গ্রন্থাগারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়ামাগারও গড়ে উঠতে থাকে। শরীরচর্চায় এমনই অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় যে, খেলার মাঠে লোক-অভাব বিস্ময়ের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। যে-খেলা তরঙ্গ তোলে মনে, সেই ফুটবল, ক্রিকেট থেকে লাঠিখেলা, ছোরাখেলার আকর্ষণ প্রবল হয়ে ওঠে। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লাগে। জোয়ান ছেলে জোর কদমে চলে অটুট সংকল্প নিয়ে।
প্রবীণদের ও মধ্যবয়স্কদের আড্ডা বসে বসুবাটিতে, রাজকাছারিতে, আর মিত্রবাবুদের বৈঠকখানা ঘরে। দু-মাইল দীর্ঘ গ্রামখানির অধিকাংশ লোক জমাজমির ওপর নির্ভরশীল, অভাবের তাড়না নেই তেমন। তা ছাড়া সম্পন্ন পরিবারের যারা, আড্ডা জমাতে তাদেরই উৎসাহ বেশি। তাস, পাশা ও দাবাকে ভর করে নৈশ আড্ডা জমে ওঠে। এই আড্ডার আনুষঙ্গিক পান-তামাক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চা। রাত্রি আটটায় গ্রাম যখন ঘুমোয়, এদের খেলার আসর সবে তখন জমে ওঠে। রাত্রি বারোটায় সুপ্তিমগ্ন গ্রামের জনবিরল পথে যে যার গৃহের পানে চলে। ডরে আশঙ্কায় কেউ বা হাততালি দেয়, কেউ বা লাঠি ঠক-ঠক করে চলে। আর বলে দস্যি ছেলেদের হাতের কোদাল পড়ে বর্ষা-বোয়া গ্রামের দুর্গম পথও এমনই সুগম হয়েছে যে, চোখ বুজে চলতেও বাধা নেই আর। সোয়াস্তিতে চলে আর আশীর্বাদ করে মনে মনে।
পথের প্রান্তে চালাঘরের মধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়ে শখের যাত্রার মহড়া চলে। নারীকন্ঠের ব্যর্থ অনুকরণে পুরুষের কর্কশ স্বর, অন্ধকারের বুকে আছড়ে পড়তে থাকে। হারমোনিয়ামের চড়া আওয়াজ নিশুতি রাতের স্তব্ধতাকে ব্যঙ্গ করে মাঝে মাঝে, আকাশে তারার মালা তখনও মিটমিট করে।
গ্রামের ছেলেরা প্রতিবছর দলে দলে পড়তে যায় পার্শ্ববর্তী শহরের স্কুলে। লজিং-এর অথবা বোর্ডিং-এ আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়। তবু গ্রামে হাই স্কুল গড়ে ওঠে না। চাষি প্রজারা ইংরেজি লেখা পড়া শিখলে বাবুদের মান্য করবে না, এই আশঙ্কাতেই নাকি গ্রামের কর্তারা গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠায় বাদী হন–সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকেও হার মানিয়ে ছাড়েন। কেরানির অভাব পূরণের জন্যে একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্রিটিশকে একদিন বাধ্য হয়েই ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করতে হয়েছিল। এঁদের তো সে বালাই নেই। উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যা হলেই নায়েব গোমস্তার কাজ আটকায় না। তাই স্কুল স্থাপনের প্রয়াস কয়েকবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কৃতী ছেলেরা সেবার ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে কাজে নেমে গেল। প্রধানশিক্ষক বাইরে থেকে এলেন, বহুজনের সমবেত চেষ্টায় স্কুল গড়ে উঠল। যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনও পাওয়া গেল। দুই শতাধিক ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির পাকা ভিত গড়ে তুলল। চালু প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে লাগল। কর্তারা বললেন, এইবার গ্রাম গেল, মানীর মান সম্ভ্রম বিপন্ন হল। কিন্তু সেদিনও গ্রাম যায়নি। বিদ্যাপীঠ পল্লবিত হয়ে জীবন্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। সম্ভম কিন্তু তখনও বিপন্ন হয়নি, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচিত হয়ে জীবনের জয় সূচিত হল। নীল আকাশের আস্তরণের নীচে আজও স্কুল ভবনটি তেমনই আছে। সেইসব শিক্ষক আজ আর নেই, যাঁরা ত্যাগের আদর্শকে ছাত্রদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, আর সেইসব ছাত্রও নেই যাঁরা আর্তের সেবায় বিপদের ঝুঁকি নিতে অকুণ্ঠিত ছিলেন। আর সবই আছে, নেই শুধু প্রাণের স্পন্দন।
জেলাবোর্ডের রাস্তাটি আজও এইভাবে গ্রাম ও বিলের স্বতন্ত্র সত্তার সাক্ষ্য হয়ে আছে। আজও এই পথে দেশ-দেশান্তরের লোক যাতায়াত করে; গ্রামের লোক বাজারে যায়, ডাকঘরে যায়, স্টিমার ঘাটে যায় এই পথে। কিন্তু সংকীর্তনের দল আর বেরোয় না, শিবের গাজন এ পথে চলে না।
শারদোৎসবে, চড়ক মেলায়, কালীপুজোয় ও হোলিখেলায় যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ-বন্যা গ্রামখানাকে প্লাবিত করে দিত, বাজি-বাজনায়, সাজে-সজ্জায়, আমন্ত্রণে-নিমন্ত্রণে যে প্রাণের পরিচয় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠত, আজ তা অলীক কাহিনি।
ছেড়ে-আসা গ্রামের ছায়াশীতল ঘরের মায়া নিত্যপিছন টানে, তবু চলতে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়। পারিপার্শ্বিক ভুলে যাই, মনের গভীরে জাগে–মাটি চাই, ঠাঁই চাই, জীবনের বিকাশের পথ উন্মুক্ত পেতে চাই।
ট্রেনের গতি আবার স্তব্ধ হয়ে আসে। চোখ-ঝলসানো আলো এসে চোখে লাগে। বড়ো স্টেশন–বালেশ্বর। অগ্নিযুগের রোমাঞ্চময় স্মৃতি বিজড়িত এর সাথে। বিপ্লবের পূজারির ঐতিহাসিক বীরগাথা সহসাই প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে–চলচ্চিত্রের মতোই ছায়া ফেলে যায় মনে। অমাবস্যার অন্ধকারের পারে একফালি চাঁদ চিকচিক করে ওঠে। বাঙালি বীরের বিপ্লবসাধনার তীর্থপীঠ বালেশ্বরে দাঁড়িয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন জাগে চোখে। ভরসা জাগে, অনাগত ভবিষ্যতে পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মানুষের শবদেহের সারে অঙ্কুরিত হবে নবীন শস্য। বিপ্লবের বহ্নিশিখায় পূর্ণ হবে আবর্তন।
রংপুর – হরিদেবপুর
মন বলে, যাই। অনেকদিন স্বপ্নেও দেখেছি। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় বৃদ্ধ ছুতোর মথুর কাকা। খোল-বাজিয়ে কানাইদার মিষ্টি গলার গান শুনতে পাই যেন। বৃদ্ধ আফসর দাদু এসে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান। উতলা হয়ে ওঠে মন। মনে মনেই ফিরে যাই উত্তর বাংলার সেই লোক-না-জানা অজ্ঞাত গ্রামে, আমার জন্মভূমিতে।