কোমরের কাছ পর্যন্ত। সে যখন বাঘারুর সামনে ঐরকম কদমে কদমে পেছনে পা ফেলে, তখন মনে হয়, বাঘারু যেন কোনো উঁচু মূর্তি, লোকটি তাই দেখছে। আর সেই দেখার যুক্তিতেই সে তার বাধানো স্টিকটা তুলে বাঘারুর বা বাহুতে মারে। হাতে পেলে টিপে দেখত, পাচ্ছে না বলে স্টিক দিয়ে টিপছে। ডান বাহুতেও একই রকম মারে। বাঘারুর পেটে একটা বেঁচা-মত দিতেই যে মেয়েদের দল বাঘারুকে ঘিরে ফেলেছিল তারা হাতগুলি দিয়ে নেচে উঠে কৌতুকে দুই হাত একসঙ্গে ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে, আচমকা, বাতাসে-হেলা গাছের মত, হাসির দমকে হেলে পড়ে।
মাথায় ফুল গোজা, রঙচঙে শাড়ি পরা, এমন একদল মেয়ে যদি সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে আর এক দিকে হেলে যায়, তা হলে তাদের হাতে-হাতে ধরতেই হয়। আর তেমন ধরলেই, নাচের তাল এসে যায় পায়ে। নিজেরাই বুঝে ওঠার আগে বাঘারুকে ঘেরা এই মেয়েদের সারি পরস্পরের কোমরে হাত দিয়ে নাচের তালে-তালে পা ফেলে দেয় আর আপন মনেই খিলখিল হেসে সেই নাচের সঙ্গত দেয়।
আরে ও রাখোয়াল, তাড়াতাড়ি এসো,
পাহাড় থেকে এক বুনো, ভালুক নেমে এসে
আমাদের নাচের সারি ভেঙে দিল
এই গানের সঙ্গতিতে ঐ লোকটি চট করে বাঘারুর পেছনে চলে আসে, বাঘারু আর মেয়েদের সারির মাঝখানে। মেয়েদের গানের তালে-তালে পা.ফেলে সে বাঘারুর পেছনে-পেছনে চলে। বাঘারুর অত বড় শরীরটার পেছনে লোকটির অতটুকু শরীর আর টাইট ছোট প্যান্টে তার কোমরের অত ঘন-ঘন দুলুনি, কেমন নাচে-গানে অভিনয়ে নটঙ্গী তামাশা-মতই জমে ওঠে। লোকটি তার স্টিক তুলে বাঘারুর পেছনে-পেছন চলে, একবার বা পায়ের বায়ে ডান পা ফেলে, আবার ডান পায়ের ডাইনে বা পা ফেলে। লোকটি স্টিকটা দিয়ে বাঘারুর পায়ের বাটিতে মারে, ডাইনোয়ে, উরুতে মারে, ডাইনোয়ে, পেছনে মারে, ডাইনে বায়ে। আর শেষে পেছনের ফাঁকটাতে, কানিটার ওপরে, লাঠিটাকে সোজা করে ধরে, যেন সেটা বাঘারুর পাছার ভেতরে ঢোকাবে।
এতে হাসি সামলানোর জন্যে হাতগুলো মেয়েদের দরকার হয় বলে নাচের সারি ভেঙে যায়, গান থেমে যায়, আর এই লোকটির পেছনে সারাটা মিছিল হো হো হাসিতে, খিলখিল হাসিতে, ফেটে পড়ে। বাঘারু ত মিছিলটার মাঝখানে পড়ে গেছে, তার সামনেও ত লোকজন আছে। তারাও ফিরে তাকায়, আর বাঘারুকে দেখেই বুঝে নেয়, পেছনের অত হল্লার কারণ কী।
তাকে ঘিরে এই মিছিলটা মেতে উঠেছে–বাঘারু টের পায়। তাকে ঘিরে সারাটা মিছিলে হাসি উঠেছে–বাঘারু বোঝে। তাকে ঘিরে মেয়েদের দল নাচতে শুরু করে–বাঘারু দেখেও খানিকটা। ঐ বেঁটে লোকটা এসে তাকে খোঁচায়। সামনে থেকে আবার পেছনে চলে যায়। কিন্তু বাঘারু বুঝে উঠতেই পারে না, সে কী করবে। বাঘারু এই ভিড়টা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যাবে কোথায়। এই মিছিলের পাশেই ত ঘরবাড়ি, ঘরের দুয়োরে বাচ্চারা ও মুরগি-ছাগল। মিছিলটাকে তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সে দাঁড়াবে কোথায়? মিছিলের বাইরে? মিছিলটা চলে যাওয়ার অপেক্ষায়? বন্যায় উৎপাটিত শালগাছের মত বাঘারু অগত্যা মিছিলের টানে চলে–তাকে ঘিরে হাততালি আর নাচগানার হুল্লোড়ের সঙ্গে সঙ্গে।
তাকে ত এক পলক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে এ-ভিড়ের কেউ নয়। এই সাতসকালে কাজের মিছিলে বাঘারুর শরীরটা বড় বেশি নগ্ন হয়ে গেছে। এতটা নগ্নতা এই মিছিলেরও সয় না। হুল্লোড় বাধিয়ে মিছিলটা তাই বাঘারু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিচ্ছে, বাঘারুর এই নগ্ন শরীরটা থেকে নিজেকে তফাত করছে।
অথচ বাঘারুর পায়ের পাতা দুটো এমনই লম্বা-চওড়া, যে মনে হয় এই মিছিলেই প্রোথিত, মাটির ভেতর থেকে উঠে মাটিসহ চলছে। তার শরীরময় শুধু ত সেই নেমে যাওয়া শিকড়ের টান। কয়েক দশক ধরে বেড়ে ওঠা মহীরুহের কাণ্ডের মত তার পিঠটা কোথাও পিছল, কোথাও শ্যাওলাধরা, কোথাও রুক্ষ। অথচ মেরুদণ্ডের দু পাশের পেশিপুঞ্জ এমন ঝরনার মত নেচে-নেচে ওঠেনামে যে বোঝা যায়, এ-শরীরে বৃক্ষের প্রাচীনতা আছে অথচ স্থাণুতা নেই। ঐ কোমর থেকে পায়ের সরল অবতরণ, মূর্তির আকার নেয়, কোথাও কোনো ঢাকা নেই বলেই। যেন, নির্মীয়মাণ কোনো ব্রিজের সদ্য তৈরি দুটো পিলার নদীখাত থেকে উঠে এসে এই মিছিলে ছুটছে। অথচ এই মিছিলে প্রোথিত এই শরীর এই। মিছিলের নয়। বাঘারুর শরীর এখন বাঘারুর বৈরী।
বাঘারুকে ঘিরে নাচতে নাচতে, গাইতে-গাইতে, বাঘারুকে বেঁচাতে-খোঁচাতে এই মিছিলটা একটা চড়াই ভেঙে ওঠে। বাঘারু চড়াইটা দেখতে পায় নিতার আগে এত লোক। কিন্তু পায়ে-পায়ে পায়ের বাটির পেশির টানে, আঙুলের ভরে, টের পেয়ে যায়। চড়াইটায় উঠতেই এই মিছিল থেকে একটা ভিড় আলাদা হয়ে ডাইনে বেঁকে। বাঘারু সরে দাঁড়াতে গেলে আবার সেই মিছিল তাকে সোজা টেনে নিয়ে যায়, সে আর বেরতে পারে না। ফ্যাক্টরি ডাইনে পড়ে থাকে। পাতা শুকোবার শেড পড়ে থাকে। বাঘারুকে নিয়ে মিছিলটা এগিয়ে যায় আর মিছিল থেকে গোছা-গোছা নোক খসে পড়ে, যে-যার কাজের জায়গায়। এখন বাঘারু দেখতে পায় তার সামনে আনন্দপুরের গেটের মতই একটা গেট আর তার ওপরে চা-বাগিচা। সাইকেল আর ট্রানজিস্টার নিয়ে ঐ বাকি মিছিলটা চা-বাগিচায় নামে।
এখন বাঘারুকে নিয়ে মিছিলটা আর ব্যস্ত নয়, কিন্তু বাঘারু মিছিলটাতে আটকা পড়ে গেছে। এই উঁচু থেকে বাঘারু দেখতে-দেখতে নীচে নেমে যায়–তারের বেড়ার ঘের দেয়া চা বাগান, রাস্তার পর রাস্তা, মোড়ের পর মোড়, মাঠের মত সমান চা-গাছের মাথার ওপরে ছাতার মত সমান শিরীষ গাছের মাথা। আর সেই বাগিচা জুড়ে নানা রঙের মানুষ কাজ করছে।
কিন্তু, দেখতে না-দেখতেই মিছিলটা বাগিচার ভেতর নেমে পড়ে বলে বাঘারু আর দেখতে পায় না। সে সমান বেগেই ছোটে–তার শরীর ঘেরা মিছিলটা খসাতে-খসাতে।
.
০৫৮.
বাঘারু ও বাবু
দুই পাশে চা বাগিচার সারি, মাঝখানে চওড়া সবুজ রাস্তা, বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে, একলা, বাকল খুবলে নেয়া অর্জুন গাছের মত, মিছিলটা যে সম্পূর্ণ ঝরে গেছে, বুঝতে।
বাঘারুর সামনে সব জায়গাতেই কাজ। চা-ঝোপে মেয়েদের বুক পর্যন্ত ঢাকা-যেন স্নানে নেমেছে। মেয়েরা টুকটুক করে পাতি ভেঙে হাতের ভেতরই রাখছে। হাত ভরে গেলে কাঁধে ঝোলানো থলিটাতে ফেলে। আঙুলগুলো আবার গাছের ওপর নেমে আসে। খোঁজাখুজি নেই। আঙুলগুলো জানে, কোথায় পাতা! মুহূর্তে-মুহূর্তে পুটপুট আওয়াজ। ধানখেতের গোড়া নিড়নোর সময় এরকম আওয়াজ খেতময় ছড়িয়ে পড়ে। ধানখেতের কথা মনে হতেই বাগিচার এই কাজ আর তার নিজের কাজের ভেতর কেমন মিল খুঁজে পেয়ে যায়, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই, আর নিজের হাত দুটো নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে। তাকে যদি পাতি তুলতে হয়, সে কি একটি পাতিও তুলতে পারবে? নাকি, তার আঙুলগুলো, ষাড়ের জিভের মত, এক গোছ পাতা মুচড়ে আনবে? ডান হাতটা চোখের সামনে মেলে, বুড়ো আঙুলটা বঁকিয়ে, ভেতর দিকে আনার চেষ্টা করে। আঙুল বেঁকে না। বুড়ো আঙুলের তলার মাংসতে দুটো-একটা দাগ পড়ে মাত্র। বাঘারু তখন তার বুড়ো আঙুলটা দিয়ে বাকি চারটি আঙুলের মাথা ছুঁয়ে যায়। বোঝার চেষ্টা করে, হেঁয়াটা সে বুঝতে পারে কি না।
বাঁ-পাশে একদল মরদ বাকানো দা নিয়ে চা-গাছগুলোর ডাল কাটছিল। দা-টা ছুরির মত পাতলা, হাতলটা ছোট্ট। বাঘারু কি তার হাতের মুঠোয় ঐটুকু হাতল ধরতে পারত? বাঘারু আবার তার ডান হাতটা তুলে চোখের সামনে পরীক্ষা করে। অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে, তার মুঠোর ফাঁকাটা এতই বড় যে কুড়োল, কোদাল বা লাঙল ধরা যায়, কিন্তু ছুরির মত দায়ের বাট আলগা হয়ে খসে যাবে। বাঘারু ডান হাতটা মুঠো পাকায়। অবলম্বনহীন তার আঙুলগুলো গেঁথে বসতে পারে না, আলগা থাকে। বাঁ দিকে একদল মরদ নালীর মধ্যে নেমে কোদাল দিয়ে নালীর গা থেকে ভেজা মাটি তুলে-তুলে ওপরে ফেলছিল। মাথার ওপর কোদাল তুলে ধরার ভঙ্গি বাঘারুর চেনা। উৎপাটিত সেই মাটির কাল বাঘারুর চেনা। বর্ষার জঙ্গলে বন্ধ নালীটার একটা ছোট অংশের ধীরে-ধারে পরিষ্কার হয়ে ওঠাটা বাঘারুর চেনা।
সামনে তাকিয়ে দ