এবার আর জোড়াহাতটাকে মাথায় না তুলে, সে মাথাটাকেই জোড়াহাতের ওপর নামিয়ে আনে। নামাতে তার সময় লাগে। মাথা ঠিক সমান ভাবে নামতে চায় না–ভেঙে দুমড়ে ঝুলে যেতে চায়। কিন্তু ফরেস্টার এখন ঝুলে যেতে দেয় না। সে ধীরে ধীরে মাথাটাকে জোড়াহাতের কাছাকাছি নোয়াতে চায়। হাত দুটো একটু এলোমেলো ভাবে জোড়া লেগেছিল, আঙুলগুলো ঝুলছে, কব্জিটা ওপরের দিকে। কব্জির ওপরে কপাল ঠেকায় ফরেস্টার। তারপর হাতদুটো জোড়া রেখেই সে মাথাটা সোজা করে। ধীরে ধীরে সোজা করতে করতে হঠাৎ সোজা হয়–যেন খট করে শব্দও হল ঘাড়টা ফিট হয়ে যাওয়ার। তারপর ফরেস্টার কথা শুরু করে, হুজু-উর, মুই ফরেস্টারচন্দ্র আসি গেইছু। এটুকু বলতেই জোড়াহাতের দিকে নজর পড়ে। তখন, যেন ছিঁড়ে আলাদা করতে হচ্ছে এমন ভাবে, ফরেস্টার হাতদুটোকে পরস্পর থেকে আলাদা করে, সোজা দাঁড়ায়। এবার হেসে বলে, হুজুর, আসি গেইছি। মুই ফরেস্টারচন্দ্র। ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবন। দেখি নেন। মোর মুখোন, দেহখান, দেখি নেন। টর্চ ফিকেন, কি ম্যাচিসের কাঠি জ্বালান। দেখি নেন। ওয়ান-টু-থিরি
যেন একটা টর্চ সত্যি জ্বলল, ফরেস্টার এমন ভাবে দাঁড়ায়। তার দুই চোখ হাসিতে বুজে গেছে। তার মোটা-মোটা সঁহ্যাঁতগুলি বেরিয়ে আছে। সে সেই হাসিমুখ আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। যেন, তার ফোটো তোলা হচ্ছে। বায়ে একবার, ডাইনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে ফরেস্টার জিজ্ঞাসা করে, হুজুর। দেখি নিছেন তো মোক? ভাল করি দেখি নিছেন ত? মোর নামখান ফোমে রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। বাপাখানের নাম হইল। কিন্তু বাপাখানের কথা ছাড়ি দাও। বাপার বাদে অনেক কাথা। মোর নিজের কাথাটা আগত শুনাবু তোমাক।
সেই কথাটা শুরু করতে গিয়েও ফরেস্টার থেমে যায়। হঠাৎ দুই হাতের পাতা দিয়ে চোখ ঢাকে, তোমার টর্চের আলোখান মোর চোখদুইটা ঝলঝলাই দিছে হে হুজুর। চক্ষুর পাতাখানের উপর আলোর তারা চকমকাছে, চকমকাছেয্যানং তিস্তার চরত বালি চমকায়। খাড়াও হে হুজুর, এই চকমকিখান একটু কমিবার ধরুক।
দুই হাতের পাতায় চোখ ঢেকে, ফরেস্টার অন্ধকারকে আরো অন্ধকার করছিল। নীরবতা তৈরি হচ্ছিল। সে নীরবতায় এতক্ষণের কথাবার্তাগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সেই নীরবতার ভেতর থেকে ফরেস্টার শুরু করে, শুন হে হুজুর, কাথা মোর একখান। না হে, একখান না হয়, দুইখান। কাথা মোর দুইখান। কী দুইখান কাথা? একখান কাথা হই যে তোমরা ত জমির হাকিম। ত মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর জমিঠে মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর একখান ত জমি আছিল। আপলাদ ফরেস্টের গা-লোগো। মোক ঐঠে পাঠায় গয়ানাথ জোতদার। হালবদল-বিছন গায় ওর। মুই হালুয়া আছি কয়েক বছর। অ্যালায় আর নাই। মোর নামখান কাটি দাও। ঐ জমিখান লিখি দাও গয়ানাথ জোতদারের নামত। বলদ যার, বিছন যার, হালুয়া যার, ধান যার-জমি ত তারই হবা নাগে হুজুর। ত ঐ জমিখান মুই, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন, ছাড়ি দিছু। লিখি দাও, শ্রীফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মনক এই জমিঠে উচ্ছেদ দেয়া গে-এ-এ-ই-ল।
হাঁকটা শেষ করে ফরেস্টার হেসে ওঠে। হাসির ঝোঁকে শরীরের সামাল ঢিলে হয়ে যায় বলে একটু টাল সামলায় হাসতে-হাসতেই। হাসিটা শেষ হলে ফরেস্টার একটা তৃপ্তির আওয়াজ তুলে বলে, ব্যাস, হুজুর। মনত রাখিবেন। আপলচাঁদের ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন উমরার দেউনিয়া-জোতদার গয়ানাথ রায়বর্মনক উচ্ছেদ দিয়া দিল। গয়ানাথ সব শিখিবার চাছে। কহে, হে ফরেস্টার, মোক হালুয়াগিরিখান শিখি দে। বাপপিতামহর কামটা মুই ভলি গেছু, মোক শিখি দে। ত মুই নিচয় শিখি দিম। হুজুর, কালি আমি গয়ানাথক সৰ শিখাই দিম, ক্যানং করি হাল দিবার নাগে, মই দিবার নাগে, পাতা গুছিবার নাগে, ছাই ছড়ি দিবার নাগে, কোদা করিবার নাগে, রোয়া গাড়িবার নাগে–সব শিখাই দিমকালি সকালে। ব্যাস, কালি সকালঠে গয়ানাথই জোতদার, গয়ানাথই হালুয়া। মুই এ্যালায় যাছ, গয়ানাথের বাড়িত, উমরাক হালুয়াগিরি শিখাবার তানে।
ফরেস্টার যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কিন্তু মোর ত দুইখান কাথা আছে। একখান কাথা মুই ফরেস্টারচন্দ্র এ্যালায় গয়ানাথ জোতদারক খালাশ দিছু। মনত রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। এইঠে ত অনেক ফরেস্টার। অনেক বর্মন। কায় সাচা আর কায় মিছা? হুজুর! দেখি নেন। যেইলা ফরেস্টারচন্দ্রের বা পাছা, আর ডাহিন পিঠত বাঘের দুইখান থাবার দাগ আছে ঐলা ফরেস্টারচন্দ্র আসল। ত দেখাও। সগায় পাছার কাপড় তুলি দেখাও। তুলো হে তুলল। পাছার কাপড় তুলে আর পাছাখান ঘুরাও। ফরেস্টার নাচের ভঙ্গিতে ঘুরপাক খায় আর খিলখিল হাসিতে যেন তার চারপাশের অনুপস্থিত ভিড়ের এক-একজনকে আঙুল দেখিয়ে বলে, তুলল, তুলো, পাছার কাপড় তুলল, ফরেস্টার পাক খায় আর আঙুল দেখায়, তুলল, তুলল। এক পাক ঘোরা হয়ে গেলে ফরেস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, কায়ও দেখাবার পারিবে না, হুজুর। সগার পাছা ঢাকা থাকিবে। সগার পাছত, হাগা আছে, বাঘা নাই। কিন্তু মুই সাচা ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন–আদি। মুই মোর পাছাখান নং উদলা করি দিম। খাড়াও হে হুজুর। তোমার টর্চখান আর চোখত না ফেলল। হ্যাঁ, রেডি। ওয়ান-টু-থিরি।