বৈশাখের ঝড়ে সে-এক রুদ্রমূর্তি চোখে পড়ত। শ্রাবণের বর্ষণে দিগন্তের কোণে কালো মেঘ নিরুদ্দেশ হয়ে যেত চলনবিলের ওপারে। আমাদের বাড়ির ঘরের টিনের চালে বিষ্টির আওয়াজ এক অদ্ভুত ঐকতানের সৃষ্টি করত। ধান লাগানোর জন্যে কৃষকের মন তখন চঞ্চল হয়ে উঠত। সময় সময় আমিও বাবার সঙ্গে ধান লাগানো দেখতে যেতাম। কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে একসঙ্গে কৃষকদের ধান লাগানোর দৃশ্য অবর্ণনীয়। হেমন্তে যখন ধান উঠত কৃষকদের গোলায় তখন ভোরের দিকে পাশের পাড়া থেকে কৃষক-বউদের ধান ভানার আওয়াজ শুনতে পেতাম। সেই চেঁকির আওয়াজে কেমন জানি একটা গ্রামীণ আত্মীয়তার স্পর্শ লাগত মনে। মেয়েরা ধান ভানছে, কেউ-বা ধান ঢেলে দিচ্ছে গর্তে। আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে নানারকম গেরস্তির কথা। চমৎকার ঘরোয়া সেই রূপটি আজ কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি। কখনো ধান ভানতে ভানতে মেয়েরা সুর করে গান ধরেছে। সে-গানের কলি আজ মনে নেই, কিন্তু সুরটা আজও বাজছে হৃদয়ের মাঝখানে।
বিকেলের দিকে আমরা কয়েকজন প্রায়ই কুঞ্জবাড়ির দিকে বেড়াতে যেতাম। নির্জন, নিস্তরঙ্গ সন্ধ্যা। রথের মেলা বসত এইখানটায়। দু-ধারে বন্য জামগাছের সারি। সামনে বিল। সূর্যাস্তের ছায়া পড়ে বিলের জল কেমন জানি অতীত-মুখর হয়ে উঠত। বহুদূর অতীতের কথা, রানি ভবানীর আমলের কথা, বাংলার বিগতশ্রী অবিস্মরণীয় দিনের কথা। কুঞ্জবাড়ির পথের বাঁ-দিকে একটা বটগাছের তলায় মুসলমানদের একটি পীঠস্থান আছে। গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বছরে তিন দিন সেখানে গানের পালা হত। বিরাট চাঁদোয়া খাটানো হত ওপরে। সত্যপীরের গান, কৃষ্ণলীলার গান, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মুক্তিতত্ত্ব সমস্ত কিছুই সেখানে গান গেয়ে আলোচনা করা হত। হিন্দু-মুসলিম সমস্ত গ্রামবাসী স্তব্ধ কৌতূহলী হয়ে সে-গান শুনত। গানের পালার মাঝে মাঝে ঢাক-ঢোল বেজে উঠত। পরচুলা ঝাঁকানি দিয়ে ঘন ঘন নৃত্য হত। অনেক হিন্দুও সেই দরগায় সিন্নি দিত, কেউ রুগণ ছেলের রোগমুক্তির জন্যে, কেউ হয়তো স্বামীর সুস্থতার জন্যে।
হাজরা নাটোর গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে জেলা বোর্ডের রাস্তা। দু-পাশে ঝাউগাছের সারি। তরুণদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলবার জন্যে গ্রামে আমরা একটা পাঠাগার স্থাপন করেছিলাম। পাঠাগারের ভেতর দিয়ে গ্রামের তরুণদের রাজনীতিমূলক শিক্ষা দেওয়া হত। ভেবেছিলাম আমরা সমস্ত তরুণরা মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে গ্রামের সেবা করব, সে-আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এমনই ধূলিসাৎ হওয়া স্বপ্ন নিয়ে কলকাতার রাজপথে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল গ্রামের এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। ‘হঠাৎ আপনি এখানে?’–বহুদিন পর দেখা হওয়ায় বিস্ময়ে প্রশ্ন করি। ‘এই এলুম একটু এদিকে, দেখি যদি কিছু সুবিধে হয়।– নিস্তেজ হতাশ উত্তর। কৃপাপ্রার্থীর ভাব তার কথায় আর হাবভাবে। দেশসেবার পুরস্কারস্বরূপ বহুকাল কারাজীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। কোনোদিন ভেঙে পড়েননি। আজ যেন সত্যিই তিনি ভেঙে পড়েছেন। একদিন এঁকে দেখেছি বিপুল প্রাণশক্তির প্রতীকরূপে। আজ কলকাতার জনারণ্যে তাঁর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম না। মিছিলের মধ্যে তিনিও মিশে গেছেন শরণার্থী হয়ে।
.
তালন্দ
উত্তরবঙ্গের রাজসাহী জেলার ছোট্ট এক টুকরো গ্রাম। তালন্দ তার নাম। পাশেই একদিকে ছড়ানো রয়েছে দীর্ঘ প্রসারিত বিল। অন্য দিকে ছোটো একটি জলরেখার মতো শীর্ণ শিব নদী। নদীটি ছোটো কিন্তু ঐতিহ্যে বিশিষ্ট। অনেক ইতিহাস-মুখর দিনের নীরব সাক্ষ্য বহন করছে এই নদী। আজ সে বিগতযৌবনা। বর্ষাকালে বিলের সঙ্গে মিশে নিজের অস্তিত্বটুকুও হারিয়ে ফেলে। পশ্চিম দিকে সজাগ প্রহরীর মতো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চওড়া রাস্তাটা আরও উত্তরে বিলটিকে লাফিয়ে পার হয়ে দূরান্তের গ্রামের সঙ্গে মিশে গেছে।
গ্রামটি ছোটো। কিন্তু সুখ-সুবিধা অপ্রচুর নয়। রাজনৈতিক দূতক্রীড়ায় উলুখড়দের জীবনাবসান হয়েছে। কিন্তু তবুও ভুলতে পারি না ছেড়ে-আসা গ্রামের রাঙামাটির স্পর্শ। নুন তেল, রেশনকার্ড আর চাকরির বাইরে যখন মনের অবসর রেণু রেণু হয়ে উড়ে যায়, স্মৃতির টুকরো তখন ঘা দেয় অবচেতন মনের দরজায়।
প্রাণচঞ্চল গ্রাম্য আবহাওয়া প্রতিঋতুর সঙ্গেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখীর সঙ্গে যখন আম কুড়োবার ধুম পড়ে, যখন আম-জাম-কাঁঠালের রসালো চেহারা লুব্ধ করে আমাদের, তখন গ্রামের বুকে দেখা দেয় ‘মাসনা’ খেলা। ঢাকের বাজনার সঙ্গে বিভিন্ন ঢঙের মুখোশ পরে নাচতে থাকে স্থানীয় খেলোয়াড়গণ এবং অনেক সময় চেতনা হারিয়ে ফেলে দর্শকদের রুদ্ধবাক চেহারার সামনে। গ্রীষ্মের শেষে আম-কাঁঠালের বিদায়কালে আকাশের চক্ষু যেন সজল হয়ে আসে–দেখা দেয় ‘শ্যামাঙ্গী বর্ষাসুন্দরী। বিলের দেহে আস্তে আস্তে জল জমতে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা ছোট্ট এক একটা হাত-ছিপ নিয়ে জল ঘুলিয়ে মাছ ধরে। দেখতে দেখতে তাদের ছোটো ছোটো খলই’ কই, রুই, সিঙ্গি, ট্যাংরা, পাবদা মাছে ভরে ওঠে। বিলের বুকে তখন দেখা যায় নৌকার কালো রেখা। দু-দিক থেকে নৌকাগুলো পরস্পরের কাছে এগিয়ে এসে পরমুহূর্তেই ছিটকে বেরিয়ে যায় বিপরীত দিকে। সেই সময় প্রশ্নোত্তর চলে—’লাও কোতদূর কারা? তানোরের’ ইত্যাদি। এরই সমসাময়িক আর এক অনুষ্ঠান শীতলা পুজো। ভক্তের ভক্তিনম্র ডাক পাষাণ-প্রতিমার প্রাণে সাড়া জাগায় কিনা জানি না, তবে এমন করেই কেটে যায় বর্ষার দুঃসহ পরিবেশ। মাটির বুকে জেগে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। হাতছানি দিয়ে তারা যেন ডাকে শরতের মেঘদলকে। টুকরো টুকরো মেঘও তাই মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে কাশফুলের শুভ্র অঙ্গে স্নেহের পরশ দেয়–নেমে আসে একপশলা বৃষ্টি। নির্মল আকাশের বুকে বকের ঝাঁক উড়ে চলে শরৎকে অভিনন্দন জানাতে। শুভ মুহূর্তে ধরণির বুকে নেমে আসেন দশপ্রহরণধারিণী মা। গ্রামের প্রান্তে প্রান্তে আনন্দের বন্যা ছুটে চলে। থিয়েটারে, নাচে, গানে, ঢাকের বাজনায় বছরের জমানো ক্লেদ যেন পরিষ্কার হয়ে যায়, মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মায়ের বিদায়ে সান্ত্বনা দিতে হেমন্তে উঠে আসেন ধান্যলক্ষ্মী। নবান্নের উৎসবে আবার নতুন করে আলপনা পড়ে দুয়ারে দুয়ারে। মঙ্গলঘটের ওপর ধানের গুচ্ছ রেখে পুজো সারা হলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে উৎসবের ভাগী হতে হয়। আস্তে আস্তে শীতের আমেজ পাওয়া যায়। পৌষ-সংক্রান্তিতে রাখালদের বাস্তু পুজো’র লোকসংগীত সারাদেশ ধ্বনিত করে। তার পরেও আছে পিঠেপুলি, চড়কপুজোর হইহই। এমনি করেই বছরের বারোটা মাস ঘুরে ঘুরে আসে ছোটো গ্রামখানির বুকের ওপর এবং তারা চিহ্নও রেখে যায় নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের।