‘ভজুটি আছে না,কোন্টে গেইল?’–পাঁচপাড়ার তফি শেখ প্রশ্ন করে।
‘আরে নয় নয় বাহে, বেলা দুইট্যাৎ টাউনৎ গেইচে। এলায় ত ফিরবার কতা।’
‘আর ফিরোচে বাহে–আইজ আর’…কাজিমুদ্দিনের কথা শেষ না হতেই ঘরে ঢুকল ভজু। হাতে খবরের কাগজ, সওদাপত্র কিছুই নেই।
ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে বললেন—’আরে এ ভজু, তুই সদাপত্তর কিছু করিসনি!’
ভজু কাগজটা এগিয়ে দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ডাক্তার কাগজখানা খুলে বসলেন। আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার চুপ করে কাগজ খুলে বসেই রইলেন। সবাই জোরে জোরে পড়তে বলল।
‘আর কী পড়ব ভাই–আবার গন্ডগোল। ডাক্তার হতাশভাবে উত্তর দিলেন।
‘আরে বাহে, কেটে গন্ডগোল হইল কন কেনে।’–তফি শেখ বলে।
‘সান্তাহারে গাড়িতে বহুৎ হিন্দু নিহত হইছে।’–ভজু যোগ দিল।–টাউন থেকে সব । হিন্দু গাড়ি বোঝাই হয়ে হিন্দুস্থানে যাচ্ছে এবং তারাও যাবে, একথাই ভজু বলতে যাচ্ছিল।
ভজুর কথা শেষ না হতেই কাজিমুদ্দিনের গলা উঁচু হয়ে উঠল—’তোরা কেটে যাবি? হামরা কি তোর জান মারি ফেলছি?’
কাজিমুদ্দিনের মতো মুসলমান ছিল বলেই আজ বেঁচে আছি–নইলে সেদিন ভজুর দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তফি শেখের মুখের চেহারা আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমার গাঁয়ের সাধারণ মানুষের গলায় ভাওয়াইয়া গানের সুর মনকে মাতিয়ে তুলত। কথা-প্রাণ বাংলা গান। ভাওয়াইয়া গানের বেলাও তাই। একটি গানের কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে। দোতারা বাজিয়ে তাল দিয়ে দিয়ে গান গাইছে ভাবুক,
ও আমার সাধের দোতারা, তুই যেন আমার মান রাখিস,
আমি রুপো দিয়ে তোর কান বাঁধিয়ে দেব!
অল্প বয়সে দোতারার আকর্ষণে পাগল হয়ে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ভাবুক। বাপ, ভাই, গ্রামের লোক কারুর কথাই সে কানে তোলেনি। গ্রামবাসীরা বিরোধী হয়ে দারোগাকে জানিয়ে দিয়ে তাকে হাতকড়া পর্যন্ত লাগিয়েছে। তবু সে দোতারা ছাড়েনি। সেই দোতারাকেই সে বলছে, ও আমার দোতারা, তুই যেন আমার মান রাখিস, আমি রুপো দিয়ে তোর কান বাঁধিয়ে দেব। অর্থাৎ সংসারে মোহগর্তে আর যেন তাকে প্রবেশ করতে না হয়, সে মান যেন তার থাকে। সত্যি কী উচ্চভাবের গান! আজ অবশ্য আমরা কমবেশি সবাই ভগ্ন-সংসার নিরুদ্দেশের পথের মানুষ। কিন্তু যেখানেই থাকি না কেন, আমার সোনার গ্রামখানি আমার চোখের সামনে।
পুজো এসে গেছে। আমাদের বারোয়ারি বাগানের বাঁধানো বেদি এবার খাঁ খাঁ করবে বিসর্জনের প্রদীপও জ্বলবে না। নদীর ঘাটে বিসর্জনের দিনের মেলায় সে কী কোলাহল হত! হিন্দু-মুসলমান সকলকে মিলনের রাখি পরিয়ে দেওয়া হত মেলায় প্রতি বছর। এবার হয়তো শুধু একটুকরো দক্ষিণা বাতাস বয়ে যাচ্ছে হু-হুঁ করে পল্লিমায়ের চাপা কান্নার সুরে। ধান মাড়াইয়ের স্বপ্নে কৃষকদের মন এবারও আনন্দে হয়তো ভরে উঠবে। কিন্তু মথুর কাকা আর কানাইদার মিষ্টি গলার কীর্তন আর এবারের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোকে মহিমান্বিত করবে না। কালীপুজোর প্রসাদ বিলির আনন্দও আর উপভোগ করবে না কেউ। সব আনন্দই গেছে আমার গ্রামকে ছেড়ে। নইলে, পুজোয়, কালীপুজোয় যেসব থিয়েটার হত বারোয়ারি তলায়, সেগুলো তো এখানেই পেতে পারি–কিন্তু পল্লিমায়ের অদৃশ্য সেই স্নেহের টান তো পাব না আর।
রাজসাহী – হাজরা নাটোর তালন্দ বীরকুৎসা
বর্ষা নেমেছে চলনবিলের বুকে। জলে টইটম্বুর। যতদূর চোখ যায় জলে জলময়। শালুক ফুলে বিল যায় ভরে। সকালের কাঁচা রোদ সস্নেহে চুম্বন দিয়ে যায় উত্তর বাংলার এই গ্রাম হাজরা নাটোরের ধূলিকণায়। রাঙা মাটির দেশ এই বরেন্দ্রভূমি। প্রাতঃস্মরণীয়া রানি ভবানীর দেশ এই নাটোর। আজকের দিনে শিল্পীমন এই নাটোরেই হয়তো বনলতা সেনকে খুঁজে পেয়েছেন। সব কিছু মিলিয়ে এ গ্রাম আমার স্মৃতির সবটুকু জড়িয়ে আছে। আজ দেখছি ছেড়ে-আসা গ্রামের কাহিনির মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বাংলার গ্রাম কথা কয়ে উঠেছে। জেগে উঠেছে দীর্ঘদিনের সুষুপ্তি থেকে। সে-কাহিনি শুনে মন ভরে যায়। বাংলার মূক মাটি এমন করে মুখর হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার মতোই পদ্মা মেঘনা আর চলনবিলের তীরের বাসিন্দারা নতুন ইতিবৃত্ত বলতে শুরু করেছে। সে-কাহিনির অনন্ত মিছিলে আমার গ্রাম নাটোরও একান্তে মিশে যায়।
শৈশবের কথা মনে পড়ে। নাটোরের আকাশে শীত ঘনিয়ে আসে। কাকলিমুখর শীতের ভোরবেলাটায় উঠি উঠি করেও মা-র কোল ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করত না। বাগানের শিউলিতলায় একরাশ সাদা ফুলের গন্ধ কেমন করে জানি টের পেতুম। সেই ভোরে হরিদাসী বোষ্টমি করতাল বাজিয়ে বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে হরিনাম কীর্তন করে সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলত। হরিদাসী বোষ্টমির সুরেলা কণ্ঠের সে-গান আজও ভুলতে পারি না—
আর নিশি নাই ওঠ রে কানাই,
গোঠে যেতে হবে–দ্বারে দাঁড়ায়ে বলাই।
সে-গানের শব্দ অনেক দূর থেকে ভেসে আসত। আর বিছানায় থাকা সম্ভব হত না। কাঠবাদাম আর ফুল কুড়োবার লোভে খুব শীতের মধ্যেও উঠে পড়তাম। বাড়ির পাশেই জমিদারদের বাগানবাড়ি। সে-বাগানে সবরকম ফলের গাছই ছিল। উদ্যান-বিলাসী জমিদারবাবুরা বংশানুক্রমে এ বাগানে নানারকম ফলের গাছ পুঁতেছিলেন। আমাদের কৈশোরের দৌরাত্মময় রোমাঞ্চকর দিনগুলো অতিবাহিত হত সে-বাগানের গাছে গাছে। সেজন্যে যে কতদিন বাগানের মালির হাতে তাড়া খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গ্রীষ্মের দুপুরে চারধার যখন নিঃসাড় নিঝুম হয়ে যেত, মধ্যাহ্নের অলসতায় দ্বাররক্ষী তন্দ্রারত, সেই অবসরে পাঁচিল টপকে গাছে গিয়ে উঠতাম। এমনই করে প্রতিদিন গাছগুলোকে তছনছ করে চলে আসতাম আমরা; আরেকটি বিশেষ আনন্দের দিন ছিল, শ্রীপঞ্চমীর পুজোর দিনটি। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই মন ওই দিনটির জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকত। সরস্বতী পুজো এলেই গ্রামের তরুণদের মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠত। পুজোর আগেই সারারাত খেটে পুজোর আটচালা মন্ডপ তৈরি করতাম, গেট সাজাতাম। সব কাজের শেষে মধ্যরাত্রির অন্ধকারে চুপি চুপি খেজুরের ভাঁড় নামিয়ে রস চুরি করার মধ্যে যে-রোমাঞ্চ ছিল তা আজও ভুলতে পারিনি। মিলাদ শরিফ উপলক্ষ্যে স্কুলে মুসলমান ছেলেদের উৎসবেও সকলে মিলে যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করতাম। মুসলমান ছাত্ররা আমাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়িত করত। আমরাও নিঃসংকোচে তা গ্রহণ করেছি, সবাই মিলে আনন্দ করেছি।