সবুজ স্নিগ্ধ গ্রামখানির সারাঅঙ্গে অপূর্ব শ্যামলিমা। নিত্যকালের অতিথির মতোই ‘বারোমাসে তেরো পার্বণ’ এই পল্লিরও মধুর আকর্ষণ।
এইসব উৎসবে আনন্দে হিন্দু-মুসলমান সমভাবেই অংশগ্রহণ করেছে–মেলায়, নৌকাবাইচে, ঘোড়-দৌড়ে, গোরু-দৌড়ের তীব্র প্রতিযোগিতায় সে কী উদ্দীপনা! সেই আনন্দ গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনকে সাময়িকভাবে হলেও মুখর করে তুলেছে। আবার কখন গভীর রাতে ধানখেতের কিনারে দেখা গেছে অসংখ্য টিমটিমে আলো–আলেয়ার আলোর মতো কখনো স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে, কখনো-বা ধানের শিষের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখতে হয়, হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কোঁচ দিয়ে মাছ মেরে চলেছে। আলোয় মাছ মারার এই মরশুমেও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কত নিবিড় তারই পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। অনেক উঁচু ওই আকাশ, চাঁদ-সূর্য হাত ধরাধরি করে সেদিন সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে।
এই সেদিনের কথা। চারজন মুসলমান আসামি, নারী নিগ্রহের দায়ে অভিযুক্ত। মিত্রবাবুদের সদর কাছারিতে বিচার শুরু হয়েছে। গ্রামের লোক ভেঙে এসে কাছারি বাড়ির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে ভিড় জমিয়েছে। হিন্দুর কাছারিবাড়িতে বিচার, বিচারকদের মধ্যে আছেন বাবুরা ছাড়া কয়েকজন সম্ভ্রান্ত মাতব্বর মুসলমান। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হল। আসামিরা নির্বিবাদে শাস্তি মাথা পেতে নিলে। পুলিশ নেই, আদালত নেই, দন্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই, নেই। কোনো কেলাহল। সুস্থ পরিবেশে সুষ্ঠু ব্যবস্থা। কঠোর দন্ডাজ্ঞার মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর পরিস্ফুট হয়ে উঠল। অপরাধীর শাস্তি দিতে উভয় সমাজকেই একযোগে এগিয়ে আসতে দেখেছি সেদিন।
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই গো-হত্যার ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যবস্থায় বিচারসভা বসতে এবং গ্রাম্য পঞ্চায়েতের কঠোর সিদ্ধান্ত নির্মমভাবে প্রযুক্ত হতেও দেখেছি। তথাপি ধর্মের জিগির ওঠেনি, ধর্মের নামে জোট-পাকানোর কথা কেউ ভাবেনি। স্বাভাবিক জীবনধারায় ব্যতিক্রম সৃষ্টি শাস্তিবিধানের যোগ্য বলেই বিবেচিত হয়েছে।
মাস্টার সাহেবের পাঠশালাতেই বা না পড়েছে কে? পরবর্তী জীবনে যাঁরা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন, বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার হতে আহরণ করে যাঁরা সমাজে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে এমন কে আছেন যিনি মৌলবি আব্দুল বিশ্বাসের পাঠশালায় হাতে খড়ি দেননি এবং মাস্টার সাহেবের শাসানি, চোখরাঙানি ও চাবুক সহ্য করেননি। শণের মতো সাদা একগাল দাড়ি, দারিদ্র্যের কুঞ্চিত রেখা সর্ব অবয়বে, সৌম্য মূর্তি মাস্টার সাহেব। বড়ো ঘরের ছেলেদেরও তাঁর কাছে পাঠ নিতে আটকায়নি, শাস্তি গ্রহণেও অমর্যাদা হয়নি। একটানা জীবনস্রোতে কখনো বিস্ময়কর ছন্দপতন ঘটেনি।
‘ছুটি বঁটি দিয়ে কুটি’ হাঁক দিতে দিতে ছেলের দল ছুটির পর মাঠে এসে নেমেছে। ‘হাডুডু’, ‘বুড়ি-ছোঁয়া’, ‘কানামাছি’ প্রভৃতি নিভাঁজ গ্রাম্য খেলাধুলোর মধ্যে কিশোর জীবনে যে অনাবিল আনন্দের সঞ্চার হয়েছে, সে-আনন্দের অংশ থেকে মিনু, হারান, ভোলাদার সঙ্গে আজিজ, করিমও বাদ পড়েনি। খেলার মাঝে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ দেখিনি, বিত্তশালী ও বিত্তহীনের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু কখনোই কি কোনো গোলযোগ বাধেনি? খেলায় হারজিত নিয়ে মারপিট পর্যন্ত হতেও দেখেছি, কিন্তু মাস্টার সাহেবকে ডিঙিয়ে অভিযোগ অভিভাবকের কানে কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি। আজও তো সেই গ্রামই আছে।
এই তো সেই গ্রাম, যেখানে একটি পল্লি-পাঠাগারকে কেন্দ্র করে একদিন রাজনৈতিক চেতনা গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কলেজের ছাত্র ‘কালোদা’ সেবার পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে সকলকে কাছে ডেকে বোঝালেন, ক্লাসের পড়াই সব নয় রে, জীবনে বড়ো হতে হলে চাই মনীষা, চাই জ্ঞানার্জনের নেশা। এই লক্ষ্যের পথে গ্রন্থাগার যে অপরিহার্য, সে-সম্বন্ধে তাঁর কথায় নিঃসংশয় হয়ে ছেলের দল আমরা মেতে উঠলাম লাইব্রেরি গড়ে তুলতে। ‘বিবেক লাইব্রেরি’ ভূমিষ্ঠ হল। মুখ্যত স্বামীজির গ্রন্থাবলি আর স্মরণীয় যাঁরা তাঁদের কয়েকজনের জীবনী নিয়ে গ্রন্থাগারের উদবোধন হল। কিশলয় অঙ্কুরিত হল, ক্রমে ক্রমে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে যেদিন পা দিল সেদিন থেকে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক চক্র গড়ে উঠতে লাগল। মহাত্মাজির অসহযোগ আন্দোলন কিংবা অগ্নিযুগের আত্মাহুতির আহ্বান কোনোটাই বাদ পড়েনি গ্রাম্য জীবনে প্রতিফলিত হতে–প্রান্তবর্তী এই গ্রামখানির সঙ্গে আশপাশের গ্রামগুলিকেও আলোড়িত করতে। সেদিনের সেই জাতীয় আন্দোলনকে পুষ্ট করতে, প্রেরণা দিতে এই পল্লি-পাঠাগারের অবদান যে কতখানি, তার হিসাব আজ আর কে করবে?
পুলিশ সাহেব এলিসন ও পূর্ণ দারোগা নির্বিচারে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, গৃহদাহ ও লুণ্ঠন চালিয়েও জনতার কণ্ঠ রুদ্ধ করতে পারেনি, কংগ্রেস ভবনটিকে পুড়িয়ে দিয়েও গ্রামের মানুষের মন থেকে কংগ্রেসকে নির্বাসিত করতে পারেনি। বিপ্লবী সন্দেহে এগারো জন যুবককে যেদিন একসঙ্গে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সকলে সেদিন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ভিতর বাড়ির অঙ্গন ও নদীর ঘাটের বাইরে যাদের কোনো পরিচয় নেই, সেইসব পুরললনারাও সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন ধৃত তরুণদের অভিনন্দন জানাতে। স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে মুসলমান সমাজও যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিল। নারী-পুরুষের মিলিত কণ্ঠে বন্দেমাতরম ধ্বনির মধ্যে বন্দিদের নিয়ে পুলিশ সাহেবের লঞ্চ ছেড়ে গেল। জাতীয় ধ্বনির মধ্যে জনতার প্রতিবাদ ও রুদ্ধ আক্রোশ ফেটে পড়তে লাগল। লঞ্চ চলে গেল। নদীর এপারে-ওপারে তখনও গাঁয়ের লোকের ভিড়, চোখে তাদের প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ।