শহরে সময় চলে দৌড়ে, গ্রামে যেন তার কোনো তাড়াই নেই। ধীরেসুস্থে গড়িয়ে যায় প্রহরের পর প্রহর। ভোরের সূর্য ওঠে। পাশের গ্রাম দুর্লভপুরের উঁচু বটগাছটার মাথার ওপর দিয়ে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে বীরকুৎসার আনাচে-কানাচে। দেখতাম ওপাড়ার পূর্ণ সাহা কম্বল মুড়ি দিয়ে নিমের ডালে দাঁত ঘষতে ঘষতে আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াত। আর এ বছরের শীত যে খুব বেশি এবং গত আট-দশ বছরের মধ্যে তার কোনো তুলনা পাওয়া যায় কি না তারই ব্যর্থ আলোচনা নিয়ে সকালটা মাত করে রাখত। শহরে এসে যেদিকে তাকাই মানুষের হাতে গড়া ইট, কাঠ, পাথরের সৌধ। কিন্তু গ্রাম যেন মানুষের গড়া নয় প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে সে যেন আপনাতে আপনিই বিকশিত। নরম মাটির গন্ধ, ভাঁটফুল, বনতুলসী আর ঘেঁটু ফুলের আরণ্যক সমৃদ্ধি মনকে এমনিতেই কেমন জানি উতলা করে রাখত।
বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছিল ছোটো একটি খাল। বর্ষায় সেই বিশীর্ণ খালে আসত যৌবনের জোয়ার। উত্তরবঙ্গের মাঝিরা যে খাল বেয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নৌকার লগি ঠেলার আর বৈঠার টানের শব্দে কত রাত্রে ঘুম যেত ভেঙে। মনে হত গ্রাম মৃত্তিকার স্পন্দন-ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি বুকের কাছটিতে।
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আশু দাদুর প্রকান্ড বৈঠকখানায় প্রতিসন্ধ্যায় বসত তরুণদের জলসা। সর্বজনীন কালীপুজো, দুর্গাপুজো প্রভৃতি উৎসব উপলক্ষ্যে যাত্রা, থিয়েটারের গৌরচন্দ্রিকা অর্থাৎ মহড়া চলত সেখানে। পাঁচন মোল্লা, সরিতুল্লা, বৈদ্যনাথ আর ফকির পাল প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান মিলে যাত্রা গান প্রভৃতি অনুষ্ঠানে মেতে থাকত। সেদিন তো কোনো বিচ্ছেদ, বিভেদের প্রশ্ন ওঠেনি! বাহারদা ছিলেন বাঁশি বাজাতে ওস্তাদ। তাঁর বাঁশের বাঁশির সুরযোজনা গ্রামবাসীকে মুগ্ধ করেছে কত অলস অপরাহ্ন,ে কত সন্ধ্যায়। তিনি মুসলমান ছিলেন বলে তো হিন্দুর উৎসবে তাঁর আমন্ত্রণ বাদ পড়েনি আনন্দ পরিবেশনে? গ্রামের পোস্টমাস্টার ধীরেন মজুমদার ও পুরোহিত রুক্মিণী চক্রবর্তী ছিলেন রসিকপ্রবর। এঁদের মুখে সত্যি-মিথ্যে অতিরঞ্জিত কাহিনি শোনবার জন্যে গ্রামবাসীরা সাগ্রহে ভিড় করত। এঁদের সকলকে নিয়েই তো গ্রাম। তাঁদের ভুলি কী করে?
স্কুলের মাঠে খেলাধুলোর প্রায় সকলরকম ব্যবস্থাই ছিল। স্টেশনের অদূরে কুঁচেমারা’ নামে একটি রেলের সাঁকোর ওপরে ভিড় জমত ছেলে-বুড়ো অনেকেরই। এই আড্ডাটির লোভ সংবরণ করতে পারত না কেউ। শত কাজ ফেলেও সন্ধের দিকে কুঁচেমারা’ সাঁকোর কাছে যাওয়া চাই-ই। চমৎকার সে জায়গাটির পরিবেশ। একধারে সবুজ গ্রাম, আর একধারে বিস্তীর্ণ মাঠ। সূর্যাস্তের সময় কবিগুরুর কথা মনে হত– সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে। সাঁকোর তলা দিয়েই চলে গেছে খাল। সেখানে জেলেরা খেয়া পেতে মাছ ধরত। বড়ো বড়ো নৌকা পাল তুলে চলে যেত অনবরত। কোনো কোনো নৌকা জেলেনৌকার পাশে ভিড়িয়ে মাছ কিনে নিত।
গ্রামের জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে অতীতকালের সাক্ষী রয়েছে এক বিরাট বকুলগাছ। চিরদন্ডায়মান গাছটি পথক্লান্ত পথিকদের যেন আহ্বান জানায়। গাছের তলাটি বহুদিন আগে জমিদার বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। বিরাট বাঁধানো বেদির ওপর কেউ কেউ তাস পাশা খেলায় মগ্ন থাকত, ছেলেরা ছক কেটে বকুলের বিচি সাজিয়ে ‘মোগল পাঠান’ প্রভৃতি খেলায় জমে যেত। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা বকুল ফুলের মালা গাঁথবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ফুল কুড়োত।
নিকটেই ছিল ডাকঘর। ডাক-হরকরার প্রতীক্ষায় যুবক-বৃদ্ধ সবাই গাছটার তলায় জড়ো হত এবং ডাক পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই দু-তিনখানা পত্রিকা নিয়ে বকুলতলার আড্ডার প্রথমপর্ব শেষ করত। সংবাদপত্রের খবর নিয়ে মাঝে মাঝে বচসাও হত। এখন সেই বেদিটিতে বড়ো বড়ো ফাটল ধরেছে, সেখানে খবরের কাগজও আর পড়া হয় না, বকুলফুলও আর ছেলে-মেয়েদের আকর্ষণ করে না।
বৈশাখে একমাস ধরে ‘নগর-কীর্তন’–এপ্রথা বহুকালের। গ্রামের প্রান্তরে এক ঘন জঙ্গলে বুড়ো কালীর বাঁধানো বেদি এবং তারই পাশে প্রকান্ড এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। সেখান থেকে ‘নগর-কীর্তন’ আরম্ভ হয়ে নানা পথ ঘুরে আশু দাদুর মন্ডপে এসে শেষ হত। এতে কিশোরী চৌকিদার, জহিরউদ্দিন প্রভৃতি মুসলমানরাও যোগ দিত। এদের গাইবার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। গ্রামে মহরমের মেলায় ‘তাজিয়া’ শোভাযাত্রায় রমেশ, টেপা প্রভৃতির লাঠি খেলা দর্শকদের অবাক করে দিত। তখন কেউ জানত না হিন্দু-মুসলমান দুটো পৃথক জাত। একটা মিথ্যেই শেষে সত্যি হল।
মাতব্বর হালিম চাচা সকালে কাশতে কাশতে বাজারে এসে গল্প জুড়ে দিতেন। তাঁর কথা বলার একটা অদ্ভুত ভঙ্গি ছিল। সব কথা সত্যি না হলেও কথার প্যাঁচে সবাইকে স্বমতে নিয়ে আসতেন। শান্তাহারের হাঙ্গামার পর যখন গ্রামকে গ্রাম হিন্দু-শূন্য হতে লাগল তখন তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন–বাবা কালা, মদা তুরা য্যাস না, আমরা গাঁয়ে থাকতে আল্লার মর্জিতে তুদের কিছু হবে না…। কিন্তু গ্রামের লোক সেদিন তাঁর কথায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। গ্রাম ছেড়ে আসার দিন আমার প্রিয় বন্ধু আহমেদ মিয়াও আমাকে বলেছিল–ভাই, তুইও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? এই কথাটির মধ্যে যে কত ব্যথা লুকোনো ছিল তা একমাত্র আমিই জানি। আজও মনে হয় হালিম চাচার, আহমেদ মিয়ার করুণ স্নেহ-সম্ভাষণ। আমাদের মাঝখানের এই দুস্তর ব্যবধান একদিন ঘুচবেই। মিথ্যে তো কখনো সত্যি হতে পারে না!
শ্রীহট্ট – পঞ্চখন্ড রামচন্দ্রপুর
পঞ্চখন্ড